প্রথম দিনের যাত্রা
ঘটনার
স্রোত নিয়ে জীবনের নদী। সব ঘটনাই অতীত হয় কিন্তু সব অতীত ইতিহাস হয় না। তাই সব
অতীত নিয়ে মানুষ মাথা ঘামায় না। সেই অতীত নিয়ে মানুষ মাথা ঘামায় যাতে থাকে ঘটনার
ঘনঘটা। যে অতীত তার সু কাজ কিংবা কু কাজের জন্যে একটা দাগ রেখে যায় জীবন বা সমাজের
বুকে। ঘটনার স্রোত যখন এক জায়গায় পাক খেতে খেতে একটা গভীর দহ তৈরি করে-- সেই অতীত
স্থান পায় ইতিহাসে।
ইতিহাস
রেখে যায় তার স্মৃতিচিহ্ন—সুখের কিংবা দুঃখের। হয়ত সুখের কম দুঃখের বেশি।
কিন্তু দাগ না রাখলে সেটা ইতিহাসে স্থানই পাবে না। ইতিহাস মানুষকে শিক্ষা
দেয়। অতীত দিশা দেয় ভবিষ্যতে চলার সঠিক পথের। তার থাকে নানা নিদর্শন। যারা
ইতিহাসের ছাত্র বা ছাত্রী তারা ইতিহাস পড়ে সমাজকে সতর্ক করার জন্যে। অতীতের কাছ
থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতকে পথ দেখাবার জন্যে। কিন্তু যারা সাধারণ মানুষ তারা
ইতিহাস পড়ে কৌতূহলী হয়ে। এই কৌতূহলের খোরাক তার মনে এক অর্থে বিনোদন জোগায়।
আমি
সাধারণ মানুষ। তাই আমার ইতিহাস দর্শন নিতান্ত কৌতূহল নিবারণের উদ্দেশ্যে। ভারতে
ঐতিহাসিক স্থানের অন্ত নেই। আমাদের এখানে রয়েছে মুর্শিদাবাদ। এক কালে
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী। এখানে জীবন এগিয়েছে, সমাজ এগিয়েছে অনেক। কিন্তু
ইতিহাসকে মানুষ বিশেষ ঘাঁটায় নি। তাকে একপাশে তার মত করে থাকতে দিয়ে নিজের গতিপথ
ঠিক করে নিয়েছে। আর তাই হাজারদুয়ারী, কাটরা মসজিদ, ইমামবাড়া, খোসবাগ, জাফরাগঞ্জ,
পলাশীর আমবাগান, মোতিঝিল, কাশিমবাজার, জাহানকোষা কামান, কীরিটেশ্বরী মন্দির, ডাচ
সমাধি ক্ষেত্র, নসীপুরের আখড়া, জগৎ শেঠের বাড়ি, কাঠগোলা প্রভৃতি অজস্র দর্শনীয়
স্থান আজও ভবিষ্যৎ দর্শকদের জন্যে নিজেদের মত করে ঘুমিয়ে আছে।
গত
২৩শে জানুয়ারী শিয়ালদহ থেকে দুপুর বারটা পঞ্চাশ মিনিটে আমাদের লালগোলা প্যাসেঞ্জার
ছাড়ল এস ওয়ান রিজার্ভেশন কম্পার্টমেন্টে আমাদের নিয়ে। বিকেল পাঁচটার কাছাকাছি আমরা
এসে পৌঁছলাম বহরমপুর কোর্ট স্টেশনে। আর ছটার মধ্যেই স্টেশন চত্বরে চা টা খেয়ে ছবি
টবি তুলে পৌঁছে গেছি সেখানকার টুরিষ্ট লজে। এর মধ্যে ঘটনার কোনও ঘনঘটা নেই। নেই
এমন কিছু বৈচিত্র যা মনে রাখার মত বা মনে রাখানোর মত।
সেদিন
তো সন্ধ্যে হয়ে গেছে। ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে আগামী কালের সাইট সিইং এর জন্যে
গাড়ি ঠিক করে নেওয়া গেল। আগামী দুদিনের ট্যুর। আপাতত চা খেয়ে হোটেলের বাইরে বেরোন
গেল। ঠান্ডা খুব বেশিও নয় আবার খুব কমও নয়। ফুলহাতা সোয়েটার বা জ্যাকেট আর টুপির
আড়ালে রাখলে শরীর বেশ আনন্দই পাচ্ছিল। আমরা হাঁটছিলাম। সমস্ত বড় বড় সরকারি
অফিসগুলো এখানে। কারণ এটা মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহর। গান্ধী মোড়ে বিরাট বড়
পার্ক। তার পাশ দিয়ে ডানদিকে একটু দূরেই ভীড় দেখে থমকে গেছি। পরে শুনি সেটা
বহরমপুর টেক্সটটাইল কলেজ আর সেখানে সরস্বতী পুজো আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিশাল
আয়োজন। থিম বেশ ভাল লাগল। বিশাল লাইন ভেঙ্গে ঠাকুর দেখে আবার ফেরত আসতে কম বেশি
ঘন্টাখানেক লেগে গেল। তারপর একটা বেশ বড় মিষ্টির দোকানে মালপোয়া, লবঙ্গ লতিকা আর
অন্য মিষ্টি খেয়ে খিদে মেটানো গেল। এতবড় আকারের লবঙ্গ লতিকা আর মালপোয়া আমি আগে
কখনও খাই নি। ইতিহাস দর্শনের আগেই এই মিষ্টিতে বর্তমানে মুখ আর মন দুইই বেশ ভরে
গেল। এখানে দোকান টোকান বিশেষ ভাবে খাবারের দোকানগুলো বেশ বড় আর সুন্দর। পরিস্কার
পরিচ্ছন্ন তো বটেই। দেখে মন বেশ প্রসন্ন হবার কথা।
ওয়েস্ট
বেঙ্গল টুরিজমের এই লজটি দারুণ সাজানো গোছানো। খাবারও এখানে বেশ ভাল। বেরোনর আগে
আমরা ডিনারের অর্ডার দিয়ে গিয়েছিলাম। আজকের রাতের জন্যে ভাত ডাল সবজি আর চিকেন
যথেষ্ট ছিল। খেয়ে নিয়ে রুমে বসে টিভি দেখে নেওয়া গেল। আমি অবশ্য লোকের সঙ্গে কথা
বলতে ভালবাসি। মোবাইলে ইন্টারনেট ডাটা ভরা ছিল। তাছাড়াও রুমে ওয়াই ফাই চালু ছিল।
তাই ফেসবুক আগে বন্ধ করে চলে গেলেও মেসেঞ্জার হোয়াটস আপে আলাপ আর কথা বলতে কোনও
অসুবিধেই হচ্ছিল না। সেই বন্ধ ঘরে শুধুমাত্র আমার বন্ধু উপস্থিত থাকলেও আরও বহু
বন্ধুর কল্পিত উপস্থিতি (digital presence) টের পাচ্ছিলাম। রাত এগারটার মধ্যেই
শুয়ে পড়া গেল। কাল নটার মধ্যেই বেরোতে হবে।
দ্বিতীয় দিনের যাত্রা
পরের
দিন আমাদের ভ্রমণের আসল পর্ব হল শুরু। সাড়ে নটার সময় আমাদের জন্যে গাড়ি এল।
ব্রেকফাস্টে গরম ফুলকো লুচি, তরকারি আর সুস্বাদু দার্জিলিং চা খেয়ে আমরা যাত্রা
শুরু করলাম। গাড়ি নাতিবৃহৎ এক যাত্রা সেরে প্রথম দাঁড়াল মুর্শিদাবাদের জাহানকোষা
কামান দেখাতে। এটি আমাদের প্রথম দর্শনীয় বস্তু।
মুর্শিদাবাদে
নবাবের তোপখানায় মিলল এই চরম বিস্ময়ের দর্শন। কাটরা মসজিদে যাওয়ার পথে পড়ে এটি।
কাটরা মসজিদ থেকে এর দূরত্ব মাত্র সিকি মাইল। জাহানকোষা কামান ১৬৩৭ সালে দিল্লীতে
মুঘল সম্রাট শাহ জাহানের আমলে জনার্দন কর্মকার নামে এক বাঙ্গালি কারিগরের হাতে গড়া
প্রায় সাড়ে সতের ফুট দীর্ঘ আর তিনফুট ব্যাস বিশিষ্ট এক কামান। এর বিশাল আকার আর বিরাট
আর ক্ষমতার জন্যে একে ‘বৃহৎ কামান’ বা ‘গ্রেট গান’, ‘ডেস্ট্রয়ার অফ দি ওয়ার্ল্ড’,
‘কনকারার অফ দি ইউনিভার্স’, ‘ওয়ার্ল্ড সাবডুয়ার’ ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়।
প্রতিবার কামান দাগার জন্যে সতের কিলোগ্রাম বারুদের প্রয়োজন হত। এই কামানটি সতিই
দর্শনীয়। ভাল লাগবে বিশাল এই কামানের সামনে দাঁড়িয়ে একা, দোকা কিংবা সপরিবার বা
সবান্ধব ছবি তুলতে।
আমাদের
দ্বিতীয় দর্শনীয় স্থান হল মুর্শিদাবাদ শহরের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত কাটরা মসজিদ।
১৭২৩ থেকে ১৭২৪ সালের মধ্যে মুর্শিদকুলি খানের নির্মিত বিশাল এই মসজিদ স্থাপত্যের এক
চমৎকার নিদর্শন। এটি সম্পূর্ণ ইঁটের তৈরি আর খিলেনের ওপর ধারণ করা। আজকের দিনে
খিলেনের কাজের কথা অনেকেই হয়ত জানেন না। কারণ আজ কংক্রিটের যুগ। কিন্তু প্রায় তিনশ
বছর আগে সিমেন্ট ছিল স্বপ্ন। তখন ইটের পরে ইট গাঁথার জন্যে মাঝে মশলা হিসেবে
ব্যবহার করা হত সুরকি যা ইঁটকে মিহি করে গুঁড়ো করেই পাওয়া যেত। খিলেন হল ইঁটের
সঙ্গে ইঁট বিশেষ কায়দায় সাজিয়ে কড়ি বরগা ছাড়াই ছাদ তৈরি করা। এই খিলেন যে কত
শক্তিশালী হতে পারে মসজিদটিই তাঁর নিদর্শন। সেই খিলেন দিয়ে তৈরি বিশাল এই মসজিদ
সত্যিই এক চমকপ্রদ জিনিস।
এটি
শুধু মসজিদ বা নমাজের স্থান ছিল না ছিল একটি মাদ্রাসা বা শিক্ষাকেন্দ্রও। সম্পূর্ণ
চারকোণা এই মসজিদের চারকোণে চারটি ৭০ ফুট উঁচু আর ২৫ ফুট ব্যস যুক্ত অষ্টভুজাকৃতি
মিনার ছিল। দুঃখের বিষয় এর মাত্র দুটি এখন অবশিষ্ট আছে আর যেগুলির সংস্কার চলছে।
বিশাল
এই মসজিদ দুই তলা বিশিষ্ট ছিল। নিচের আর ওপরের তলা মিলিয়ে ৭০০ ছাত্রদের থাকার
জন্যে ঘর, রান্নার জন্যে রান্নাঘর ইত্যাদি ছিল। এই ঘরগুলি ইটের খিলেন করা এবং
প্রত্যেকটি ২০ ফুট বর্গ মাপের।
এই
কক্ষগুলির পরে একটি রাস্তা মাঝের মসজিদকে ঘিরে আছে। মসজিদের উপরের তলায় মাঝে বিরাট
চত্বর তাতে প্রায় ২০০০ ব্যক্তির নমাজ পাঠ করার জন্য ২০০০টি চৌকো খাঁজ কাটা আসন
তৈরি করা ছিল। এই আসনগুলি মেঝের সংগে সংশ্লিষ্ট ছিল। এই আসনগুলিও দেখার মত। চারটি
মিনারের ওপর চারটি গম্বুজ ছাড়াও মসজিদের মাঝে একটি বড় গম্বুজ ছিল যা ১৮৯৭ সালের
ভূমিকম্পে অবলুপ্ত হয়ে যায়।
কেন্দ্রীয়
মসজিদটির মূল ওঠার সিঁড়ির নিচে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁকে কবরস্থ করা হয়েছে তাঁরই
পূর্ব নির্ধারিত আর নির্দেশিত ইচ্ছার নিরিখে। জীবনের শেষ দিকে নিজের কৃত অনেক
খারাপ কাজের জন্যে অনুতপ্ত নবাবের ইচ্ছা ছিল তাঁকে কবরস্থ করা সেখানেই হবে যেখানে
তাঁর ওপর দিয়ে চলে যাবে অসংখ্য মানুষের পদতল। পর্যটকরা যে সিঁড়ি দিয়ে মসজিদে উঠবেন
চোদ্দ ধাপের সেই সিঁড়ির নিচেই সমাধিস্থ রয়েছেন নবাব মুর্শিদকুলি তাঁর নিজেরই
ইচ্ছায়। বিশাল এই মসজিদ আর তার চত্বর ঘুরে দেখার মত।
কাটরা
মসজিদ থেকে বেরিয়ে রেল লাইন পেরিয়ে ঠিক ক্রশিং –এর পারেই গেলাম একটি অসম্পূর্ণ
মসজিদে। মুর্শিদকুলি খাঁর দৌহিত্র সরফরাজ খাঁ শেষ জীবনে কাটরা মসজিদের আদলে একটি
মসজিদ বানানোর পরিকল্পনা করেন। কিন্তু কাটরা মসজিদের থেকে আকারে অনেক ছোট লম্বায়
প্রায় ১৩৫ ফুট আর উচ্চতায় ৪০ ফুট এই মসজিদ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মসজিদের তিনটি
গম্বুজের দুইটি সম্পূর্ণ হলেও মাঝের প্রধান গম্বুজটি সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি
যুদ্ধক্ষেত্রে আলীবর্দী খাঁর হাতে পরাজিত আর নিহত হন। এইভাবে নবাব বিধ্বংস বা ফৌত
হয়ে যাওয়ার কারণে এটিকে ফৌতি মসজিদ বা ফুটি মসজিদ নামে অভিহিত করা হয়। সরফরাজ খাঁর
পরে আর কোনও নবাবই এই মসজিদ সম্পূর্ণ করেন নি। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এর অন্য দুটি
গম্বুজও ভেঙ্গে পড়ে। মাথায় ফুটো থেকে যাওয়ায় অবশ্য স্থানীয়ভাবে একে ফুটো মসজিদও
বলা হয়। মসজিদের সামনের সিঁড়িটি একেবারেই ভাঙ্গা তাই পর্যটকদের বেশ অসুবিধে হবে।
আমাদের
পরবর্তী গন্তব্য কাঠগোলা বাগান ও তৎসংলগ্ন জৈন মন্দির। কাঠগোলা বাগানের বিশাল
চত্বরের মধ্যে তিনটি জিনিস। একেবারে গোড়াতেই রয়েছে ডানদিকে চিঁড়িয়াখানা আর বা দিকে
একটি গুপ্ত সুড়ঙ্গ পথ যা চলে গেছে একেবারে ভাগীরথী পর্যন্ত। মনে রাখতে হবে আমাদের
এখানের হুগলী নদীই কিন্তু মুর্শিদাবাদে ভাগীরথী নামে পরিচিত।
এরপর
আবার একটি গেট। সেখানে প্রশস্ত বাগান। অন্যান্য বহু ফুলের মধ্যেও গোলাপেরই
প্রাধান্য। বাগানে ঘোড় সওয়ারের স্ট্যাচু। এই বাগান ছিল নাকি চার ভাইয়ের যাদের
সঙ্গে স্বয়ং জগৎ শেঠের খুব দহরম মহরম ছিল। কারোর কারোর মতে এরা ছিলেন রত্ন পাথরের
ব্যাবসায়ী। আবার কেউ কেউ বলেন এরা ছিলেন কাঠের ব্যবসায়ী আর তাই থেকেই এর নাম হয়েছে
কাঠগোলা বাগান। কেউ কেউ বলে এখানে নাকি কাঠগোলাপ পাওয়া যেত। যে যাই বলুক এই বাগান
সত্যিই মনোরম। মুর্শিদাবাতে এক নাগাড়ে নিদ্রিত, মৃত বা অর্ধমৃত ঐতিহাসিক নিদর্শন
দেখতে দেখতে ক্লান্ত তাঁদের কাছে এই বাগান সত্য্যি এক নয়নসুখ।
শুধু
চিঁড়িয়াখানা বা বাগানই নয়। বিরাট এই জায়গায় রয়েছে আরও অনেক কিছু। ভাগীরথী পর্যন্ত
গুপ্ত সুড়ঙ্গর কথা তো বলেইছি। তা ছাড়াও আছে আরও তিনটি জিনিস। একটি হল সুরম্য আর
সুপ্রশস্ত এক ঝিল যার মধ্যে মাছ কিলবিল করে খেলে বেড়াচ্ছে আর উল্টোদিকে রয়েছে বাঁধানো
ঘাট। শুধু মাছের খেলাই নয়, জলে সারি সারি হাঁসের চরে বেড়ানোও কম উপভোগ্য নয়।
এই সরোবরের ঠিক পাশেই
বিরাট সুদৃশ্য মিউজিয়াম। দুইটি তলা বিশিষ্ট এই মিউজিয়ামে অতীতের বহু নিদর্শন,
অস্ত্রশস্ত্র, ব্যবহার্য বাসনপত্র ও অন্যান্য জিনিস, মূল্যবান পোশাক ইত্যাদি দেখে
তাক লেগে যাবার মত।
একটু
দূরে চলেছি এবার। সুন্দর ফুলের বাগান ঘেরা সম্পূর্ণ শ্বেত পাথরের জৈন মন্দির। এর
এক পাশে একটি ছোট জলাশয়ে আবার বোটিংও হয়। সব মিলিয়ে কাঠগোলা বাগান আর চিড়িয়াখানা
ঘুরতে ঘন্টা দুয়েক সময় তো লাগবেই। পর্যটকদের উচিত হাতে বেশ একটু সময় নিয়ে
বাগানটিকে দেখা।
[ক্রমশ]
No comments:
Post a Comment