শ্রাবণ বিদায় নিয়েছে কিছুদিন
হল। ভাদ্র মানেই কি বিরহ? ‘ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর’... না, এই
পদ রবীন্দ্রনাথের নয়; বিদ্যাপতির। তবে এই পদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের চরিত্র নিখিলেশের এই বিরহী উচ্চারণ শুনে প্রথমে চমকে উঠেছিলাম।
অদ্ভুত এক ঘটনাপ্রবাহের বাঁকে ব্যবহৃত হচ্ছে এই পঙক্তিগুলি। বিশ্ববরেণ্য কবি তিনি;
ইচ্ছে করলেই কি নিজে দুটি প্রাসঙ্গিক পঙক্তি লিখে উপন্যাসে ব্যবহার করতে পারতেন না
সেই কবিতা? সেরকম ত করেছেন আমরা দেখতে পাই ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে। একাধিক কবিতা
নেমে এসেছে উপন্যাসের পাতায়। কিন্তু না; তিনি যে শুধুই কবি নন। তিনি সত্যদ্রষ্টা। চরিত্র
নির্মাণ কিভাবে করবেন, কোন চরিত্রের ভাবনায় কেমন বীজ বুনে দেবেন, এ কথা তার থেকে
ভালো আর কে বা জানে? বিদেশী শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও নিখিলেশের দেশীয় সংস্কার
প্রবল। সে ভারতবর্ষকে আত্মস্থ করতে চেয়েছে স্বদেশী স্বনির্ভরতার মধ্য দিয়ে; বিদেশী
বর্জনের অসহযোগের মধ্য দিয়ে নয়। ভারতবর্ষের আত্মার অনুভব রয়েছে তার চরিত্রের গভীরে।
তাই প্রাচীন কবি বিদ্যাপতির পদ বারম্বার উচ্চারিত হয় উপন্যাসের এই সন্ধিক্ষণে, যখন
নিখিলেশের সঙ্গে বিমলার দুরত্ব প্রকট হয়ে উঠছে। ভরা ভাদ্রের প্লাবনের মাঝে শূন্যতার
হাহাকার জাগিয়ে তোলেন রবীন্দ্রনাথ আদি কবির পদ আশ্রয় করে।
রবীন্দ্রনাথের বিশেষ প্রিয় ছিল এই পদটি। দেখতে পাই ‘জীবনস্মৃতি’ তে কবি
লিখছেন... ‘আমার গঙ্গাতীরের সেই সুন্দর দিনগুলি গঙ্গার
জলে উৎসর্গ-করা পূর্ণবিকশিত পদ্মফুলের মতো একটি একটি করিয়া ভাসিয়া যাইতে লাগিল। কখনো
বা ঘনঘোর বর্ষার দিনে হারমোনিয়াম-যন্ত্র-যোগে বিদ্যাপতির ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর’ পদটিকে
মনের মতো সুর বসাইয়া বর্ষার রাগিণী গাহিতে গাহিতে বৃষ্টিপাতমুখরিত জলধারাচ্ছন্ন মধ্যাহ্ন
খ্যাপার মতো কাটাইয়া দিতাম; কখনো বা সূর্যাস্তের সময় আমরা নৌকা লইয়া বাহির হইয়া পড়িতাম—
জ্যোতিদাদা বেহালা বাজাইতেন, আমি গান গাহিতাম;’ এই সময়ে কবি তার জ্যোতিদাদার সঙ্গে চন্দননগরে কিছুদিন ছিলেন গঙ্গার ধারের একটি
বাগানবাড়িতে। সময়কাল ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ। অসাধারণ এক সুরসঞ্চার করেছিলেন কবি এই পদটিতে।
বিরহের এই পদ যেন এক অন্য মাত্রা পেয়েছে এই গানে। ‘দেশ’ রাগের আশ্রয়ে বর্ষা
এবং বিরহ মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে এই সঙ্গীতে। বিদ্যাপতি নিজেও কি জানতেন যে প্রায় সাড়ে
তিনশ বছর পরে এক কবি তার এই পদে সুর দিয়ে এটি একটি গানে রূপান্তরিত করবেন? প্রবল বারিপাতের
মাঝে অসীম তৃষ্ণা- ‘ফাটি যাওত ছাতিয়া’, এই হাহাকারকে সঙ্গীতে পরিণত করে তিনি বুঝিয়ে
দিয়েছিলেন প্রবল দুঃখের আঁধারের মাঝখান থেকেই উত্থিত হয় মধুর সঙ্গীত।
তবে কি কেবল বিরহ আর দুঃখের আঁধারের স্মৃতি কবির ভাদ্রমাসে?
না, এতখানি একপেশে হলে আর তাকে ‘বিশ্বকবি’ বলি কেন? উচ্ছ্বাস নিয়ে আসে তার পঙক্তি,
যখন সঙ্গীতে বেজে ওঠে ‘রিমিকি ঝিমিকি ঝরে ভাদরের ধারা’। ভাদ্র রেখে যায় এক অনির্বচনীয়
আবেশ, কবি উচ্চারণ করেন, ‘মনে মনে ভাবি এসেছিল সে কে!’
শিশুপাঠ্য কবিতায় দেখি ভাদ্রমাসের আনন্দ। শুধুই কি
‘পাগলা বাঁদর’ এর সাথে অন্ত্যমিল টানার জন্য কবিতায় তিনি ‘পয়লা ভাদর’ এর অবতারণা করেছেন?
মনে হয় না। বর্ষা ঋতু শেষ হয়ে যাবার পরে শরতের আগমনের এই সন্ধিক্ষণের মুহূর্তগুলিই
যেন ঝনঝনিয়ে বেজে ওঠে তার ছড়ার প্রতি ছত্রে। চিঁড়ে কোটার গল্প আসে, আসে ইলিশের ডিমভাজার
গন্ধ। জীবনযাপনের রঙরস খেলাচ্ছলে এভাবেই তিনি লুকিয়ে রাখেন এক শিশুপাঠ্য কবিতায়। এই
সন্ধিক্ষণের উপলব্ধি বারে বারে মূর্ত হয়ে উঠেছে তার অজস্র সঙ্গীতে...
‘আজ শরতের ছায়ানটে
মোর রাগিণীর মিলন ঘটে
সেই মিলনের তালে তালে বাজায় সে কঙ্কণ।’
তোমার এই লেখা পড়ে মন ভরে যায় ।
ReplyDelete