পঁচিশে বৈশাখের জোরদার
রিহার্সাল চলছে 'সুর ও বাণী ' তে . আর তো মাত্র কটা দিন -তারপরেই অনুষ্ঠান .
বরাবরের মতো সুরঞ্জনা দি গানে আর বাসন্তিকা দি নাচের তালিমে আছেন . রিহার্সালের
ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা ও চলছে জমজমাট ! তা নয় নয় করে কুড়ি -বাইশ বছর সঞ্চিতা আছে
এই 'সুর ও বাণী ' তে . সুতরাং সহ শিল্পী রা তার অতি পরিচিত --সদা হাস্যমুখী
সঞ্চিতা বরাবরই আড্ডার মধ্যমণি ! আজ ও তার ব্যতিক্রম হয়নি . পিয়ালী বলে উঠলো
--বাহ্ সঞ্চিতা দি --আজকেও আবার নতুন শাড়ি --কী লাগছে তোমাকে ! লজ্জা লজ্জা মুখে
সঞ্চিতা বললো --এই তোদের সন্দীপন দা কদিন আগেই নিয়ে এলো এটা --অফিস থেকে ফিরেই এই
সারপ্রাইজ সেদিন ! আসলে এবার আমাদের বিয়ের রজত জয়ন্তী বছর চলছে কি না
----তাই মাঝে মাঝেই এই টুকটাক উপহার চলছে ! ও বাবা কী প্রেম এখনও --অহনা
-চিরশ্রী তো হেসে গড়িয়ে পড়লো ! আমাদের বরগুলোকে সন্দীপন দার কাছে পাঠিয়ে
দেবো --ভালো করে ট্রেনিং দিয়ে দিতে বোলো তো ! আবার সমস্বরে হা হা হি হি ! -----নাঃ
ঠিকঠাকই আছে --অভিনয় টাও আজকাল ভালোই করতে পারে সঞ্চিতা ----ভালো থাকার অভিনয় !
হ্যাঁ --এটা ও শিখতে হয়েছে --নিজের যন্ত্রণা টাকে প্রাণপণ ঢাকতে চায় সঞ্চিতা ! তার
চুরমার হয়ে ভেঙে যাওয়া নারীত্বের টুকরো টুকরো সম্মানগুলোকে এই ভালো থাকার অভিনয়
দিয়ে কোনমতে জুড়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালায় ও --আর চায় তাতাই --ওদের একমাত্র
সন্তান --তার গায়ে যেন আঁচড় টি না লাগে !
সম্পর্ক
যখন ডালপালা মেলে শিকড় বাকড় ছড়িয়ে অনেকদূরে বিস্তৃত হয় , বটের ঝুড়ি নামার মত
অসংখ্য ঝুড়ির মধ্যে যখন আর আসল শিকড় টাকেই খুঁজে পাওয়া ভার হয়ে ওঠে --তখন যদি
জানা যায় যে গুঁড়ি তে পোকা ধরেছে --আসল গাছটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে --তখন যেমন অবস্থা
হয় --ঠিক তেমনই হয়েছিল সেদিন সঞ্চিতা র --যেদিন ও আবিস্কার করেছিল --সন্দীপনের
সঙ্গে দেবলীনা র সম্পর্ক টা !
দেবলীনা সন্দীপনের অফিস কলিগ ! স্মার্ট -শিক্ষিতা তার ওপর ওমন রূপের
চটক ! ওর প্রতিটি শরীরি বিভঙ্গে আগুন ধরে যায় পুরুষের মনে --কত পতঙ্গ মন পুরুষ
অহরহ ঝাঁপ দিতে চায় তার রূপের আগুনে --এহেন রূপসী কি না সব্বাই কে ছেড়ে -সন্দীপন
কেই বেছে নেয় বন্ধু হিসেবে --হয়তো শুধুই ব্ন্ধু নয় আর ও বেশী কিছু ! এমন ডাক
কে উপেক্ষা করতে পারে নি সন্দীপন ও ---সম্পর্ক গড়িয়েছে সবার অলক্ষেই ! মাঝে মধ্যে
সন্দীপনের সঙ্গে ওদের বাড়ি ও এসেছে --বৌদি বৌদি করে ভাব ও জমিয়েছে ! মাসীমা
মাসীমা করে সন্দীপনের মায়ের মন ও জয় করেছে ! অথচ সন্দীপনের মা কোনদিন ই সহজভাবে
মেনে নিতে পারে নি সঞ্চিতা কে !
হয়তো সেই কোন ভরা যৌবনে
বিধবা হয়ে --একমাত্র সম্বল ছেলেকে আঁকড়ে ধরে বাঁচছিলেন --নিজের সমস্ত সাধ -আহ্লাদ
বিসর্জন দিয়ে সমস্ত মন -প্রাণ সঁপেছিলেন ছেলেকে মানুষ করার তাগিদে ! একটু একটু করে
বড় ও করে তুলেছিলেন --সন্দীপন --মেধাবী , রুচিশীল , দায়িত্ববান -মানুষ হয়েও উঠেছিল
! মায়ের নয়নের মণি সে ! সেই সন্দীপন যখন নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে
করবে বলে বায়না ধরে বসলো --স্বভাবতই সে মেয়ের প্রতি বিরূপ হলো মায়ের মন !
সেবারে কলেজ স্যোসালে অসাধারণ
গান গেয়েছিল সঞ্চিতা ! গান গেয়ে কলেজে তখন মোটামুটি বেশ পপুলার ! এইসময় হঠাত্ই একদিন
থার্ড ইয়ারের সন্দীপন মিত্র --কলেজের জি .এস --কোন ভূমিকা না করেই প্রপোজ করেছিল
ওকে ---হকচকিয়ে গেছিল সঞ্চিতা --স্বয়ং কলেজের জি .এস --যার একটু কৃপাদৃষ্টি পাবার
জন্য মেয়েরা হত্যে দিয়ে পড়ে আছে --সে--ই সন্দীপন মিত্র কিনা তাকে চাইছে !
তক্ষুণি উত্তর দিতে পারেনি ও --দুদিন সময় চেয়ে নিয়েছিল .
তারপর উথাল -পাথাল প্রেমের জোয়ারে গা
ভাসিয়ে কেটে গেল কয়েকটা বছর --সঞ্চিতা র গান ও চলছিলো পুরোদমে . আর সন্দীপন এরই
মধ্যে এম .বি .এ ডিগ্রী টা হাসিল করে ফেললো একদিন . আর সঙ্গে সঙ্গে এই মাল্টিন্যাশনাল
কোম্পানি র লোভনীয় চাকরি টা ! ----মা কে এতোদিনে জানালো ওর আর সঞ্চিতা র সম্পর্কের
কথা টা . মা তো রাগে অভিমানে --দুদিন কথাই বলেন নি সন্দীপনের সঙ্গে ! তিনি নাকি
তাঁর কোন বান্ধবী র সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে সন্দীপনের বিয়ের প্রায় ঠিকঠাক ই করে
ফেলেছিলেন .
পরে ধীরে ধীরে মা কে সন্দীপন
রাজী অবশ্য করিয়ে নিতে পেরেছিলো --কিন্তু মায়ের সমস্ত বিদ্বেষ যেন গিয়ে পড়লো
সঞ্চিতা র ওপর ! কোনদিন আপন করে নিতে পারেননি তাকে !
এরই মধ্যে তাতাই এলো ! ভালোবাসা -মান অভিমান স্বামী স্ত্রী র
ঝগড়া -খুনসুটি এসবের মধ্যে দিয়েই চলছিল দিনগুলো ! শাশুড়ী র সঙ্গে মানিয়ে
চলার একটা অদম্য প্রয়াস বরাবরই ছিল সঞ্চিতা র মধ্যে ! তবে সবকিছুর মধ্যে
সঙ্গীত চর্চা ও চলছিল --এ ব্যাপারে সন্দীপনের পূর্ণ সমর্থন ছিল ! কতগুলো
কচিকাঁচা জোগাড় করে গান ও শেখাতে শুরু করেছিল সঞ্চিতা . তারপর ঝড়ের মতো কাটছিল
দিনগুলো ---তাতাই এর স্কুল -টিউশন , সন্দীপনের অফিস --সে এক চরম ব্যস্ততার দিন
!
তাতাই তখন ক্লাস টুয়েলভ --স্কুল থেকে ফিরেই
কোনোরকমে নাকে মুখে গুঁজে টিউশন যাবার জন্য রেডি হচ্ছে -----এসময় হঠাত্ ফোন
--বিরক্ত হয়ে ফোন ধরলো সঞ্চিতা --হ্যালো -----ওপারে শ্রীপর্না --হ্যাঁ রে সন্দীপন
দা কোথায় রে ? ----কেন -অফিসেই হয়তো ------না রে এইমাত্র দেখলাম শপিং মলে
-----এক হেব্বি স্টাইলিশ লেডির সাথে ঘুরে ঘুরে শপিং করছে ! -----ও হো --ও বোধহয়
দেবলীনা রে --ওর কলিগ --হয়তো অফিস ফেরতা শপিং এ গেছে ---আমাদের বাড়িতেও আসে তো !
-----তাই বুঝি ---অত ক্যাজুয়ালি নিস না রে ----সন্দীপন দা কে চোখে চোখে রাখিস !
-------ধূর ছাড় তো ! এখন রাখছি রে --তাতাই টিউশনে বের হবে .------বললো বটে ছাড়তো
---অস্বস্তি টা কি ওর মনেও ছেয়ে নেই ! এই দেবলীনার হুট্হাট করে ওদের বাড়ি আসা
---আজ আবার শপিং ! ছিঃ ছিঃ !
দেবলীনা সমেত সেদিন বাড়ি এলো সন্দীপন ----যেন রাজ্য
জয় করে এসেছেন --এমন ভঙ্গি তে বললো --খুব টায়ার্ড লাগছে সঞ্চিতা --দু কাপ কফি দিয়ে
যাও তো ! একটা যন্ত্রণা --অপমান আসতে আসতে দানা বাঁধছিল সঞ্চিতা র বুকে ----বেশ
কড়া গলায়ই বললো --সরি --আমার ছাত্রছাত্রীরা এসে গেছে --আমি এখন নীচে যাচ্ছি !
------মানে ? দেবলীনা এসেছে আর তুমি ? ----সো হোয়াট --তোমরা কথা বলোনা --আমার তো
ক্লাসের টাইম হয়ে গেছে !
সেদিন রাতে বেশ একচোট হয়ে গেল সন্দীপনের সাথে ! বাড়িতে গেস্ট আসলে
কিভাবে বিহেভ করতে হয় তুমি জান না ? ----গেস্ট নাকি ! ---তোমরা শপিং করে করে
টায়ার্ড হয়ে যাবে --আর তোমাদের চাঙ্গা করার জন্য আমায় কফি জুগিয়ে যেতে হবে বুঝি !
---_হোয়াট ডু ইউ মিন ? ------না বোঝার মতো তো কিছু বলিনি ----আজ তোমরা শপিং মলে
যাও নি ? -----সো ? যেতে পারি না ? আজ ওর বার্থ ডে ছিল --আর হ্যাঁ তোমাকে
এতো কৈফিয়ত ই বা দেবো কেন ? -----সে তো নিশ্চয় একশো বার যেও --বাধা কে
দিচ্ছে !
সেদিনের পর থেকে
দেবলীনা আর এ বাড়িতে আসেনি . এখন সন্দীপন অফিস থেকে অনেক রাত করে ফেরে ---কোন কোন
দিন তো বলে ডিনার করেই এসেছি . একই বিছানায় এখন সন্দীপন আর সঞ্চিতা --যোজন দূরত্বে
দুজন ! শুধু তাতাই এর জন্য মুখ বুঁজে সব টা সয়ে যাচ্ছে . এ বছর টা তাতাই এর
ভাইটাল ইয়ার --ক্লাস টুয়েলভ ! ধৈর্য্য হারালে চলবে না --সে যে মা !
সেদিন তাতাই এর জন্মদিন ছিল --ওর কয়েকজন বন্ধুবান্ধব কে নিয়ে একটু
ছোট্ট আয়োজন --ঐ কেক কাটা --তারপর ডিনার এইসব . সেদিনও সন্দীপন যথারীতি রাত করেই
ফিরলো --বললো ডিনার করেই এসেছে . আজ আর শাশুড়ি মা থাকতে না পেরে বলেই দিলেন
---ছেলের জন্মদিন টায় তো তাড়াতাড়ি ফিরতে পারতিস ! -----ওহ্ সরি --সরি বেটা
--হ্যাপি বার্থডে ---একেবারে মাথা থেকে চলেই গেছিলো --তোমার গিফট টা ডিউ রইলো বেটা
! ছেলেটাও কেমন যেন একটু চুপচাপ --ইন্ট্রোভার্ট ধরণের --শুধু বললো --ইট্
স ওকে পাপা --থ্যাংকস ! ব্যস্ ঐ টুকুই --কোন অভিমান নেই --আবদার নেই !
সঞ্চিতা বললো --আজ তোর কাছে শুই সোনা ! হ্যাঁ হ্যাঁ শোও না . সেদিন রাতে তাতাই এর
ঝাঁকড়া চুল গুলোতে বিলি কাটতে কাটতে কত ছোটবেলার গল্প হল --তারপর কখন দুজনে ঘুমিয়ে
পড়লো !
তাতাই ইঞ্জিনিযারিং এ
চান্স পেয়ে যখন হোস্টেল এ চলে গেল -----হু হু করে উঠলো সঞ্চিতার বুকটা ---তবু
কোথাও যেন একটা নিশ্চিন্তি ---সন্দীপন দিন দিন যেরকম বেপরোয়া হয়ে উঠছে --ছেলের
কাছে ধরা না পড়ে যায় ----তার চেয়ে এই ভালো --তাতাই দূরেই থাক .
অপমানে অবহেলায় রোজ একটু
একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে সঞ্চিতা ! তবু সদা হাস্যমুখী র রোল টা প্লে করতে গিয়ে
--ভিতরের রক্তক্ষরণ টা বুঝি আরও বেড়ে যাচ্ছে ! আজকাল শাশুড়ী মা যেন নিঃশব্দে তার
পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন --তাঁর স্নেহময়ী রূপ অবশ্য সঞ্চিতার যন্ত্রণায় খানিক আরামের
প্রলেপ --এও তো এক পরম পাওয়া ! চির বিরূপ শাশুড়ী মা আজ তার সমব্যথী !
সেদিন সকাল সকাল সন্দীপন অফিস ব্যাগ ও কয়েকদিনের
থাকার মত কিছু জিনিস পত্র গুছিয়ে বললো নাকি ট্যুরে যেতে হবে আজই ----তাই নাকি
-আজকাল তোমার ট্যুর ও হচ্ছে ! ইদানিং খুব প্রয়োজন ছাড়া দুজনের কথা হয় না --আজ
সঞ্চিতা উত্তেজনার বশে বলেই ফেললো কথাটা ---দেবলীনা ও যাচ্ছে নিশ্চয় ট্যুরে ?
----হ্যাঁ যাচ্ছে --তোমার আপত্তি আছে ?------বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বললো সন্দীপন
---এটা অফিস ট্যুর --ও যেতেই পারে ! ------বাহ্ -আজকাল অফিস তোমাদের ট্যুরের ও
ব্যবস্থা করে দিচ্ছে তাহলে ! ওর সাথে রাত কাটানোর বন্দোবস্তও পাকা ! -----হ্যাঁ
বেশ করবো --তুমি যা খুশি করতে পারো --যত্তোসব !
আজকাল ওদের বাদ
-বিতণ্ডা আর শাশুড়ী মার কান এড়ায় না --উনি বললেন চুপ করো বৌমা -ওকে যেতে দাও
----সন্দীপন ওর নাকের ডগা দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেলো ---রাগে অপমানে সঞ্চিতা র গলা
ধরে এলো --আর কথা যোগালো না মুখে --শুধু দুচোখ বেয়ে টুপটাপ বৃষ্টি ফোঁটা !
শাশুড়ী মা --মাথায় হাত রাখলেন --আসলে কি জান মা ---'ভালোবাসা ' বারবার আধার
বদলায় !
সেদিন এতো কষ্টের
মধ্যেও একঝলক খুশীর হাওয়া নিয়ে এলো তাতাই এর ফোন টা ------মা ক্যম্পাসিং এ আজ আমার
চাকরী টা হয়ে গেল ---আর মাত্র কয়েকটা মাস --তারপর তুমি আর ঠাম্মি আমার কাছে --আর
ওখানে থাকতে হবেনা ! ------আর এ ছেলেটা বলে কী ! ও কি করে আমার দুঃখ কষ্ট
টের পেলো ! এ তো তাতাই নয় এ তো যেন একজন পরিণত মানুষ কথা বলছে --তাতাই যে
এখন মিস্টার তিয়াস মিত্র !
নাঃ সত্যিই ছেলেটা বড়
হয়ে গেল !
No comments:
Post a Comment