Thursday, May 24, 2018

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া


সম্পাদকীয় -/ গৌতম সেন





বৈশাখ বিদায় নিল। ঋতুচক্রের প্রথম ঋতু গ্রীষ্মকালে আগমন ঘটল আরো একটি মাসের - জ্যৈষ্ঠ মাস। হয়ত প্রকৃতির সামান্য দাক্ষিণ্যে এবছর বৈশাখের দাবদাহ ততটা তার প্রখরতর দাপট ছড়াতে পারেনি - মাঝে মাঝেই ইতস্তত ঝড় জলের উপস্থিতি কিছুটা হলেও দহনের মাঝে এনেছে স্বস্তি। এরই ফাঁকে আমরা পেলাম বিশ্বকবির জন্মতিথি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন পালনের উৎসবে বঙ্গবাসী প্রতি বছরের মত এবারও মাতিয়ে রাখল প্রায় একপক্ষকাল বা তার কিঞ্চিতধিক সময়, তাঁরই রচিত কবিতা, গান, নাটকের নানাবিধ আনন্দানুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে।



আমাদের চিলেকোঠার সদস্য-সদস্যারাও এর ব্যতিক্রম নয়। গত ১৩ই মে, রবিবার, নাকতলার 'উত্তরণ' ক্লাবে পালিত হল কবির জন্মোৎসব - 'রবি পুজো’। এক সুন্দর ছিমছাম মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে চিলেকোঠার সদস্য সদস্যাবৃন্দ পরিবেশন করলেন সঙ্গীত, নৃত্য ও শ্রুতিনাটক। এছাড়া উত্তরণের তরফে তাঁদের ছাত্রছাত্রীরা এবং শিক্ষিকাগণ এক অতি মনোরম অনুষ্ঠান উপহার দিলেন। সব মিলিয়ে সেদিনের ‘রবি পুজো’ সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে উঠেছিল সকলে স্বতঃস্ফুর্ত যোগদানে।



পাকা আম, কাঁঠাল, লিচুর গন্ধে এখন বাতাস মদির, এমনই একটা সময়ে আনন্দের সাথে বলি প্রতিমাসের মত ঠিক সময়ে আবার প্রকাশ পেল চিলেকোঠার ই-ম্যাগ – আরো আনন্দের কথা এই যে এই সংখ্যায় প্রতিবারের মতই চিলেকোঠার সদস্য-সদস্যা এগিয়ে এসেছেন তাঁদের স্বীয় রচনার অনবদ্য সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে। কবিতা, গল্প, অনুগল্প ও নিবন্ধে সাজানো এবারের সংখ্যাও সকলের মন কেড়ে নেবে সহজেই এই আশা নিয়েই আজ তুলে দিলাম আপনাদের কাছে এই ই-ম্যাগ। গ্রীষ্ণের দহনবেলার মাঝেও ভাল থাকুন সবাই।

একটি প্রতিবেদন / আহুতি ভট্টাচার্য





"জীবন যেন দিই আহুতি মুক্তি আশে"....রবিঠাকুর বলে গেছেন।আমরা পারি কতটুকু?তবু সেই আমার মুক্তি আলোয় আলোয় কে জীবনের মূল মন্ত্র করে নিয়ে খোঁজ নিরন্তর।

প্রাণের ঠাকুর এর জন্মদিন কে একটু অন্যভাবে পালন করতে পারলে আলোর খোঁজ মিলবে এই আশায় বুক বেঁধে চিলেকোঠা পরিবার গত তেরই মে পৌঁছে যায় নাকতলা উত্তরণে।ওই এলাকার কয়েকজন আলোমাখা মানুষ হাত ধরে আছেন একটু পিছিয়ে পড়া কিছু বাচ্চার। ওদের মাঝে রবিআলো ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন তাঁরা প্রকৃত অর্থেই। প্রকৃতির চোখ রাঙানিকে তোয়াক্কা না করে চিলেকোঠা পৌঁছে যায় উত্তরণে। কচিমুখ গুলির সেকি আনন্দ ! তারা দামোদর শেঠ থেকে পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে সব শিখে নিয়েছে যে!

উদ্বোধনী সংগীত উত্তরণের দিদিমনিরা শুরু করতেই বোঝা গেল তাঁরা সত্যি রবি আলোকিত। এর ই মাঝে আতিথেয়তা,অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। আমরাও সবাই মিলে সাধ্যমত আয়োজন করলাম জলযোগের।একসাথে সবাই খেলাম,তার সাথেই চলতে লাগল চিলেকোঠা র 'রবিপুজো '।বলতে দ্বিধা নেই আমাদের আরেকটু প্রস্তুতি দরকার ছিল। চিলেকোঠা বাচ্চাদের হাতে তুলে দিয়েছে ওদের প্রয়োজনীয় স্কুল ব্যাগ। কি দিতে পেরেছি সেটা বড় কথা নয় , সেদিন আমরা সবাই উত্তরণে কিছুসময়ের জন্য হলেও প্রকৃত মুক্তি খুঁজে পেয়েছিলাম। আমাদের মানসিক উত্তরণ ঘটুক প্রতিদিন এটাই প্রতিদিনের প্রার্থনা। চিলেকোঠা এভাবেই অন্য আলোক পথে এগিয়ে চলুক।

ধন্যবাদ সেদিন উপস্থিত সকল সদস্য কে। আলোকিত থাকুন সবাই সুচেতনায়।

ধারাবাহিক / স্বপ্নস্বরূপ – ১৮ /- ন ন্দি নী সে ন গু প্ত




ত্রিশের দশকের শেষভাগে চীন-জাপান যুদ্ধের সময় এক অদ্ভুত ঘটনায় কবি বিচলিত হয়েছিলেন। ঘটনাটি হল, এক জাপানী সৈন্য যুদ্ধের সাফল্য কামনা করে বুদ্ধমন্দিরে পূজা দিতে গিয়েছিল। হ্যাঁ, সঙ্গতভাবেই তার কাছে অদ্ভুত এবং নিন্দনীয় বলে মনে হয়েছিল হিংসাকে আবাহনের জন্য এই অহিংসার দূতের অর্চনা। কবি লিখেছিলেন...   
‘হত-আহতের গনি সংখ্যা
তালে তালে মন্দ্রিত হবে জয়ডঙ্কা।
নারীর শিশুর যত কাটা-ছেঁড়া অঙ্গ
জাগাবে অট্টহাসে পৈশাচী রঙ্গ,
মিথ্যায় কলুষিবে জনতার বিশ্বাস,
বিষবাষ্পের বাণে রোধি দিবে নিশ্বাস
     মুষ্টি উঁচায়ে তাই চলে
     বুদ্ধেরে নিতে নিজ দলে ।
তূরী ভেরি বেজে ওঠে রোষে গরোগরো,
ধরাতল কেঁপে ওঠে ত্রাসে থরোথরো’ ...
আসলে আমরা সর্বদা আমাদের নিজস্ব বিশ্বাস, ভাবনা, অভিব্যক্তি সবকিছুর প্রতিফলন দেখতে চাই এবং প্রকারান্তরে সমর্থন আদায় করে নিতে চাই আমাদের প্রিয় মানুষ এবং আরাধ্য দেবতার থেকে। মাঝেমধ্যেই বুঝে উঠতে চাইনা যে, সে কাজে হয়তো সেই মানুষটির বিশেষ সায় নেই, আগ্রহও নেই।  সমর্থন দূরে থাক, আপত্তিও থাকতে পারে। তবুও যেন আমরা নিজের দল ভারি করতে চাই ওজনদার মানুষকে দলে টেনে নিয়ে।  
এখন এই মুহূর্তে হয়তো সেটাই ঘটে চলেছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও। সবাই নিজের নিজের ভাবনা প্রকাশ করবার জন্য তারই লেখাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। বিপদ সেখানেই। কখনো বা সম্পূর্ণ প্রসঙ্গের অবতারণা ছাড়াই খণ্ড খণ্ড ভাবে তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে আশ্রয় হিসেবে নয়, ঢাল হিসেবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তিনি বেঁচে থাকতে, প্রাণ থাকতে কোনওদিন চরমপন্থী মৌলবাদকে সমর্থন    করতেন না। কিন্তু এমনটি হলে আশ্চর্য হব না, যদি দেখি আজ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, মানুষ ক্ষুদ্রস্বার্থের জন্য তার বাণীকে ব্যবহার করছে। পরাধীন ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলনের চরমপন্থী হিংসাশ্রয়ী  ভাবনার ধারাটির বিশেষ বিরোধিতা তিনি বার বার করেছেন। সে লড়াই বিদেশী শাসনের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করবার লড়াই ছিল, তা সত্ত্বেও তিনি সর্বান্তকরণে সমর্থন করেননি। আজ দেখি ক্ষুদ্রস্বার্থে দেশেরই মানুষ নিজেদের মধ্যে কখনো রাজনৈতিক অথবা সাম্প্রদায়িক লড়াইয়ে মত্ত, বাধে না এতটুকু একে অপরের প্রাণ নিতে; যে মুখের কথায় তারা হিংসায় ইন্ধন দেয়, সেই একই মুখে তারা  রবীন্দ্রনাথের বাণী আউড়ে ফেরে। জানতে ইচ্ছে হয়, একালে জন্মালে রবীন্দ্রনাথের দশা কী হত!   
অবশ্য তার জীবদ্দশাতেও যে আপামর বাঙ্গালী তাঁকে চিনতে পেরেছিল এমন নয় প্রতিপক্ষ প্রবল ইংরেজ হলেও যেকোনো রকম হিংসার এবং যুদ্ধের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে ছিল তার অবস্থান। বারবার  মানুষ তাঁকে ভুল বুঝেছিল সেকালেও। কিন্তু তিনি দমে না গিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন যে স্বাধীনতা কিংবা স্বরাজ বিষয়ে আমজনতার ভাবনার মধ্যে গলদ ঠিক কোন জায়গায়। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা যখন বলি স্বাধীনতা চাই, তখন কী চাই সেটা ভেবে দেখা চাই। মানুষ  যেখানে সম্পূর্ণ একলা সেইখানে সে সম্পূর্ণ  স্বাধীন। সেখানে তার কারো সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ নেই, কারো কাছে কোনো দায়িত্ব নেই, কারো প্রতি কোনো নির্ভর নেই, সেখানে তার স্বাতন্ত্র্যে লেশমাত্র হস্তক্ষেপ করবার কোনো মানুষই নেই। কিন্তু মানুষ এ স্বাধীনতা কেবল যে চায় না, তা নয়, পেলে বিষম দুঃখ বোধ করে’ তিনি সঠিক জায়গায় ঘা দিয়েছিলেন, এই “কী চাই” সেই ব্যাপারটা তলিয়ে ভাববার কথা বলে। কারণ, স্বাধীনতা বলতে আমরা ঠিক কি বুঝি, সেটা সত্যিই বড় ঘোলাটে, বড় ধোঁয়াশার জায়গা। দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা শুধুই একটি ভূখণ্ডকে বিদেশী শাসনের হাত থেকে মুক্ত করলে যে আসা সম্ভব নয়, সেকথা তার মত করে ক’জন  বুঝেছিল? হয়তো সে সময় ভারতবর্ষ এক জটিল সন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে চলছিল বলেই তিনি এই ব্যাপার নিয়ে তলিয়ে ভেবেছিলেন। তবে অনেক ক্ষেত্রেই নামীদামী রাজনৈতিক নেতাদের সাথে মতপার্থক্য ঘটেছিল তার। ‘বিদেশী বর্জন’ এর উন্মাদনায় গা ভাসিয়ে দেননি বলে কম সমালোচনা সইতে হয়নি। সে সব কথায় কান না দিয়েই তিনি লিখেছিলেন, ‘আজকাল আমরা এই একটা বুলি ধরেছি, ঘরে যখন  আগুন লেগেছে তখন শিক্ষা দীক্ষা সব ফেলে রেখে সর্বাগ্রে আগুন নেবাতে কোমর বেঁধে দাঁড়ানো চাই; অতএব সকলকেই চরকায় সুতো কাটতে হবে। আগুন লাগলে আগুন নেবানো চাই এ কথাটা আমার মতো মানুষের কাছেও দুর্বোধ্য নয়। এর মধ্যে দুরূহ ব্যাপার হচ্ছে কোন্‌টা আগুন সেইটে স্থির করা, তারপরে স্থির করতে হবে কোন্‌টা জল 
    বিভিন্ন সঙ্কটের সময় এভাবেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হয়ত তিনি বলতে চেয়েছিলেন ‘আগুন’ কে, অর্থাৎ বিপদটাকে ঠিকঠাক চিনে নেবার কথা। তবে বিপদ চিনে নিয়ে সেখানে জল ঢালাও ভারি বিপদের কাজ। যাকে জল বলে ভাবছি, কে জানে, জলভাণ্ড বদলে সেখানে কেউ ঘৃতভাণ্ড রেখে দিয়েছে কিনা। সেসময় আপামর ভারতবাসী একচক্ষু হরিণের মত শুধুই স্বরাজের কথা ভেবেছিল। স্বরাজের সাথে ঘনিয়ে আসা অন্যান্য বিপদ অর্থাৎ আনুষঙ্গিক আধিব্যাধি নিয়ে একেবারেই ভাবিত ছিল নাকারণ, তারা সম্ভবত বুঝে উঠতে পারেনি যে ভারতবর্ষ প্রস্তুত ছিল না স্বরাজের জন্যরবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, সতর্ক করেছিলেন এবং সমালোচিত হয়েছিলেন, কারণ বাকিদের মত ছিল যে তিনি সময়ের দাবী অর্থাৎ ‘প্রায়োরিটি’ বুঝতে পারছেন না। আসল ব্যাপারটা হল, তিনি কোনও সমস্যাকে খণ্ডচিত্রের মত দেখেননি। সত্যদ্রষ্টা দার্শনিকের মত সমস্যার সমগ্র স্বরূপ বুঝবার চেষ্টা করেছিলেন। হয়তো সেই কারণেই চরমপন্থী এবং নরমপন্থী সবরকম আন্দোলনের বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের সমস্যাগুলি দূর থেকে দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। দূরে ছিলেন, তাই গোটা চিত্রটি দেখতে পেয়েছিলেন। কাছাকাছি থাকলে হয়তো বা অন্ধ হয়ে যেতেন। শ্লোগানের চিৎকারে শুনতে পেতেন না অন্তরাত্মার মনের কথা। তার মত করে কেউ বোঝেনি যে যেন তেন প্রকারেণ প্রতিবাদ করাই মোক্ষ হতে পারেনা যেকোনো আন্দোলনের। সমস্যার স্বরূপ বুঝেই তিনি লিখেছিলেন, ‘আগুনের জ্বালানি কাঠটা হচ্ছে ধর্মে কর্মে অবুদ্ধির অন্ধতা  
  লিখেছিলেন ,ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
       অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে’ ...   
তার মতে, দেশকে সর্বব্যাপী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা ছিল সমাধানের পথ। প্রকৃত শিক্ষাই একমাত্র পারে সবরকম হিংসা, ধর্মবিদ্বেষ এবং অন্ধতা দূর করতে। শিক্ষার চটকদারি পাশ্চাত্য অনুকরণ নয়, অল্প কিছু মানুষকে পাইয়ে দেওয়া শিক্ষা নয়, অন্ধকার ভাসিয়ে দেওয়া আলোর কথা বলে গিয়েছিলেন তিনি। ভাবতে অবাক লাগে, স্বাধীনতার এত বছর পরেও কি দেশ তাঁকে বুঝতে পারলো না? তাহলে কেন আজো এ দেশের স্তরে স্তরে এত অন্ধতা? সেই কবে তিনি লিখেছিলেন,    
  ‘দেশকে মুক্তি দিতে গেলে দেশকে শিক্ষা দিতে হবে, এ কথাটা হঠাৎ এত অতিরিক্ত মস্ত বলে ঠেকে যে একে আমাদের সমস্যার সমাধান বলে মেনে নিতে মন রাজি হয় না। দেশের মুক্তি কাজটা খুব বড়ো অথচ তার উপায়টা খুব ছোটো হবে, এ কথা প্রত্যাশা করার ভিতরেই একটা গলদ আছে’ তিনি এই প্রত্যাশার গলদটা হাতে ধরে চিনিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমরা কি আদৌ কোনও দিন চিনতে পারবো?
(চলবে)   

                   
        
 
 




কবিতা / দেশ / অনুপম দাশশর্মা



এই তো, ঠিক এই-তো আমার গর্বের দেশ।
এখনো পুরনো দেয়াল থেকে খসে পড়ে সুরকির অভিমান।
ইতিহাস ফেলে রেখেছি প্রাবন্ধিকের হাতে
অনোনুপায় শর্তে।
ঠিক এই দেশে, চাষির লিভারে বাস করে
ঋণ, পরিশোধ‍্য ফলিডলের নিঃশ্বাসে।
অথচ, শীত দরবারে প্রবেশ করলে
নবান্ন উৎসবে ভেসে ওঠে যুবতীর লাশ
কাগুজে প্রতিবাদ খেপিয়ে তোলে পিত্তি
সম্বৎসরে!
দেবতা নেমে আসে সমস্ত বিপর্যয়ের পর-
শুধু নিঃসীম চরাচরে।


শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্প অবলম্বনে নবনির্মাণ / অভাগীর সুখ / সুজয় চক্রবর্তী



শত চেষ্টা করে যখন একটা কাঠও জোগাড় করা গেল না , তখন নদীর চরে গর্ত খুঁড়ে অভাগীকে শোয়ানো হল । যে খড়ের আঁটি জ্বেলে কাঙালি মায়ের মুখে আগুন দিয়েছিল, তার থেকেই কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছিল উপরে । গায়ে হাত দিয়ে বসে , সে দিকেই তাকিয়ে ছিল কাঙালি । রসিক এসে পিঠে হাত রাখলো তার । কিছুটা ঘৃণাভরে নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো কাঙালি । মৃত মায়ের কথা মনে পড়তেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোটা । অব্যক্ত এক প্রতিশোধ স্পৃহায় চোখ জ্বালা করতে লাগলো তার । রসিকের হাতটা সরিয়ে চোখ মুছে সামনের আম বাগানের দিকে দিল ছুট । আজ সারাদিন মায়ের কথাই ভেবেছে সে । মা’র সঙ্গে ‘সগ্যে’ গেলেই মনে হয় ভালো হত । জল আর বাতাসা খেয়েই না হয় থাকতো । তবু তো মা’র পাশে শুয়ে রূপকথার গল্প শোনা যেতো । এর জন্য মা’র ওপর তার একটু অভিমানও হল যেন । মা কি তাকে নিয়ে যেতে পারতো না ? মা ছাড়া তো তার এই পৃথিবীতে কেউ নেই ! সে এখন কার কাছে থাকবে ? কোথায় থাকবে ? কে তাকে আদর করে ডাকবে ----‘কাঙালি , আয় বাবা, আমার কাছে আয় । পান্তাভাত নুন লংকা দিয়ে মেখেছি , দুটো খেয়ে নে ।‘ মা বলতো, ‘ কাঙালি, তুই বড় হয়ে আমার সব আশা মিটাবি ,বাবা। তোর বাবা তো আমার কথা কোনও দিন ভাবলোও না । আর আমার যা কপাল ! কোনও দিন সুখের মুখ দেখবো বলে মনে হয় না !কাঙালি তখন মায়ের কথা কেড়ে নিয়ে বলতো, ‘ তুমি চুপ করো না মা , আমি তো আছি !’ মা’কে হারিয়ে মন ভারাক্রান্ত কাঙালির । তবু বাবার সামনে দাঁড়িয়ে কতগুলো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে তার । কেন মা থাকতে বাবা আবার বিয়ে করলো ? বাবা হিসেবে তার কোন আব্দারটাই বা সে রেখেছে ? অভাগীর অকাল মৃত্যু কাঙালিকে বাবা রসিকের কাছে নিয়ে এল বটে , তবে বেশ খানিকটা দূরত্ব রচনা করেই । একরাশ ঘৃণা ঝরে পড়লো কাঙালির ; বাবা রসিকের উপর, এই সমাজটার উপরেও । যে সমাজ জাত-পাতের দুয়ো দিয়ে মানুষের শেষ ইচ্ছে নিয়ে পরিহাস করে, কাঙালির ইচ্ছা করে ঘূণধরা এই সমাজটাকেই জ্বালিয়ে দিতে । আর জন্মদাতা পিতার খুব কাছে গিয়ে বলতে ইচ্ছা করে , ‘ তুমি একটা ঠগ, বুঝলে ? তুমি একতা ঠগ ‘
    কাঙালি এখন নরেশ মিত্তিরের চালের আড়তে কাজ করে । নরেশবাবু লোকটা ভালো । ছেলেটার দুঃখ সহ্য করতে না পেরে নিজের আড়তেই কাজ জুটিয়ে দিয়েছেন । টিফিন বাবদ রোজ পাঁচ টাকা মিলিয়ে মাসের শেষে কাঙালির হাতে থাকে প্রায় বারো’শ টাকার মতো । সৎভাই বিশুকে এবার দুর্গা পুজোয় নতুন জামা কিনে দিয়েছে কাঙালি । টাকা জমিয়ে জমিয়ে একটা নতুন সাইকেলও কিনে ফেলেছে সে । আড়তের কর্মচারী বৃন্দাবনের পুরনো রেডিওটাও এখন কাঙালির জিম্মায় । বৃন্দাবন কাঙালিকে ছোট ভাইয়ের মতোই দেখে , তাই কম দামে দিয়েছে ওটা । বৃন্দাবন আরও কিছু দিয়ে একটা টেপরেকর্ডার কিনেছে । রসিক বাড়ি থাকলে রেডিওটা চালিয়ে গান শোনে , শোনায় বিশুর মা’কেও । রসিকের সংসারে কাঙালির এখন খুব কদর । কিছুদিন ধরে শুধু রসিক নয় , কাঙালির সৎ মা ও ভাইও তাকে বেশ সুনজরে দেখছে । কাঙালির বুঝতে দেরি হয় না , এর কারণটা কী । তার শুধু মনে হয় , যদি মা বেচে থাকতো কতো আনন্দই না পেতো ! মা বেঁচে থাকলে তার হাতে নতুন কাপড়ের প্যাকেটটা ধরিয়ে পরনের শতছিন্ন কাপড়টা বদলে আসতে বলতো কাঙালি । কিন্তু সেতো আর হওয়ার নয় ! মাঝেমধ্যে রসিক যখন তার দ্বিতীয় গিন্নির সঙ্গে রসিকতায় মেতে ওঠে , তখন কাঙালির খুব মনে পড়ে মায়ের মুখটা । মা’কি দেখতে সেই তেমনই আছে ? কে জানে ! মা কি এখনও তাকে ডাকে ? মা’কে যে সে বড় ভালোবাসে । 
     আজ নরেশবাবুর কাছ থেকে মাসের টাকা হাতে পেয়ে খুশিতে মন ভরে গেল কাঙালির । রাতের দিকে চপ আর জিলিপি কিনে বাড়ি ফিরলো সে । রসিক আজ কাজে যায়নি । ঝড় বৃষ্টি হলে রঙের কাজ হয় না । বাড়িতেই ছিল । বেশ আনন্দ করেই জিলিপি চপ খেল চারজনে । একে তো চৈত্রের শেষ , তায় আবার গাছের পাতাও একটা নড়ছিল না । স্নান করে, চুল আচড়ে ঘরের দাওয়ায় বসে পাখার হাওয়া খাচ্ছিল কাঙালি । হঠাত তেল উঠে দপ দপ করতে করতে হ্যারিকেনটা গেল নিভে । পাখাটা রেখে হ্যারিকেনটা নিয়ে বসলো কাঙালি । এমন সময়ই রসিকের চিৎকার শুনে রান্নাঘর থেকে লম্প হাতে বেরিয়ে এল বউ । কাঙালিও একছুটে বাইরে । কাঁঠাল গাছটার নিচে শুয়ে ছটফট করছে রসিক । মুখ দিয়ে গ্যাজলা বেরচ্ছে । দংশনের জায়গাটা দেখেই আঁতকে উঠলো বউ । জাত সাপে কামড়েছে তাকে । সেই রাতেই কাঙালি ছুটলো নবীন ওঝার বাড়ি । ওঝা এল , ঝাড়ফুক হল । রসিকের জ্ঞান ফিরলো না । শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হল রসিককে । কাঙালি বড় । নিয়মমতো তাকেই মুখাগ্নি করতে হল । এরপর নদীর চরে গ্ররত খুঁড়ে পুঁতে দেওয়া হল রসিকের দেহটাকে । সতভাই বিশুর কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিল কাঙালি । হাত জোড় করে প্রণাম করে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঙালি মনে মনে বললো , ‘ মা, বাবাও দেখো সগ্যে যাচ্ছে , এবার তুমি সুখী হবে ।‘


কবিতা / তুলনাহীন / গৌতম সেন



গুটিকতক চড়াইপাখির লাফিয়ে লাফিয়ে চলা
ওই ছোট্ট ঠোঁটে খুঁটে খুঁটে খাওয়া,
তদের মাঝে শালিখ পাখির ঝাঁক,  দুটো একটা কাক
রোজ সকালে এদের দেখতে পাওয়া-
শহুরে পাখিদের নৈমিত্তিক জীবন।

আমার তোমার ও তো এমনই লাফিয়ে চলা
মাঝে সাজে দেখা হওয়া
খুঁটে খুঁটে জীবনকে পাওয়া আর তার কথা বলা,
এতদিনে নিতান্তই গা-সওয়া
হয়ে গেছে বেঁচে থাকার কারণ।

তফাৎ শুধু এই - আমাদের এই জীবন পালন
দেখাশোনার মাঝে, এত চেনা পরিচিতি
হাসি আনন্দ কলরবে শুনি ক্লান্ত আস্ফালন
করে ব্যপ্তিহীন আশাহত স্বল্প পরিমিতি।
ওরা ক্ষুদ্র প্রাণী, তবু জানে জীবনের সঠিক উচ্চারণ।


রবীন্দ্রশ্রদ্ধা / আমাদের রবিঠাকুর / অরুণ চট্টোপাধ্যায়



মহামতি সেক্সপিয়ার বলেছিলেন, ‘নামে কি আসে যায়!’ কিন্তু আমার মনে হয় নামেও কিছু আসে যায়। নাম অনেক কিছুর সাক্ষ্য বহন করে। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, দর্শন, রাজনীতি, সমাজনীতি, লোকাচার অনেক কিছু বহন করতে পারে একটা নাম। এমন কি নাম থেকে খুঁজে তার ধাম অর্থাৎ অস্তিত্ব আর উৎস খুঁজে বার অসম্ভব কোন কাজ নয়।
এ ছাড়াও নামের সঙ্গে হৃদয়ের একটা যোগাযোগ আছে এটা তো অস্বীকার করা যায় না। দেড়শ বছর আগে ২৫শে বৈশাখের কোনও এক পুন্য মুহূর্তে কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়িতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঔরসে সারদা দেবীর কোল আলো করে ভবিষ্যতের ‘বিশ্বকবির’ একটা পোশাকী নাম দেওয়া হয়েছিল নামকরণের রীতি মেনেই। বছরের সব দিন জগতে অরুণালোকে উদ্ভাসিত হবার পূর্বেই উচ্চারণযোগ্য সেই নাম হল ‘শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।‘
বাল্যকালের ছটফটে অথচ ভাবুক প্রকৃতির এই ছেলেটির জীবনরথ যতই গড়াতে লাগল বয়ঃপ্রাপ্তির পথ ধরে, ততই তাঁর প্রতিভার কিরণ ছড়িয়ে পড়তে লাগল দিক থেকে দিগন্তরে। আর সে কিরণ হতে লাগল প্রখর থেকে প্রখরতর। অবশেষে শুধু বাংলা নয়, শুধু ভারত নয় –সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল সে আলোকদীপ্তি। বিশ্ব চিনল রবীন্দ্রনাথকে, চিনল বৃটিশের পদানত তথাকথিত তদানীন্তন ‘নেটিভ’দের দেশ ভারতবর্ষকেও।   
ফল যেমন গাছের পরিচয় বহন করে তেমনি সন্তান বহন করে মাতার পরিচয়। গৌরবান্বিত সন্তান ধারণ করে ধন্য হন, গরবিনী হন, সুপরিচিতা হন মাতাও। সুসন্তান রবীন্দ্রনাথকে ধারণ, পালন ও রক্ষণ করে গরবিনী দেশমাতৃকা আমাদের এই ভারতবর্ষ বিশ্বের কাছে নতুন করে পরিচিতা হলেন। সারা বিশ্ব হাঁ করে তাকিয়ে রইল মহান এই ভারতবর্ষের দিকে। পরিচিতির এক নতুন পাঠ গ্রহণ করল যেন তারা।
কবি রবীন্দ্রনাথ হলেন মহাকবি, বিশ্বকবি, কবিগুরু। কী নামে যে ডাকবে এই প্রতিভাটিকে তা যেন তারা ভেবেই পাচ্ছিল না। কিন্তু বাঙ্গালীর অন্তর এক মুহূর্ত দেরি করে নি সঠিক নামটিকে চয়ন করতে। সারা বাঙ্গালী তাদের হৃদয় দিয়ে ডেকে উঠল ‘রবিঠাকুর’ এই ছোট্ট, মিষ্টি, আদরের, শ্রদ্ধার আর সম্মানের নামে।
আজ আমাদের ‘রবিঠাকুর’ শুধুমাত্র তাঁর সৃষ্ট কাব্য, গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সমালোচনা, আলোচনা আর নাটকের ক্ষুদ্র পরিসরে আবদ্ধ নন। তা ছাড়িয়ে ঢুকে গেছেন প্রত্যেক বাঙ্গালীর অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে। আবেগ আর যুক্তিবোধের রস গাঢ় হয়ে সযত্নে সঞ্চিত হয়েছে আমাদের হৃদয়ে। আজ বাঙ্গালী রবীন্দ্র অন্ত প্রাণ।
রবীন্দ্রনাথের জীবনকাহিনী অনেকেরই জানা। আর এই দেড়শ বছরের সুদীর্ঘ পরিসরে কারোর যদি জানা না হয়ে থাকে তো সে দুর্ভাগ্য আমাদের। সেই দুর্ভাগ্যকে উপেক্ষা করে আমরা ঢুকে যাব তাঁর অন্তরে আর তাঁর সাহিত্যের অন্দরে। কিন্তু আকারের দিক থেকে সেই ক্ষেত্রটি এতই বিশাল যে, সেখানে আমাদের বিচরণ শুধু সময় সাপেক্ষই নয়, শ্রম-সাপেক্ষ, ধৈর্য সাপেক্ষ আর মনন সাপেক্ষ তো বটেই। এমন কী কোনও একজনের পক্ষে সারা জীবনেও তা সম্ভব না হওয়ারই সম্ভাবনা।
জনপ্রিয়তার নিরিখে প্রথমেই নাম করা যেতে পারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের। নিজের গানে নিজে সুর দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নির্দিষ্ট গন্ডীতে বেঁধে গিয়েছেন বলে অনেক আধুনিক পন্থী আক্ষেপ করতেন। যেন সময়ের গতিতে সুর যদি সমসাময়িকতার গতি লাভ করে তবেই সঙ্গীত আরও বেশি জনপ্রিয়তা, বেশি প্রাসঙ্গিকতা লাভ করবে। বিশ্বভারতীর খবরদারির ওপর অনেকেই ছিলেন প্রায় খড়্গহস্ত। বিশ্বভারতীর প্রশাসন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে মুক্ত করার আবেদন এসেছে বারবার।
অবশেষে বিশ্বভারতীর কবলমুক্ত হয়ে নতুন সুরে বেশ কিছু গান তো গাওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তা স্থায়িত্ব লাভ করে নি। রবীন্দ্রসঙ্গীত আবার ফিরেছে তার নিজস্ব স্বত্বায়, নিজস্ব রীতিতে, নিজস্ব ঢঙে। এক কথায় তার নিজস্ব ঘরানায়। আর এটা খুশির খবর রবীন্দ্রসঙ্গীত কিন্তু ক্রমেই চড়ছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। মানুষের স্মৃতিতে যদি কিছু থাকে তো তা চলে যেতে পারে বিস্মৃতির আড়ালে। কিন্তু মানুষের হৃদয়ে যদি কিছু থাকে তো তা কি চলে যেতে পারে হৃদয়ের বাইরে?
রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাষা আর ভাব এমনভাবে সমন্বিত যে সর্বসাধারণের অন্তরে তা গেঁথে যায় সহজে। এটা সবাই জানেন যে রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষা বহু ক্ষেত্রেই দ্ব্যর্থব্যঞ্জক। কবিই একমাত্র জানেন তিনি কী ভেবে লিখেছেন। কিন্তু একাধারে বিস্ময় আর আনন্দের এই যে, যে গানের নৈবেদ্য নিবেদন করেছেন দেবতাকে, তা অনায়াসেই পরিবেশন করা যায় সর্বসাধারণকে। কারণ রবীন্দ্রনাথ ছিলেন চিন্তায় ও বিশ্বাসে সার্বজনীন।  তাই তো রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নিজের মনে করে সবাই। মুগ্ধ-বিস্ময়ে কবির নিজের কথাতেই তাই বলতে ইচ্ছে করে, ‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী/ আমি অবাক হয়ে শুনি, শুধু শুনি......’।
আসি রবীন্দ্রকাব্যের কথায়। সংখ্যার বিচারে কত হবে তা আমার সঠিক জানা নেই। আর এই যে ‘জানা নেই’ কথাটা বললাম তাতেই আমার গর্ব। কারণ রবীন্দ্রনাথকে ‘অনেক জানি’ এই কথাটা একটা ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিছু নয়। সঠিক সংখ্যা কেউ জানে কি না জানে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন আছে বলেও আমার মনে হয় না। কারণ বিরাট সংখ্যা দিয়ে যেমন গুণের বিচার হয় না তেমনি সংখ্যার স্বল্পতা দিয়েও ঢাকা যায় না তার গুনকে। অনেকে বলেন quantity আর quality পরস্পর ব্যস্তানুপাতিক। অর্থাৎ একটির বৃদ্ধি বা হ্রাস অন্যটির হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটায়। নিয়মের পাশে যেমন বাস করে ব্যতিক্রম তবে রবীন্দ্রকাব্যের ক্ষেত্রেও গণিতের এই সূত্র অবশ্যই ব্যতিক্রমের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। অর্থাৎ রবীন্দ্রকাব্যের বিশাল সাগরে সাঁতার কাটতে কাটতেও কখনও একঘেয়েমী আসে না। ক্লান্ত মনে হয় না নিজেকে। মনে হয় যেন সাঁতার কেটেই যাই আর সাঁতার কেটেই যাই। অমৃতসুধা পান করেই যাই আর পান করেই যাই।
রবীন্দ্রকাব্যের সেই স্নিগ্ধ সুশীতল বাতাস ছুঁয়ে যায়নি কার অঙ্গন, ক্ষণমাত্র আন্দোলিত করে নি কার অঞ্চল বা উত্তরীয় সেটা বলা খুব শক্ত। আসলে বাতাস যেমন জগতের কোন স্থানই ফাঁকা রাখতে দেয় না রবীন্দ্রকাব্যও তেমনই। ধনী, দরিদ্র, শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ, সুস্থ, অসুস্থ কার না অন্তরে প্রবেশ করেছে এই কাব্যের ঢেউ। কার না জীবনের প্রতিফলন ঘটেনি এই কাব্যে? এক সময় যারা রবীন্দ্রকবিতা আবৃত্তি করত আড়ালে তাদের অভিহিত হতে হত ‘আঁতেল’ বা ‘এঁতেল’ নামে। ইংরিজি ‘intellectual’ শব্দটির বিদ্রূপাত্মক বাংলা প্রতিশব্দ। যত দিন যাচ্ছে ততই উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে সেই অদ্ভুত নামদানের। জনপ্রিয়তা আর আভিজাত্যের বিচারে রবীন্দ্রকাব্য আর রবীন্দ্র-আবৃত্তিকারদের সংখ্যা আর মর্যাদা আজ ক্রমবর্ধমান। পরিচ্ছন্ন আর পরিশীলিত সংস্কৃতি বলতে রবীন্দ্র-বিকল্প খুঁজে পাওয়া ভার। সংস্কৃতির গাম্ভীর্য আর মর্যাদাপূর্ণ আবহাওয়া বজায় রাখতে আমাদের হাতে রবীন্দ্রকাব্য আর রবীন্দ্রসঙ্গীত দুই অমূল্য সম্পদ।  
ছোটগল্প, বড়গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, রসরচনা, ভ্রমণকাহিনী, পত্রসাহিত্য, আলোচনা, সমালোচনা—এই সব কিছু নিয়ে রবীন্দ্রসাহিত্য এক বিশাল ক্ষেত্রে সুসজ্জিত। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের সার্থকতা বিচার করতে গেলে প্রথমেই বিচার করতে হয় তাঁর নিজের নামকরণের সার্থকতা। সূর্য যেমন ঊষা থেকে গোধূলি পর্যন্ত সারা আকাশ পরিভ্রমণ করে বেড়ায়, আলোকে উদ্ভাসিত করে জগতের প্রতিটি কোণ, রবীন্দ্রনাথ তেমনি সারা জীবন ধরে হৃদয়, অন্তর আর মনন দিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন সমগ্র সমাজটায়। ধনীর সুসজ্জিত সুবিশাল অট্টালিকা বা দরিদ্রের পর্ণকুটীর সকল স্থানই রবীন্দ্রসাহিত্যের সযত্ন ও সাদর পদক্ষেপে ধন্য হয়েছে এ কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
মানুষ দরিদ্র হলেই যে মিথ্যুক হয় না বা প্রত্যেক মানুষ যে অসৎ বা স্বজন পোষণে দুষ্ট হয় না তার জ্বলন্ত উদাহরণ হল ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’ গল্পটি। স্বজন-প্রিয়তার থেকে সততাকেই আপন করেছিল রামকানাই। আপন ছেলেকে জেলে যেতে হয়েছিল তার সত্যনিষ্ঠ সাক্ষ্যে। হয়ত স্বজন পোষণ আর অসাধুতার বাস্তব এই জীবনে এ ঘটনা অত্যন্ত বিরল, তবু এটি আদর্শনিষ্ঠা আর সত্যনিষ্ঠার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই বিন্দুমাত্র।
ধর্ম যে মানুষের সঙ্গে মানুষের সামাজিক মিলনের পক্ষে অন্তরায় হতে পারে না তার উদাহরণ ‘মুসলমানির মেয়ে’ গল্পটি। তাঁর উপন্যাসে স্থান পাওয়া বিষয়ের মধ্যে সমাজ, নারীসত্ত্বা, দারিদ্র, কামনা, বাসনা, বঞ্চনা, ধর্ম, ইতিহাস কি না আছে তা খুঁজে বার করা এক গবেষণা সাপেক্ষ বিষয়।
মাত্র কুড়ি বছর বয়েসে লিখলেন নাটক ‘বাল্মিকী প্রতিভা’। অভিনীত হল তা রঙ্গমঞ্চে আর সাফল্যও পেল। তাঁর নাটকগুলি তিনভাগে বিভক্তঃ গদ্যনাট্য, গীতিনাট্য আর নৃত্যনাট্য। ডাকঘর, গান্ধারীর আবেদন, শাপমোচন, রক্তকরবী, চিত্রাঙ্গদা, কর্ণ-কুন্তী সংবাদ, বিসর্জন আরও বহু নাটকের নাম প্রতিটি বাঙ্গালীর প্রায় মুখস্থ।  
চার দেওয়ালে ঘেরা রুদ্ধশ্বাস পরিসরে কড়া শাসনের আবহে যে শিক্ষা প্রচলিত ছিল ইতিপূর্বে, তা চিরকাল অস্বীকার করেছেন রবীন্দ্রনাথ। নিজে কোনোদিন বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ের ছায়া মাড়ান নি। কিন্তু শিক্ষা যে সভ্যতার অন্যতম মুখ্য বাহন আর তাই আবশ্যিক এটাকেও অস্বীকার করেন নি কখনও। তাই তিনি চলে গেলেন সুদূর বোলপুরে। যেখানে উন্মুক্ত প্রকৃতি মানুষের মনের সঙ্গে নিয়ত খেলা করে চলেছে। স্থাপন করে চলেছে এক মধুর আর হার্দিক সম্পর্ক। মৃদুমন্দ বাতাস, গাছের শীতল ছায়া, দিগন্ত বেষ্টিত অর্ধবর্তুলাকার নীলাম্বর যেখানে মানুষের সঙ্গে কথা বলে, সেখানে মুক্ত আবহে গাছের নীচে বসালেন শিক্ষালয়। ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে স্থাপিত হল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এক মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। আজ সারা বিশ্বে যার খ্যাতি ক্রম প্রসার্যমাণ।
১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলী রচনা আর ইংরাজীতে অনুবাদের জন্যে এল বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি নোবেল পুরষ্কার। যদিও পদকটি দুর্ভাগ্যবশত চুরি হয়ে গেছে কিন্তু স্বীকৃতিটি নয়। পদক থাকে সিন্দুকে রক্ষিত আর স্বীকৃতি থাকে হৃদয়ে রক্ষিত যেখানে হাত দেবার কোনও সামর্থ চোরের নেই।
রবীন্দ্রসাহিত্য এত বিশাল যে তা এই স্বল্প পরিসর ব্যাখ্যা করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। তবে তাঁর সাহিত্যের একটা দিক অনুল্লেখিত থাকাটা নিতান্তই অনুচিত। তা হল তাঁর লেখা বিখ্যাত পত্র-সাহিত্য। অন্যকে লেখা সংবাদ আদান-প্রদানের মাধ্যম নিছক একটা পত্রও যে রসোত্তীর্ণ হয়ে সাহিত্যের মর্যাদা পেতে পারে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ব্যক্তিকে লেখা রবীন্দ্রনাথের পত্রগুচ্ছ তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। সংখ্যাতেও তারা প্রশংসনীয় ভাবেই বিপুল। তাঁর জন্মশতবর্ষ অর্থাৎ ১৯৬১ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলীর একাদশ খন্ডের ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে ২৫২টি এমন সাহিত্যরস পুষ্ট পত্র লিপিবদ্ধ হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ যে একজন ভাল চিত্রশিল্পী ছিলেন সেকথা হয়ত আমরা বেশি লোকে জানি না। বা খোঁজ রাখার চেষ্টা করি না। অঙ্কনশিল্পে যথার্থ পারদর্শী রবীন্দ্রনাথ তাঁর ষাট বছর বয়েসে ইউরোপের প্যারিসে নিজের আঁকা ছবির প্রদর্শনী করেছিলেন সর্বপ্রথম। পরাধীন ভারতের এই বহুমুখী প্রতিভাধরের প্রতিভার আর একটির উপস্থাপনায় সারা বিশ্ব মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল এ বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না।
কবি-সাহিত্যিকদের অন্তর সর্বদাই মানবিকতায় পূর্ণ থাকে এটা বলাই বাহুল্য। তাঁদের মুখ কম কথা বলে। লেখনী কথা বলে বেশী। লেখনী যে কথা বলতে পারে না তা বলে কাব্য-সাহিত্যের ভাব, ব্যঞ্জনা আর উপস্থাপনা কৌশল। তাঁরা প্রকাশ্যে হয়ত মানুষের দুঃখে কাঁদেন না, হয়ত হন না প্রকাশ্যে সরবও। তাঁরা না কাঁদলেও কাঁদে তাঁদের কলম। ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে তীব্র যন্ত্রণার অভিব্যক্তি। প্রতিবাদের শব্দগুলোকেও তীক্ষ্ণ অস্ত্রের মত সুসজ্জিত করেন।
তাই ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগে নিরীহ নিরস্ত্র শত শত মানুষ যখন উত্তপ্ত বৃটিশ-বুলেটের অগ্নিচুম্বনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, সুদূর এই বাংলায় বসে আমাদের প্রিয় রবিঠাকুর স্থির থাকতে পারেন নি। ১৯১৫ সালে ইংরেজ শাসকের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ঘৃণাভরে ফিরিয়ে দিলেন বৃটিশ বাঘের কোলের ওপর। যে নাইট উপাধি ছিল এক বিশাল সম্মান সারা পৃথিবীর বুকে, তাকে একটা ছেঁড়া কাগজের মত হেলায় ছুঁড়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ যেন আমাদের কাছে এক অবিশ্বাস্য গল্প বা কল্পকাহিনীর মত মনে হয়। সেই সঙ্গে গর্বে বুক ভরে ওঠে। এই গর্ব শুধু তাঁর জন্য নয়। এই গর্ব সমগ্র বাঙ্গালী সমাজের জন্য। এই গর্ব সমগ্র বাংলার জন্য। এই গর্ব সমগ্র ভারতের জন্য।  
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। প্রবল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর কলমও। লিখলেন অন্তত ডজন খানেক দেশাত্মবোধক গান। ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার কোলে ঠেকাই মাথা...’, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি...’ ‘বাংলার মাটি বাংলার জল...’, ‘অয়ি ভূবনমনোমোহিনী মা...।‘
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই ‘জন-গন-মন অধিনায়ক...’ গানটি সারা ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুত্থানে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি...’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। একজন বাঙ্গালী কবি বিশ্বের দু দুটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচনাকার এ গর্ব একজন বাঙ্গালী হিসেবে কতখানি আমাদের গর্বিত করতে পারে ভাবা যায় কি?
যুগে যুগে পন্ডিত আর গবেষকেরা রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে চলেছেন তাঁর লেখার মধ্যে, তাঁর কাব্যের ভাষায় আর গানের সুরে। যা তাঁরা পেয়েছেন, তা কিন্তু যা তাঁরা পাননি তার থেকে অনেক কম। তাঁরা খুঁজেই চলেছেন আর খুঁজেই চলবেন। পার হয়ে যাবে যুগের পরে যুগ। শতকের পরে শতক। রবীন্দ্রসৃষ্টি প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না এতটুকু। অনুজ্জ্বল হবে না এতটুকু। আমাদের হৃদয়ের গাঁথা শেকড়ের বিস্তার শুধু বাড়তেই থাকবে। রবীন্দ্রবিশ্বাসের গভীরতায় হারাতেই থাকবে।   


কবিতা / যখন বৃষ্টি এলো / বুবুসীমা চট্টোপাধ্যায়




ওকি বৃষ্টির শব্দ ? 
নাকি পায়ের থেকে নূপুর খুলে
হাতে নিয়ে তোর দৌড়ে আসার শব্দ ;
যদি তাই হয় তবে এখন কেন ? 
এখন তো  অনেক রাত ,
বুকের কাছাকাছি কোনও মাটি নেই -
নিঃশব্দের রাজ্যে একটা মেঘ
আসাযাওয়া করে শুধু ;   
রাতের বৃষ্টি  মাথার কাছে এসে স্থির হয়ে দাঁড়ায় -
অথচ ------- 
এখন উল্টে যাওয়া কুয়োর মতো 
একটা কালো আকাশ 
আমার মুখের উপর উপুড় হয়ে তাকিয়ে আছে 
দেখতে পাচ্ছিস তুই ? 
আমার চোখ লাল হবার আগেই 
সে ঝরে পড়বে  বলে কথা দিয়েছে ;
কিন্তু দ্যাখ ---------- 
সব মন খারাপ তো তুই  ধুয়ে দিবি বলে 
গেল বছর  কথা দিয়েছিলি ,  
তা কি আর তোর মনে আছে ?
কয়েকটা জলজংলা পেরিয়েই একহাঁটু কাদায়
একটা সবুজ ধানক্ষেত সাজিয়ে দিয়েছিলি ;  
বড় ভালো আষাঢ় এঁকেছিলি তুই সেদিন
খরা - মনজুড়ে সেদিন ঝমঝম আর ঝিরিঝিরি  
তবু -------
বৃষ্টির শব্দ আঁকতে পারিসনি তুই কোনোদিন -
চুবচুবে হয়ে ভিজে যাবে সাদা ক্যানভাস 
পোড়ামনের ঘ্রাণ ভ্যানিস হবে সেই শব্দে - 
আর জলছবি হয়ে ভেসে উঠবি তুই 
নূপুরপায়ে তুই আর তুই আর তুই
সেদিন বৃষ্টি নামবে আমার উঠোনজুড়ে ।। 





কবিতা / পূর্ণ বিস্ময় / সোমা বসু








কতবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছি ঐ চোখের রেখায়, 
পাথুরে ভূমিতে পেতে দিয়েছি সবুজ মনের  বাসনা সিক্ত গালিচা । 
প্রশান্ত তটভূমি মিলিয়েছে জলের গভীরে ॥

ভালোবাসা এসে পড়ে সহসা বাধা বন্ধ ছাপিয়ে -
ডুবিয়ে ভাসিয়ে পূর্ব আয়োজন, 
পূর্ণ কলস, পূর্ণ জীবনের ডালি, 
সমাপতনের আবছাযায় দোলা খায় 
আর প্রহর গোনে নিরুদ্ধ বাতায়নপাশে
আমরণ ভালোবাসা ! 

পাব না ফিরে জানি ফেলে আসা দিন, 
ঢেউ গোণা মালা গাঁথা অলস দিন, 
প্রহর গোণা  মিছে বেলা  । 
খোলা আকাশের তারাদের অনিমেষ চাউনি, 
মুখর নির্বাক  ॥

সন্ধ্যের কালো মসীমাখা উজ্জ্বল অন্ধকার জ্বালে ফেনায় ফেনায়  মায়াবী আলো, 
বিন্দু বিন্দু জুঁই চামেলী কুন্দের সদাবাহার ॥
ভাবনার পরপারে গভীর আঁধারে ঢাকে
পুরানো যা কিছু আর যা কিছু ক্ষীণ... 
দরজায় থামে এসে নতুন যৌবন নিয়ে আর এক নতুন জীবন ॥

কে যেন বলে ওঠে বুকের মাঝে থেকে থেকে
সংশয দোলাচল চিত্তে - 

"তুমি কি এসেছ মোর দ্বারে... ॥" 

কৃতজ্ঞতা :রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 


অনু গল্প / ঋণশোধ / রীনা রায়।




ভোরের আলো তখনও ভালো করে ফোটেনি, 3 নম্বর হরিতলা স্ট্রীট তখনও ঘুমিয়ে, প্রতিদিনের মতোই রামশরণ তার জিনিসপত্র গুছিয়ে কাজে চলে এসেছে, জিনিস বলতে বড় ডান্ডা লাগানো ঝাঁটা, আর ময়লা তোলার জন্য ছোট একটা গাড়ি।
রামশরণ, এখানে রাস্তা ঝাঁট দেয়। এই তিন নম্বর হরিতলা স্ট্রীট থেকে ওই পূবদিকে চ্যাটার্জী পাড়া যেখানে শুরু হয়েছে,তার আগে পর্যন্ত ওর এলাকা, সঙ্গে অবশ্য লাখান আছে, কিন্তু ওই ছোড়া যা ফাঁকিবাজ!
কাজে ফাঁকি দেওয়া রামশরণ একদম বরদাস্ত করতে পারেনা, তাই লাখানের ভরসায় না থেকে নিজেই এলাকা ঝকঝকে করে তোলে। লাখান পরে এসে ময়লাগুলো গাড়িতে তুলে দেয়।
লাখান, রামশরণের নিজের ছেলে, ঘরে বউ বাচ্চা আছে, ও একটু দেরি করেই আসে। 
ছমাসের ফুটফুটে নাতিটা রামশরণের জীবনে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে, নাহলে,লাখানের মা যখন সেবার বর্ষায় সাপের কামড়ে ভগবানের পেয়ারা হয়ে গেল, রামশরণের বাঁচতে ইচ্ছে হতো না, সরস্বতী যে তার বড়ো পেয়ারের ছিলো, আর এখন এই নাতি তার জানপ্রাণ আছে।

রামশরণ ঝাঁট দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছিলো, শিবমন্দিরের পাশ দিয়ে যেতেই একটা বস্তা চোখে পড়লো, শুধু তাই নয় বস্তাটা যেন একটু নড়েও উঠল, রামশরণ কি ভেবে বস্তার মুখটা খুলতেই চমকে ওঠে, " রামজী, এ সুবহ সুবহ কেয়া দিখায়া আপনে, হায়, আব কেয়া করে, এ লাখান ভি আভিতক নেহি আয়া..", যদিও লাখানের আসার সময় এখনো হয়নি, দিশেহারা রামশরণ তাও বলে চলে, আর এইসব বলতে বলতেই বস্তা থেকে ঘুমন্ত শিশুটিকে বার করে, একটা ফুটফুটে ছ সাত বছরের মেয়েকে বস্তাবন্দি করে কেউ শিবমন্দিরের পাশে ফেলে গেছে, কি করবে বুঝতে না পেরে নিজের জলের বোতল থেকেই বাচ্চাটার মুখে ঝাপটা দেয়, ঠান্ডা জলের স্পর্শে মেয়েটা চোখ মেলে তাকায়, অবাক দৃষ্টিতে রামশরণকে দেখে, তারপর ওর চোখ দুটো কাকে যেন খুঁজে বেড়ায়..
"তুম কউন হো বিটিয়া? কাঁহা সে আয়ি হো? আউর ইসমে ক্যাইসে ঘুঁসি?"
মেয়েটি যেন কিছু শুনতেই পায়নি, কোনো উত্তরই দিলোনা, ঘুম ভেঙে যেমন মাকে খোঁজে , তেমন করে ও যেন কাউকে খুঁজছিলো।
"হা রামজী, হা শিবজী আব ম‍্যয় সমঝি.. এ বাচ্চা বোল ভি না সকে, আউর শুন ভি না সকে, ইসলিয়ে কোই ইসে ইসতারা ফেককে গিয়া"
"বাবুজি, এ কোন হ্যায়?"
"লাখান, তু আ গিয়া? দেখ,বেটা দেখ, এ ফুল সি বাচ্ছি কো কিসিনে ইঁহা ফেক কে গ‍্যায়ি হ‍্যায়"
"আব কা করে বাবুজি? চলো, ইসে হাম পোলিশকে পাশ লে চলে"
"নেহি লাখান, হাম বিটিয়া কো ঘর লে যাতে হ‍্যায়"
"এ ঠিক নেহি হোগা বাবুজি, বাদমে মুসিবত হো সকতি হ‍্যায়"

রামশরণের ইচ্ছেতে মুন্নির একটা আশ্রয় জুটে গেলো।
শুধু, জুটে গেল নয়, লাখানের মন দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও লাখানের বউ সুন্দরী, ওকে পরম আদরে বুকে টেনে নিলো।
আর মুন্নি নামটাও রামশরণেরই দেওয়া।
দেখতে দেখতে দু বছর পেরিয়ে গেছে, নাহ, কোনো পুলিশী ঝামেলায় পড়তে হয়নি। আসলে, ওই মূক বধির মেয়েটার সন্ধান কেউ করতেই চায়নি।
সুন্দরীও মুন্নির কাছে নিজের আড়াই বছরের ছেলেটাকে রেখে একটু দূরেই একটা বাড়িতে কাজে যায়। সেদিনও গেছিলো।
সেদিন সকালে রামশরণ আর লাখান নিজেদের কাজে বেরিয়ে গেছে, একটু পরেই আকাশ কালো করে সকালেই আঁধার নেমে এলো, প্রায় দেড়ঘন্টা টানা বৃষ্টির পর, বৃষ্টিটা তখন একটু ধরে এসেছে, সুন্দরী ভাবলো, এই ফাঁকে বাবুদের বাড়ির কাজটা সেরে আসবে। সেই ভেবে ছেলেকে প্রতিদিনের মতো মুন্নির জিম্মায় রেখে ও বেরিয়ে গেল। কিন্তু, কিছুক্ষণ পরেই আবার বৃষ্টি শুরু হলো।

সুন্দরী তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলো, "ঘরমে দোনো ক্যায়সে হ্যায় কা মালুম, ইতনা বারিস হোগা কোন যানতা থা..ঘরকা কা হাল ......",সুন্দরী অস্থির হয়ে উঠছিলো।
ঘরে পা দিয়েই চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়লো সুন্দরী।বাচ্চা দুটোকে কোথাও দেখতে পেলোনা, 
ঘরের একদিকের দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। সুন্দরী পাগলের মত ওদের খুঁজতে লাগলো। 
এদিকে রামশরণ আর লাখান ও ততক্ষণে ফিরে এসেছে।
হঠাৎ ভাঙা পাঁচিলের ভেতর থেকে একটা কান্নার আওয়াজ কানে আসতেই তিনজনে সেদিকে দৌড়ে গেলো। 
প্রানপনে পাঁচিলের একাংশ সরিয়ে ওরা দেখলো, মুন্নির কোলের মধ্যে ওদের সন্তান অক্ষত ,আর পাঁচিলের ভার টা মুন্নির শরীরের ওপর পড়েছে।
বাঁচানো গেলো না মুন্নিকে, নিজের প্রাণ দিয়ে ও যেন এই পরিবারের ঋণ শোধ করে গেল।
রামশরণ, সুন্দরীর সাথে লাখান ও সেদিন মুন্নির জন্য কেঁদে উঠলো।
বাইরে তখন অঝোর শ্রাবনে প্রকৃতিও যেন তার মন খারাপ জানাচ্ছে।

ছোট গল্প / ভালোবাসা আধার বদলায় / শমিতা চক্রবর্তী






পঁচিশে বৈশাখের জোরদার রিহার্সাল চলছে 'সুর ও বাণী ' তে . আর তো মাত্র কটা দিন -তারপরেই অনুষ্ঠান . বরাবরের মতো সুরঞ্জনা দি গানে আর বাসন্তিকা দি নাচের তালিমে আছেন . রিহার্সালের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা ও চলছে জমজমাট !  তা নয় নয় করে কুড়ি -বাইশ বছর সঞ্চিতা আছে এই 'সুর ও বাণী ' তে . সুতরাং সহ শিল্পী রা তার অতি পরিচিত --সদা হাস্যমুখী সঞ্চিতা বরাবরই আড্ডার মধ্যমণি !  আজ ও তার ব্যতিক্রম হয়নি . পিয়ালী বলে উঠলো --বাহ্ সঞ্চিতা দি --আজকেও আবার নতুন শাড়ি --কী লাগছে তোমাকে ! লজ্জা লজ্জা মুখে সঞ্চিতা বললো --এই তোদের সন্দীপন দা কদিন আগেই নিয়ে এলো এটা --অফিস থেকে ফিরেই এই সারপ্রাইজ সেদিন !  আসলে এবার আমাদের বিয়ের রজত জয়ন্তী বছর চলছে কি না ----তাই মাঝে মাঝেই এই টুকটাক উপহার চলছে !  ও বাবা কী প্রেম এখনও --অহনা -চিরশ্রী তো হেসে গড়িয়ে পড়লো !  আমাদের বরগুলোকে সন্দীপন দার কাছে পাঠিয়ে দেবো --ভালো করে ট্রেনিং দিয়ে দিতে বোলো তো ! আবার সমস্বরে হা হা হি হি ! -----নাঃ ঠিকঠাকই আছে --অভিনয় টাও আজকাল ভালোই করতে পারে সঞ্চিতা ----ভালো থাকার অভিনয় ! হ্যাঁ --এটা ও শিখতে হয়েছে --নিজের যন্ত্রণা টাকে প্রাণপণ ঢাকতে চায় সঞ্চিতা ! তার চুরমার হয়ে ভেঙে যাওয়া নারীত্বের টুকরো টুকরো সম্মানগুলোকে এই ভালো থাকার অভিনয় দিয়ে কোনমতে জুড়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালায় ও --আর চায় তাতাই --ওদের একমাত্র সন্তান --তার গায়ে যেন আঁচড় টি না লাগে !  

                          সম্পর্ক যখন ডালপালা মেলে শিকড় বাকড় ছড়িয়ে অনেকদূরে বিস্তৃত হয় , বটের ঝুড়ি নামার মত অসংখ্য ঝুড়ির মধ্যে যখন আর আসল শিকড় টাকেই খুঁজে পাওয়া ভার হয়ে ওঠে --তখন যদি জানা যায় যে গুঁড়ি তে পোকা ধরেছে --আসল গাছটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে --তখন যেমন অবস্থা হয় --ঠিক তেমনই হয়েছিল সেদিন সঞ্চিতা র --যেদিন ও আবিস্কার করেছিল --সন্দীপনের সঙ্গে দেবলীনা র সম্পর্ক টা ! 

         দেবলীনা সন্দীপনের অফিস কলিগ ! স্মার্ট -শিক্ষিতা তার ওপর ওমন রূপের চটক ! ওর প্রতিটি শরীরি বিভঙ্গে আগুন ধরে যায় পুরুষের মনে --কত পতঙ্গ মন পুরুষ অহরহ ঝাঁপ দিতে চায় তার রূপের আগুনে --এহেন রূপসী কি না সব্বাই কে ছেড়ে -সন্দীপন কেই বেছে নেয় বন্ধু হিসেবে --হয়তো শুধুই ব্ন্ধু নয় আর ও বেশী কিছু !  এমন ডাক কে উপেক্ষা করতে পারে নি সন্দীপন ও ---সম্পর্ক গড়িয়েছে সবার অলক্ষেই ! মাঝে মধ্যে সন্দীপনের সঙ্গে ওদের বাড়ি ও এসেছে --বৌদি বৌদি করে ভাব ও জমিয়েছে !  মাসীমা মাসীমা করে সন্দীপনের মায়ের মন ও জয় করেছে ! অথচ সন্দীপনের মা কোনদিন ই সহজভাবে মেনে নিতে পারে নি সঞ্চিতা কে !
হয়তো সেই কোন ভরা যৌবনে বিধবা হয়ে --একমাত্র সম্বল ছেলেকে আঁকড়ে ধরে বাঁচছিলেন --নিজের সমস্ত সাধ -আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে সমস্ত মন -প্রাণ সঁপেছিলেন ছেলেকে মানুষ করার তাগিদে ! একটু একটু করে বড় ও করে তুলেছিলেন --সন্দীপন --মেধাবী , রুচিশীল , দায়িত্ববান -মানুষ হয়েও উঠেছিল !  মায়ের নয়নের মণি সে !  সেই সন্দীপন যখন নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবে বলে বায়না ধরে বসলো --স্বভাবতই সে মেয়ের প্রতি বিরূপ হলো মায়ের মন ! 

                   সেবারে কলেজ স্যোসালে অসাধারণ গান গেয়েছিল সঞ্চিতা ! গান গেয়ে কলেজে তখন মোটামুটি বেশ পপুলার ! এইসময় হঠাত্ই একদিন থার্ড ইয়ারের সন্দীপন মিত্র --কলেজের জি .এস --কোন ভূমিকা না করেই প্রপোজ করেছিল ওকে ---হকচকিয়ে গেছিল সঞ্চিতা --স্বয়ং কলেজের জি .এস --যার একটু কৃপাদৃষ্টি পাবার জন্য মেয়েরা হত্যে দিয়ে পড়ে আছে --সে--ই সন্দীপন মিত্র কিনা তাকে চাইছে !  তক্ষুণি উত্তর দিতে পারেনি ও --দুদিন সময় চেয়ে নিয়েছিল .

                  তারপর উথাল -পাথাল প্রেমের জোয়ারে গা ভাসিয়ে কেটে গেল কয়েকটা বছর --সঞ্চিতা র গান ও চলছিলো পুরোদমে . আর সন্দীপন এরই মধ্যে এম .বি .এ ডিগ্রী টা হাসিল করে ফেললো একদিন . আর সঙ্গে সঙ্গে এই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি র লোভনীয় চাকরি টা ! ----মা কে এতোদিনে জানালো ওর আর সঞ্চিতা র সম্পর্কের কথা টা . মা তো রাগে অভিমানে --দুদিন কথাই বলেন নি সন্দীপনের সঙ্গে ! তিনি নাকি তাঁর কোন বান্ধবী র সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে সন্দীপনের বিয়ের প্রায় ঠিকঠাক ই করে ফেলেছিলেন .
পরে ধীরে ধীরে মা কে সন্দীপন রাজী অবশ্য করিয়ে নিতে পেরেছিলো --কিন্তু মায়ের সমস্ত বিদ্বেষ যেন গিয়ে পড়লো সঞ্চিতা র ওপর ! কোনদিন আপন করে নিতে পারেননি তাকে ! 

            এরই মধ্যে তাতাই এলো ! ভালোবাসা -মান অভিমান স্বামী স্ত্রী র ঝগড়া -খুনসুটি এসবের মধ্যে দিয়েই চলছিল দিনগুলো !  শাশুড়ী র সঙ্গে মানিয়ে চলার একটা অদম্য প্রয়াস বরাবরই ছিল সঞ্চিতা র মধ্যে !  তবে সবকিছুর মধ্যে সঙ্গীত চর্চা ও চলছিল --এ ব্যাপারে সন্দীপনের পূর্ণ সমর্থন ছিল !  কতগুলো কচিকাঁচা জোগাড় করে গান ও শেখাতে শুরু করেছিল সঞ্চিতা . তারপর ঝড়ের মতো কাটছিল দিনগুলো ---তাতাই এর স্কুল -টিউশন , সন্দীপনের অফিস --সে এক চরম ব্যস্ততার দিন ! 

               তাতাই তখন ক্লাস টুয়েলভ --স্কুল থেকে ফিরেই কোনোরকমে নাকে মুখে গুঁজে টিউশন যাবার জন্য রেডি হচ্ছে -----এসময় হঠাত্ ফোন --বিরক্ত হয়ে ফোন ধরলো সঞ্চিতা --হ্যালো -----ওপারে শ্রীপর্না --হ্যাঁ রে সন্দীপন দা কোথায় রে ?  ----কেন -অফিসেই হয়তো ------না রে এইমাত্র দেখলাম শপিং মলে -----এক হেব্বি স্টাইলিশ লেডির সাথে ঘুরে ঘুরে শপিং করছে ! -----ও হো --ও বোধহয় দেবলীনা রে --ওর কলিগ --হয়তো অফিস ফেরতা শপিং এ গেছে ---আমাদের বাড়িতেও আসে তো ! -----তাই বুঝি ---অত ক্যাজুয়ালি নিস না রে ----সন্দীপন দা কে চোখে চোখে রাখিস ! -------ধূর ছাড় তো ! এখন রাখছি রে --তাতাই টিউশনে বের হবে .------বললো বটে ছাড়তো ---অস্বস্তি টা কি ওর মনেও ছেয়ে নেই ! এই দেবলীনার হুট্হাট করে ওদের বাড়ি আসা ---আজ আবার শপিং ! ছিঃ ছিঃ ! 

              দেবলীনা সমেত সেদিন বাড়ি এলো সন্দীপন ----যেন রাজ্য জয় করে এসেছেন --এমন ভঙ্গি তে বললো --খুব টায়ার্ড লাগছে সঞ্চিতা --দু কাপ কফি দিয়ে যাও তো ! একটা যন্ত্রণা --অপমান আসতে আসতে দানা বাঁধছিল সঞ্চিতা র বুকে ----বেশ কড়া গলায়ই বললো --সরি --আমার ছাত্রছাত্রীরা এসে গেছে --আমি এখন নীচে যাচ্ছি ! ------মানে ? দেবলীনা এসেছে আর তুমি ? ----সো হোয়াট --তোমরা কথা বলোনা --আমার তো ক্লাসের টাইম হয়ে গেছে ! 
                           সেদিন রাতে বেশ একচোট হয়ে গেল সন্দীপনের সাথে !  বাড়িতে গেস্ট আসলে কিভাবে বিহেভ করতে হয় তুমি জান না ? ----গেস্ট নাকি ! ---তোমরা শপিং করে করে টায়ার্ড হয়ে যাবে --আর তোমাদের চাঙ্গা করার জন্য আমায় কফি জুগিয়ে যেতে হবে বুঝি ! ---_হোয়াট ডু ইউ মিন ? ------না বোঝার মতো তো কিছু বলিনি ----আজ তোমরা শপিং মলে যাও নি ? -----সো ? যেতে পারি না ?  আজ ওর বার্থ ডে ছিল --আর হ্যাঁ তোমাকে এতো কৈফিয়ত ই বা দেবো কেন ?  -----সে তো নিশ্চয় একশো বার যেও --বাধা কে দিচ্ছে !
সেদিনের পর থেকে দেবলীনা আর এ বাড়িতে আসেনি . এখন সন্দীপন অফিস থেকে অনেক রাত করে ফেরে ---কোন কোন দিন তো বলে ডিনার করেই এসেছি . একই বিছানায় এখন সন্দীপন আর সঞ্চিতা --যোজন দূরত্বে দুজন !  শুধু তাতাই এর জন্য মুখ বুঁজে সব টা সয়ে যাচ্ছে . এ বছর টা তাতাই এর ভাইটাল ইয়ার --ক্লাস টুয়েলভ ! ধৈর্য্য হারালে চলবে না --সে যে মা ! 

          সেদিন তাতাই এর জন্মদিন ছিল --ওর কয়েকজন বন্ধুবান্ধব কে নিয়ে একটু ছোট্ট আয়োজন --ঐ কেক কাটা --তারপর ডিনার এইসব . সেদিনও সন্দীপন যথারীতি রাত করেই ফিরলো --বললো ডিনার করেই এসেছে . আজ আর শাশুড়ি মা থাকতে না পেরে বলেই দিলেন ---ছেলের জন্মদিন টায় তো তাড়াতাড়ি ফিরতে পারতিস !  -----ওহ্ সরি --সরি বেটা --হ্যাপি বার্থডে ---একেবারে মাথা থেকে চলেই গেছিলো --তোমার গিফট টা ডিউ রইলো বেটা !  ছেলেটাও কেমন যেন একটু চুপচাপ --ইন্ট্রোভার্ট ধরণের --শুধু বললো --ইট্  স ওকে পাপা --থ্যাংকস ! ব্যস্ ঐ টুকুই --কোন অভিমান নেই --আবদার নেই ! 
      সঞ্চিতা বললো --আজ তোর কাছে শুই সোনা ! হ্যাঁ হ্যাঁ শোও না . সেদিন রাতে তাতাই এর ঝাঁকড়া চুল গুলোতে বিলি কাটতে কাটতে কত ছোটবেলার গল্প হল --তারপর কখন দুজনে ঘুমিয়ে পড়লো ! 

                      তাতাই ইঞ্জিনিযারিং এ চান্স পেয়ে যখন হোস্টেল এ চলে গেল -----হু হু করে উঠলো সঞ্চিতার বুকটা ---তবু কোথাও যেন একটা নিশ্চিন্তি ---সন্দীপন দিন দিন যেরকম বেপরোয়া হয়ে উঠছে --ছেলের কাছে ধরা না পড়ে যায় ----তার চেয়ে এই ভালো --তাতাই দূরেই থাক .

                      অপমানে অবহেলায় রোজ একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে সঞ্চিতা ! তবু সদা হাস্যমুখী র রোল টা প্লে করতে গিয়ে --ভিতরের রক্তক্ষরণ টা বুঝি আরও বেড়ে যাচ্ছে ! আজকাল শাশুড়ী মা যেন নিঃশব্দে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন --তাঁর স্নেহময়ী রূপ অবশ্য সঞ্চিতার যন্ত্রণায় খানিক আরামের প্রলেপ --এও তো এক পরম পাওয়া ! চির বিরূপ শাশুড়ী মা আজ তার সমব্যথী ! 

              সেদিন সকাল সকাল সন্দীপন অফিস ব্যাগ ও কয়েকদিনের থাকার মত কিছু জিনিস পত্র গুছিয়ে বললো নাকি ট্যুরে যেতে হবে আজই ----তাই নাকি -আজকাল তোমার ট্যুর ও হচ্ছে ! ইদানিং খুব প্রয়োজন ছাড়া দুজনের কথা হয় না --আজ সঞ্চিতা উত্তেজনার বশে বলেই ফেললো কথাটা ---দেবলীনা ও যাচ্ছে নিশ্চয় ট্যুরে ? ----হ্যাঁ যাচ্ছে --তোমার আপত্তি আছে ?------বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বললো সন্দীপন ---এটা অফিস ট্যুর --ও যেতেই পারে ! ------বাহ্ -আজকাল অফিস তোমাদের ট্যুরের ও ব্যবস্থা করে দিচ্ছে তাহলে ! ওর সাথে রাত কাটানোর বন্দোবস্তও পাকা ! -----হ্যাঁ বেশ করবো --তুমি যা খুশি করতে পারো --যত্তোসব ! 
আজকাল ওদের বাদ -বিতণ্ডা আর শাশুড়ী মার কান এড়ায় না --উনি বললেন চুপ করো বৌমা -ওকে যেতে দাও ----সন্দীপন ওর নাকের ডগা দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেলো ---রাগে অপমানে সঞ্চিতা র গলা ধরে এলো --আর কথা যোগালো না মুখে --শুধু দুচোখ বেয়ে টুপটাপ বৃষ্টি ফোঁটা !  শাশুড়ী মা --মাথায় হাত রাখলেন --আসলে কি জান মা ---'ভালোবাসা ' বারবার আধার বদলায় ! 

                       সেদিন এতো কষ্টের মধ্যেও একঝলক খুশীর হাওয়া নিয়ে এলো তাতাই এর ফোন টা ------মা ক্যম্পাসিং এ আজ আমার চাকরী টা হয়ে গেল ---আর মাত্র কয়েকটা মাস --তারপর তুমি আর ঠাম্মি আমার কাছে --আর ওখানে থাকতে হবেনা ! ------আর এ ছেলেটা বলে কী !  ও কি করে আমার দুঃখ কষ্ট টের পেলো !  এ তো তাতাই নয় এ তো যেন একজন পরিণত মানুষ কথা বলছে --তাতাই যে এখন মিস্টার তিয়াস মিত্র !  
নাঃ সত্যিই ছেলেটা বড় হয়ে গেল ! 


সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া