Sunday, July 23, 2017

ধারাবাহিক গল্প / দিয়ার ডায়েরী থেকে / পারমিতা চ্যাটার্জী





 অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নাকি একটা সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে হয়,এই কথাটা দিয়া তার মহামান্য স্বামী শ্বশুরের কছে প্রায়শই শুনে আসত, কিন্তু সে কি একতরফা? দিয়া জানত তা্র শ্বশুর এ কথা বলত যাতে তার দুই মেয়ে জামাই, তাদের শ্বশুরবাড়ীর লোকেদের কোন সেবা যত্নের কোন ত্রুটি না থাকে।
এখন দিয়া মাঝে মাঝে একলা জানলার ধারে বসে হাসে। হায় রে ভাগ্য কোথায় সব সম্পর্ক, যে যার ঝোলা গুছিয়ে নিয়েছে, কে মনে রাখে এই বৌদিকে, যে একদিন একটা বিশাল সংসারের তরণী বেয়ে চলেছিল, অথচ সেদিন কিন্তু এই সম্পর্কগুলোকে আপন করে কাছে টেনে নিয়ে চলতে চেয়েছিল, শেষ্ পর্যন্ত পারেনি, সম্পর্কগুলো ধূসর বিবর্ণ হয়ে পড়ে গেছে, কেউ মনে রাখেনি মা বিহীন সংসারে তাদেরই সমবয়সী বৌদি সবাইকে নিয়ে চলছিল একভাবে, কোনদিন কারও কোন ত্রুটি হতে দেয়নি। বাপেরবাড়ীতে নিজের জামাইষষ্ঠী উপেক্ষা করে বছরের পর বছর জামাইষষ্ঠী পালন করে গেছে। বছরের পর বছর গুরুদেবের জন্মোৎসব পালন করে গেছে ।জন্মোৎসব মানে ৩০০ লোক প্রতি বছর খাওয়া দাওয়া করত । শুধু খাওয়া দাওয়া নয় ভোর পাঁচটায় উঠে গুরুদেবের চা করা থেকে আরম্ভ হত , তারপর মেয়েদের স্কুল পাঠাতে না পাঠাতেই শুরু হয়ে যেত কুমারী ভোজনের আয়োজন । কুমারী ভোজন শেষ হয়ে গেলে তার প্রসাদ বিতরন করা, অত লোকের চা- সরবতের ব্যাবস্থা করা ইত্যাদি কত আর লিখব।সবাই সাহায্য করতে এগিয়ে আসত ঠিকই, কিন্তু সংসারটা তো দিয়ার, অনবরত ডাকাডাকি চলত ‘দিয়া এটা কোথায় থাকে ? দিয়া গুরুদেব চান করবেন গরম জলটা দিতে হবে তো ওঁর রান্না হয়েছে তো? হ্যাঁ মূল রান্না ঠাকুর করলেও গুরুদেবেকে যেটা ভোগ ,যা রূপোর থালা করে সাজিয়ে  দেওয়া হত তা দিয়াই রান্না করত আর জন্মদিনের পায়েস রান্না করত বড়ননদ । তাঁর খাওয়া শেষ হলে সেই প্রসাদ দিয়ে অন্যদের খাওয়া শুরু হত। এত বড় কর্মকাণ্ডর আয়োজন বছরের পর বছর ধরে দিয়া একা হাতে করে গেছে। হয়তো উৎসবের দিন তাকে সাহায্য করতে অনেকেই এগিয়ে আসত কিন্তু তার আগে পরের সমস্ত জোগড় তো দিয়াই করত, তার মধ্যে থাকত নিজের দুই শিশু সন্তান এবং তিন শ্বশুরের সমস্ত দায়িত্ব। তার জন্য কেউ তাকে কখনও আহা বলেনি এমনকি দিয়ার স্বামীও না । সে চলত স্রোতের জোয়ারে গা ভাসিয়ে চিরকাল স্ত্রীর কষ্টের মূল্য কোনদিনই দেয়নি তা যদি হত তাহলে হয়তো তাকে ডায়েরী লিখতে বসতে হতনা। যখনই মেয়ে জামাই তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ী এসেছে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে তাদের আদর যত্ন করা, আর আজ যখন দিয়া অসুস্থ হয়ে ঘরের এককোণে বসে থাকে কোনরকমে একবার দেখে গিয়ে সবাই ডিউটি সেরে দেয়, দিয়া এ ডিউটি চায়না , যেখানে কোন প্রাণের টান নেই সেখানে শুধুমাত্র সৌজন্যবোধের তার প্র্য়োজন নেই।
আজ দিয়া বড় একলা ,তার সামনে দিয়ে জীবন নদীটা এখনো বয়ে চলেছে, মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে নোঙর খোঁজে ,তারপর হতাশ হয়ে দেখে চতুর্দিকে শুধু বালি আর কাদা,নোঙর ফেলার কোন জায়গা নেই।
গোধূলি বেলা শেষ হয়ে গিয়ে জীবন লগ্ন এখন রাতের কালো অন্ধকার দিয়ে হাঁটছে, কখনো থামছে ,কখনও মনের জোরে হাল টেনে এগিয়ে চলেছে, পাল হীন নৌকাটাকে। আজ অবসাদ গ্রস্ত মনটা বার বার অতীতের হাত ধরে হাঁটতে চাইছে।
দিয়া সকালে মেয়েকে স্কুলে পাঠাবে বলে ওপরে এসেছে ওকে তৈরী করবে বলে। ছোট মেয়ে খেতে গিয়ে বমি করে,তাও আপ্রাণ চেষ্টা করছে ও যাতে একটু খায়। অনেক বেলায় আসবে, বেশীক্ষণ ধরে মে্যেকে খাওয়াবার অবকাশ সে পেতনা, হয়তো একটু পরেই তার ডাক আসবে। মেয়েকে বকছিল তাড়াতাড়ি খেয়ে নে না, ছোট মেয়েটা তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে বমি করে ফেলল, দিয়ার সমস্ত রাগ ছিল মেয়েদের ওপর, ছোট মেয়েটাকে খুব বকে দিল, ঠিক তার একটু পরেই রান্নার ঠাকুর এসে দাঁড়াল দরজায়,দিয়া মুখ তুলে তাকিয়ে বলল , কি হল?
বৌদি রানাঘাট থেকে সমর জেঠু এসেছে, বাবু নীচে ডাকছে,
বাবুকে বল আসছি আমি টুম্পা বমি করেছে ওকে পরিস্কার করে তারপর নীচে যাচ্ছি।
দিয়া জানে সঙ্গে সঙ্গে সে নীচে নামলনা বলে শ্বশুরের মেজাজ ভারি হবে, কিন্তু সেই বা কি করে। মেয়েটাকে স্কুলে তৈরী করে তো পাঠাতেই হবে, অথচ এই শ্বশুরমশাইয়ের মেয়ের বড়ীতে যখন একবেলার জন্য তার শ্বশুরশাশুড়ী আসত, অমনি তিনি আর মেজজ্যাঠা শ্বশুর বলতে আরম্ভ করতেন, উফ! কি অমানবিক মেয়েটা একলা সব কাজ করে যাচ্ছে এখন কি না এলেই নয়! দিয়ার হাসি পেত, খুব হাসি পেত। মনে হত হায়রে! মানুষ কি স্বার্থপর হতে পারে! আজ মেয়েদের সমবয়সী বাড়ীর বৌমার ওপর যখন নিজের এবং নিজের দুই অবিবাহিত অবুঝ দাদ্‌ নিজের মেয়ে জামাই, ছেলে- নাতিনাতনী, গুরুদেব বাড়ীতে আসা যাওয়া, সমস্ত অতিথি বর্গের ভার,বিনা দ্বিধায় চাপিয়ে দিতে এতোটুকু কুণ্ঠিতবোধ করেন নি। মেয়েটা সারাদিন মরে মরে কাজ করে যেত , এতো সমাজদরদী শ্বশুরমশাইদের কখনও মনে হয়নি ওর নাম করে একটুরো ফল এনে দেয়। বিশেষ করে মেয়েটা যখন অন্তঃসত্বা, তখন একটু তার আলাদা কিছু খাবারের বা বিশ্রামের ব্যাবস্থা করি। না দিয়ার মহামান্য উচ্চস্তরের শ্বশুরমশাইদের একথা কখন মনে হয়নি, উপোরন্তু কোন কাজের ত্রুটি হলে দিয়ার শ্বশুরমশাই বলতেন আমার বাড়ীতে থাকতে হলে আমার মতে চলতে হবে। দিয়া মাঝে মাঝে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে বাবা মায়ের কাছে গিয়ে বলত,” কি করতে যে এই তিনতলা বাড়ি গাড়ী দেখে বিয়ে দিয়েছিলে, প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ দেখে বিয়ে দিতে পারোনি?” দিয়ার বাবা ম্লান হয়ে যেতেন ,”বলতেন বাড়ী গাড়ী দেখে বিয়ে দিইনি মা, বাড়ীর খুব কাছে আর খুব জানাশোনা পরিবার বলে দিয়েছিলাম। কি করে জানব এরকম হবে ?কথা বলতে যখন গিয়েছিলাম তখন তো অন্যরকম ছবি দিয়েছিলেন---।“ এইভাবে তার স্বপ্নমাখা দিনগুলো এক বিশাল তরণী বাইতে বাইতে চলছিল।মাঝে মাঝে মনে হত এ যেন এক অজানা পারাবার, এই পারাবা্রের মধ্যে একটা বিশাল তরী সে একলা বেয়ে চলছে। সে জানে যতক্ষণ সে দিতে পারবে ততক্ষণই ভালো , যে মুহুর্তে সে বলবে ,পারবে না তখনই শ্বশুরের মুখের ছবি অন্য রকম হয়ে যাবে।এইভাবেই ভয় দ্বিধা দ্বন্দে তার দিনগুলি কেটে যাচ্ছিল, আর বলি দিচ্ছিল নিজের সমস্ত স্বপ্নের।
দিয়ার বিয়ে হয়েছিল ১৯৮২ সালে, সেই সময়েও মেয়েদের দিয়ে এরকম জোয়াল টানিয়ে নিত অনেক শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা। বউ হয়ে এসেছ যখন, তখন জোয়াল তো টানতেই হবে, অবশ্যই ব্যাতিক্রম তো আছেই।
ক্রমশঃ


No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া