Thursday, May 24, 2018

রবীন্দ্রশ্রদ্ধা / আমাদের রবিঠাকুর / অরুণ চট্টোপাধ্যায়



মহামতি সেক্সপিয়ার বলেছিলেন, ‘নামে কি আসে যায়!’ কিন্তু আমার মনে হয় নামেও কিছু আসে যায়। নাম অনেক কিছুর সাক্ষ্য বহন করে। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, দর্শন, রাজনীতি, সমাজনীতি, লোকাচার অনেক কিছু বহন করতে পারে একটা নাম। এমন কি নাম থেকে খুঁজে তার ধাম অর্থাৎ অস্তিত্ব আর উৎস খুঁজে বার অসম্ভব কোন কাজ নয়।
এ ছাড়াও নামের সঙ্গে হৃদয়ের একটা যোগাযোগ আছে এটা তো অস্বীকার করা যায় না। দেড়শ বছর আগে ২৫শে বৈশাখের কোনও এক পুন্য মুহূর্তে কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়িতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঔরসে সারদা দেবীর কোল আলো করে ভবিষ্যতের ‘বিশ্বকবির’ একটা পোশাকী নাম দেওয়া হয়েছিল নামকরণের রীতি মেনেই। বছরের সব দিন জগতে অরুণালোকে উদ্ভাসিত হবার পূর্বেই উচ্চারণযোগ্য সেই নাম হল ‘শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।‘
বাল্যকালের ছটফটে অথচ ভাবুক প্রকৃতির এই ছেলেটির জীবনরথ যতই গড়াতে লাগল বয়ঃপ্রাপ্তির পথ ধরে, ততই তাঁর প্রতিভার কিরণ ছড়িয়ে পড়তে লাগল দিক থেকে দিগন্তরে। আর সে কিরণ হতে লাগল প্রখর থেকে প্রখরতর। অবশেষে শুধু বাংলা নয়, শুধু ভারত নয় –সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল সে আলোকদীপ্তি। বিশ্ব চিনল রবীন্দ্রনাথকে, চিনল বৃটিশের পদানত তথাকথিত তদানীন্তন ‘নেটিভ’দের দেশ ভারতবর্ষকেও।   
ফল যেমন গাছের পরিচয় বহন করে তেমনি সন্তান বহন করে মাতার পরিচয়। গৌরবান্বিত সন্তান ধারণ করে ধন্য হন, গরবিনী হন, সুপরিচিতা হন মাতাও। সুসন্তান রবীন্দ্রনাথকে ধারণ, পালন ও রক্ষণ করে গরবিনী দেশমাতৃকা আমাদের এই ভারতবর্ষ বিশ্বের কাছে নতুন করে পরিচিতা হলেন। সারা বিশ্ব হাঁ করে তাকিয়ে রইল মহান এই ভারতবর্ষের দিকে। পরিচিতির এক নতুন পাঠ গ্রহণ করল যেন তারা।
কবি রবীন্দ্রনাথ হলেন মহাকবি, বিশ্বকবি, কবিগুরু। কী নামে যে ডাকবে এই প্রতিভাটিকে তা যেন তারা ভেবেই পাচ্ছিল না। কিন্তু বাঙ্গালীর অন্তর এক মুহূর্ত দেরি করে নি সঠিক নামটিকে চয়ন করতে। সারা বাঙ্গালী তাদের হৃদয় দিয়ে ডেকে উঠল ‘রবিঠাকুর’ এই ছোট্ট, মিষ্টি, আদরের, শ্রদ্ধার আর সম্মানের নামে।
আজ আমাদের ‘রবিঠাকুর’ শুধুমাত্র তাঁর সৃষ্ট কাব্য, গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সমালোচনা, আলোচনা আর নাটকের ক্ষুদ্র পরিসরে আবদ্ধ নন। তা ছাড়িয়ে ঢুকে গেছেন প্রত্যেক বাঙ্গালীর অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে। আবেগ আর যুক্তিবোধের রস গাঢ় হয়ে সযত্নে সঞ্চিত হয়েছে আমাদের হৃদয়ে। আজ বাঙ্গালী রবীন্দ্র অন্ত প্রাণ।
রবীন্দ্রনাথের জীবনকাহিনী অনেকেরই জানা। আর এই দেড়শ বছরের সুদীর্ঘ পরিসরে কারোর যদি জানা না হয়ে থাকে তো সে দুর্ভাগ্য আমাদের। সেই দুর্ভাগ্যকে উপেক্ষা করে আমরা ঢুকে যাব তাঁর অন্তরে আর তাঁর সাহিত্যের অন্দরে। কিন্তু আকারের দিক থেকে সেই ক্ষেত্রটি এতই বিশাল যে, সেখানে আমাদের বিচরণ শুধু সময় সাপেক্ষই নয়, শ্রম-সাপেক্ষ, ধৈর্য সাপেক্ষ আর মনন সাপেক্ষ তো বটেই। এমন কী কোনও একজনের পক্ষে সারা জীবনেও তা সম্ভব না হওয়ারই সম্ভাবনা।
জনপ্রিয়তার নিরিখে প্রথমেই নাম করা যেতে পারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের। নিজের গানে নিজে সুর দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নির্দিষ্ট গন্ডীতে বেঁধে গিয়েছেন বলে অনেক আধুনিক পন্থী আক্ষেপ করতেন। যেন সময়ের গতিতে সুর যদি সমসাময়িকতার গতি লাভ করে তবেই সঙ্গীত আরও বেশি জনপ্রিয়তা, বেশি প্রাসঙ্গিকতা লাভ করবে। বিশ্বভারতীর খবরদারির ওপর অনেকেই ছিলেন প্রায় খড়্গহস্ত। বিশ্বভারতীর প্রশাসন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে মুক্ত করার আবেদন এসেছে বারবার।
অবশেষে বিশ্বভারতীর কবলমুক্ত হয়ে নতুন সুরে বেশ কিছু গান তো গাওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তা স্থায়িত্ব লাভ করে নি। রবীন্দ্রসঙ্গীত আবার ফিরেছে তার নিজস্ব স্বত্বায়, নিজস্ব রীতিতে, নিজস্ব ঢঙে। এক কথায় তার নিজস্ব ঘরানায়। আর এটা খুশির খবর রবীন্দ্রসঙ্গীত কিন্তু ক্রমেই চড়ছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। মানুষের স্মৃতিতে যদি কিছু থাকে তো তা চলে যেতে পারে বিস্মৃতির আড়ালে। কিন্তু মানুষের হৃদয়ে যদি কিছু থাকে তো তা কি চলে যেতে পারে হৃদয়ের বাইরে?
রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাষা আর ভাব এমনভাবে সমন্বিত যে সর্বসাধারণের অন্তরে তা গেঁথে যায় সহজে। এটা সবাই জানেন যে রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষা বহু ক্ষেত্রেই দ্ব্যর্থব্যঞ্জক। কবিই একমাত্র জানেন তিনি কী ভেবে লিখেছেন। কিন্তু একাধারে বিস্ময় আর আনন্দের এই যে, যে গানের নৈবেদ্য নিবেদন করেছেন দেবতাকে, তা অনায়াসেই পরিবেশন করা যায় সর্বসাধারণকে। কারণ রবীন্দ্রনাথ ছিলেন চিন্তায় ও বিশ্বাসে সার্বজনীন।  তাই তো রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নিজের মনে করে সবাই। মুগ্ধ-বিস্ময়ে কবির নিজের কথাতেই তাই বলতে ইচ্ছে করে, ‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী/ আমি অবাক হয়ে শুনি, শুধু শুনি......’।
আসি রবীন্দ্রকাব্যের কথায়। সংখ্যার বিচারে কত হবে তা আমার সঠিক জানা নেই। আর এই যে ‘জানা নেই’ কথাটা বললাম তাতেই আমার গর্ব। কারণ রবীন্দ্রনাথকে ‘অনেক জানি’ এই কথাটা একটা ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিছু নয়। সঠিক সংখ্যা কেউ জানে কি না জানে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন আছে বলেও আমার মনে হয় না। কারণ বিরাট সংখ্যা দিয়ে যেমন গুণের বিচার হয় না তেমনি সংখ্যার স্বল্পতা দিয়েও ঢাকা যায় না তার গুনকে। অনেকে বলেন quantity আর quality পরস্পর ব্যস্তানুপাতিক। অর্থাৎ একটির বৃদ্ধি বা হ্রাস অন্যটির হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটায়। নিয়মের পাশে যেমন বাস করে ব্যতিক্রম তবে রবীন্দ্রকাব্যের ক্ষেত্রেও গণিতের এই সূত্র অবশ্যই ব্যতিক্রমের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। অর্থাৎ রবীন্দ্রকাব্যের বিশাল সাগরে সাঁতার কাটতে কাটতেও কখনও একঘেয়েমী আসে না। ক্লান্ত মনে হয় না নিজেকে। মনে হয় যেন সাঁতার কেটেই যাই আর সাঁতার কেটেই যাই। অমৃতসুধা পান করেই যাই আর পান করেই যাই।
রবীন্দ্রকাব্যের সেই স্নিগ্ধ সুশীতল বাতাস ছুঁয়ে যায়নি কার অঙ্গন, ক্ষণমাত্র আন্দোলিত করে নি কার অঞ্চল বা উত্তরীয় সেটা বলা খুব শক্ত। আসলে বাতাস যেমন জগতের কোন স্থানই ফাঁকা রাখতে দেয় না রবীন্দ্রকাব্যও তেমনই। ধনী, দরিদ্র, শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ, সুস্থ, অসুস্থ কার না অন্তরে প্রবেশ করেছে এই কাব্যের ঢেউ। কার না জীবনের প্রতিফলন ঘটেনি এই কাব্যে? এক সময় যারা রবীন্দ্রকবিতা আবৃত্তি করত আড়ালে তাদের অভিহিত হতে হত ‘আঁতেল’ বা ‘এঁতেল’ নামে। ইংরিজি ‘intellectual’ শব্দটির বিদ্রূপাত্মক বাংলা প্রতিশব্দ। যত দিন যাচ্ছে ততই উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে সেই অদ্ভুত নামদানের। জনপ্রিয়তা আর আভিজাত্যের বিচারে রবীন্দ্রকাব্য আর রবীন্দ্র-আবৃত্তিকারদের সংখ্যা আর মর্যাদা আজ ক্রমবর্ধমান। পরিচ্ছন্ন আর পরিশীলিত সংস্কৃতি বলতে রবীন্দ্র-বিকল্প খুঁজে পাওয়া ভার। সংস্কৃতির গাম্ভীর্য আর মর্যাদাপূর্ণ আবহাওয়া বজায় রাখতে আমাদের হাতে রবীন্দ্রকাব্য আর রবীন্দ্রসঙ্গীত দুই অমূল্য সম্পদ।  
ছোটগল্প, বড়গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, রসরচনা, ভ্রমণকাহিনী, পত্রসাহিত্য, আলোচনা, সমালোচনা—এই সব কিছু নিয়ে রবীন্দ্রসাহিত্য এক বিশাল ক্ষেত্রে সুসজ্জিত। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের সার্থকতা বিচার করতে গেলে প্রথমেই বিচার করতে হয় তাঁর নিজের নামকরণের সার্থকতা। সূর্য যেমন ঊষা থেকে গোধূলি পর্যন্ত সারা আকাশ পরিভ্রমণ করে বেড়ায়, আলোকে উদ্ভাসিত করে জগতের প্রতিটি কোণ, রবীন্দ্রনাথ তেমনি সারা জীবন ধরে হৃদয়, অন্তর আর মনন দিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন সমগ্র সমাজটায়। ধনীর সুসজ্জিত সুবিশাল অট্টালিকা বা দরিদ্রের পর্ণকুটীর সকল স্থানই রবীন্দ্রসাহিত্যের সযত্ন ও সাদর পদক্ষেপে ধন্য হয়েছে এ কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
মানুষ দরিদ্র হলেই যে মিথ্যুক হয় না বা প্রত্যেক মানুষ যে অসৎ বা স্বজন পোষণে দুষ্ট হয় না তার জ্বলন্ত উদাহরণ হল ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’ গল্পটি। স্বজন-প্রিয়তার থেকে সততাকেই আপন করেছিল রামকানাই। আপন ছেলেকে জেলে যেতে হয়েছিল তার সত্যনিষ্ঠ সাক্ষ্যে। হয়ত স্বজন পোষণ আর অসাধুতার বাস্তব এই জীবনে এ ঘটনা অত্যন্ত বিরল, তবু এটি আদর্শনিষ্ঠা আর সত্যনিষ্ঠার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই বিন্দুমাত্র।
ধর্ম যে মানুষের সঙ্গে মানুষের সামাজিক মিলনের পক্ষে অন্তরায় হতে পারে না তার উদাহরণ ‘মুসলমানির মেয়ে’ গল্পটি। তাঁর উপন্যাসে স্থান পাওয়া বিষয়ের মধ্যে সমাজ, নারীসত্ত্বা, দারিদ্র, কামনা, বাসনা, বঞ্চনা, ধর্ম, ইতিহাস কি না আছে তা খুঁজে বার করা এক গবেষণা সাপেক্ষ বিষয়।
মাত্র কুড়ি বছর বয়েসে লিখলেন নাটক ‘বাল্মিকী প্রতিভা’। অভিনীত হল তা রঙ্গমঞ্চে আর সাফল্যও পেল। তাঁর নাটকগুলি তিনভাগে বিভক্তঃ গদ্যনাট্য, গীতিনাট্য আর নৃত্যনাট্য। ডাকঘর, গান্ধারীর আবেদন, শাপমোচন, রক্তকরবী, চিত্রাঙ্গদা, কর্ণ-কুন্তী সংবাদ, বিসর্জন আরও বহু নাটকের নাম প্রতিটি বাঙ্গালীর প্রায় মুখস্থ।  
চার দেওয়ালে ঘেরা রুদ্ধশ্বাস পরিসরে কড়া শাসনের আবহে যে শিক্ষা প্রচলিত ছিল ইতিপূর্বে, তা চিরকাল অস্বীকার করেছেন রবীন্দ্রনাথ। নিজে কোনোদিন বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ের ছায়া মাড়ান নি। কিন্তু শিক্ষা যে সভ্যতার অন্যতম মুখ্য বাহন আর তাই আবশ্যিক এটাকেও অস্বীকার করেন নি কখনও। তাই তিনি চলে গেলেন সুদূর বোলপুরে। যেখানে উন্মুক্ত প্রকৃতি মানুষের মনের সঙ্গে নিয়ত খেলা করে চলেছে। স্থাপন করে চলেছে এক মধুর আর হার্দিক সম্পর্ক। মৃদুমন্দ বাতাস, গাছের শীতল ছায়া, দিগন্ত বেষ্টিত অর্ধবর্তুলাকার নীলাম্বর যেখানে মানুষের সঙ্গে কথা বলে, সেখানে মুক্ত আবহে গাছের নীচে বসালেন শিক্ষালয়। ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে স্থাপিত হল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এক মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। আজ সারা বিশ্বে যার খ্যাতি ক্রম প্রসার্যমাণ।
১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলী রচনা আর ইংরাজীতে অনুবাদের জন্যে এল বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি নোবেল পুরষ্কার। যদিও পদকটি দুর্ভাগ্যবশত চুরি হয়ে গেছে কিন্তু স্বীকৃতিটি নয়। পদক থাকে সিন্দুকে রক্ষিত আর স্বীকৃতি থাকে হৃদয়ে রক্ষিত যেখানে হাত দেবার কোনও সামর্থ চোরের নেই।
রবীন্দ্রসাহিত্য এত বিশাল যে তা এই স্বল্প পরিসর ব্যাখ্যা করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। তবে তাঁর সাহিত্যের একটা দিক অনুল্লেখিত থাকাটা নিতান্তই অনুচিত। তা হল তাঁর লেখা বিখ্যাত পত্র-সাহিত্য। অন্যকে লেখা সংবাদ আদান-প্রদানের মাধ্যম নিছক একটা পত্রও যে রসোত্তীর্ণ হয়ে সাহিত্যের মর্যাদা পেতে পারে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ব্যক্তিকে লেখা রবীন্দ্রনাথের পত্রগুচ্ছ তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। সংখ্যাতেও তারা প্রশংসনীয় ভাবেই বিপুল। তাঁর জন্মশতবর্ষ অর্থাৎ ১৯৬১ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলীর একাদশ খন্ডের ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে ২৫২টি এমন সাহিত্যরস পুষ্ট পত্র লিপিবদ্ধ হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ যে একজন ভাল চিত্রশিল্পী ছিলেন সেকথা হয়ত আমরা বেশি লোকে জানি না। বা খোঁজ রাখার চেষ্টা করি না। অঙ্কনশিল্পে যথার্থ পারদর্শী রবীন্দ্রনাথ তাঁর ষাট বছর বয়েসে ইউরোপের প্যারিসে নিজের আঁকা ছবির প্রদর্শনী করেছিলেন সর্বপ্রথম। পরাধীন ভারতের এই বহুমুখী প্রতিভাধরের প্রতিভার আর একটির উপস্থাপনায় সারা বিশ্ব মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল এ বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না।
কবি-সাহিত্যিকদের অন্তর সর্বদাই মানবিকতায় পূর্ণ থাকে এটা বলাই বাহুল্য। তাঁদের মুখ কম কথা বলে। লেখনী কথা বলে বেশী। লেখনী যে কথা বলতে পারে না তা বলে কাব্য-সাহিত্যের ভাব, ব্যঞ্জনা আর উপস্থাপনা কৌশল। তাঁরা প্রকাশ্যে হয়ত মানুষের দুঃখে কাঁদেন না, হয়ত হন না প্রকাশ্যে সরবও। তাঁরা না কাঁদলেও কাঁদে তাঁদের কলম। ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে তীব্র যন্ত্রণার অভিব্যক্তি। প্রতিবাদের শব্দগুলোকেও তীক্ষ্ণ অস্ত্রের মত সুসজ্জিত করেন।
তাই ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগে নিরীহ নিরস্ত্র শত শত মানুষ যখন উত্তপ্ত বৃটিশ-বুলেটের অগ্নিচুম্বনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, সুদূর এই বাংলায় বসে আমাদের প্রিয় রবিঠাকুর স্থির থাকতে পারেন নি। ১৯১৫ সালে ইংরেজ শাসকের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ঘৃণাভরে ফিরিয়ে দিলেন বৃটিশ বাঘের কোলের ওপর। যে নাইট উপাধি ছিল এক বিশাল সম্মান সারা পৃথিবীর বুকে, তাকে একটা ছেঁড়া কাগজের মত হেলায় ছুঁড়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ যেন আমাদের কাছে এক অবিশ্বাস্য গল্প বা কল্পকাহিনীর মত মনে হয়। সেই সঙ্গে গর্বে বুক ভরে ওঠে। এই গর্ব শুধু তাঁর জন্য নয়। এই গর্ব সমগ্র বাঙ্গালী সমাজের জন্য। এই গর্ব সমগ্র বাংলার জন্য। এই গর্ব সমগ্র ভারতের জন্য।  
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। প্রবল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর কলমও। লিখলেন অন্তত ডজন খানেক দেশাত্মবোধক গান। ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার কোলে ঠেকাই মাথা...’, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি...’ ‘বাংলার মাটি বাংলার জল...’, ‘অয়ি ভূবনমনোমোহিনী মা...।‘
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই ‘জন-গন-মন অধিনায়ক...’ গানটি সারা ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুত্থানে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি...’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। একজন বাঙ্গালী কবি বিশ্বের দু দুটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচনাকার এ গর্ব একজন বাঙ্গালী হিসেবে কতখানি আমাদের গর্বিত করতে পারে ভাবা যায় কি?
যুগে যুগে পন্ডিত আর গবেষকেরা রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে চলেছেন তাঁর লেখার মধ্যে, তাঁর কাব্যের ভাষায় আর গানের সুরে। যা তাঁরা পেয়েছেন, তা কিন্তু যা তাঁরা পাননি তার থেকে অনেক কম। তাঁরা খুঁজেই চলেছেন আর খুঁজেই চলবেন। পার হয়ে যাবে যুগের পরে যুগ। শতকের পরে শতক। রবীন্দ্রসৃষ্টি প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না এতটুকু। অনুজ্জ্বল হবে না এতটুকু। আমাদের হৃদয়ের গাঁথা শেকড়ের বিস্তার শুধু বাড়তেই থাকবে। রবীন্দ্রবিশ্বাসের গভীরতায় হারাতেই থাকবে।   


1 comment:

  1. কি সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী প্রতিভা !!!

    ReplyDelete

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া