ত্রিশের দশকের শেষভাগে চীন-জাপান যুদ্ধের
সময় এক অদ্ভুত ঘটনায় কবি বিচলিত হয়েছিলেন। ঘটনাটি হল, এক জাপানী সৈন্য যুদ্ধের
সাফল্য কামনা করে বুদ্ধমন্দিরে পূজা দিতে গিয়েছিল। হ্যাঁ, সঙ্গতভাবেই তার কাছে
অদ্ভুত এবং নিন্দনীয় বলে মনে হয়েছিল হিংসাকে আবাহনের জন্য এই অহিংসার দূতের
অর্চনা। কবি লিখেছিলেন...
‘হত-আহতের গনি সংখ্যা
তালে তালে মন্দ্রিত হবে
জয়ডঙ্কা।
নারীর শিশুর যত
কাটা-ছেঁড়া অঙ্গ
জাগাবে অট্টহাসে পৈশাচী
রঙ্গ,
মিথ্যায় কলুষিবে জনতার
বিশ্বাস,
বিষবাষ্পের বাণে রোধি
দিবে নিশ্বাস —
মুষ্টি উঁচায়ে তাই চলে
বুদ্ধেরে নিতে নিজ দলে ।
তূরী ভেরি বেজে ওঠে রোষে
গরোগরো,
ধরাতল কেঁপে ওঠে ত্রাসে
থরোথরো।’
...
আসলে আমরা সর্বদা আমাদের
নিজস্ব বিশ্বাস, ভাবনা, অভিব্যক্তি সবকিছুর প্রতিফলন দেখতে চাই এবং প্রকারান্তরে
সমর্থন আদায় করে নিতে চাই আমাদের প্রিয় মানুষ এবং আরাধ্য দেবতার থেকে। মাঝেমধ্যেই
বুঝে উঠতে চাইনা যে, সে কাজে হয়তো সেই মানুষটির বিশেষ সায় নেই, আগ্রহও নেই। সমর্থন দূরে থাক, আপত্তিও থাকতে পারে। তবুও যেন
আমরা নিজের দল ভারি করতে চাই ওজনদার মানুষকে দলে টেনে নিয়ে।
এখন এই মুহূর্তে হয়তো
সেটাই ঘটে চলেছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও। সবাই নিজের নিজের ভাবনা প্রকাশ করবার জন্য
তারই লেখাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। বিপদ সেখানেই। কখনো বা সম্পূর্ণ প্রসঙ্গের
অবতারণা ছাড়াই খণ্ড খণ্ড ভাবে তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে আশ্রয় হিসেবে নয়, ঢাল
হিসেবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তিনি বেঁচে থাকতে, প্রাণ থাকতে কোনওদিন চরমপন্থী
মৌলবাদকে সমর্থন করতেন
না। কিন্তু এমনটি হলে আশ্চর্য হব না, যদি দেখি আজ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, মানুষ
ক্ষুদ্রস্বার্থের জন্য তার বাণীকে ব্যবহার করছে। পরাধীন ভারতবর্ষে স্বাধীনতা
আন্দোলনের চরমপন্থী হিংসাশ্রয়ী ভাবনার
ধারাটির বিশেষ বিরোধিতা তিনি বার বার করেছেন। সে লড়াই বিদেশী শাসনের হাত থেকে
দেশকে মুক্ত করবার লড়াই ছিল, তা সত্ত্বেও তিনি সর্বান্তকরণে সমর্থন করেননি। আজ
দেখি ক্ষুদ্রস্বার্থে দেশেরই মানুষ নিজেদের মধ্যে কখনো রাজনৈতিক অথবা সাম্প্রদায়িক
লড়াইয়ে মত্ত, বাধে না এতটুকু একে অপরের প্রাণ নিতে; যে মুখের কথায় তারা হিংসায়
ইন্ধন দেয়, সেই একই মুখে তারা রবীন্দ্রনাথের বাণী আউড়ে ফেরে। জানতে ইচ্ছে হয়,
একালে জন্মালে রবীন্দ্রনাথের দশা কী হত!
অবশ্য তার জীবদ্দশাতেও যে
আপামর বাঙ্গালী তাঁকে চিনতে পেরেছিল এমন নয়। প্রতিপক্ষ প্রবল ইংরেজ হলেও যেকোনো রকম হিংসার এবং
যুদ্ধের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে ছিল তার অবস্থান। বারবার মানুষ তাঁকে ভুল বুঝেছিল সেকালেও। কিন্তু তিনি
দমে না গিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন যে স্বাধীনতা কিংবা
স্বরাজ বিষয়ে আমজনতার ভাবনার মধ্যে গলদ ঠিক কোন জায়গায়। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা যখন বলি স্বাধীনতা চাই, তখন কী চাই সেটা ভেবে
দেখা চাই। মানুষ যেখানে সম্পূর্ণ একলা
সেইখানে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। সেখানে তার
কারো সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ নেই, কারো কাছে কোনো দায়িত্ব নেই,
কারো প্রতি কোনো নির্ভর নেই, সেখানে তার
স্বাতন্ত্র্যে লেশমাত্র হস্তক্ষেপ করবার কোনো মানুষই নেই। কিন্তু মানুষ এ
স্বাধীনতা কেবল যে চায় না, তা নয়, পেলে
বিষম দুঃখ বোধ করে।’ তিনি সঠিক জায়গায় ঘা দিয়েছিলেন, এই
“কী চাই” সেই ব্যাপারটা তলিয়ে ভাববার কথা বলে। কারণ, স্বাধীনতা বলতে আমরা ঠিক কি
বুঝি, সেটা সত্যিই বড় ঘোলাটে, বড় ধোঁয়াশার জায়গা। দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা শুধুই
একটি ভূখণ্ডকে বিদেশী শাসনের হাত থেকে মুক্ত করলে যে আসা সম্ভব নয়, সেকথা তার মত
করে ক’জন বুঝেছিল? হয়তো সে সময় ভারতবর্ষ
এক জটিল সন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে চলছিল বলেই তিনি এই ব্যাপার নিয়ে তলিয়ে ভেবেছিলেন। তবে
অনেক ক্ষেত্রেই নামীদামী রাজনৈতিক নেতাদের সাথে মতপার্থক্য ঘটেছিল তার। ‘বিদেশী
বর্জন’ এর উন্মাদনায় গা ভাসিয়ে দেননি বলে কম সমালোচনা সইতে হয়নি। সে সব কথায় কান
না দিয়েই তিনি লিখেছিলেন, ‘আজকাল আমরা এই একটা বুলি ধরেছি, ঘরে যখন আগুন লেগেছে তখন শিক্ষা দীক্ষা সব ফেলে রেখে
সর্বাগ্রে আগুন নেবাতে কোমর বেঁধে দাঁড়ানো চাই; অতএব সকলকেই
চরকায় সুতো কাটতে হবে। আগুন লাগলে আগুন নেবানো চাই এ কথাটা আমার মতো মানুষের কাছেও
দুর্বোধ্য নয়। এর মধ্যে দুরূহ ব্যাপার হচ্ছে কোন্টা আগুন সেইটে স্থির করা,
তারপরে স্থির করতে হবে কোন্টা জল।’
বিভিন্ন সঙ্কটের সময় এভাবেই প্রশ্নের মুখে
দাঁড় করিয়ে দিয়ে হয়ত তিনি বলতে চেয়েছিলেন ‘আগুন’ কে, অর্থাৎ বিপদটাকে ঠিকঠাক চিনে
নেবার কথা। তবে বিপদ চিনে নিয়ে সেখানে জল ঢালাও ভারি বিপদের কাজ। যাকে জল বলে
ভাবছি, কে জানে, জলভাণ্ড বদলে সেখানে কেউ ঘৃতভাণ্ড রেখে দিয়েছে কিনা। সেসময় আপামর
ভারতবাসী একচক্ষু হরিণের মত শুধুই স্বরাজের কথা ভেবেছিল। স্বরাজের সাথে ঘনিয়ে আসা
অন্যান্য বিপদ অর্থাৎ আনুষঙ্গিক আধিব্যাধি নিয়ে একেবারেই ভাবিত ছিল না। কারণ, তারা সম্ভবত বুঝে উঠতে পারেনি যে
ভারতবর্ষ প্রস্তুত ছিল না স্বরাজের জন্য। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, সতর্ক করেছিলেন এবং সমালোচিত হয়েছিলেন, কারণ
বাকিদের মত ছিল যে তিনি সময়ের দাবী অর্থাৎ ‘প্রায়োরিটি’ বুঝতে পারছেন না। আসল ব্যাপারটা
হল, তিনি কোনও সমস্যাকে খণ্ডচিত্রের মত দেখেননি। সত্যদ্রষ্টা দার্শনিকের মত
সমস্যার সমগ্র স্বরূপ বুঝবার চেষ্টা করেছিলেন। হয়তো সেই কারণেই চরমপন্থী এবং
নরমপন্থী সবরকম আন্দোলনের বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের সমস্যাগুলি দূর থেকে দেখতে
পেয়েছিলেন তিনি। দূরে ছিলেন, তাই গোটা চিত্রটি দেখতে পেয়েছিলেন। কাছাকাছি থাকলে
হয়তো বা অন্ধ হয়ে যেতেন। শ্লোগানের চিৎকারে শুনতে পেতেন না অন্তরাত্মার মনের কথা।
তার মত করে কেউ বোঝেনি যে যেন তেন প্রকারেণ প্রতিবাদ করাই মোক্ষ হতে পারেনা যেকোনো
আন্দোলনের। সমস্যার স্বরূপ বুঝেই তিনি লিখেছিলেন, ‘আগুনের জ্বালানি কাঠটা হচ্ছে ধর্মে কর্মে অবুদ্ধির অন্ধতা।’
লিখেছিলেন ,‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে’ ...
তার মতে, দেশকে সর্বব্যাপী
শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা ছিল সমাধানের পথ। প্রকৃত শিক্ষাই একমাত্র পারে সবরকম
হিংসা, ধর্মবিদ্বেষ এবং অন্ধতা দূর করতে। শিক্ষার চটকদারি পাশ্চাত্য অনুকরণ নয়,
অল্প কিছু মানুষকে পাইয়ে দেওয়া শিক্ষা নয়, অন্ধকার ভাসিয়ে দেওয়া আলোর কথা বলে
গিয়েছিলেন তিনি। ভাবতে অবাক লাগে, স্বাধীনতার এত বছর পরেও কি দেশ তাঁকে বুঝতে
পারলো না? তাহলে কেন আজো এ দেশের স্তরে স্তরে এত অন্ধতা? সেই কবে তিনি লিখেছিলেন,
‘দেশকে মুক্তি দিতে গেলে দেশকে শিক্ষা দিতে
হবে, এ কথাটা হঠাৎ এত অতিরিক্ত
মস্ত বলে ঠেকে যে একে আমাদের সমস্যার সমাধান বলে মেনে নিতে মন রাজি হয় না। দেশের মুক্তি কাজটা খুব বড়ো অথচ তার উপায়টা খুব ছোটো হবে, এ কথা প্রত্যাশা করার ভিতরেই
একটা গলদ আছে।’ তিনি এই প্রত্যাশার গলদটা হাতে ধরে চিনিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমরা কি
আদৌ কোনও দিন চিনতে পারবো?
(চলবে)
যত পড়ছি, সমৃদ্ধ হচ্ছি...
ReplyDeleteসুন্দর মূল্যায়ন
ReplyDelete