Tuesday, July 24, 2018

হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি / -অরুণ চট্টোপাধ্যায়



আশি বছরে হাঁটতে ভাল পারত সদাশিব। এমন কি বাইরেও যেতে পারত। এখন এই পঁচাশি বছরের দোরগোড়ায় এসে বিছানা তার প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়েছে।
মোবাইলে রিং। কষ্ট করে একটু কাত হয়ে বিছানা থেকে মোবাইলটা নিল সে। শরীরে জোর কমেছে—মনেও। কিন্তু আবেগ একটু বেড়েছে। আর অভিমানও। তাই সন্তুর ছবিটা মোবাইলের স্ক্রীনে ঠিক দেখে নিয়েছে সে। সন্তু তার নাতি। বড় ছেলের ছোটছেলে। ওরা থাকে আমস্টারডামে।
মোবাইল নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তার দিকে। নাতির এই ছবিটা দারুণ হয়েছে। সেদিন ওর জন্মদিনের একটা কেক কাটার ছবি পাঠিয়েছিল বৌমা। আজ হঠাৎ ছবিটা মনে পড়ে গেল।
বড়ছেলে সুধা মানে সুধাকরের সঙ্গে ওর মুখের ভারি মিল। মাঝে মাঝে তো নাতিকে দেখেই ছেলেকে দেখছে বলে ভ্রম হয় তার। এ যে শুধু এই ভ্রমের পঁচাশি বছরে তা নয়। ছেলেটার জন্মের একবছর পর থেকেই।
কানের কাছে বাজছে শাঁখের আওয়াজ। খুব ভাল লাগছে সদাশিবের এই আওয়াজটা। যেন আরামে চোখ বুঝল সে। বুজে যাওয়া চোখের পেছেনে আর একটা চোখ খুলে গেল ঠিক তক্ষুনি।  
বাড়িটা গমগম করছে তখন। সদাশিবের বাবা, মা, জ্যাঠা, জেঠিমা, পিসিমা পিসেমশাই, তার বৌ প্রতিমা, নিজের দুই ভাই অমল আর চঞ্চল। তখন অবশ্য ওদের বিয়ে হয় নি। নিজের দুই বোন জয়ন্তী আর বাসন্তী। জয়ন্তীর বিয়ে হয়ে গেছে। তার বর মানে সদাশিবের জামাইবাবু দীনদয়াল। দুই ভাগ্না আর এক ভাগ্নী। কত আত্নীয়—আনন্দ যেন উথলে পড়ছে।
বড়ছেলে সুধাকরের জন্মদিন আজ। সুধার মেজকাকা মানে তার মেজভাই অঘোর সাতসকালে নিমুগয়লাকে হাঁক পেড়ে ডেকে খাঁটি ফ্যানাওঠা দুধ জোগাড় করেছে। ছোটভাই অসিত জোগাড় করেছে সাধুখাঁর দোকানের কামিনী আতপ আর কিসমিস কাজু।  
--জন্মদিনের পায়েস হল আসল। সেটা তুমিই রেঁধ বৌমা। পায়েসের সঙ্গে যাবে মায়ের আশীর্বাদ। সদাশিবের মা বলেছিলেন, আর বাকি রান্না আমরা সব মেয়েরা ঠিক সামলে নেব।
দুপুর তখন একটা বোধহয়। মাটিতে মায়ের নিজের হাতে সেলাই করা ফুলকাটা আসন পাতা হয়েছে। প্রদীপ জ্বালানো হয়েছে। একটা কাঁসার রেকাবে ধান-দুর্বা। আসনে মুখ নীচে করে হাসিমুখে বসে আছে সুধা। এক এক করে সবাই ধান-দুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ সারা হল। প্রথমে তার মা মানে সদাশিবের বৌ প্রতিমার লাল শাড়ী মাথার মাঝে জ্বলজ্বল করছে লাল সিঁদুরের টিপখানা। প্রদীপের শিখায় উজ্জ্বল যেন এক মাতৃমূর্তি। নিজের বৌএর সেই ছবি আজও চোখের সামনে এতটুকু অনুজ্জ্বল হয় নি।
শাঁখ তো বেজেই চলেছে। মনের আনন্দে বাজিয়ে চলেছে মেয়ের দল। বাজাতে বাজাতে খুশির আনন্দে একে অন্যের কাঁধে ঢলে পড়ছে হাসতে হাসতে।
কিছুদিন আগে দাদুভাই ফোনে জানিয়েছিল বাংলার দুর্গাপুজো তার খুব ভাল লাগে। কি সুন্দর সব থিমের পুজো। এবারে সে আসবে দেখতে। দাদু কি জিন্স পরতে পারে? তার মাও এখন ওখানে জিন্স পরে। বলে এইতেই বেশ স্বস্তি। বাবা তো স্যুটেই ধোপদুরস্ত। তবে আউটিং-এর সময় মাঝে মাঝে জিন্স আর গেঞ্জি পরে।
সেদিন সদাশিব বলেছিল, আর দাদুভাই জিন্স পরব কি? এই পঁচাশি বছরে লুঙ্গিটাই তো ভাল করে পরতে পারি না।
এসব কথা শোনে নি সন্তু। পুজোর সময় দাদুকে সে জিন্স পরিয়েই ছাড়বে। নিয়ে যাবে ডিস্কো থ্রেটে। সদাশিব হেসে বলেছিল, তবেই তো হয়েছে দাদু। আমার হাত পা আর গোটা থাকবে না একটাও। সন্তু বলেছিল, আমার তিন বেষ্ট বান্ধবী হয়েছে দাদু অ্যামস্টারডামে। ওরা খুব ভাল ড্যান্স করে। ওদের নিয়ে যাব পুজোয়। ওরা তোমায় ডিস্কো থ্রেটে হেল্প করে দেবে।
শাঁখের আওয়াজ মিলিয়ে গেল। বাইরে কী যেন ধপ ধপ শব্দ করে একটা গাড়ি চলে গেল। পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ সদাশিবের কানে কে যেন বাজাতে লাগল ঢাক। একটা ধুনোর গন্ধ। দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল। নতুন পোশাক আর সাজ। কী মিষ্টি কলরব। বাতাসে যেন কী মিষ্টি এক রঙ। মাইকে সুন্দর বাংলা গান বাজছে। হেমন্ত, মান্না, শ্যামল, পান্নলাল, ধনঞ্জয়—কত কত নাম। সুর মনে আছে নামগুলো সব হয়ত এখন আবছা হতে শুরু করেছে।  
সেই বিজয়ার দিন। সুধা আর আরও সব ছোটরা তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছে। সদাশিব বলল, আগে সব ঠাকুর্দা ঠাকুমাদের করে এস। তারপর মাকে তারপর আমাকে।
বিজয়ার মিষ্টি খাওয়ার আগে বড়দের সঙ্গে কোলাকুলি। আজ এখন যেন তেমন পুরোন হয় নি সদাশিবের চোখে। এখন ওরা যে কি একটা ভাষা বার করেছে নস্টালজিয়া না কি? আচ্ছা এই শব্দটা কি সেকালে ছিল কিংবা প্রচলিত ছিল? স্মরণশক্তি কমে গেছে বলেই কি মনে পড়ছে না? হতে পারে।
মোবাইলে আবার রিং হচ্ছে। একটা কী বাজনা দিয়েছে কোম্পানী। নাতি যখন দেশে ছিল তখন দাদুর জন্যে এই মিউজিক সেট করে দিয়েছে। আর অবশ্য তাকে হাতে ধরে মোবাইল চালানোও শিখিয়ে গেছে। বলেছে, জানলে দাদু এখন থেকে আর ল্যান্ড ফোনে কল ধরার জন্যে বিছানা থেকে তোমায় উঠতে হবে না। বিছানায় বসে বসেই তুমি আমার সঙ্গে গল্প বলতে পারবে। যখন খুশি যতবার খুশি।
এর কিছুদিন পরে ল্যান্ডফোন কানেকশন কেটে দিয়েছে সুধা। বলেছে, এসব এখন অবসোলেট। একটা মোবাইল কিনে দিয়েছি বাবা। দেখবে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব হয়ে যাবে এক সঙ্গে।
সেই নস্টালজিয়াটা তাড়া করল সদাশিবকে। এই অবসোলেট ল্যান্ডফোন আনতে কম কাঠখড় পোয়াতে হয়েছিল তাকে? বকুলনগর তখনও খাঁ খাঁ করছে একটা গাঁ। শহরের কল্কে পায় নি। একটা টেলিফোন করতে দৌড়তে হত এক কিলোমিটার দূরে সেই ডাকঘরে।  
আত্মীয় স্বজনের কারোর শরীর খারাপের একটা টেলিফোন ধরতে আসতে হত আধ কিলোমিটার দূরের মিশিরবাবুর বাড়ি। মিশিরবাবু ছিলেন বড়লোক রেশন ডিলার। লোক ভাল ছিলেন। সম্মান করতেন সদাশিবের বাবা জ্যাঠাদের। ছেলেবেলায় পড়েছেন এদের কাছে। খেয়েছেন অনেক কানমোলা। আবার অবশ্য ভাল রেজাল্ট করার জন্যে ভীমানাগের সেই বিখ্যাত রাংতা দেওয়া সন্দেশ। একদিন আগে কোলকাতা থেকে আনিয়ে রাখতেন বাবার আর এক ছাত্র সঞ্জীবকে দিয়ে। সঞ্জীব কোলকাতায় চাকরি করত আর ভীমনাগের সন্দেশ কোলকাতা ছাড়া কোথাও পাওয়া যেত না।
সারা গ্রামের মধ্যে দুটো বাড়িতে টেলিফোন। এক ওই মিশিরবাবু আর এক পোষ্টাফিস। বাবা বললেন, এত বড় পরিবার। এত আত্মীয়স্বজন। একটা টেলিফোন থাকলে ভাল হত না। সেই ইচ্ছেকে সম্মান দিয়ে দরখাস্ত করা হয়েছিল।
পাঁচ বছর পরে সেই কানেকশন লাগে। তাও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। কিন্তু ফোন তো আছে সে ফোনে ডায়ালটোন কই? মাঝে মাঝে যেন বেড়াতে আসে। তখন সারা দেশে কটাই বা এক্সচেঞ্জ ছিল। আজ তো গন্ডা গন্ডা। ভাড়াও কমেছে আর হয়রানিও।
স্মার্ট ফোনে সদাশিবকে একটা ফেসবুক খুলে দিয়ে গেছে সন্তু। বলেছে, এখানে তো আর এখন কেউ থাকল না তোমার সঙ্গে। কিন্তু দেখবে ফেসবুকে সারা পৃথিবী থেকে তোমার বন্ধু হবে। তোমাকে কত ভালবাসবে। তোমার লোনলিনেস কেটে যাবে দাদু। তুমি আবার চনমনে হয়ে উঠবে। একজন আমস্টারডামের তরুণীর সঙ্গে ফেসবুকে বন্ধুত্ব করিয়ে দিয়েছে নাতি। নাম ক্লারা।   
সেদিন মোবাইল খুলে দেখল তার সেই ঊনিশ বছরের সদ্য হওয়া তরুণী ক্লারা প্রেম নিবেদন করেছে তাকে। বেশ মজা লেগেছিল। দাদুর সঙ্গে নাতনির কল্পিত প্রেমের কথা বেশ বুক বাজিয়ে বলত দাদুরা। সিনেমাতেও এমন গল্পের ছোড়াছড়ি। একালেও এই প্রেম কল্পিত বটে তবে আরও মজার কিংবা বিপজ্জনকও।  
সে কথাটা মনে এল হঠাৎ। মনে এল আর একটা কথা। সেদিন তার দিদি শান্তিকে যেদিন চুলের ঝুঁটি ধরে টানতে টানতে আনা হয়েছিল পুকুরঘাটের এক ঝোপের পাশ থেকে। শ্রীপুরের দাশরথী দাসের সঙ্গে নাকি প্রেম করছিল দিদি। সন্ধেবেলায় গাছের ডালে দুজনে পাশাপাশি বসে পা দোলাতে দোলাতে কুলের আচার খাচ্ছিল। এক অসবর্ণ গোত্র আর দুই, অভিভাবকদের অমত।    
এক মাসের মধ্যে ঘটক ডেকে পাকাপাকি বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল এক সরকারি উঠতি হত্তাকত্তার সঙ্গে। দিদি প্রথমে খুব কেঁদেছিল। তারপর সারাজীবন খুব হেসেছিল।
মেজ ভাই অমল তখন মেদিনীপুরে বদলি হয়ে গিয়েছিল। বাবার হঠাৎ কেমন শরীর খারাপ হতে লাগল। ডাক্তার নিজেই বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। তখন এত অমুক পরীক্ষা তমুক পরীক্ষার ফ্যাকড়া ছিল না। আজ যেমন রুগীরা সারা রাত বসে থাকে ডাক্তারের বাড়ির দোরগোড়ায় অথবা হাসপাতাল বা নার্সিং হোমের চত্বরে তখন কিন্তু ডাক্তাররা বসে থাকতেন রুগীর বাড়িতে সারারাত। কি জানি ইমার্জেন্সি যদি কিছু হয়ে যায়।
সদাশিব পরের দিন পড়িমরি করে তিন কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে পোষ্টাফিসে গিয়ে টেলিগ্রাম করিয়ে এল। খটা খট করে মেশিন চালিয়ে কর্মীটি বলল, আর্জেন্ট তো তাই মনে হয়, কাল সকালেই ডেলিভারি হয়ে যাবে।  
জ্যাঠামশাই বললেন, তুই বাবা আর একটা খাম পোষ্টকার্ড কিছু একটা লিখে ফেলে দে। ওই খট খটকে অত বিশ্বাস করি না আমি।
তা সে চিঠি পৌছল তিনদিন পরে। মেজভাই এল চারদিন পরে আর বাবা ঠিক হয়ে যাবার দশদিন পরে যখন সে ফেরত গেল সেদিন সে হাতে পেল সেই আর্জেন্ট টেলিগ্রাম। সেদিনই পৌঁছেছে।  
আগে ছিল ডাকতার বিভাগ মানে ডাক ও তার বিভাগ। লোকে হেসে হেসে বলত ডাক্তার। পোষ্টাফিস ডাক্তারিও করে। এখন সেই ‘তার’ কথাটা চলে গেছে। শুধু ডাকবিভাগ। কেননা ‘তার’ মানে টেলিগ্রাম উঠেই গেছে দেশ থেকে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সদাশিব। নস্টালজিয়া আক্রমণের একটা লক্ষণ বোধহয়।  
অন্যমনস্কভাবে আবার চোখ পড়ে গেল মোবাইলের স্ক্রীনে। দাদুভাইয়ের ছবি। সুন্দর মিউজিক দিয়ে বেজে চলেছে রিং টোন। এই তো কিছুদিন আগেই দাদুভাই বেশ ভাল একটা মেসেজ করেছিল। পঁচিশ বছরের দাদুভাই কি সুন্দর তরতাজা তরুণ হয়েছে। এম-টেক পাশ করতে আর হয়ত মাত্র কয়েকটা মাস। আমস্টারডামে ওর চাকরি একেবারে তৈরি আছে।
কি সুন্দর ঝরঝরে বাংলায় মেসেজ করেছে। ইন্টারনেটের এই একটা সুবিধে। পৃথিবীর সব প্রান্তেই তুমি যে কোনও ভাষা পাবে। যদি খোঁজ। আর লিখেতে পার যদি তোমার ইচ্ছে থাকে তো।
বাড়িতে অবশ্য বাংলা চললেও বাবা কাকার অফিসে ইংরেজি ছাড়া তো গতি ছিল না। সেই বৃটিশ যুগে অফিসের কত ইংরেজ বাবু আসত তাদের বাড়িতে। তাদের সঙ্গে সদাশিবের বাবা কাকা জ্যাঠারা গড় গড় করে ইংরেজি বলতেন। না বলে উপায় ছিল?
একটা পোষ্ট কার্ড আর একটা এনভেলাপ অনেক কষ্টে নিজের একটা পছন্দের পড়ার বইয়ের ফাঁকে গুঁজে রেখেছিলেন। সে হয়ে গেল বেশ কয়েক বছর পোষ্টকার্ড খাম এনভেলাপ এসব হাওয়া। এখন স্মার্ট ফোনে সবাই মেসেজ করে। মেসেঞ্জার আছে, হোয়াটস অ্যাপ আছে। খামের কথা শুনলে সবাই হেসে ফেলে। বলে এখন কোথাও অ্যাপ্লিকেশন পাঠাতেও খাম লাগে না তো এমনি চিঠি পাঠাতে।
যেমন এখন মানুষের সুবিধে হচ্ছে ক্যাসলেস দুনিয়া। মানে পকেটে টাকা নেই তবু জিনিস তুমি কিনছ দেদার। যেন ভূতে তোমার টাকা বয়ে এনে দিচ্ছে দোকানদারের কাছে। ইলেক্ট্রিকের বিল মেটাও বা বৌয়ের শাড়ী কিংবা ছেলে বৌমার সাধ মেটাতে কেনো টাটা ইন্ডিকা—যা থাকার গরবে তোমার পা দুখানি ভারি করলেও নগদ তোমার পকেট ভারি করবে না একটুও। এই হল ক্যাসলেস দুনিয়া।
তেমনি আছে খামলেস দুনিয়া। বদলে আছে শুধু মেসেজ আর মেসেঞ্জার। নিজের স্মার্ট ফোনে একটা খামের আর একটা পোস্ট কার্ডের ছবি ফাইল করে রেখেছে সদাশিব। মাঝে মাঝে খুলে দেখে আর অবাক হয়ে ভাবে পৃথিবীটা যা তাড়াতাড়াই ঘুরছে ছিটকে না পড়তে হয়।
নাতি সেদিন মেসেজ করেছিল দাদুকে, দাদু আমি প্রায় আড়াই হাজার ইউরো জমিয়েছি চাকরি পাবার আগেই। দাদু খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন, বাবা বেশ বড় ছিল ভাঁড়টা কী বল?   
নাতি হেসে বলল, দাদু, তূমি এযুগে অচল দাদু।
দাদু থতমত খেয়ে বলল, কেন দাদুভাই?
--আমাদের এ যুগ আর তোমাদের সে যুগে পড়ে নেই। এখন আর ভাঁড়ে কেউ টাকা পয়সা জমায় না। জমায় একাউন্টে। আমার নামে বাবা একটা একাউন্ট খুলে দিয়েছিল। তাতে মা বাবা বা আমি যে যখন খুশি যতবার খুশি টাকা জমিয়েছি। আর এ টাকা ভাঁড় ভেঙ্গে গুনতেও হয় না দাদু। শুধু একাউন্টে ব্যালেন্স দেখতে হয়। আর গোনার কাজটা করে কমপিউটার।
তাই সেকালের একটা মাটির লক্ষ্মীভাড়ের ছবি সে স্মার্ট ফোনে বেশ যত্ন করে রেখে দিয়েছে। এ বাড়িতে এখন তো আর বিশেষ থাকে না। তার ওপরের সবাই চলে গেছে। এমন কী ছোট হওয়া সত্বেও নিজের বৌও। ভায়েরাও সব বাইরে বাড়ি করে নিয়েছে। ভবিষ্যতে যৌথ সংসার নিয়ে যদি কেউ গবেষণা করে তো সেটা শুধু এই ফাঁকা বিশাল মাপের সংস্কারহীন বাড়ীটাকেই দেখতে হবে।
কি সুন্দর করে বাজছে স্মার্ট ফোনটা। কে আবিষ্কার করেছিল তা জানে না সদাশিব। কিন্তু এখন বেশ কৌতূহল হচ্ছে। ছোট্ট একটা মুঠির মধ্যে ধারণযোগ্য যন্ত্র যা দিয়ে নাকি সব কাজ করা যায়। এই যে সেদিন হোয়াটস অ্যাপে ভিডিও চ্যাট করল সদাশিব তার পঁচিশ বছরের নাতির সঙ্গে। ছেলে ছিল না। ছিল তার মা মানে সদাশিবের বৌমা। কেমন স্পষ্ট কথা শোনা যাচ্ছে নাতি আর বৌমার। শুধু কথা বলতে দেখাই নয়, তার মুখের সমস্ত অভিব্যক্তি এমন কি এরা যাকে বলে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ তাও। মনে হচ্ছে যেন পাশে বসে পাঁচ বছরের বাচ্চার মত কলকল করে কথা বলে যাচ্ছে পঁচিশ বছরের নাতি। কে বলবে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে রয়েছে সে?
সেদিন কথা বলতে বলতে কথার ছলে একটা অদ্ভুত কথা বলল দাদুভাই। বলল, দাদু তোমার যখন মন খারাপ হবে তখন আমায় ভিডিও কল করবে। জান অনেকে তো আড্ডা দেয় এই ভিডিও চ্যাট করে।
আড্ডার কথায় হঠাৎ খুব মন খারাপ হয়ে গেল সদাশিবের। এই শব্দগুলোর মধ্যে কি অসাধারণ জোর ছিল তা ভাবাই যায় না। আজ থেকে তিরিশ-চল্লিশ বছর আগেও এমন বাড়ি ছিল না যার সদর ঘরের লাগোয়া একটা রক ছিল। এই রকে ছেলেবয়েসে কত আড্ডা দিয়ে বড়দের কানমলা খেয়েছে সে গুরুজনদের তার ঠিক নেই। আবার বড় বয়েসেও বড়দের সঙ্গে এই রকে বসে দিব্বি আড্ডা জমত। এমন কি সন্ধ্যায় চাপড়ে মশা মারতে মারতে কত রাজা-উজির মেরেছেন তার ঠিক নেই।  
আবার কে যেন বলছিল ফেসবুক হল এক ভার্চুয়াল বুক যা কোনদিন শেষ হবে না। এটা নাকি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আড্ডাখানা। কোনও সদর ঘর বা রক টক কিছু দরকার নেই। শুধু হাতের মুঠোয় একটা স্মার্ট ফোন থাকলেই হল। আর বিছানা বা সোফা এসব কিছু থাকাটাও খুব জরুরি নয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এমন কি হাঁটতে হাঁটতেও তুমি যোগ দিতে পার এই আড্ডায়।  
না এখন আর রক টক নেই কোথাও। সব রক ঘিরে সেখানে ঘেরা বারান্দা করে নেওয়া হয়েছে। নিজের চৌহদ্দি আর বাইরের কারোর জন্যে নয়। নিজের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে অন্যের চৌহদ্দিতে পা রাখারও দরকার নেই কারোর।
হঠাৎ চোখ পড়ে গেল মোবাইলের দিকে। রিং তো আর হচ্ছে না? দাদুভায়ের ছবিটাও তো আর নেই। একেবারে কালো হয়ে গেছে স্ক্রীন। বোধহয় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
অন করল মোবাইল। ইস মিসকলের একেবারে ছড়াছড়ি। এক দুই করে গোনার চেষ্টা করতেই ক্লান্তি এল। দূর ছাই। এত মিস হয়েছে একি আর গুণে বার করা যায়? থাক নাতি আবার কল করবে। নতুন ভাবে। নতুন মেজাজে।  
  



1 comment:

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া