Wednesday, May 24, 2017

রম্য রচনা / ষেটের বাছারা / শ্যামশ্রী চাকী



'ষষ্ঠীঠাকরুনের মুখে জলবিন্দু পড়ল না, ঠাকরুন কাঠামোর ভিতর ছটফট করতে লাগলেন, ঠাকরুণের কালো বেড়াল মিউ-মিউ করে কাঁদতে লাগল। বানর তখন মনে-মনে ফন্দি এঁটে পালকির দরজা খুলে রেখে আড়ালে গেল। ষষ্ঠীঠাকরুণ ভাবলেন--- আঃ আপদ গেল! কাঠফাটা রোদে কাঠামো থেকে বার হয়ে নৈবিদ্যের ছোলাটা কলাটা সন্ধান করতে লাগলেন'। ছোটবেলায় এপর্যন্ত এসে হোঁচট খেতাম। জাদুকরের দেশের মায়া বানর বড়ো ভালবাসে তার দুখিনী মা'কে। চোখের জল মুছিয়ে দিতে চায়।কি দারুণ বুদ্ধি খাটিয়ে মা ষষ্ঠীর কোল থেকে সোনার চাঁদ ছেলেকে পালকি চড়ে বাদ্যি বাজিয়ে দিগ্ নগরে ছেড়ে গেল!! আমিও মা কে খুব ভালবাসি ষষ্ঠীর দিন বাবা যখন মামাবাড়ি যেতে চাইতনা,মায়ের দুঃখী দুঃখী মুখের দিকে তাকিয়ে আমিও মায়ের বাঁদর সন্তান হয়ে মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর উপায় বের করার কথা ভাবতাম। বাবা কিছু জিনিষ কট্টর ভাবে মেনে চলত, ষষ্ঠী, পূজো, শ্রাদ্ধতে অংশগ্রহণ এড়িয়ে চলত। কিন্তু কাউকে বাধা দিত না। প্রণাম নিতনা কারুর। তাই বলে আমাদের বাড়িতে পূজা পার্বণ হত না তা নয় কিন্তু বাবা অংশগ্রহণ করতনা। ষষ্ঠী বলতে আমার আজকাল অবন ঠাকুর আর একটা আলোছায়া দিন মনে ভাসে। আগের দিন সাজো সাজো রব। পিসিমনি আসবে চা-বাগান থেকে, আমের ঝুড়ি এসেছে,মর্তমান কাঁঠালি দু'রকম কলা, কালোজাম, গাছ থেকে কাঁঠাল পাড়ানো হয়েছে। সাদা ফটফটে জামরুল। পাকা ফুটির গন্ধে ম ম করছে সারা বাড়ি। রান্নাঘরে বিকেলের শেষ জ্বালে পায়েস হচ্ছে। মুঠো ভরা ভেজা কিসমিস পড়বে পড়বে করছে সেই পায়েসে।ঠাকুমার সাথে ছয় পাতার দূব্বো আর বাঁশের শিষ বাছাই করছি আমরা। দাদার সাথে পঞ্চবটের ডাল পাড়তে যাচ্ছি। এদিকে অন্য ঘরে মায়ের মুখ থমথমে,দিদার শত অনুরোধ সত্বেও বরফ গলত না, অফিস বাড়ি পার্টি অফিস এই ঘেরাটোপে নিজেকে আটকে রাখত বাবা। বাবার জীবনের মন্ত্র বা পাঁজিপুঁথি ছিল জন রিডের দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন, নিকোলাই অস্ত্রভস্তির ঈস্পাত, ম্যাক্সিম গোর্কির মা, এরিক মারিয়া রেমার্ক এর অল কোয়েস্ট অফ দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট ব্রেটল্ট বেখট থ্রি পেনি অপেরা নাটক, যার বাংলা নাট্যরূপ নান্দীকার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিন পয়সার পালা। কিছু বই হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল সেই বয়েসেই। কিছু বুঝতাম কিছু বুঝতাম না। রাশিয়ার নিউজ পেপার ইসপ্রা'র গল্প শোনাত বাবা। সম্পূর্ণ বিপরীতমুখি দুই সংস্কারে আমার ছোটবেলাটা প্রায় স্যান্ডুইচ হয়ে গিয়েছিল। বাবার কিন্তু বেদ পূরাণে অসম্ভব জ্ঞান ছিল। কিন্তু সবকিছু যুক্তিদিয়ে বিচার করতেন। এবার ফিরে আসি মূল বিষয়ে। ভোরবেলা পূজোর ফুল যোগাড় করতাম আমরা। ঝটপট স্নান সেরে নিতাম। মা পিসি কাকিমাদের স্নান করতে হত নতুন পাখা নিয়ে। ওদের জন্য আলাদা আলাদা পেতলের গামলায় তালপাতার পাখা ভেজান থাকত। পাখার ওপড়ে দূব্বোর গাছা, বাঁশের করুল, কচি সুপুরির ছড়া, ডাল সহ করমচা, পাকা খেজুরের ছড়া। আর একটা গোটা আম, কলা।
সেদিন তেল সাবান ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। ঠাকুর ঘরের অন্য ব্যাপার গুলো সামলাত ঠাকুমা। মাটির তালে গাঁথা হত বট, অশত্থ, পাকুড়, আম, কাঁঠালের ডাল। মঙ্গল চিহ্ন আঁকা হত সিঁদুর দিয়ে। সার দিয়ে সাজানো চালের পিটুলি আর কলা, ঘী মেখে বানানো ছ'টা পুতুল। ঘটে সাজান আমের পল্লব, কলা, সুপুরি, হরতকি। কাঁচা হলুদ বেটে রাঙানো সুতোগাছা ছটা দুব্বো দিয়ে একটা গিঁঠ, বাকি পাঁচটা গিঁঠ দুব্বো ছাড়া। প্রত্যেকের জন্য এক গাছা করে সুতো বরাদ্দ। গিঁঠ গুলো বাঁধা হত ব্রতকথা পড়ার সময়। আমরা ঠাকুর ঘরের এক কোনে গুটিসুটি মেরে বসে অপেক্ষা করতাম ব্রতকথা শোনার জন্য। জামাইষষ্ঠী বা অরণ্য ষষ্ঠীর গল্পটা এমন ছিল,এক বুড়ির আর তার ছয় ছেলের বৌ মিলে ষষ্ঠী পুজো করত। ছোট বৌএর স্বভাবটা অনেকটা আমার মত, লোভ সামলাতে না পেরে চুরি করে প্রসাদ খেয়ে কালো বেড়ালের মুখে দই মাখিয়ে দেয়। এবারে ষষ্ঠী ঠাকরুণের বাহন রেগে কাঁই গিয়ে নালিশ জানায় মা ষষ্ঠীকে। ছোট-বৌ এর পরপর জন্মানো ছয় সন্তান বেড়াল চুরি করে মা ষষ্টীর কাছে লুকিয়ে রাখে পড়ে অবশ্য ক্ষমা চেয়ে বেড়ালের সাথে একটা প্যাচ আপ করে নেয় ছোট-বৌ। আর ছানা গুলো ফেরত পায়। আমাদের বাড়িতে একটা কালো বেড়াল ছিল, মাঝে মাঝেই জুলজুল করে তাকাত। একটু সমীহ করেই চলতাম আমরা,বেড়াল বড্ডো নালশে। এরপরের অধ্যায়ে সেই গামলার জলে ভেজানো তালপাখার বাতাস দেওয়া হত আমাদের। 'ষাট ষাট ষষ্ঠীর ষাট... 'কথাটা বার কয়েক উচ্চারণ করতেন ঠাকুমারা, সাথে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত আম কলা আর একটা নতুন জামা। দুব্বো বাঁধা হলুদ সুতো হাতে বেঁধে দিয়ে জলখাবারের আয়োজন শুরু হত। একটা বারকোশে কাটা হত ফল। চালুন দিয়ে কাঁঠালের রস চেলে ফল, দই, খই, দিয়ে মাখা হত। মা, কাকিমা ঠাকুমা পিসিমনি সারাদিন ধরে তাই খেত। বাদবাকি দের জন্য কাটা ফল ফুলকো সাদা লুচি আর নারকোল কুচি দেওয়া ছোলার ডাল পায়েস। দুপুরে টানা বারান্দায় ঠাকুমার হাতে বানানো শাড়ির পাড়ের সুতো দিয়ে ফুলকাটা আসনে বসে ঝকঝকে কাঁসার থালায় কালোনুনিয়া চালের ভাত, আলাদা আলাদা বাটিতে চিতল/তেল কই, পাকা রূই /ইলিশ পাঁঠার মাংস সাথে ছানার ডালনা, পটলের দোলমা, আমের চাটনি খেতাম। মাঝে মাঝে মাংসের আরো দুপিস, বা একটা পাকা রুই এর কালিয়া পাতে নেওয়ার জন্য পিসেমশায় দের সাধাসাধি করত মা কাকিমা পিসিমনিরা।পাকা রুই বলতে তখন বোঝাত জালে ধরা কিলো দশেকের টাটকা রুই, খাওয়ার পরে তেল হাতে আঠার মত লেগে থাকত। আজকাল বাজারে সেই মাছ ডোডোপাখির মতই বিলুপ্ত। বিকেলে মায়ের হাত ধরে মামাবাড়ি যেতাম, সারাটা রাস্তা মা গম্ভীর থাকত। সেখানে বায়নার আম কলা, লুচি হালুয়া আর আলুর দম খেয়ে বাড়ি ফিরতাম। তখনো বাবা পার্টি অফিস থেকে ফেরেনি। খুব রাগ হত বাবার ওপড়ে। দিন চলে যায় বদলায় মূল্যবোধ, দিদা বাবা কেউ আজ আর ইহলোকে নেই। তবুও ষষ্ঠী বা বিশেষ দিন গুলোতে স্মৃতিপথ কায়াহীন ছায়াগুলো ফিরে ফিরে আসে.... 'দিগনগরে যখন দিন,ঘুমের দেশে তখন রাত। ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি সারারাত দিগ্ নগরে ষষ্টীরদাস ষেঠের -বাছা ছেলেদের চোখে ঘুম দিয়ে, সকালবেলা ঘুমের দেশে রাজার মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে, অনেক বেলায় একটু চোখ বোজেন'।



2 comments:

  1. প্রাচীন পুজো আচার এই ষষ্ঠী পুজো নিয়ে হালকা রসের এক সুন্দর আলেখ্য ।

    ReplyDelete
  2. সুন্দর একটি স্মৃতি চারন বলা যায়||কিন্তু রম্যরচনা বোধহয় ঠিক হলনা, তবে নিঃসন্দেহে সুখপাঠ্য রচনা

    ReplyDelete

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া