তিনি কবি। তিনি শুধু সত্যদ্রষ্টা নন,
সুন্দরের দ্রষ্টা এবং স্রষ্টা। যিনি সুন্দরকে দেখতে পান, উপলব্ধি করতে পারেন,
তিনিই তাকে সৃষ্টি করতে পারেন। চতুর্দিকে প্রবল অসুন্দরের মধ্যেও সুন্দরকে ঠিক
খুঁজে পায় তার চোখ। এ যেন এক আধ্যাত্মিক সাধনা, ঠিক যেন পরমহংসের মতো জলের মধ্য
থেকে দুধটুকু বেছে নেওয়া। প্রশ্ন উঠতে পারে, অসুন্দর কেন বলছি? হ্যাঁ, বলছি। একথা
পরিষ্কার যে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার জটিলতার মধ্যে সুন্দর সবসময় থাকেনা। তাছাড়া
কবি বেঁচেছিলেন ভারতবর্ষের এক অদ্ভুত সমস্যাসঙ্কুল সময়ে। পরাধীন ভারতবর্ষের নানা
সমস্যা খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। সামাজিক বিবর্তন এবং ভারতবর্ষের রেনেসাঁর অন্যতম
পথিকৃৎ ছিলেন তিনি নিজেই। ফলে, তার জীবনের চলার পথ একেবারেই মসৃণ, কুসুমাস্তীর্ণ
ছিল, একথা ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। অজস্র অসুন্দর সমস্যার মধ্য দিয়ে চলতে
হয়েছিল তাকে, লড়াই করতে হয়েছিল নানা বাধাবিঘ্নের কাঁটার সঙ্গে, তবেই তিনি ফোটাতে
পেরেছিলেন ফুল।
তার লেখার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সময়ে ফুটে ওঠে এই সুন্দর এবং অসুন্দর নিয়ে লড়াই।
কবির দৃষ্টিভঙ্গির বিশেষ পরিবর্তন দেখতে পাই, যখন তিনি আধুনিক সাহিত্য নিয়ে আলোচনা
করতে গিয়ে বলেন,
‘কেউ সুন্দর,
কেউ অসুন্দর; কেউ কাজের, কেউ অকাজের; কিন্তু সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনো
ছুতোয় কাউকে বাতিল করে দেওয়া অসম্ভব। সাহিত্যে, চিত্রকলাতেও
সেইরকম। কোনো রূপের সৃষ্টি যদি হয়ে থাকে তো আর-কোনো জবাবদিহি নেই; যদি না হয়ে থাকে, যদি তার সত্তার জোর না থাকে,
শুধু থাকে ভাবলালিত্য, তা হলে সেটা
বর্জনীয়।' ঠিক এই জায়গায় এসে
ভাবতে বসি। ‘সত্তার জোর’ শব্দটা নিয়ে নাড়াচাড়া করি। সত্তার সাথে কি আন্তরিক সততার
কোনও সম্পর্ক থাকে? হ্যাঁ, এই আন্তরিক সততা ছাড়া সত্তার জোর আর কীভাবে থাকা সম্ভব?
অনেকটা পথ হেঁটে এসে, নিছক ভাবলালিত্য আর তার বিশেষ কোনও মনোযোগের জায়গা কেড়ে নিতে
পারেনা, তাকে বর্জন করতেই চান। এখানে এসে সুন্দর, অসুন্দরের সংজ্ঞা গুলিয়ে যেতে
পারে যে কারো।
আসলে তিনি যে ডুব দিয়েছিলেন রূপসাগরে। কিন্তু সে তো বাইরের। অন্তরের যিনি
‘অরূপ’ তাকে যে সুন্দর- অসুন্দরের দাঁড়িপাল্লায় মাপা যায় না, এই কথাই হয়ত তিনি মনে
করিয়ে দিলেন নিছক ভাবলালিত্য বর্জন করতে বলে।
অদ্ভুতভাবে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে কবি ক্ষুধার প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তার
ভাষায়, ‘ফল যে কেবল
আমাদের পেট ভরায় তাহা নহে, তাহা স্বাদে গন্ধে দৃশ্যে সুন্দর। কিছুমাত্র সুন্দর যদি নাও হইত তবু
আমরা তাহাকে পেটের দায়েই খাইতাম। আমাদের এতবড়ো একটা গরজ থাকা সত্ত্বেও, কেবল পেট ভরাইবার দিক হইতে নয়, সৌন্দর্যভোগের
দিক হইতেও সে আমাদিগকে আনন্দ দিতেছে। এটা আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত লাভ।’ তিনি কবি, তাই তিনি মনে
করিয়ে দেন যাপনের সৌন্দর্য, ‘আজ
ক্ষুধা লাগিলেও আমরা পশুর মতো, রাক্ষসের মতো, যেমন-তেমন করিয়া খাইতে বসিতে
পারি না; শোভনতাটুকু রক্ষা না করিলে আমাদের খাইবার
প্রবৃত্তিই চলিয়া যায়। অতএব যখন আমাদের খাইবার প্রবৃত্তিই একমাত্র নহে, শোভনতা তাহাকে নরম করিয়া আনিয়াছে।’
আবার কখনো তিনি বলেছেন যা মঙ্গলজনক, যা
হিতকর, তাই সুন্দর। এখানেও সেই প্রয়োজনের প্রসঙ্গ আসে; ক্ষুদ্রস্বার্থ বাদ দিয়ে
বৃহত্তর জগতের কল্যাণের প্রসঙ্গ আসে। সেখানে যা সত্য, তাই সুন্দর হয়ে ওঠে। কিন্তু
সত্যকে উপলব্ধি করা? হ্যাঁ, সে আবার ভিন্ন সাধনার কথা। ‘সত্যকে যখন শুধু আমরা চোখে দেখি, বুদ্ধিতে পাই তখন নয়, কিন্তু যখন তাহাকে হৃদয় দিয়া পাই তখনই তাহাকে সাহিত্যে প্রকাশ করিতে
পারি।' হ্যাঁ, এখানে এসেই বুঝতে
পারি যে সাহিত্যে সৌন্দর্যসৃষ্টির ক্ষেত্রেও কবি যে ‘সত্তার জোর’ এর কথা বলেছিলেন,
সেই জোর হৃদয়ের সত্য ছাড়া আর কোনও কিছু দ্বারা উপলব্ধি করা অসম্ভব।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment