‘উস্রি
নদীর ঝর্না দেখতে যাব। দিনটা বড়ো বিশ্রী। শুনছ বজ্রের শব্দ? শ্রাবণ মাসের বাদ্লা।
উস্রিতে বান নেমেছে। জলের স্রোত বড়ো দুরন্ত। অবিশ্রান্ত ছুটে চলেছে।’...
রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমেই শিশুদের পরিচয় ঘটছে ‘শ্রাবণ মাসের বাদ্লা’র সঙ্গে। কিন্তু
এইসময়ে কেজো মানুষদের ভারি অসুবিধে। বাইরে বের হওয়া মুস্কিল। তাই কি শিশুদের র-ফলা
শেখাতে গিয়ে সহজপাঠের পাতায় কবিকে ছাপিয়ে একটা বাক্যে শুধুমাত্র বেরিয়ে এসেছিল
ভেতরকার কর্মবীর মানুষটি? হ্যাঁ, তিনি স্বীকার করেছেন ‘দিনটা বড়ো বিশ্রী।’ এই
শ্রীহীনতার অনুভব বোধহয় শুধুমাত্র র-ফলা শেখানোর আবশ্যিক কারণে নেমে আসেনি। কখনো
বা কবিসত্তা অবদমিত থাকে। এখানেও তাই ঘটেছে। কিন্তু পরের বাক্যবিন্যাসেই প্রকাশিত
হয় প্রকৃতির রূপবর্ণনা। আসলে শ্রাবণকে হয়ত কবি একই সাথে ভালবাসেন আবার ভয়ও পান।
শ্রাবণ যে বেশিরভাগ সময়ে বয়ে নিয়ে আসে বিধ্বংসী প্লাবন, এই আশঙ্কা থেকেই কবি
শ্রাবণকে পুরোপুরি উপভোগ করতে পারছেন না। এখানেই কবির কল্পনাকে ছাপিয়ে অমোঘ
সত্য লেখে এক কালজয়ী সাহিত্যিকের কলম যেখানে শোননদীতে শ্রাবণের বানে
শিউনন্দনের ঘর-পরিবার ভেসে যায়। সেই ‘সুধিয়া’ কবিতা শিশুদের জন্য লেখা হলেও তা
বাস্তবের মাটি ছুঁয়ে থাকে।
‘সাঁওতাল
মেয়ে’র রূপবর্ণনা করতে গিয়েও কবি টেনে আনেন শ্রাবণের মেঘ ও বিদ্যুতের উপমা, যেন
শ্রাবণ এক সহজ সুন্দরী হলেও নিজেকে ঢেকে রাখে এক অপরিচয়ের অবগুণ্ঠনে। এই অচেনা
শ্রাবণের রহস্য বারে বারে বিম্বিত হয় কবির বিভিন্ন গানে, কবিতায়। ‘শ্রাবণের
আমন্ত্রণে’ তাঁর ‘ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে’। কখনও আবার তিনি উচ্চারণ করেন, ‘আজ
শ্রাবণের বর্ষণে, আশীর্বাদের স্পর্শ নে’।
‘জীবনস্মৃতি’
তে দেখতে পাই বর্ষাঋতু বাল্যকাল থেকেই কবির মনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে আছে।
শিশুমনে ‘সুপ্তির অধিক এক পুলক’ জাগিয়ে তুলছে শ্রাবণের বর্ষণমুখর রাত। কবি বলছেন,
‘মনে পড়ে, ইস্কুলে গিয়াছি; দরমায়-ঘেরা দালানে আমাদের ক্লাস বসিয়াছে; অপরাহ্নে
ঘনঘোর মেঘের স্তূপে স্তূপে আকাশ ছাইয়া গিয়াছে; দেখিতে দেখিতে নিবিড় ধারায় বৃষ্টি
নামিয়া আসিল; থাকিয়া থাকিয়া দীর্ঘ একটানা মেঘ-ডাকার শব্দ; আকাশটাকে যেন বিদ্যুতের
নখ দিয়া এক প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্ত পর্যন্ত কোন্ পাগলি ছিঁড়িয়া ফাড়িয়া
ফেলিতেছে; বাতাসের দমকায় দরমার বেড়া ভাঙিয়া পড়িতে চায়; অন্ধকারে ভালো করিয়া বইয়ের
অক্ষর দেখা যায় না— পণ্ডিতমশায় পড়া বন্ধ করিয়া দিয়াছেন; বাহিরের ঝড়-বাদলটার উপরেই
ছুটাছুটি-মাতামাতির বরাত দিয়া বদ্ধ ছুটিতে বেঞ্চির উপরে বসিয়া পা দুলাইতে দুলাইতে
মনটাকে তেপান্তরের মাঠ পার করিয়া দৌড় করাইতেছি।'
সেই যে
মন তেপান্তরের মাঠ পেরিয়েছিল, সে ত আর ফেরে নি। ভাগ্যিস ফেরে নি। ফিরলে আমরা কবিকে
পেতাম না। বর্ষার এই বিশেষত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে কৌতুকপ্রিয় কবি বলেন, ‘বর্ষা-ঋতুটা
বিশেষভাবে কবির ঋতু। কেননা কবি গীতার উপদেশকে ছাড়াইয়া গেছে। তাহার কর্মেও অধিকার
নাই; ফলেও অধিকার নাই। তাহার কেবলমাত্র অধিকার ছুটিতে; কর্ম হইতে ছুটি, ফল হইতে
ছুটি।'
বর্ষার
বিদায় সেইকারণে সঞ্চার করে এক বিষাদ। অবশ্যম্ভাবী জেনেও কি কবি তাকে আঁকড়ে ধরতে
চান? আর কোনও ঋতুকে এভাবে আরও কিছুদিন থেকে যাবার আকুতি জানিয়ে বলে ওঠেন না,
‘শ্যামল ছায়া, নাই বা গেলে’। বিরহী উচ্চারণে দিকে দিকে ধ্বনিত হয় বিদায়বার্তা,...
‘শ্রাবণ সে যায় চলে পান্থ ,
কৃশতনু ক্লান্ত ,
উড়ে উড়ে উত্তরী-প্রান্ত
উত্তর-পবনে ।
যূথীগুলি সকরুণ গন্ধে
আজি তারে বন্দে ,
নীপবন মর্মর ছন্দে
জাগে তার স্তবনে...’
No comments:
Post a Comment