Sunday, July 23, 2017

গল্প / (সব চরিত্র কাল্পনিক) একপাতা ঘুমের ওষুধ - অরুণ চট্টোপাধ্যায়




দেখে সন্দেহ হবার মতই চেহারাখানা। মাথার উস্কোখুস্কো চুলগুলো বেয়াড়া ভাবে মুখের এদিকে ওদিকে পড়েছে।  চোখগুলো বেশ ফোলা ফোলা আর লাল। জবাফুল কি করমচা এ হিসেব করার মত ধৈর্য দোকানির নেই। যা অবস্থা, কোনোরকমে তাড়ানো গেলে বাঁচা যায় এমনই মনের ভাব।
- স্যর, একপাতা ঘুমের ওষুধ দিন না স্যর। প্লিজ।
ঘুমের ওষুধ? তার মানে tranquilizer? হাইলি রেস্ট্রিক্টেড।  তাও আবার এক আধটা নয়, একেবারে একপাতা। একবার কেস খেয়ে গেলে কি হবে বুঝছ? অতএব ও রাস্তায় পা মাড়াবে কে ভাই? মানে মানে বিদেয় হও মানে সটকে পড়।
প্রেসক্রিপশন দেখাতে পারে নি লোকটা। সুতরাং সকলের ঘাড় ধাক্কা। দোকানীদের কেউ মিউ মিউ করে। কেউ গলাবাজি করে। কেউ চোখ পাকিয়ে বলেছে, উইদাউট প্রেসক্রিপশন তো এ ওষুধ হয় না দাদা। ডাক্তার দেখিয়েছেন তো? প্রেসক্রিপশন দেখান।
- যাব যাব। ওষুধ খেয়ে এ বেলা একটু ঘুমিয়ে ও বেলা যাব ডাক্তারের কাছে। আপনি দাদা না হয় অন্ততঃ একখানা দিন। মাত্র একখানা?
 মোড়ের ও মাথা থেকে এ মাথা পর্যন্ত যে কটা দোকানে ট্রাই করা হল তার সংখ্যাও  নেহাত মন্দ নয়।
- কোথাও পেলাম না স্যর, কেউ দিল না। লোকটার কাকুতি মিনতি সাদিকের দোকানেও অব্যাহত, কত করে ঘুরে মরছি একটা দিন না কাইন্ডলি?
সাদিক দোকানের মালিক। তার কাজ সেলসম্যানদের বিক্রি করা ওষুধগুলোর পেমেন্ট নিয়ে বিল দেওয়া। এখন বিশেষ ভিড় ছিল না দোকানে। পেমেন্টের কাজ নেই তেমন। সামনের খবরের কাগজটায় চোখ বুলোচ্ছিল আর কানে ডটপেনের পেছন দিকটা দিয়ে আরাম করে কানের খোল বার করছিল।
কাগজ পড়বে কি। খবর আর কোথায়? শুধু ধর্ষণ আর ধর্ষণ। গুলি গোলা খুন রাজনীতি। আন্দোলন পথ দুর্ঘটনা এ সব। ধুস জান একেবারে কয়লা হয়ে গেল। এসব যেদিন বন্ধ তো ঝড় বৃষ্টি বন্যা। আর কী যে সব বিদঘুটে খবর মাইরি। যেখানে বন্যা হবার কথা নয় সেখানে বন্যা। আর যেখানে খরা বিগত হাজার বছরে কখনও কেউ ভাবে নি সেখানে খরা।   
 লোকটার কথা-বার্তা বেশ কিছুক্ষন ধরে শুনছিল সাদিক। বিশেষ মন দেয় নি। ও তার কর্মচারীরাই সামলে নেবে। তাই তাদের সঙ্গে একটু রসিকতার লোভ সামলাতে পারছিল না।
কান খুঁটতে খুঁটতে বলল, বুঝলি কালি, এখন দেখছি রাজস্থানে বন্যা হচ্ছে । আর বঙ্গোপসাগরে নাকি যে খরা চলছে তা নাকি বিগত একশ বছরেও হয় নি। এসব যদি সত্যি হয় তো কাগজ আর নিউজ চ্যানেলগুলোর পোয়া বার। ওদের হৈ হৈ কাটতি আর রৈ রৈ টি-আর-পি রোখে কে? জগতটা সব উল্টেপাল্টে যাচ্ছে রে কালি সব উল্টেপাল্টে যাচ্ছে।
-- ওই জন্যেই তো আমার ঘুমের ওষুধটা লাগবে স্যার।
কর্মচারীদের কিছুতেই ম্যানেজ করতে না পেরে লোকটা এতক্ষনে ছুটে এসেছে মালিকের কাছে। একেবারে দৌড়ে এসেছে যেন হাতে চাঁদ বা পরিত্রাতা পেয়েছে।
-  এমন সব ঘটছে বলেই তো আর একটু ঘুমোতে চাই স্যার। একটা পাতা না দেন গোটা কয়েক  ট্যাবলেট অন্তত দিন। লোকটা বলল গড়গড় করে।
একজন কর্মচারীকে ইশারায় কাছে ডেকে নিচু গলায় বললেন, পেট গরম হয়েছে লোকটার বুঝতে পারছ না? জেলুসিল আর হাল্কা কটা সিডেটিভ দিয়ে ছেড়ে দাও।
- এক পাতা দিলেই ভাল হত। লোকটা তবু গাঁইগুই করে।
- কেন এক পাতা পেলে কি করবেন? একটা চোখ কুঁচকে প্রশ্নটা করল সাদিক।
- কি আর করব। একটা স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলে লোকটা বলল, আরও গোটা কুড়ি বছর শান্তিতে একটু ঘুমোতে পারতুম আর কি।
- কু –ড়ি বছর ! এমন একটা হাফ পাগলকে এত কাছ থেকে পেয়ে সবাই যেমন আশ্চর্য তেমনি খুশি। সত্যি পাগলরা এমন কৌতুকের খোরাক জোগাতে পারে যা নামকরা সার্কাসের নামকরা জোকাররাও পারে না। সে ভাবল। আর ভেবেই মনে মনে দম ফাটানো হাসতে লাগল।
--কেন এতদিন ঘুমোতে চান দাদা?
সাদিকের প্রশ্নে লোকটা একটু ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, সত্যি কথা বলব স্যার?
হাসি চেপে রেখে সাদিক বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন না।
--আমি আরও অনেক অনেক বছর বাঁচতে চাই স্যার---
--তা বাঁচুন না মশায়। আপনার বাঁচা আটকায় কে?
--আজকাল আর কী গ্যারান্টি আছে বলুন?  শুধু মারামারি কাটাকাটি আর খুনোখুনি। স্যার আপনার ওষুধের তবু একটা দাম আছে বিনাপয়সায় পাওয়া যায় না। কিন্তু আমার—মানে এই আমাদের অর্থাৎ মানুষদের? সত্যি কথা বলুন তো কোনও দাম আছে? একটা পয়সাও দাম আছে?
খুব উত্তেজিত গলায় কথা বলছিল সে। ওর চোখেমুখে ভয় যেন ঠিকরে পড়ছে। কেন এত ভয় কে জানে। সাদিকের মনে হল লোকটা নির্ঘাত পাগল। পাগলরা নাকি এমন অকারণে ভয় পায়। আবার যেখানে ভয় পাওয়ার সেখানে অকারণে অতিরিক্ত সাহস দেখায়।  
কর্মচারী আর মালিকে চোখাচুখি হল যার মানে হল লোকটাকে এখন ছেড়ো না । ওকে বেশ কিছুক্ষন ‘খদ্দের’ করা যাবে ।
দোকানে ভীড় নেই তেমন। যে অল্প কটা আছে কর্মচারী ঢিমেতালে তাদের ওষুধ সার্ভ করছে। মালিক রসিয়ে আলাপ জুড়েছে। হচ্ছে রাজনীতি, রণনীতি, আবহাওয়া এই সব  আলোচনা ।
- আবহাওয়া পাগলা হয়ে গেছে স্যার একেবারে just  পাগলা । উস্কোখুস্কো পাগলা লোকটার ঝটতি মন্তব্য।
মালিকের মুখে অর্থপূর্ণ গাম্ভীর্য আর চোখের কোণে ইশারা দেখে কর্মচারীরাও মুখ টিপে হাসছে। সত্যি এমন খদ্দের কি হয় বড় একটা।
-- আর শুধু কি আবহাওয়া স্যার? সাগর থেকে পাহাড়—স্বদেশ থেকে বিদেশ কোনটা আর ঠান্ডা বলুন তো? বেঁচে থাকাটা এখন শুধুই যন্ত্রণা। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে কি বেঁচে সুখ থাকে বলুন? ওই জন্যেই তো---আমি একটু ঘুমোতে চাই। এক পাতা দিলে ভাল হত। ওই ক’টা ট্যাবলেটে আর কী হবে বলুন?
লোকটা এবার স্বগতোক্তি করল, ঘুমোতে চাই আবার অন্তত কুড়ি বছর। দুঃসহ জীবনের থেকে কুড়িটা বছর অন্তত কমে যাক।
মেডিসিন সারভ করা হয়ে গেছে। জেলুসিল আর হাল্কা সিডেটিভ। দোকানের মালিকের প্রেস্ক্রিপশন অনুযায়ী একজন কর্মচারী দিয়েছে। সাদিক এবার পেমেন্ট নিয়ে বিল লিখবে। Quantity, দাম, ব্যাচ নম্বর এসব লেখা হয়ে গেছে। এসব হাল্কা ব্যাপারে ক্রেতার নাম কেউ লেখে না। তবু সাদিকের মনে হল নামটা হলে মন্দ হয় না। “খদ্দের”   যখন হয়েছে তখন একটু “নামী” খদ্দের হলে ক্ষতি কি?
- নামটা কি লিখব দাদা?
-আমার নাম স্যার?
হাসিটাকে বাঁকা ঠোঁটের আড়ালে আটকে রেখে সাদিক বলল, তবে কার? আপনি তো কিনছেন?
-  আমার নাম স্যার - লোকটা ইতস্ততঃ করল, নাম - কুড়ি বছরে অনেক কিছু গুলে মেরে দিয়েছি স্যার। কিন্তু এটা তো আমার দেশও নয় মনে হচ্ছে। আচ্ছা স্যর, সারা পৃথিবীটা কি এখন একটা দেশ হয়ে গেছে? দুনিয়া কি সত্যি একটা মুঠির মধ্যে এসে গেছে?
কর্মচারীরা হাসছে। একজন বলল, তাই তো মনে হয় দাদা। একজন শিল্পপতি স্লোগান তুলেছে যখন। সাদিক গম্ভীর। উত্তর দেওয়াটা জরুরী মনে করল না। তোল্লাইটা কর্মচারিরা বেশ ভালই দিচ্ছে। তার শুধু চুপ করে উপভোগ করে যাওয়ার কথা।
- হ্যাঁ, মনে পড়েছে। 
- কি মনে পড়েছে? সাদিক কৌতূহলী। ঠেলায় পড়লে নিজের বাপের নাম অনেকেই নাকি ভুলে যায়। কিন্তু নিজের নাম ভুলে যায় এমন লোক তো এখনও দেখে নি সাদিক। কৌতূহলী হবারই কথা।
- নাম স্যার। মনে পড়েছে মনে পড়েছে। লোকটা প্রবল উৎসাহে বলে উঠল, লিখুন রিপ ভ্যান উইংকল। শুনেছেন কখনও? আপনি লেখাপড়া জানা পন্ডিত লোক স্যর। নিশ্চয় শুনে থাকবেন।
এরপর আবার স্বগতোক্তি, ভেবেছিলুম কুড়ি বছর পর জেগে উঠে এক নতুন পৃথিবীকে দেখব। দেখলুম বটে। তবে মাথা অনেক নিচু করে দেখতে হচ্ছে এই পৃথিবীকে এটাই যা কষ্টের। তলিয়ে গেছে তো অনেকটা। স্পন্ডিলাইটিসের ওষুধ আছে তো স্যার আপনার দোকানে?
সাদিক এবার আর হাসল না। তার মন থেকে সমস্ত হাসি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল নিমেষে।


No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া