ভোরের আলো তখনও ভালো করে ফোটেনি, 3 নম্বর হরিতলা স্ট্রীট তখনও ঘুমিয়ে, প্রতিদিনের মতোই রামশরণ তার জিনিসপত্র গুছিয়ে কাজে চলে এসেছে, জিনিস বলতে বড় ডান্ডা লাগানো ঝাঁটা, আর ময়লা তোলার জন্য ছোট একটা গাড়ি।
রামশরণ, এখানে রাস্তা ঝাঁট দেয়। এই তিন নম্বর হরিতলা স্ট্রীট থেকে ওই পূবদিকে চ্যাটার্জী পাড়া যেখানে শুরু হয়েছে,তার আগে পর্যন্ত ওর এলাকা, সঙ্গে অবশ্য লাখান আছে, কিন্তু ওই ছোড়া যা ফাঁকিবাজ!
কাজে ফাঁকি দেওয়া রামশরণ একদম বরদাস্ত করতে পারেনা, তাই লাখানের ভরসায় না থেকে নিজেই এলাকা ঝকঝকে করে তোলে। লাখান পরে এসে ময়লাগুলো গাড়িতে তুলে দেয়।
লাখান, রামশরণের নিজের ছেলে, ঘরে বউ বাচ্চা আছে, ও একটু দেরি করেই আসে।
ছমাসের ফুটফুটে নাতিটা রামশরণের জীবনে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে, নাহলে,লাখানের মা যখন সেবার বর্ষায় সাপের কামড়ে ভগবানের পেয়ারা হয়ে গেল, রামশরণের বাঁচতে ইচ্ছে হতো না, সরস্বতী যে তার বড়ো পেয়ারের ছিলো, আর এখন এই নাতি তার জানপ্রাণ আছে।
রামশরণ ঝাঁট দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছিলো, শিবমন্দিরের পাশ দিয়ে যেতেই একটা বস্তা চোখে পড়লো, শুধু তাই নয় বস্তাটা যেন একটু নড়েও উঠল, রামশরণ কি ভেবে বস্তার মুখটা খুলতেই চমকে ওঠে, " রামজী, এ সুবহ সুবহ কেয়া দিখায়া আপনে, হায়, আব কেয়া করে, এ লাখান ভি আভিতক নেহি আয়া..", যদিও লাখানের আসার সময় এখনো হয়নি, দিশেহারা রামশরণ তাও বলে চলে, আর এইসব বলতে বলতেই বস্তা থেকে ঘুমন্ত শিশুটিকে বার করে, একটা ফুটফুটে ছ সাত বছরের মেয়েকে বস্তাবন্দি করে কেউ শিবমন্দিরের পাশে ফেলে গেছে, কি করবে বুঝতে না পেরে নিজের জলের বোতল থেকেই বাচ্চাটার মুখে ঝাপটা দেয়, ঠান্ডা জলের স্পর্শে মেয়েটা চোখ মেলে তাকায়, অবাক দৃষ্টিতে রামশরণকে দেখে, তারপর ওর চোখ দুটো কাকে যেন খুঁজে বেড়ায়..
"তুম কউন হো বিটিয়া? কাঁহা সে আয়ি হো? আউর ইসমে ক্যাইসে ঘুঁসি?"
মেয়েটি যেন কিছু শুনতেই পায়নি, কোনো উত্তরই দিলোনা, ঘুম ভেঙে যেমন মাকে খোঁজে , তেমন করে ও যেন কাউকে খুঁজছিলো।
"হা রামজী, হা শিবজী আব ম্যয় সমঝি.. এ বাচ্চা বোল ভি না সকে, আউর শুন ভি না সকে, ইসলিয়ে কোই ইসে ইসতারা ফেককে গিয়া"
"বাবুজি, এ কোন হ্যায়?"
"লাখান, তু আ গিয়া? দেখ,বেটা দেখ, এ ফুল সি বাচ্ছি কো কিসিনে ইঁহা ফেক কে গ্যায়ি হ্যায়"
"আব কা করে বাবুজি? চলো, ইসে হাম পোলিশকে পাশ লে চলে"
"নেহি লাখান, হাম বিটিয়া কো ঘর লে যাতে হ্যায়"
"এ ঠিক নেহি হোগা বাবুজি, বাদমে মুসিবত হো সকতি হ্যায়"
রামশরণের ইচ্ছেতে মুন্নির একটা আশ্রয় জুটে গেলো।
শুধু, জুটে গেল নয়, লাখানের মন দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও লাখানের বউ সুন্দরী, ওকে পরম আদরে বুকে টেনে নিলো।
আর মুন্নি নামটাও রামশরণেরই দেওয়া।
দেখতে দেখতে দু বছর পেরিয়ে গেছে, নাহ, কোনো পুলিশী ঝামেলায় পড়তে হয়নি। আসলে, ওই মূক বধির মেয়েটার সন্ধান কেউ করতেই চায়নি।
সুন্দরীও মুন্নির কাছে নিজের আড়াই বছরের ছেলেটাকে রেখে একটু দূরেই একটা বাড়িতে কাজে যায়। সেদিনও গেছিলো।
সেদিন সকালে রামশরণ আর লাখান নিজেদের কাজে বেরিয়ে গেছে, একটু পরেই আকাশ কালো করে সকালেই আঁধার নেমে এলো, প্রায় দেড়ঘন্টা টানা বৃষ্টির পর, বৃষ্টিটা তখন একটু ধরে এসেছে, সুন্দরী ভাবলো, এই ফাঁকে বাবুদের বাড়ির কাজটা সেরে আসবে। সেই ভেবে ছেলেকে প্রতিদিনের মতো মুন্নির জিম্মায় রেখে ও বেরিয়ে গেল। কিন্তু, কিছুক্ষণ পরেই আবার বৃষ্টি শুরু হলো।
সুন্দরী তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলো, "ঘরমে দোনো ক্যায়সে হ্যায় কা মালুম, ইতনা বারিস হোগা কোন যানতা থা..ঘরকা কা হাল ......",সুন্দরী অস্থির হয়ে উঠছিলো।
ঘরে পা দিয়েই চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়লো সুন্দরী।বাচ্চা দুটোকে কোথাও দেখতে পেলোনা,
ঘরের একদিকের দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। সুন্দরী পাগলের মত ওদের খুঁজতে লাগলো।
এদিকে রামশরণ আর লাখান ও ততক্ষণে ফিরে এসেছে।
হঠাৎ ভাঙা পাঁচিলের ভেতর থেকে একটা কান্নার আওয়াজ কানে আসতেই তিনজনে সেদিকে দৌড়ে গেলো।
প্রানপনে পাঁচিলের একাংশ সরিয়ে ওরা দেখলো, মুন্নির কোলের মধ্যে ওদের সন্তান অক্ষত ,আর পাঁচিলের ভার টা মুন্নির শরীরের ওপর পড়েছে।
বাঁচানো গেলো না মুন্নিকে, নিজের প্রাণ দিয়ে ও যেন এই পরিবারের ঋণ শোধ করে গেল।
রামশরণ, সুন্দরীর সাথে লাখান ও সেদিন মুন্নির জন্য কেঁদে উঠলো।
বাইরে তখন অঝোর শ্রাবনে প্রকৃতিও যেন তার মন খারাপ জানাচ্ছে।
No comments:
Post a Comment