Tuesday, July 24, 2018

ধারাবাহিক / স্বপ্নস্বরূপ – ২০ ন ন্দি নী সে ন গু প্ত




‘যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে
             রইব কত আর’... 
অনেক কিছু হারিয়ে যাচ্ছে এই পৃথিবীর বুকের উপর থেকে প্রতিমুহূর্তে। লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে কোনও না কোনও প্রাণী, উদ্ভিদ, কিংবা কোনও ভাষা, জনগোষ্ঠী। কখনো আবার মানুষেরই হঠকারিতায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সভ্যতা, শিল্প এবং প্রকৃতি। কালের নিয়মে একদিন এই পৃথিবীও ধ্বংস হয়ে যাবে। হয়তো বা মহাপ্রলয়ে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবার অনেক আগেই পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাবে বাংলা ভাষা। তখন আর রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করে আসন্ন অনাগত দিনের জন্য আশঙ্কা প্রকাশ করে এইকথাটুকুও বলতে পারব না...        
‘আর   পারি নে রাত জাগতে হে নাথ,
             ভাবতে অনিবার।...’

এখন যে মুহূর্তকে ঘিরে বসে রয়েছি, কিছুক্ষণের মধ্যে তা হারিয়ে গিয়ে অতীত হয়ে যাবে। এটাই কালের নিয়ম। হারিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক, সময়ের এগিয়ে চলার অন্যতম স্বাক্ষর। তবুও আমরা হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফিরে পেতে চাই। কিন্তু সত্যিই কি সব হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফিরে পেতে চাই? না, শুধুমাত্র প্রিয় জিনিস ফেরত পেতে চাই। অপ্রিয় জিনিস, অপ্রিয় মুহূর্ত যাকে পেছনে ফেলে এসেছি, তাকে আর ফিরে পেতে চাইনা। প্রিয়জন, যিনি হারিয়ে গিয়েছেন জীবন থেকে, ফিরে পেতে চাই তার সান্নিধ্য। রবীন্দ্রনাথের অজস্র গানে কবিতায় দেখতে পাই এই ধরনের ভাবের নিয়ত যাতায়াতস্মৃতিমেদুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে কবি বলে ওঠেন,  ‘আমার হারিয়ে-যাওয়া দিন / আর কি খুঁজে পাব তারে/ বাদল-দিনের  আকাশ-পারে/ ছায়ায় হল লীন...’
আবার কখনো কবির ভাষা হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের মনের কথা; যে কেউ হঠাৎ করে গেয়ে ওঠেন, ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না’...  
এগিয়ে চলা সময়ের নদীর সাথে একই ছন্দে বয়ে যাওয়া, স্বাভাবিক বিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলা   কি তবে মানুষ সাধারণভাবে অপছন্দ করে? নাকি একটা বড় অংশের মানুষ অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়? একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে বয়সে অপেক্ষাকৃত প্রবীণ মানুষজন সবসময় বেশি বিলাপ করেন হারিয়ে যাওয়া জিনিসের জন্য। অর্থাৎ যার জীবনে স্মৃতির ভার যত বেশি, তিনি তত বেশি আচ্ছন্ন হতে থাকেন হারিয়ে যাওয়া জিনিসের প্রতি আকর্ষণে। সেইজন্যই প্রবীণতা জরাজীর্ণ অথচ নবীনতা চিরসবুজ। আশিবছরের জীবনে স্মৃতির ভালোমন্দ অজস্র বিচিত্র ভার নিয়েও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক সবুজ গাছের মত চিরনবীন। সময়ের থেকে অনেকখানি এগিয়ে থাকা মানুষটি হারিয়ে যাওয়া কোনও জিনিসের জন্য পা ছড়িয়ে বিলাপ করবার পক্ষপাতী ছিলেন না। আধুনিকতার পক্ষে সওয়াল করে গিয়েছেন আজীবন। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে যে সাহিত্যে আধুনিকতার ধারাকে দুহাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, বলেছেন... ‘আজ পর্যন্ত আমাদের সাহিত্যে যদি কবিকঙ্কণ চণ্ডী, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, মনসার ভাসানের পুনরাবৃত্তি নিয়ত চলতে থাকত তা হলে কী হত? পনেরো আনা লোক সাহিত্য পড়া ছেড়েই দিত। বাংলার সকল গল্পই যদি বাসবদত্তা কাদম্বরীর ছাঁচে ঢালা হত তা হলে জাতে ঠেলার ভয় দেখিয়ে সে গল্প পড়াতে হত। কবিকঙ্কণ চণ্ডী, কাদম্বরীর আমি নিন্দা করছিনে। সাহিত্যের শোভাযাত্রার মধ্যে চিরকালই তাদের একটা স্থান আছে কিন্তু যাত্রাপথের সমস্তটা জুড়ে তারাই যদি আড্ডা করে বসে, তা হলে সে  পথটাই মাটি, আর তাদের আসরে কেবল তাকিয়া পড়ে থাকবে, মানুষ থাকবে না।’... এই যে মানুষের কথা ভাবা এবং ভেবে অনড় জগদ্দল পুরানো অবস্থান থেকে সরে আসা, এর থেকে বড় আধুনিকতা আর কিছু হতে পারেনা।
   হারিয়ে যাওয়ার চিন্তা কবির ভাবনায় নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। পেয়েছে এক অদ্ভুত মহিমা। কোনও জাগতিক বস্তু, প্রিয়মানুষ কিংবা হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির জন্য বিলাসিতা নয়। নিজেকে হারিয়ে ফেলে আবার নতুন করে খুঁজে পাওয়ার খেলা। ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’... সুরে সুরে যেন এক মন্ত্রের মত দোলা লাগে। হারিয়ে ফেলা দিনের স্মৃতি কিংবা অতীত আগলে রাখার ইচ্ছে সচেতনভাবেই কি কবি বর্জন করেছিলেন, নাকি তা ছিল একেবারেই স্বভাবসিদ্ধ? কখনো তিনি ঘোষণা করেন,... ‘বিধাতা আমাকে মস্ত একটি বর দিয়েছেন, সে হচ্ছে আমার অসামান্য বিস্মরণশক্তি। সংবাদের ভাণ্ডারঘরের জিম্মে তিনি আমার হাতে দেন নি। প্রহরীর কাজ আমার নয়; আমাকে আমার মনিব প্রহরে প্রহরে ভুলে যাবার অধিকার দিয়েছেন।... আমার মনটাকে বিধাতা নাট্যশালা করতে ইচ্ছা করেছেন, তাকে তিনি জাদুঘর বানাতে চান না।’ এক অদ্ভুত বিশ্বাস কাজ করে হয়তো বা, যখন কবি বলে ওঠেন, ‘হারিয়ে যেতে হবে আমায়, ফিরিয়ে পাব তবে।’ এই জায়গায় এসে মনে হয়, তাহলে কি জগতে কিচ্ছুটি হারায় না কোনওদিন?
হ্যাঁ, জগতের পরম নিত্যতার বৈজ্ঞানিক সূত্র কবির ভাষায় প্রকাশ পায়... ‘ফুরায় যা, তা ফুরায় শুধু চোখে/ অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে...’ । আলোকের আধার যিনি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরম আলোকময়ের কাছে বেজে ওঠে কবির প্রার্থনা...  ‘তোমাতে রয়েছে কত শশী ভানু,   হারায় না কভু অণু পরমাণু,/ আমারই ক্ষুদ্র হারাধনগুলি রবে না কি তব পায়...’।        
    

No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া