ট্রেন থেকে নামতেই ঝমঝম
করে বৃষ্টি শুরু হল উঃ আবার বৃষ্টি -বিরক্ত হল তিস্তা ! শনি -রবি দুটো দিন স্কুল
ছুটি আর সোমবার টা ছুটি নিতেই হল তবেই না আসতে পারলো -হালিশহরের বাড়িতে ! সত্যি
আজ প্রায় দুবছর বাদে এখানে এলো ভাবা যায় ! সেই এসেছিলো জ্যেঠু মারা যাবার পর !
আজকাল মোটে সময় করে উঠতে পারে না ওর স্কুল , তাতানের স্কুল -অয়নের হসপিটাল সব মিলে ঝড়ের বেগে দিনগুলো কাটছে বাপের বাড়ি ঘুরতে আসা এখন বিলাসিতা --তাও যদি
বাবা -মা থাকতো !
এবার আসতেই হল বড়দার জরুরী তলব বাড়ি নিয়ে কিসব কথা
বার্তা আছে ! বাপ -মায়ের একমাত্র সন্তান তিস্তার কাছে এই তুতো ভাইরাই তো সব ! বড়
জ্যেঠুর ছেলেই ওদের সবার বড়দা --জ্ঞান হয়ে এস্তক সেটাই মেনে এসেছে !
বাড়ির কাছে রাস্তার মোড়টায় রিক্সাটা
আসতেই -বড়দার মেয়ে টিউলিপ দৌড়ে এসে পাকড়াও করলো তিস্তা কে --ও পিসিমণি কতদিন পরে
এলে গো --তোমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি --ওমা একদম ভিজে গেছো যে ! একরকম টানতে টানতেই
বাড়ি নিয়ে এলো ওকে --কি ছেলেমানুষ আছে এখনও টিউলিপ টা --কে বলবে ও মাস্টার্স করছে
! টিউলিপের হাত ধরে আসতে আসতেই কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগলো বাড়ির সামনে টা !
মেয়েটার তাড়নায় আর ভালো করে বোঝাই গেলো না ব্যাপারটা --তার ওপর এই বৃষ্টির
উত্পাত !
বড় বৌদি সেই আগের মতোই
আছে সহজ সরল হাসিখুশী ! কত আন্তরিক জড়িয়ে ধরলো তিস্তা কে ! ইস্ ভিজে গেছিস
যে এক্কেবারে নে নে আগে ফ্রেশ হয়ে নে শুকনো জামাকাপড় পর আমি আদা দিয়ে চা বসাচ্ছি
!
সন্ধ্যেবেলায় জমজমাট আসর ছোড়দা , ফুল দা , রাঙা দা সব্বাই উপস্থিত --এমনকি ছোটকার ছেলে পিকু সবার
আদরের ছোট ভাই সেও উপস্থিত -সপরিবারে ! ইস্ মনে হচ্ছে সেই আগের মতো !
এই জল ছপছপ সন্ধ্যেয় জমজমাট মুড়ি আর তেলেভাজার আসর বড় বৌদি তাড়া দিলো নাও সব চটপট খেয়ে নাও কুমু দির হাতের গরম গরম পাকোড়া . গলা চড়িয়ে বললো চায়ের
জলটা বসাও কুমু দি এরপর কিন্তু চায়ের অর্ডার যাবে ! হাসি ঠাট্টায় মশগুল
সবাই ! সবাই তো এসে গেছো দেখছি এবার তাহলে কথাটা বলেই ফেলি বড়দা আসল কথায় এলো দেখো তোমরা সবাই যে যার কাজের জায়গায় থাকছো প্রত্যেকেই নিজেদের ফ্ল্যাট গুছিয়ে
নিয়েছো , কিন্তু কথা হচ্ছে এই এত্তো বড় বাড়ি -বাড়ির আশেপাশের জমি সব মিলিয়ে তো
দশ /বারো কাঠা হবেই --এসব আমাকে একাই দেখভাল করতে হচ্ছে , ভেবেছিলাম ছেলেটা সাথ
দেবে -কিন্তু সেও তো এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় এদেশে আর ফিরবে বলে তো মনে হয়না .
আমারও বয়স বাড়ছে বাবা -কাকারাও সব একে একে গত হলেন --সব কিছু আগলে রাখা মুশকিল
হয়ে যাচ্ছে বুঝলে ! ঐ যে গো মিশ্র বাড়ির ছেলে -এখন এখানকার একজন বড় প্রোমোটার ,
নেতা -মন্ত্রীদের সঙ্গে এখন তার ওঠাবসা ! তা সেদিন সে বললে --চিনুদা
সব ভাইবোন তো আপনাকে ছেড়ে কেটে পড়লো --আপনিই এখন বাড়ি আগলে বসে আছেন --দিন না
আমাকে বাড়ি -জমি --ভালো দাম পাবেন -সঙ্গে একটা পুরো ইউনিট ও ! -----ভাবছি
প্রস্তাব টা মন্দ নয় --কি বল তোমরা ? এই তো দেখোনা ---দেবী পিসি -মিহির
কাকুদের বাড়িটাও তো ও -ই কিনে নিলো --ওখানেও একটা মস্ত বড় আবাসন উঠবে নাকি .
তিস্তা এবার বুঝলো বাড়ির সামনে টা অমন খাঁ খাঁ লাগছিলো কেন ! দেবী পিসি -মিহিরকাকু
দের বাড়িটাই উধাও ---কেমন যেন মন কেমন করে উঠলো --ও তখন খুব ছোট্ট --দেবী পিসির
বিয়ে হল --ঐ ওদের ছাদে প্যান্ডেল -খাওয়াদাওয়া --সব মনে আছে ! দেবী পিসি আর
নেই --তবু তো সমস্ত বাড়িটা জুড়ে ওদের স্মৃতিমাখা একটা গল্প ছিল --সেটাও নিশ্চিন্হ
হয়ে গেল ! এক বুক শূন্যতা অনুভব করলো তিস্তা !
বড়দার প্রস্তাবে ছোড়দা ,
রাঙা দা , ফুল দা , পিকু সব হ্যাঁ হ্যাঁ করে রাজী হয়ে গেল --তাই তো আমরা আসতেও
পারি না --এরপর টিউলিপের বিয়ে থা হয়ে গেলে তো তুমি আর বৌদি --আর কুমু দি যতদিন আছে
আর কি ! --বাকি রইলো তিস্তা --বড়দা ওর সম্মতি পাবার আশায় ব্যকুল হল !
তিস্তার চোখ ছলছল
করে উঠলো --এ বাড়ি ময় তার শৈশব -কৈশোর -সদ্য যৌবনের কত স্মৃতি ছড়ানো ! ঐ যে বসার
ঘরের কোণে শ্বেত পাথরের গোল টেবিল --আর তার ওপর বুদ্ধ মূর্তিটা --জন্মের পর থেকেই
দেখে আসছে --দাদাই মানে ঠাকুর্দার সংগ্রহ ! ঐ যে ভিতরের বারান্দায় বড় ডাইনিং
টেবিল টা --বাবা কিনেছিলো --সেই ওর কোন ছোট্ট বেলায় --বাড়ির এতগুলো সদস্য -বড়
টেবিল না হলে চলে ! ঠাম্মি খালি ওটার ছোয়াঁচ বাঁচিয়ে চলতো -আঁশ নিরামিষ এর
ব্যাপার তো আছেই ! আর দাদাই -ঠাম্মির বড় ঘর টা -মেহগনি কাঠের মস্ত পালঙ্ক
--ঠাম্মির পাশে শোবার জন্য ভাই বোনদের সে কি প্রতিযোগিতা --শেষে লটারী হতো --কে
শোবে ঠাম্মির পাশে ! আর ঐ ঘরের মস্ত কাঠের আলমারী টা -যেটায় এখনও বোধহয়
ঠাম্মির গায়ের গন্ধ মাখা শাড়িগুলো পাট পাট করে রাখা ! সেই লাল পাড় গরদের শাড়িখানা যেটায় ঠাম্মি কে মা দুগ্গার মতো লাগতো !
দক্ষিণের বারান্দাটা কে দেখেও ভীষণ মন কেমন করে উঠলো
তিস্তার সেই গরমকালের সন্ধ্যেগুলো ঐ বারান্দায় সব ভাইবোনদের দুলে দুলে
পড়া মুখস্থ করা ছোটকা মাঝে মাঝে এসে দেখে যেতো সত্যিই পড়াশোনা চলছে কি না !
পুকুরের ঠান্ডা হাওয়া এসে জুড়িয়ে দিতো গরমের ভ্যাপসানি ! দক্ষিণের বারান্দা
টা আরও একটা কারণে ভারী পছন্দের ছিলো তিস্তার --ঐ বারান্দার জাফরীর আড়াল দিয়েই
চলতো বৈদ্য বাড়ির মেয়ে মুকুলের সঙ্গে ওর পড়ার ফাঁকে আড্ডা ! আর দোতলার ঝুল
বারান্দা থেকে কতদূর দেখা যেতো স্টেশন বাজার -চৌমাথা মোড় -রেল কোয়াটার্স !
ঐ বারান্দায় দাঁড়ালে কখন সময় পার হয়ে যেতো !
আর একটা প্রিয় জায়গা এই বাড়িটার চিলেকোঠার ঘর ! মা -র জ্যেঠিমাদের সব বাতিল ট্রাঙ্ক ঐ ঘরে --মা-র ট্রাঙ্কে
তিস্তার কত জিনিস ঝিনি পিসির দেওয়া বিদেশী ডল , রান্নাবাটির হাতা -খুন্তি -কড়াই
; কতরকমের ডাক টিকিট , কতরকমের খাম গোলাপী , হলুদ , ফুল ফুল ছাপ ! স্কুলের হাতের
কাজের তৈরী রুমালের সেট -আর ও কত কি ! বড় হবার পরে ওগুলো মাঝে মধ্যেই নেড়েচেড়ে
দেখতো তিস্তা !
কেমন যেন আবেগশূন্য হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী টা ! এই একান্নের সংসারগুলো সব
ভেঙে খান খান হয়ে ছোট ছোট নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি তৈরী হচ্ছে ! সাবেকী বাড়িগুলো সব
নিশ্চিন্হ হয়ে যাচ্ছে --সে জায়গায় উঠছে মস্ত মস্ত বহুতল ! সেই বহুতল গুলোর একেকটি
ইউনিট যেন একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ! সেই দ্বীপগুলির বাসিন্দারা সবাই নিজেকে নিয়ে
ব্যস্ত কারো সময় নেই অন্যকে নিয়ে মাথা ঘামানোর !
আর সাবেকী বাড়িগুলোর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে
যাচ্ছে কতগুলো পরিচিত জায়গা চিলেকোঠার ঘর , দক্ষিণের বারান্দা , বার উঠোন ,
তুলসী মঞ্চ আর ও কত কি !
আনমনা তিস্তা কে সচকিত করে বড়দা বলে
উঠলো তা তুই কি বলছিস তিস্তা ? ভেবে বলতে পারিস -চাইলে অয়নের সঙ্গে ও এ ব্যাপারে
আলোচনা করে নিতে পারিস . না বড়দা আমি আর আলাদা কি বলবো আর অয়ন ই বা কেন এ
ব্যাপারে কথা বলবে বল ! তোমরা যা ভালো বোঝ তাই কর .না না তা বললে হয় তুই
হলি গিয়ে আমাদের একমাত্র বোন তোর একটা মতামত তো চাই !ঐ যে বললাম -তোমরা যা
বলবে !
পরদিন খুব সকাল সকাল তিস্তার মোবাইল
অনবরত ক্লিক ক্লিক করে গেলো বাড়ির সামনের বড় গেট সেনগুপ্ত ভিলা লেখা ফলক টা ,
দক্ষিণের বারান্দা , চিলেকোঠার ঘর , তুলসী মঞ্চ , শ্বেত পাথরের টেবিল -বুদ্ধ
মূর্তি , বাড়ির পিছনের বাগানে সেই কবেকার জামরুল গাছ টা সবাই ধরা থাকলো
ক্যামেরায় ---সুসভ্যতার তুমুল প্লাবনে যারা নিশ্চিত বিলুপ্তির পদধ্বনি শুনছে
!
No comments:
Post a Comment