Wednesday, May 24, 2017

ধারাবাহিক / স্বপ্নস্বরূপ - ৬ / ন ন্দি নী সে ন গু প্ত




কিছুদিন ধরে আমরা বারে বারে তাকে স্মরণ করছি। হ্যাঁ, বৈশাখ যে কবিকে মনে করবার সময়। আজ বাঙ্গালীর জীবনে কবিপক্ষ এক উৎসবের আকার নিয়েছে। কবির আবির্ভাব এই কঠিন নিদাঘবেলাতেই। অনুরাগীদের মৃদু অনুযোগও আছে সে নিয়ে, যে যদি কবি রম্য অঘ্রাণে জন্মাতেন, হয়ত বা বাঙ্গালী আরও জমকালো উৎসবে পালন করত তার জন্মদিন। কিন্তু বাংলায় বৈশাখের রুদ্র আবহাওয়াকে উপেক্ষা করেও বাঙ্গালী মহাউৎসাহে উদযাপন করে চলেছে কবির জন্মদিন। অবশ্য বৈশাখ যে শুধুই নিদাঘবেলার ক্রুদ্ধ আত্মা, তা নয়। সে মাঝে মাঝে দেখায় তার বিচিত্র রূপ, কালবৈশাখী ঝড়ের মুহূর্তে। যখন ঝড় আসে, তখনো সেই ঝড়ের রূপ বর্ণনা করার জন্য তার ভাষা ধার করা ছাড়া আমাদের উপায় থাকে না। তিনি বলে গিয়েছেন ‘তাপস-নিঃশ্বাসবায়ে আসে ঝড়। সে যেন এক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। ঝড় উড়িয়ে দেবে যা অপ্রয়োজনীয়, প্রথম এই বোধ জেগেছিল তার লেখা পড়েই। যেন সম্পূর্ণ ধ্বংস নয়, ঝড় এসে স্থান করে দেয় নতুনের আগমনের জন্য। আমাদের নাগরিক জীবনে সেভাবে খোলা আকাশের ঝড়ের সেই সন্ন্যাসীর আবির্ভাবের রূপ দেখবার অবকাশ কতটুকু? কিন্তু তার লেখায় যেন আমরা বারে বারে খুঁজে পাই সেই খোলা আকাশ। ‘শালের বনে থেকে থেকে, ঝড় দোলা দেয় হেঁকেহেঁকে... প্রথমে শুনে মনে হয়েছিল ঝড় এভাবে হেঁকে যেতে পারে নাকি? কিন্তু খোলাপ্রান্তরে এমনটিই হয়। মনে হয় যেন কোনও পুরোহিত মন্দ্রস্বরে যজ্ঞের মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছেন। কবি যেন ঝড়ের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন যজ্ঞের সেই হোতাকে। ঝড় শুধুই এক প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, সে এক পরিবর্তনের সূচক । কবি ঝড়কে কোথাও করেছেন নিজের সাথী, বন্ধু। কখনও বা যে পথে তিনি যাচ্ছিলেন, ঝড় এসে ভুলিয়ে দিয়ে তাকে চালিত করে অন্যপথে। কিন্তু প্রবল ঝড়ের গভীর রাত শেষ হয়ে আলোর প্রভাতের ইঙ্গিত থাকে তার সব লেখাতেই।
হ্যাঁ, এই অলীক আলোকরেখার আশাবাদী ইঙ্গিত তাকে করে তুলেছে কালজয়ী কবি। কবি সবসময় স্বপ্ন দেখেন। তাই ঝড়ের ধ্বংসও তার লেখায় নিয়ে আসে সকালের আলোর খবর।
ঝড়ের শেষে তিনি অপেক্ষায় থাকেন সেই চিরপ্রেমিকের...
সকালবেলায় চেয়ে দেখি, দাঁড়িয়ে আছ তুমি একী!
ঘর ভরা মোর শূন্যতারই বুকের ‘পরে।

ঝড়ের শেষে বৃষ্টির ধারা যখন ধৌত করে দিয়েছে প্রকৃতিকে, তখন তার শ্যামল উত্তরীয় নির্মল করে তিনি সাজিয়ে তুলবেন সেই প্রাণবল্লভকে।  কবির স্বপ্নে ঝড় বয়ে নিয়ে আসে অজানার বার্তা,‘অজানাতে করবি গাহন, ঝড় সে পথের হবে বাহন। ... এই কথা সম্ভবত উঠে এসেছিল শুধু স্বপ্ন নয়, তার অনুভবের অন্তস্থল থেকে। ‘জাপান যাত্রী প্রবন্ধে দেখতে পাই সমুদ্রযাত্রাপথে কিরকম বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল কবি যে জাহাজে ভ্রমণ করছিলেন সেই তরীটি। সেই অভিজ্ঞতা তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল,... ‘মানুষের মধ্যে শরীর- মন- প্রাণের চেয়েও বড়ো একটা সত্তা আছে। ঝড়ের আকাশের উপরেও যেমন শান্ত আকাশ, তুফানের সমুদ্রের নীচে যেমন শান্ত সমুদ্র, সেই আকাশ সেই সমুদ্রই যেমন বড়ো, মানুষের অন্তরের গভীরে এবং সমুচ্চে সেইরকম একটি বিরাট শান্ত পুরুষ আছে বিপদ এবং দুঃখের ভিতর দিয়ে তাকিয়ে দেখলে তাকে পাওয়া যায় দুঃখ তার পায়ের তলায়, মৃত্যু তাকে স্পর্শ করে না।' পেয়েছিলেন ঝড়ের রাতের শেষে সেই অমৃতভাণ্ডের সন্ধান, সেই অমৃতের অনুভবেই ব্যক্তিগত দুঃখকষ্ট ঝড়- ঝাপটা সবকিছুকে অতিক্রম করেছিলেন তিনি। তার সৃষ্টির মাঝে রেখে গিয়েছেন সে অমৃতের পরশ, তাই ঝড়ের শেষের শান্তিদূত হয়েই আজো তার ভাষা প্রলেপ দেয় সারা পৃথিবীর অজস্র মানুষের মনে।

2 comments:

  1. খুব ভাল লাগছে এই ধারাবাহিক.........তোমার অনুভূতি র মধ্যে দিইয়ে অনুভব করছি কবিগুরু র আশাবাদী ভাবনাকে।।

    ReplyDelete
  2. সত্যিই রবি ঠাকুর নাহলে কে যে প্রাণের আবেগকে এমন করে ভাষা দিত ! আগের পর্ব গুলো পড়তে হবে ।

    ReplyDelete

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া