শত চেষ্টা করে যখন একটা কাঠও
জোগাড় করা গেল না , তখন নদীর চরে গর্ত খুঁড়ে অভাগীকে শোয়ানো হল । যে খড়ের আঁটি জ্বেলে
কাঙালি মায়ের মুখে আগুন দিয়েছিল, তার থেকেই কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছিল উপরে । গায়ে
হাত দিয়ে বসে , সে দিকেই তাকিয়ে ছিল কাঙালি । রসিক এসে পিঠে হাত রাখলো তার । কিছুটা
ঘৃণাভরে নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো কাঙালি । মৃত মায়ের কথা মনে পড়তেই চোখ দিয়ে জল
গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোটা । অব্যক্ত এক প্রতিশোধ স্পৃহায় চোখ জ্বালা করতে লাগলো তার । রসিকের
হাতটা সরিয়ে চোখ মুছে সামনের আম বাগানের দিকে দিল ছুট । আজ সারাদিন মায়ের কথাই ভেবেছে
সে । মা’র সঙ্গে ‘সগ্যে’ গেলেই মনে হয় ভালো হত । জল আর বাতাসা খেয়েই না হয় থাকতো ।
তবু তো মা’র পাশে শুয়ে রূপকথার গল্প শোনা যেতো । এর জন্য মা’র ওপর তার একটু অভিমানও
হল যেন । মা কি তাকে নিয়ে যেতে পারতো না ? মা ছাড়া তো তার এই পৃথিবীতে কেউ নেই ! সে
এখন কার কাছে থাকবে ? কোথায় থাকবে ? কে তাকে আদর করে ডাকবে ----‘কাঙালি , আয় বাবা,
আমার কাছে আয় । পান্তাভাত নুন লংকা দিয়ে মেখেছি , দুটো খেয়ে নে ।‘ মা বলতো, ‘ কাঙালি,
তুই বড় হয়ে আমার সব আশা মিটাবি ,বাবা। তোর বাবা তো আমার কথা কোনও দিন ভাবলোও না । আর
আমার যা কপাল ! কোনও দিন সুখের মুখ দেখবো বলে মনে হয় না !কাঙালি তখন মায়ের কথা
কেড়ে নিয়ে বলতো, ‘ তুমি চুপ করো না মা , আমি তো আছি !’ মা’কে হারিয়ে মন ভারাক্রান্ত
কাঙালির । তবু বাবার সামনে দাঁড়িয়ে কতগুলো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে তার । কেন
মা থাকতে বাবা আবার বিয়ে করলো ? বাবা হিসেবে তার কোন আব্দারটাই বা সে রেখেছে ? অভাগীর
অকাল মৃত্যু কাঙালিকে বাবা রসিকের কাছে নিয়ে এল বটে , তবে বেশ খানিকটা দূরত্ব রচনা
করেই । একরাশ ঘৃণা ঝরে পড়লো কাঙালির ; বাবা রসিকের উপর, এই সমাজটার উপরেও । যে সমাজ
জাত-পাতের দুয়ো দিয়ে মানুষের শেষ ইচ্ছে নিয়ে পরিহাস করে, কাঙালির ইচ্ছা করে ঘূণধরা
এই সমাজটাকেই জ্বালিয়ে দিতে । আর জন্মদাতা পিতার খুব কাছে গিয়ে বলতে ইচ্ছা করে , ‘
তুমি একটা ঠগ, বুঝলে ? তুমি একতা ঠগ ‘
কাঙালি এখন নরেশ মিত্তিরের চালের আড়তে কাজ করে
। নরেশবাবু লোকটা ভালো । ছেলেটার দুঃখ সহ্য করতে না পেরে নিজের আড়তেই কাজ জুটিয়ে দিয়েছেন
। টিফিন বাবদ রোজ পাঁচ টাকা মিলিয়ে মাসের শেষে কাঙালির হাতে থাকে প্রায় বারো’শ টাকার
মতো । সৎভাই বিশুকে এবার দুর্গা পুজোয় নতুন জামা কিনে দিয়েছে কাঙালি । টাকা জমিয়ে জমিয়ে
একটা নতুন সাইকেলও কিনে ফেলেছে সে । আড়তের কর্মচারী বৃন্দাবনের পুরনো রেডিওটাও এখন
কাঙালির জিম্মায় । বৃন্দাবন কাঙালিকে ছোট ভাইয়ের মতোই দেখে , তাই কম দামে দিয়েছে ওটা
। বৃন্দাবন আরও কিছু দিয়ে একটা টেপরেকর্ডার কিনেছে । রসিক বাড়ি থাকলে রেডিওটা চালিয়ে
গান শোনে , শোনায় বিশুর মা’কেও । রসিকের সংসারে কাঙালির এখন খুব কদর । কিছুদিন ধরে
শুধু রসিক নয় , কাঙালির সৎ মা ও ভাইও তাকে বেশ সুনজরে দেখছে । কাঙালির বুঝতে দেরি হয়
না , এর কারণটা কী । তার শুধু মনে হয় , যদি মা বেচে থাকতো কতো আনন্দই না পেতো ! মা
বেঁচে থাকলে তার হাতে নতুন কাপড়ের প্যাকেটটা ধরিয়ে পরনের শতছিন্ন কাপড়টা বদলে আসতে
বলতো কাঙালি । কিন্তু সেতো আর হওয়ার নয় ! মাঝেমধ্যে রসিক যখন তার দ্বিতীয় গিন্নির সঙ্গে
রসিকতায় মেতে ওঠে , তখন কাঙালির খুব মনে পড়ে মায়ের মুখটা । মা’কি দেখতে সেই তেমনই আছে
? কে জানে ! মা কি এখনও তাকে ডাকে ? মা’কে যে সে বড় ভালোবাসে ।
আজ নরেশবাবুর
কাছ থেকে মাসের টাকা হাতে পেয়ে খুশিতে মন ভরে গেল কাঙালির । রাতের দিকে চপ আর জিলিপি
কিনে বাড়ি ফিরলো সে । রসিক আজ কাজে যায়নি । ঝড় বৃষ্টি হলে রঙের কাজ হয় না । বাড়িতেই
ছিল । বেশ আনন্দ করেই জিলিপি চপ খেল চারজনে । একে তো চৈত্রের শেষ , তায় আবার গাছের
পাতাও একটা নড়ছিল না । স্নান করে, চুল আচড়ে ঘরের দাওয়ায় বসে পাখার হাওয়া খাচ্ছিল কাঙালি
। হঠাত তেল উঠে দপ দপ করতে করতে হ্যারিকেনটা গেল নিভে । পাখাটা রেখে হ্যারিকেনটা নিয়ে
বসলো কাঙালি । এমন সময়ই রসিকের চিৎকার শুনে রান্নাঘর থেকে লম্প হাতে বেরিয়ে এল বউ ।
কাঙালিও একছুটে বাইরে । কাঁঠাল গাছটার নিচে শুয়ে ছটফট করছে রসিক । মুখ দিয়ে গ্যাজলা
বেরচ্ছে । দংশনের জায়গাটা দেখেই আঁতকে উঠলো বউ । জাত সাপে কামড়েছে তাকে । সেই রাতেই
কাঙালি ছুটলো নবীন ওঝার বাড়ি । ওঝা এল , ঝাড়ফুক হল । রসিকের জ্ঞান ফিরলো না । শ্মশানে
নিয়ে যাওয়া হল রসিককে । কাঙালি বড় । নিয়মমতো তাকেই মুখাগ্নি করতে হল । এরপর নদীর চরে
গ্ররত খুঁড়ে পুঁতে দেওয়া হল রসিকের দেহটাকে । সতভাই বিশুর কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিল
কাঙালি । হাত জোড় করে প্রণাম করে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঙালি মনে মনে বললো , ‘ মা, বাবাও
দেখো সগ্যে যাচ্ছে , এবার তুমি সুখী হবে ।‘
Sir ei porbo ta porar e66a onek din dhorei 6ilo ...seta ajke purno holo
ReplyDeleteThank you sir.
ধন্যবাদ আপনাকে।
ReplyDeleteধন্যবাদ আপনাকে।
ReplyDelete