Tuesday, July 24, 2018

সুসভ্যতার প্লাবন / শমিতা চক্রবর্তী



ট্রেন থেকে নামতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হল উঃ আবার বৃষ্টি -বিরক্ত হল তিস্তা ! শনি -রবি দুটো দিন স্কুল ছুটি আর সোমবার টা ছুটি নিতেই হল তবেই না আসতে পারলো -হালিশহরের বাড়িতে ! সত্যি আজ প্রায় দুবছর বাদে এখানে এলো ভাবা যায় ! সেই এসেছিলো জ্যেঠু মারা যাবার পর !  আজকাল মোটে সময় করে উঠতে পারে না ওর স্কুল , তাতানের স্কুল -অয়নের হসপিটাল সব মিলে ঝড়ের বেগে দিনগুলো কাটছে বাপের বাড়ি ঘুরতে আসা এখন বিলাসিতা --তাও যদি বাবা -মা থাকতো ! 
             এবার আসতেই হল বড়দার জরুরী তলব বাড়ি নিয়ে কিসব কথা বার্তা আছে ! বাপ -মায়ের একমাত্র সন্তান তিস্তার কাছে এই তুতো ভাইরাই তো সব ! বড় জ্যেঠুর ছেলেই ওদের সবার বড়দা --জ্ঞান হয়ে এস্তক সেটাই মেনে এসেছে ! 

                  বাড়ির কাছে রাস্তার মোড়টায় রিক্সাটা আসতেই -বড়দার মেয়ে টিউলিপ দৌড়ে এসে পাকড়াও করলো তিস্তা কে --ও পিসিমণি কতদিন পরে এলে গো --তোমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি --ওমা একদম ভিজে গেছো যে ! একরকম টানতে টানতেই বাড়ি নিয়ে এলো ওকে --কি ছেলেমানুষ আছে এখনও টিউলিপ টা --কে বলবে ও মাস্টার্স করছে ! টিউলিপের হাত ধরে আসতে আসতেই কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগলো বাড়ির সামনে টা !  মেয়েটার তাড়নায় আর ভালো করে বোঝাই গেলো না ব্যাপারটা --তার ওপর এই বৃষ্টির উত্পাত ! 
           
                      বড় বৌদি সেই আগের মতোই আছে সহজ সরল হাসিখুশী ! কত আন্তরিক জড়িয়ে ধরলো তিস্তা কে ! ইস্ ভিজে গেছিস যে এক্কেবারে নে নে আগে ফ্রেশ হয়ে নে শুকনো জামাকাপড় পর আমি আদা দিয়ে চা বসাচ্ছি ! 

                      সন্ধ্যেবেলায় জমজমাট আসর ছোড়দা , ফুল দা , রাঙা দা সব্বাই উপস্থিত --এমনকি ছোটকার ছেলে পিকু সবার আদরের ছোট ভাই সেও  উপস্থিত -সপরিবারে ! ইস্ মনে হচ্ছে সেই আগের মতো !  এই জল ছপছপ সন্ধ্যেয় জমজমাট মুড়ি আর তেলেভাজার আসর বড় বৌদি তাড়া দিলো নাও সব চটপট খেয়ে নাও কুমু দির হাতের গরম গরম পাকোড়া . গলা চড়িয়ে বললো চায়ের জলটা বসাও কুমু দি এরপর কিন্তু চায়ের অর্ডার যাবে !  হাসি ঠাট্টায় মশগুল সবাই ! সবাই তো এসে গেছো দেখছি এবার তাহলে কথাটা বলেই ফেলি বড়দা আসল কথায় এলো দেখো তোমরা সবাই যে যার কাজের জায়গায় থাকছো প্রত্যেকেই নিজেদের ফ্ল্যাট গুছিয়ে নিয়েছো , কিন্তু কথা হচ্ছে এই এত্তো বড় বাড়ি -বাড়ির আশেপাশের জমি সব মিলিয়ে তো দশ /বারো কাঠা হবেই --এসব আমাকে একাই দেখভাল করতে হচ্ছে , ভেবেছিলাম ছেলেটা সাথ দেবে -কিন্তু সেও তো এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় এদেশে আর ফিরবে বলে তো মনে হয়না . আমারও বয়স বাড়ছে বাবা -কাকারাও সব একে একে গত হলেন --সব কিছু আগলে রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে বুঝলে ! ঐ যে গো মিশ্র বাড়ির ছেলে -এখন এখানকার একজন বড় প্রোমোটার ,  নেতা -মন্ত্রীদের সঙ্গে এখন তার ওঠাবসা !  তা সেদিন সে বললে --চিনুদা সব ভাইবোন তো আপনাকে ছেড়ে কেটে পড়লো --আপনিই এখন বাড়ি আগলে বসে আছেন --দিন না আমাকে বাড়ি -জমি --ভালো দাম পাবেন -সঙ্গে একটা পুরো ইউনিট ও !  -----ভাবছি প্রস্তাব টা মন্দ নয় --কি বল তোমরা ?  এই তো দেখোনা ---দেবী পিসি -মিহির কাকুদের বাড়িটাও তো ও -ই কিনে  নিলো --ওখানেও একটা মস্ত বড় আবাসন উঠবে নাকি . তিস্তা এবার বুঝলো বাড়ির সামনে টা অমন খাঁ খাঁ লাগছিলো কেন ! দেবী পিসি -মিহিরকাকু দের বাড়িটাই উধাও ---কেমন যেন মন কেমন করে উঠলো --ও তখন খুব ছোট্ট --দেবী পিসির বিয়ে হল --ঐ ওদের ছাদে প্যান্ডেল -খাওয়াদাওয়া --সব মনে আছে !  দেবী পিসি আর নেই --তবু তো সমস্ত বাড়িটা জুড়ে ওদের স্মৃতিমাখা একটা গল্প ছিল --সেটাও নিশ্চিন্হ হয়ে গেল !  এক বুক শূন্যতা অনুভব করলো তিস্তা ! 

                     বড়দার প্রস্তাবে ছোড়দা , রাঙা দা , ফুল দা , পিকু সব হ্যাঁ হ্যাঁ করে রাজী হয়ে গেল --তাই তো আমরা আসতেও পারি না --এরপর টিউলিপের বিয়ে থা হয়ে গেলে তো তুমি আর বৌদি --আর কুমু দি যতদিন আছে আর কি ! --বাকি রইলো তিস্তা --বড়দা ওর সম্মতি পাবার আশায় ব্যকুল হল ! 

                       তিস্তার চোখ ছলছল করে উঠলো --এ বাড়ি ময় তার শৈশব -কৈশোর -সদ্য যৌবনের কত স্মৃতি ছড়ানো ! ঐ যে বসার ঘরের কোণে শ্বেত পাথরের গোল টেবিল --আর তার ওপর বুদ্ধ মূর্তিটা --জন্মের পর থেকেই দেখে আসছে --দাদাই মানে ঠাকুর্দার সংগ্রহ !  ঐ যে ভিতরের বারান্দায় বড় ডাইনিং টেবিল টা --বাবা কিনেছিলো --সেই ওর কোন ছোট্ট বেলায় --বাড়ির এতগুলো সদস্য -বড় টেবিল না হলে চলে !  ঠাম্মি খালি ওটার ছোয়াঁচ বাঁচিয়ে চলতো -আঁশ নিরামিষ এর ব্যাপার তো আছেই !  আর দাদাই -ঠাম্মির বড় ঘর টা -মেহগনি কাঠের মস্ত পালঙ্ক --ঠাম্মির পাশে শোবার জন্য ভাই বোনদের সে কি প্রতিযোগিতা --শেষে লটারী হতো --কে শোবে ঠাম্মির পাশে !  আর ঐ ঘরের মস্ত কাঠের আলমারী টা -যেটায় এখনও বোধহয় ঠাম্মির গায়ের গন্ধ মাখা শাড়িগুলো পাট পাট করে রাখা ! সেই লাল পাড় গরদের শাড়িখানা যেটায় ঠাম্মি কে মা দুগ্গার মতো লাগতো !  
              দক্ষিণের বারান্দাটা কে দেখেও ভীষণ মন কেমন করে উঠলো  তিস্তার সেই গরমকালের সন্ধ্যেগুলো ঐ বারান্দায় সব ভাইবোনদের দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করা ছোটকা মাঝে মাঝে এসে দেখে যেতো সত্যিই পড়াশোনা চলছে কি না ! পুকুরের ঠান্ডা হাওয়া এসে জুড়িয়ে দিতো গরমের ভ্যাপসানি !  দক্ষিণের বারান্দা টা আরও একটা কারণে ভারী পছন্দের ছিলো তিস্তার --ঐ বারান্দার জাফরীর আড়াল দিয়েই চলতো বৈদ্য বাড়ির মেয়ে মুকুলের সঙ্গে ওর পড়ার ফাঁকে আড্ডা ! আর দোতলার ঝুল বারান্দা থেকে কতদূর দেখা যেতো স্টেশন বাজার -চৌমাথা মোড় -রেল কোয়াটার্স !  ঐ বারান্দায় দাঁড়ালে কখন সময় পার হয়ে যেতো ! 
                   আর একটা প্রিয় জায়গা এই বাড়িটার চিলেকোঠার ঘর ! মা -র জ্যেঠিমাদের সব বাতিল ট্রাঙ্ক ঐ ঘরে --মা-র ট্রাঙ্কে তিস্তার কত জিনিস ঝিনি পিসির দেওয়া বিদেশী ডল , রান্নাবাটির হাতা -খুন্তি -কড়াই ; কতরকমের ডাক টিকিট , কতরকমের খাম গোলাপী , হলুদ , ফুল ফুল ছাপ ! স্কুলের হাতের কাজের তৈরী রুমালের সেট -আর ও কত কি ! বড় হবার পরে ওগুলো মাঝে মধ্যেই নেড়েচেড়ে দেখতো তিস্তা ! 

         কেমন যেন আবেগশূন্য হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী টা ! এই একান্নের সংসারগুলো সব ভেঙে খান খান হয়ে ছোট ছোট নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি তৈরী হচ্ছে ! সাবেকী বাড়িগুলো সব নিশ্চিন্হ হয়ে যাচ্ছে --সে জায়গায় উঠছে মস্ত মস্ত বহুতল ! সেই বহুতল গুলোর একেকটি ইউনিট যেন একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ! সেই দ্বীপগুলির বাসিন্দারা সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত কারো সময় নেই অন্যকে নিয়ে মাথা ঘামানোর ! 
                 আর সাবেকী বাড়িগুলোর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে কতগুলো পরিচিত জায়গা চিলেকোঠার ঘর , দক্ষিণের বারান্দা , বার উঠোন , তুলসী মঞ্চ আর ও কত কি ! 

                  আনমনা তিস্তা কে সচকিত করে বড়দা বলে উঠলো তা তুই কি বলছিস তিস্তা ? ভেবে বলতে পারিস -চাইলে অয়নের সঙ্গে ও এ ব্যাপারে আলোচনা করে নিতে পারিস . না বড়দা আমি আর আলাদা কি বলবো আর অয়ন ই বা কেন এ ব্যাপারে কথা বলবে বল ! তোমরা যা ভালো বোঝ তাই কর .না না তা বললে হয় তুই হলি গিয়ে আমাদের একমাত্র বোন তোর একটা মতামত তো চাই !ঐ যে বললাম -তোমরা যা বলবে ! 

                 পরদিন খুব সকাল সকাল তিস্তার মোবাইল অনবরত ক্লিক ক্লিক করে গেলো বাড়ির সামনের বড় গেট সেনগুপ্ত ভিলা লেখা ফলক টা , দক্ষিণের বারান্দা , চিলেকোঠার ঘর , তুলসী মঞ্চ , শ্বেত পাথরের টেবিল -বুদ্ধ মূর্তি , বাড়ির পিছনের বাগানে সেই কবেকার জামরুল গাছ টা সবাই ধরা থাকলো ক্যামেরায় ---সুসভ্যতার তুমুল প্লাবনে যারা নিশ্চিত বিলুপ্তির পদধ্বনি শুনছে ! 


No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া