Monday, July 24, 2017

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন - গৌতম সেন... কারিগরী সহায়তা --নূপুর বড়ুয়া


সম্পাদকীয় / গৌতম সেন



সম্পাদকীয় –
এখন শ্রাবণ মাস – ভরা বর্ষাকাল। গত কয়েকদিন কলকাতার বুকে মেঘ উজাড় করে দিচ্ছে তার শীতল বারি-বর্ষণ। আমরা প্রখর গ্রীষ্ম দাবদাহের দিনগুলোতে এমনটাই তো চেয়েছিলাম, তাই না!
প্রকৃতি সে বাসনা পূরণ করেছে অকৃপণ হাতে। শীতল করেছে আমাদের তৃষ্ণার্ত দেহ-মন। আসুন আমাদের চিলেকোঠা ওয়েবজিনের জুলাই সংখ্যাকে আজ এই ভরা শ্রাবণকেই উৎসর্গ করি।

প্রতিবারের মত চিলেকোঠা আয়োজন করেছিল মাধ্যমিক/ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সদস্য-সদস্যাদের সফল ছেলেমেয়েদের জন্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। গত ৫ই জুলাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ডঃ ত্রিগুণা সেন অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত হল এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। বিশেষ অতিথি রূপে উপস্থিত ছিলেন অনুভব পত্রিকার সম্মানীয়া সম্পাদিকা শ্রীমতি বিতস্তা ঘোষাল ও বিশিষ্ট তথ্যচিত্র নির্মাতা শ্রী সৌমিত্র ঘোষ দস্তিদার মহাশয়। অনুষ্ঠানের সূচনা হ’ল আমাদের অতি প্রিয় দিদি শ্রীমতি তনুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি সুন্দর গান পরিবেশনের মাধ্যমে। এর পর উপস্থিত সফল ছাত্র-ছাত্রীদের সম্বর্ধিত করা হল এবং বিশেষ অতিথিরা তাদের হাতে তুলে দিলেন দীপ প্রকাশনের পক্ষ থেকে কিছু বই ও মেডেল উপহার স্বরূপ। উপস্থিত দর্শকমন্ডলীর বিপুল করতালি ধ্বনিতে এই ছোট ছোট ছেলেমেয়ের ভবিষ্যত জীবনের প্রতি শুভেচ্ছা ও ভালবাসার স্রোত বয়ে গেল। সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে ছিল এক সর্বাঙ্গসুন্দর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান – মাউথ অরগানে মাতিয়ে দিলেন চিলেকোঠার প্রিয় সদস্য শ্রী সৌমিত্র মুখার্জী এবং সদস্য-সদস্যাবৃন্দের এক বিরাট দল সাফল্যের সাথে পরিবেশন করলেন ‘জীবনের ধারাপাত’ – এক নৃ্ত্যগীতকাব্য সম্বলিত অনুষ্ঠান। তাদের এই সুন্দর পরিবেশন উপস্থিত দর্শকবন্ধুদের মোহিত করে রেখেছিল।
পরিশেষে জানাই চিলেকোঠা ওয়েবজিন আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে সকল সদস্য-সদস্যাদের অশেষ সহযোগীতা করার জন্য, তা নাহলে এই পত্রিকা ফি-মাসে ঠিক সময়মত প্রকাশ করা সম্ভবপর হত না। এই সংখ্যাতেও রয়েছে কবিতা, গল্প-অনুগল্প ও অন্যান্য বিবিধ বিষয় নিয়ে মননশীল লেখা। সদস্য- সদস্যাদের কাছে আবারও অনুরোধ, আপনারা এই পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন স্বাদের রচনাগুলি পড়ুন, মতামত ব্যক্ত করুন। লেখক লেখিকারা যে উৎসাহ পাবেন শুধু তাই নয়, পত্রিকা নিজেও ঋদ্ধ হবে লেখক ও পাঠকের এই মূল্যবান মতামত বিনিময়ের মাধ্যমে।
আজ শেষ করছি। সকলের এ বাদলের মরশুম খুব ভাল কাটুক। মনে মনে প্রার্থনা জানাই এই মরশুমের আপামর বাঙালির প্রিয় খাদ্য প্রাণের ইলিশ তার মহার্ঘতার মসনদ ছেড়ে সাধ্যের নাগালে এসে নামে। ভোজনরসিক বাঙালি মহাসুখে আহার করুন খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা, চোখের সামনে খোলা থাক চিলেকোঠা ওয়েবজিন। সকলকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।

Sunday, July 23, 2017

ধারাবাহিক / স্বপ্নস্বরূপ - ৮ ন ন্দি নী সে ন গু প্ত


‘উস্রি নদীর ঝর্না দেখতে যাব। দিনটা বড়ো বিশ্রী। শুনছ বজ্রের শব্দ? শ্রাবণ মাসের বাদ্‌লা। উস্রিতে বান নেমেছে। জলের স্রোত বড়ো দুরন্ত। অবিশ্রান্ত ছুটে চলেছে।’... রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমেই শিশুদের পরিচয় ঘটছে ‘শ্রাবণ মাসের বাদ্‌লা’র সঙ্গে। কিন্তু এইসময়ে কেজো মানুষদের ভারি অসুবিধে। বাইরে বের হওয়া মুস্কিল। তাই কি শিশুদের র-ফলা শেখাতে গিয়ে সহজপাঠের পাতায় কবিকে ছাপিয়ে একটা বাক্যে শুধুমাত্র বেরিয়ে এসেছিল ভেতরকার কর্মবীর মানুষটি? হ্যাঁ, তিনি স্বীকার করেছেন ‘দিনটা বড়ো বিশ্রী।’  এই শ্রীহীনতার অনুভব বোধহয় শুধুমাত্র র-ফলা শেখানোর আবশ্যিক কারণে নেমে আসেনি। কখনো বা কবিসত্তা অবদমিত থাকে। এখানেও তাই ঘটেছে। কিন্তু পরের বাক্যবিন্যাসেই প্রকাশিত হয় প্রকৃতির রূপবর্ণনা। আসলে শ্রাবণকে হয়ত কবি একই সাথে ভালবাসেন আবার ভয়ও পান। শ্রাবণ যে বেশিরভাগ সময়ে বয়ে নিয়ে আসে বিধ্বংসী প্লাবন, এই আশঙ্কা থেকেই কবি শ্রাবণকে পুরোপুরি  উপভোগ করতে পারছেন না। এখানেই কবির কল্পনাকে ছাপিয়ে অমোঘ সত্য  লেখে এক কালজয়ী সাহিত্যিকের কলম যেখানে শোননদীতে শ্রাবণের বানে শিউনন্দনের ঘর-পরিবার ভেসে যায়। সেই ‘সুধিয়া’ কবিতা শিশুদের জন্য লেখা হলেও তা বাস্তবের মাটি ছুঁয়ে থাকে।
‘সাঁওতাল মেয়ে’র রূপবর্ণনা করতে গিয়েও কবি টেনে আনেন শ্রাবণের মেঘ ও বিদ্যুতের উপমা, যেন শ্রাবণ এক সহজ সুন্দরী হলেও নিজেকে ঢেকে রাখে এক অপরিচয়ের অবগুণ্ঠনে। এই অচেনা শ্রাবণের রহস্য বারে বারে বিম্বিত হয় কবির বিভিন্ন গানে, কবিতায়। ‘শ্রাবণের আমন্ত্রণে’ তাঁর ‘ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে’। কখনও আবার তিনি উচ্চারণ করেন, ‘আজ শ্রাবণের বর্ষণে, আশীর্বাদের স্পর্শ নে’।
‘জীবনস্মৃতি’ তে দেখতে পাই বর্ষাঋতু বাল্যকাল থেকেই কবির মনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে আছে। শিশুমনে ‘সুপ্তির অধিক এক পুলক’ জাগিয়ে তুলছে শ্রাবণের বর্ষণমুখর রাত। কবি বলছেন, ‘মনে পড়ে, ইস্কুলে গিয়াছি; দরমায়-ঘেরা দালানে আমাদের ক্লাস বসিয়াছে; অপরাহ্নে ঘনঘোর মেঘের স্তূপে স্তূপে আকাশ ছাইয়া গিয়াছে; দেখিতে দেখিতে নিবিড় ধারায় বৃষ্টি নামিয়া আসিল; থাকিয়া থাকিয়া দীর্ঘ একটানা মেঘ-ডাকার শব্দ; আকাশটাকে যেন বিদ্যুতের নখ দিয়া এক প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্ত পর্যন্ত কোন্‌ পাগলি ছিঁড়িয়া ফাড়িয়া ফেলিতেছে; বাতাসের দমকায় দরমার বেড়া ভাঙিয়া পড়িতে চায়; অন্ধকারে ভালো করিয়া বইয়ের অক্ষর দেখা যায় না— পণ্ডিতমশায় পড়া বন্ধ করিয়া দিয়াছেন; বাহিরের ঝড়-বাদলটার উপরেই ছুটাছুটি-মাতামাতির বরাত দিয়া বদ্ধ ছুটিতে বেঞ্চির উপরে বসিয়া পা দুলাইতে দুলাইতে মনটাকে তেপান্তরের মাঠ পার করিয়া দৌড় করাইতেছি।' 
সেই যে মন তেপান্তরের মাঠ পেরিয়েছিল, সে ত আর ফেরে নি। ভাগ্যিস ফেরে নি। ফিরলে আমরা কবিকে পেতাম না। বর্ষার এই বিশেষত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে কৌতুকপ্রিয় কবি বলেন, ‘বর্ষা-ঋতুটা বিশেষভাবে কবির ঋতু। কেননা কবি গীতার উপদেশকে ছাড়াইয়া গেছে। তাহার কর্মেও অধিকার নাই; ফলেও অধিকার নাই। তাহার কেবলমাত্র অধিকার ছুটিতে; কর্ম হইতে ছুটি, ফল হইতে ছুটি।'
বর্ষার বিদায় সেইকারণে সঞ্চার করে এক বিষাদ। অবশ্যম্ভাবী জেনেও কি কবি তাকে আঁকড়ে ধরতে চান? আর কোনও ঋতুকে এভাবে আরও কিছুদিন থেকে যাবার আকুতি জানিয়ে বলে ওঠেন না, ‘শ্যামল ছায়া, নাই বা গেলে’। বিরহী উচ্চারণে দিকে দিকে ধ্বনিত হয় বিদায়বার্তা,...
‘শ্রাবণ সে যায় চলে পান্থ ,
কৃশতনু ক্লান্ত ,
উড়ে উড়ে উত্তরী-প্রান্ত
উত্তর-পবনে ।
যূথীগুলি সকরুণ গন্ধে
আজি তারে বন্দে ,
নীপবন মর্মর ছন্দে
জাগে তার স্তবনে...’
             
         


কবিতা / অপহৃত / অনুপম দাশশর্মা



যান্ত্রিক তপোবনে প্রতিটি নাগরিক জানে
সভ্য পৃথিবী আসলে ডিজিটাল অরণ্য
একটা প্রচন্ড উত্তপ্ত ইস্পাতের রড
ভাঙ্গছে ক্রমাগত
টুকরো টুকরো হয়ে মিশে যাচ্ছে
মন-মজ্জায়, আর স্নায়ুর সবুজ রং হচ্ছে
বিবর্ণ প্রতিদিন

দিনশেষে সন্ধ্যের নরম ছোঁয়া পড়তে
চোখ বেয়ে নেমে আসে যন্ত্রসুখের
স্তিমিত খোলস

ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটলে দু'পায়ের তলায়
জেগে ওঠে কান্নার রোল
কংক্রিটের ফুটপাথের নীচে শোয়ানো আছে
অজস্র বৃক্ষের নিষ্পাপ হাড়গোড় ।

কবিতা / বৃষ্টি- ভালবাসা তোমাকে / গৌতম সেন



সেদিন ছিল অঝোরধারে বৃষ্টি,
বরষা ঝরণা হয়েছিল
আলোআঁধারি পাহাড়ের গায়ে -
একদল মানুষ সদলবলে ছাতার পতাকা তুলে
কোন এক অনন্য সৃষ্টি সুখে,
জলে ভেজা দৃষ্টি দিয়েছিল মেলে
অন্য সব কিছু ভুলে।

একটু দূরে
পাহাড়ের অদৃশ্য আবডালে
ছাতাশূন্য মাথা নিয়ে আপন খেয়ালে

ভিজে একশা দুটো প্রাণ,
সোঁদা বাতাসের ঘ্রাণ নিতে নিতে
ভালবেসেছিল বৃষ্টিকে,
জোলো হাওয়ায় তাদের
ইচ্ছেডানার ছিল সে উড়ান।
জমায়েত, ভিড় ছেড়ে নিরালা নিভৃতে
সিক্তসুধা রাগিনীতে বরষা শোনাল তাদের
হৃদি মন্দ্রিত ভালবাসা গান।

ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যপট
বৃষ্টিকে জানাল ভালবাসা -
একদল আনন্দ কলরবে
আর
একজোড়া প্রাণ একান্ত অনুভবে।
                                                                                          

কবিতা / দ্বাররক্ষী, উদ্বাস্ত আর আমি / পিনাকী দত্ত গুপ্ত



আমার ঘরের থেকে নগরের ধোঁয়া দেখা যায়।
আমার ঘরের থেকে দেখা যায় বস্তির ভিড়।
উদ্বাস্তুরা যত সীমানার কাঁটাতার কেটে
দূর থেকে চেয়ে দেখে নগরের উচ্চ-প্রাচীর।

দ্বার-রক্ষীর চোখে রাত্রি অতীত এঁকে যায়...
ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভেসে আসে ধানসিঁড়ি’টির।
মেয়েটা’কে মনে পড়ে ভাঙনের  শীতল হাওয়ায়
মেয়েটাকে  খেয়েছিলো  ব্যারাকের  শ্বাপদের  ভিড়।

রাত হলে টিমটিম লন্ঠনগুলি জ্বলে ওঠে।
ঝিলের জলেতে কিলবিল করে বস্তির ঘুম।
মৃত্যুরা ওঁত পেতে, ধুতুরা ফলের বীষ ঠোঁটে,
কপালে’তে ধুম জ্বর, মাছি ওড়ে, চোখে কুমকুম।

আমার ঘরের থেকে দেখা যায় সাতচল্লিশ,
যদিও আমার জন্ম আরো তিন দশকের পর;
কাঁটাতারে  ক্ষত-বিক্ষত  আজও আমার শরীর,
উদ্বাস্তুর  ভিড়ে  দ্বাররক্ষী  খোঁজে  তাঁর  ঘর;
ভাঙনের  পারে  আমি  খুঁজে  চলি  জন্মান্তর।

গল্প / (সব চরিত্র কাল্পনিক) একপাতা ঘুমের ওষুধ - অরুণ চট্টোপাধ্যায়




দেখে সন্দেহ হবার মতই চেহারাখানা। মাথার উস্কোখুস্কো চুলগুলো বেয়াড়া ভাবে মুখের এদিকে ওদিকে পড়েছে।  চোখগুলো বেশ ফোলা ফোলা আর লাল। জবাফুল কি করমচা এ হিসেব করার মত ধৈর্য দোকানির নেই। যা অবস্থা, কোনোরকমে তাড়ানো গেলে বাঁচা যায় এমনই মনের ভাব।
- স্যর, একপাতা ঘুমের ওষুধ দিন না স্যর। প্লিজ।
ঘুমের ওষুধ? তার মানে tranquilizer? হাইলি রেস্ট্রিক্টেড।  তাও আবার এক আধটা নয়, একেবারে একপাতা। একবার কেস খেয়ে গেলে কি হবে বুঝছ? অতএব ও রাস্তায় পা মাড়াবে কে ভাই? মানে মানে বিদেয় হও মানে সটকে পড়।
প্রেসক্রিপশন দেখাতে পারে নি লোকটা। সুতরাং সকলের ঘাড় ধাক্কা। দোকানীদের কেউ মিউ মিউ করে। কেউ গলাবাজি করে। কেউ চোখ পাকিয়ে বলেছে, উইদাউট প্রেসক্রিপশন তো এ ওষুধ হয় না দাদা। ডাক্তার দেখিয়েছেন তো? প্রেসক্রিপশন দেখান।
- যাব যাব। ওষুধ খেয়ে এ বেলা একটু ঘুমিয়ে ও বেলা যাব ডাক্তারের কাছে। আপনি দাদা না হয় অন্ততঃ একখানা দিন। মাত্র একখানা?
 মোড়ের ও মাথা থেকে এ মাথা পর্যন্ত যে কটা দোকানে ট্রাই করা হল তার সংখ্যাও  নেহাত মন্দ নয়।
- কোথাও পেলাম না স্যর, কেউ দিল না। লোকটার কাকুতি মিনতি সাদিকের দোকানেও অব্যাহত, কত করে ঘুরে মরছি একটা দিন না কাইন্ডলি?
সাদিক দোকানের মালিক। তার কাজ সেলসম্যানদের বিক্রি করা ওষুধগুলোর পেমেন্ট নিয়ে বিল দেওয়া। এখন বিশেষ ভিড় ছিল না দোকানে। পেমেন্টের কাজ নেই তেমন। সামনের খবরের কাগজটায় চোখ বুলোচ্ছিল আর কানে ডটপেনের পেছন দিকটা দিয়ে আরাম করে কানের খোল বার করছিল।
কাগজ পড়বে কি। খবর আর কোথায়? শুধু ধর্ষণ আর ধর্ষণ। গুলি গোলা খুন রাজনীতি। আন্দোলন পথ দুর্ঘটনা এ সব। ধুস জান একেবারে কয়লা হয়ে গেল। এসব যেদিন বন্ধ তো ঝড় বৃষ্টি বন্যা। আর কী যে সব বিদঘুটে খবর মাইরি। যেখানে বন্যা হবার কথা নয় সেখানে বন্যা। আর যেখানে খরা বিগত হাজার বছরে কখনও কেউ ভাবে নি সেখানে খরা।   
 লোকটার কথা-বার্তা বেশ কিছুক্ষন ধরে শুনছিল সাদিক। বিশেষ মন দেয় নি। ও তার কর্মচারীরাই সামলে নেবে। তাই তাদের সঙ্গে একটু রসিকতার লোভ সামলাতে পারছিল না।
কান খুঁটতে খুঁটতে বলল, বুঝলি কালি, এখন দেখছি রাজস্থানে বন্যা হচ্ছে । আর বঙ্গোপসাগরে নাকি যে খরা চলছে তা নাকি বিগত একশ বছরেও হয় নি। এসব যদি সত্যি হয় তো কাগজ আর নিউজ চ্যানেলগুলোর পোয়া বার। ওদের হৈ হৈ কাটতি আর রৈ রৈ টি-আর-পি রোখে কে? জগতটা সব উল্টেপাল্টে যাচ্ছে রে কালি সব উল্টেপাল্টে যাচ্ছে।
-- ওই জন্যেই তো আমার ঘুমের ওষুধটা লাগবে স্যার।
কর্মচারীদের কিছুতেই ম্যানেজ করতে না পেরে লোকটা এতক্ষনে ছুটে এসেছে মালিকের কাছে। একেবারে দৌড়ে এসেছে যেন হাতে চাঁদ বা পরিত্রাতা পেয়েছে।
-  এমন সব ঘটছে বলেই তো আর একটু ঘুমোতে চাই স্যার। একটা পাতা না দেন গোটা কয়েক  ট্যাবলেট অন্তত দিন। লোকটা বলল গড়গড় করে।
একজন কর্মচারীকে ইশারায় কাছে ডেকে নিচু গলায় বললেন, পেট গরম হয়েছে লোকটার বুঝতে পারছ না? জেলুসিল আর হাল্কা কটা সিডেটিভ দিয়ে ছেড়ে দাও।
- এক পাতা দিলেই ভাল হত। লোকটা তবু গাঁইগুই করে।
- কেন এক পাতা পেলে কি করবেন? একটা চোখ কুঁচকে প্রশ্নটা করল সাদিক।
- কি আর করব। একটা স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলে লোকটা বলল, আরও গোটা কুড়ি বছর শান্তিতে একটু ঘুমোতে পারতুম আর কি।
- কু –ড়ি বছর ! এমন একটা হাফ পাগলকে এত কাছ থেকে পেয়ে সবাই যেমন আশ্চর্য তেমনি খুশি। সত্যি পাগলরা এমন কৌতুকের খোরাক জোগাতে পারে যা নামকরা সার্কাসের নামকরা জোকাররাও পারে না। সে ভাবল। আর ভেবেই মনে মনে দম ফাটানো হাসতে লাগল।
--কেন এতদিন ঘুমোতে চান দাদা?
সাদিকের প্রশ্নে লোকটা একটু ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, সত্যি কথা বলব স্যার?
হাসি চেপে রেখে সাদিক বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন না।
--আমি আরও অনেক অনেক বছর বাঁচতে চাই স্যার---
--তা বাঁচুন না মশায়। আপনার বাঁচা আটকায় কে?
--আজকাল আর কী গ্যারান্টি আছে বলুন?  শুধু মারামারি কাটাকাটি আর খুনোখুনি। স্যার আপনার ওষুধের তবু একটা দাম আছে বিনাপয়সায় পাওয়া যায় না। কিন্তু আমার—মানে এই আমাদের অর্থাৎ মানুষদের? সত্যি কথা বলুন তো কোনও দাম আছে? একটা পয়সাও দাম আছে?
খুব উত্তেজিত গলায় কথা বলছিল সে। ওর চোখেমুখে ভয় যেন ঠিকরে পড়ছে। কেন এত ভয় কে জানে। সাদিকের মনে হল লোকটা নির্ঘাত পাগল। পাগলরা নাকি এমন অকারণে ভয় পায়। আবার যেখানে ভয় পাওয়ার সেখানে অকারণে অতিরিক্ত সাহস দেখায়।  
কর্মচারী আর মালিকে চোখাচুখি হল যার মানে হল লোকটাকে এখন ছেড়ো না । ওকে বেশ কিছুক্ষন ‘খদ্দের’ করা যাবে ।
দোকানে ভীড় নেই তেমন। যে অল্প কটা আছে কর্মচারী ঢিমেতালে তাদের ওষুধ সার্ভ করছে। মালিক রসিয়ে আলাপ জুড়েছে। হচ্ছে রাজনীতি, রণনীতি, আবহাওয়া এই সব  আলোচনা ।
- আবহাওয়া পাগলা হয়ে গেছে স্যার একেবারে just  পাগলা । উস্কোখুস্কো পাগলা লোকটার ঝটতি মন্তব্য।
মালিকের মুখে অর্থপূর্ণ গাম্ভীর্য আর চোখের কোণে ইশারা দেখে কর্মচারীরাও মুখ টিপে হাসছে। সত্যি এমন খদ্দের কি হয় বড় একটা।
-- আর শুধু কি আবহাওয়া স্যার? সাগর থেকে পাহাড়—স্বদেশ থেকে বিদেশ কোনটা আর ঠান্ডা বলুন তো? বেঁচে থাকাটা এখন শুধুই যন্ত্রণা। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে কি বেঁচে সুখ থাকে বলুন? ওই জন্যেই তো---আমি একটু ঘুমোতে চাই। এক পাতা দিলে ভাল হত। ওই ক’টা ট্যাবলেটে আর কী হবে বলুন?
লোকটা এবার স্বগতোক্তি করল, ঘুমোতে চাই আবার অন্তত কুড়ি বছর। দুঃসহ জীবনের থেকে কুড়িটা বছর অন্তত কমে যাক।
মেডিসিন সারভ করা হয়ে গেছে। জেলুসিল আর হাল্কা সিডেটিভ। দোকানের মালিকের প্রেস্ক্রিপশন অনুযায়ী একজন কর্মচারী দিয়েছে। সাদিক এবার পেমেন্ট নিয়ে বিল লিখবে। Quantity, দাম, ব্যাচ নম্বর এসব লেখা হয়ে গেছে। এসব হাল্কা ব্যাপারে ক্রেতার নাম কেউ লেখে না। তবু সাদিকের মনে হল নামটা হলে মন্দ হয় না। “খদ্দের”   যখন হয়েছে তখন একটু “নামী” খদ্দের হলে ক্ষতি কি?
- নামটা কি লিখব দাদা?
-আমার নাম স্যার?
হাসিটাকে বাঁকা ঠোঁটের আড়ালে আটকে রেখে সাদিক বলল, তবে কার? আপনি তো কিনছেন?
-  আমার নাম স্যার - লোকটা ইতস্ততঃ করল, নাম - কুড়ি বছরে অনেক কিছু গুলে মেরে দিয়েছি স্যার। কিন্তু এটা তো আমার দেশও নয় মনে হচ্ছে। আচ্ছা স্যর, সারা পৃথিবীটা কি এখন একটা দেশ হয়ে গেছে? দুনিয়া কি সত্যি একটা মুঠির মধ্যে এসে গেছে?
কর্মচারীরা হাসছে। একজন বলল, তাই তো মনে হয় দাদা। একজন শিল্পপতি স্লোগান তুলেছে যখন। সাদিক গম্ভীর। উত্তর দেওয়াটা জরুরী মনে করল না। তোল্লাইটা কর্মচারিরা বেশ ভালই দিচ্ছে। তার শুধু চুপ করে উপভোগ করে যাওয়ার কথা।
- হ্যাঁ, মনে পড়েছে। 
- কি মনে পড়েছে? সাদিক কৌতূহলী। ঠেলায় পড়লে নিজের বাপের নাম অনেকেই নাকি ভুলে যায়। কিন্তু নিজের নাম ভুলে যায় এমন লোক তো এখনও দেখে নি সাদিক। কৌতূহলী হবারই কথা।
- নাম স্যার। মনে পড়েছে মনে পড়েছে। লোকটা প্রবল উৎসাহে বলে উঠল, লিখুন রিপ ভ্যান উইংকল। শুনেছেন কখনও? আপনি লেখাপড়া জানা পন্ডিত লোক স্যর। নিশ্চয় শুনে থাকবেন।
এরপর আবার স্বগতোক্তি, ভেবেছিলুম কুড়ি বছর পর জেগে উঠে এক নতুন পৃথিবীকে দেখব। দেখলুম বটে। তবে মাথা অনেক নিচু করে দেখতে হচ্ছে এই পৃথিবীকে এটাই যা কষ্টের। তলিয়ে গেছে তো অনেকটা। স্পন্ডিলাইটিসের ওষুধ আছে তো স্যার আপনার দোকানে?
সাদিক এবার আর হাসল না। তার মন থেকে সমস্ত হাসি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল নিমেষে।


THE CONCEPT OF JOHARI WINDOW / DURBA MITRA


Let me crack open a bit – a narrow window inside our psyche.
This is one of the theory that I use in my practice of Corporate Training – to facilitate the Communication Skill among the participants of my workshop.
So far, this theory had really helped the people to understand their mental blocks and eventually minimising them to reach a greater height of Self Contentment.
The Johari Window is shown as a four-quadrant grid:-

The four quadrants are:
1. Open Area (Quadrant 1)
This quadrant represents the things that you know about yourself, and the things that others know about you. This includes your behaviour, knowledge, skills, attitudes, and "public" history.


2. Blind Area (Quadrant 2)
This quadrant represents things about you that you aren't aware of, but that are known by others.
3. Hidden Area (Quadrant 3)
This quadrant represents things that you know about yourself, but that others don't know.
4. Unknown Area (Quadrant 4)
This last quadrant represents things that are unknown by you, and are unknown by others.
The End Goal
The ultimate goal of the Johari Window is to enlarge the Open Area, without disclosing information that is too personal. The Open Area is the most important quadrant, as, generally, the more your people know about each other, the more productive, cooperative, and effective they'll be when working together.

The process of enlarging the Open Area quadrant is called "self-disclosure," and it's a give-and-take process that takes place between yourself and the people that you're interacting with.
As you share information, your Open Area expands vertically and your Hidden Area gets smaller. As people in your team provide feedback  to you about what they know or see about you, your Open Area expands horizontally, and your Blind Area gets smaller.
Done well, the process of give and take, sharing, and open communication builds trust within the group.
At first glance, the Johari Window may look like a complex tool, but it's actually very easy to understand with just a little effort. As such, it provides a visual reference that people can use to look at their own character, and it illustrates the importance of sharing, being open, and accepting feedback from others.
People who have a large Open Area are usually very easy to talk to, they communicate honestly and openly with others, and they get along well with a group. People who have a very small Open Area are difficult to talk to, they seem closed off and uncommunicative, and they often don't work well with others, because they're not trusted.
Other people might have a large Blind Area, with many issues that they haven't identified or dealt with yet. However, others can see these issues clearly. These people might have low self-esteem, or they may even have anger issues when working with others.
The importance of feedback in this process can't be overstated. It's only by receiving feedback from others that your Blind Area will be reduced, and your Open Area will be expanded.
Group members should strive to help other team members to expand their Open Area by offering constructive feedback. The size of the Open Area can also be expanded vertically downwards into the Hidden Area, as people disclose information and feelings to the group.
Also, group members can help a person expand their Open Area into the Hidden Area by asking personal questions. Managers and team leaders play a key role here, by teaching team members how to give constructive feedback  to individuals about their own Blind Areas.






কবিতা / গুটিসুটি সুখ/ অজেয় বিক্রম শিবু


আমি তোকে ছুঁয়ে সময় কাটাই
যতো দূরে সব ভুলে, উড়িস তুই
ভালোবাসার সুতোয় বাঁধা নাটাই
 ভালোলাগে সন্ধ্যা রাতের জুঁই।

রাত গভীরে হৃদয়ে ব্যথা বাড়ে
নাড়া দেয় সেই ঝগড়া খুনসুটি
তুই আমার মনের সুখের দ্বারে
অবুঝ আদর আর সুখ গুটিসুটি।

আমি তোকে চিনি জন্ম থেকে
তোকে নিয়ে ঘুরেছি কত মেলায়,
 হেরে গিয়ে ঝগড়া করতিস জেঁকে
 পাড়ার মাঠে গোল্লাছুট খেলায়।

আজকাল আমায় নিয়ে ভাবিস
বাবু টা বখে গিয়ে কখন কী যে করে
পাড়ার মোড়ে বাজায় নাকি শিষ!
শোন বাবু টা সারাক্ষণ তোর জন্যই মরে।


অণু গল্প / বিনিময় / সুজয় চক্রবর্তী


আমার ভাঙা বাড়িটার চিলেকোঠায় ইদানিং চড়াই-এর আনাগোনা হয়েছে খুব। রোজ ওদের সাথে দেখা হওয়ায় সখ্যতা এমন হয়ে গিয়েছে যে, আমি চড়াই-এর ভাষা বুঝি আর ওরাও বোঝে আমার ভাষা।
সেদিন একটা চড়াই বললো, " আমার বাচ্চা দুটো বড়ো হোক তোমার ঘুলঘুলিতে।
আমি বললাম, " ঠিক আছে।"
চড়াই বললো, " বেশি দিন না, ক'দিন পরেই ওরা ডানা মেলতে পারবে।"
আমি বললাম," তোমার যতদিন ইচ্ছে ওদের রাখতে পারো।"
চড়াই বললো, " আমাদের থাকার বিনিময়ে, কিছুই তো দিতে পারবো না; থাকতে দেবে তো? "
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল চড়াই।
আমি বললাম," তোমাদের 'কিচিরমিচির' শব্দটাই আমার নিস্তব্ধ বাড়িটাতে প্রাণের স্পন্দন জাগায়; তা কি জানো ? "

অণু গল্প / ঠিক বিকেল পাঁচটা / উৎসব দত্ত



এর চেয়ে লিভ ইন সম্পর্ক ভালো ছিল। কোন দায় দায়িত্ব বাঁধা ধরা নিয়ম ছিলনা অবাধ স্বাধীনতা। যেমন খুসি থাকো। মাঝখান থেকে হল কি একদিন হঠাৎ রিমা কে বিয়ে করে ফেলল ঋজু। বাড়িতে আপত্তি ছিলনা। বেশ ধুম ধাম করে বিয়ে হল
কিন্তু বিয়ের প্রায় দুবছর যেতে না যেতেই গোল বাঁধল। যে রিমাকে ঋজু ভালোবাসত সেই রিমা আস্তে আস্তে বদলে যেতে থাকল। রিমা বরাবরই একটু জেদি এবং পজেসিভ কিন্তু ভালোবাসায় কোনো খামতি ছিলনা। বিয়ের এই দুবছরে ভালবাসা যেমন ছিল তেমনি হাতাহাতি মারামারি পর্যন্ত হয়েছে। ঝগড়াঝাঁটি তো লেগেই থাকে। তাবলে এরকম সম্পর্ক নিয়ে টানাটানি কোনোদিন হয়নি। ঈশিতার ব্যাপারটা তো রিমা জানতোই। নতুন করে কি আর হওয়ার আছে। ওদের মধ্যে কোনোদিন বন্ধুত্ব ছিলনা, শত্রুতাও ছিলনা
গাড়ি চালাতে চালাতে এই সব কথাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে ঋজুর। কাল রাতে জম্পেশ মদ খেয়েছে। ঘোর যেন এখনও কাটছেনা। দশটার মধ্যে অফিস ঢুকতে হবে গাড়িটা বেশ জোরেই চালাচ্ছে। এক একটা বাঁক এমন ভাবে টার্ন নিচ্ছে যেন এই বুঝি ধাক্কা খাবে। একসপ্তাহ হতে চলল রিমা ওর বাবার বাড়িতে চলে গেছে। যথারীতি ফোন ধরছেনা। এবার একটা ব্যবস্থা করতে হয় কিন্তু ওর বাড়ি যাওয়া সম্ভব নয়
অফিসে ঢুকতেই নতুন মেয়েটা বলে গেলো 'স্যার আজ বিকেলে মিটিং আছে আপনি মনে করিয়ে  দিতে বলেছিলেনকথাটা শুনেই যেন একটা ঘোর কাটলএক্ষুনি কাজের জগতে ঢুকে যেতে হবে। ব্যাগ থেকে জলের বোতল আর মোবাইলটা বের করতেই রিমার মেসেজ 'ঠিক বিকেল পাঁচটায় গাড়ি নিয়ে চলে আসিস,লং ড্রাইভে যাবো

ধারাবাহিক গল্প / দিয়ার ডায়েরী থেকে / পারমিতা চ্যাটার্জী





 অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নাকি একটা সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে হয়,এই কথাটা দিয়া তার মহামান্য স্বামী শ্বশুরের কছে প্রায়শই শুনে আসত, কিন্তু সে কি একতরফা? দিয়া জানত তা্র শ্বশুর এ কথা বলত যাতে তার দুই মেয়ে জামাই, তাদের শ্বশুরবাড়ীর লোকেদের কোন সেবা যত্নের কোন ত্রুটি না থাকে।
এখন দিয়া মাঝে মাঝে একলা জানলার ধারে বসে হাসে। হায় রে ভাগ্য কোথায় সব সম্পর্ক, যে যার ঝোলা গুছিয়ে নিয়েছে, কে মনে রাখে এই বৌদিকে, যে একদিন একটা বিশাল সংসারের তরণী বেয়ে চলেছিল, অথচ সেদিন কিন্তু এই সম্পর্কগুলোকে আপন করে কাছে টেনে নিয়ে চলতে চেয়েছিল, শেষ্ পর্যন্ত পারেনি, সম্পর্কগুলো ধূসর বিবর্ণ হয়ে পড়ে গেছে, কেউ মনে রাখেনি মা বিহীন সংসারে তাদেরই সমবয়সী বৌদি সবাইকে নিয়ে চলছিল একভাবে, কোনদিন কারও কোন ত্রুটি হতে দেয়নি। বাপেরবাড়ীতে নিজের জামাইষষ্ঠী উপেক্ষা করে বছরের পর বছর জামাইষষ্ঠী পালন করে গেছে। বছরের পর বছর গুরুদেবের জন্মোৎসব পালন করে গেছে ।জন্মোৎসব মানে ৩০০ লোক প্রতি বছর খাওয়া দাওয়া করত । শুধু খাওয়া দাওয়া নয় ভোর পাঁচটায় উঠে গুরুদেবের চা করা থেকে আরম্ভ হত , তারপর মেয়েদের স্কুল পাঠাতে না পাঠাতেই শুরু হয়ে যেত কুমারী ভোজনের আয়োজন । কুমারী ভোজন শেষ হয়ে গেলে তার প্রসাদ বিতরন করা, অত লোকের চা- সরবতের ব্যাবস্থা করা ইত্যাদি কত আর লিখব।সবাই সাহায্য করতে এগিয়ে আসত ঠিকই, কিন্তু সংসারটা তো দিয়ার, অনবরত ডাকাডাকি চলত ‘দিয়া এটা কোথায় থাকে ? দিয়া গুরুদেব চান করবেন গরম জলটা দিতে হবে তো ওঁর রান্না হয়েছে তো? হ্যাঁ মূল রান্না ঠাকুর করলেও গুরুদেবেকে যেটা ভোগ ,যা রূপোর থালা করে সাজিয়ে  দেওয়া হত তা দিয়াই রান্না করত আর জন্মদিনের পায়েস রান্না করত বড়ননদ । তাঁর খাওয়া শেষ হলে সেই প্রসাদ দিয়ে অন্যদের খাওয়া শুরু হত। এত বড় কর্মকাণ্ডর আয়োজন বছরের পর বছর ধরে দিয়া একা হাতে করে গেছে। হয়তো উৎসবের দিন তাকে সাহায্য করতে অনেকেই এগিয়ে আসত কিন্তু তার আগে পরের সমস্ত জোগড় তো দিয়াই করত, তার মধ্যে থাকত নিজের দুই শিশু সন্তান এবং তিন শ্বশুরের সমস্ত দায়িত্ব। তার জন্য কেউ তাকে কখনও আহা বলেনি এমনকি দিয়ার স্বামীও না । সে চলত স্রোতের জোয়ারে গা ভাসিয়ে চিরকাল স্ত্রীর কষ্টের মূল্য কোনদিনই দেয়নি তা যদি হত তাহলে হয়তো তাকে ডায়েরী লিখতে বসতে হতনা। যখনই মেয়ে জামাই তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ী এসেছে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে তাদের আদর যত্ন করা, আর আজ যখন দিয়া অসুস্থ হয়ে ঘরের এককোণে বসে থাকে কোনরকমে একবার দেখে গিয়ে সবাই ডিউটি সেরে দেয়, দিয়া এ ডিউটি চায়না , যেখানে কোন প্রাণের টান নেই সেখানে শুধুমাত্র সৌজন্যবোধের তার প্র্য়োজন নেই।
আজ দিয়া বড় একলা ,তার সামনে দিয়ে জীবন নদীটা এখনো বয়ে চলেছে, মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে নোঙর খোঁজে ,তারপর হতাশ হয়ে দেখে চতুর্দিকে শুধু বালি আর কাদা,নোঙর ফেলার কোন জায়গা নেই।
গোধূলি বেলা শেষ হয়ে গিয়ে জীবন লগ্ন এখন রাতের কালো অন্ধকার দিয়ে হাঁটছে, কখনো থামছে ,কখনও মনের জোরে হাল টেনে এগিয়ে চলেছে, পাল হীন নৌকাটাকে। আজ অবসাদ গ্রস্ত মনটা বার বার অতীতের হাত ধরে হাঁটতে চাইছে।
দিয়া সকালে মেয়েকে স্কুলে পাঠাবে বলে ওপরে এসেছে ওকে তৈরী করবে বলে। ছোট মেয়ে খেতে গিয়ে বমি করে,তাও আপ্রাণ চেষ্টা করছে ও যাতে একটু খায়। অনেক বেলায় আসবে, বেশীক্ষণ ধরে মে্যেকে খাওয়াবার অবকাশ সে পেতনা, হয়তো একটু পরেই তার ডাক আসবে। মেয়েকে বকছিল তাড়াতাড়ি খেয়ে নে না, ছোট মেয়েটা তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে বমি করে ফেলল, দিয়ার সমস্ত রাগ ছিল মেয়েদের ওপর, ছোট মেয়েটাকে খুব বকে দিল, ঠিক তার একটু পরেই রান্নার ঠাকুর এসে দাঁড়াল দরজায়,দিয়া মুখ তুলে তাকিয়ে বলল , কি হল?
বৌদি রানাঘাট থেকে সমর জেঠু এসেছে, বাবু নীচে ডাকছে,
বাবুকে বল আসছি আমি টুম্পা বমি করেছে ওকে পরিস্কার করে তারপর নীচে যাচ্ছি।
দিয়া জানে সঙ্গে সঙ্গে সে নীচে নামলনা বলে শ্বশুরের মেজাজ ভারি হবে, কিন্তু সেই বা কি করে। মেয়েটাকে স্কুলে তৈরী করে তো পাঠাতেই হবে, অথচ এই শ্বশুরমশাইয়ের মেয়ের বড়ীতে যখন একবেলার জন্য তার শ্বশুরশাশুড়ী আসত, অমনি তিনি আর মেজজ্যাঠা শ্বশুর বলতে আরম্ভ করতেন, উফ! কি অমানবিক মেয়েটা একলা সব কাজ করে যাচ্ছে এখন কি না এলেই নয়! দিয়ার হাসি পেত, খুব হাসি পেত। মনে হত হায়রে! মানুষ কি স্বার্থপর হতে পারে! আজ মেয়েদের সমবয়সী বাড়ীর বৌমার ওপর যখন নিজের এবং নিজের দুই অবিবাহিত অবুঝ দাদ্‌ নিজের মেয়ে জামাই, ছেলে- নাতিনাতনী, গুরুদেব বাড়ীতে আসা যাওয়া, সমস্ত অতিথি বর্গের ভার,বিনা দ্বিধায় চাপিয়ে দিতে এতোটুকু কুণ্ঠিতবোধ করেন নি। মেয়েটা সারাদিন মরে মরে কাজ করে যেত , এতো সমাজদরদী শ্বশুরমশাইদের কখনও মনে হয়নি ওর নাম করে একটুরো ফল এনে দেয়। বিশেষ করে মেয়েটা যখন অন্তঃসত্বা, তখন একটু তার আলাদা কিছু খাবারের বা বিশ্রামের ব্যাবস্থা করি। না দিয়ার মহামান্য উচ্চস্তরের শ্বশুরমশাইদের একথা কখন মনে হয়নি, উপোরন্তু কোন কাজের ত্রুটি হলে দিয়ার শ্বশুরমশাই বলতেন আমার বাড়ীতে থাকতে হলে আমার মতে চলতে হবে। দিয়া মাঝে মাঝে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে বাবা মায়ের কাছে গিয়ে বলত,” কি করতে যে এই তিনতলা বাড়ি গাড়ী দেখে বিয়ে দিয়েছিলে, প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ দেখে বিয়ে দিতে পারোনি?” দিয়ার বাবা ম্লান হয়ে যেতেন ,”বলতেন বাড়ী গাড়ী দেখে বিয়ে দিইনি মা, বাড়ীর খুব কাছে আর খুব জানাশোনা পরিবার বলে দিয়েছিলাম। কি করে জানব এরকম হবে ?কথা বলতে যখন গিয়েছিলাম তখন তো অন্যরকম ছবি দিয়েছিলেন---।“ এইভাবে তার স্বপ্নমাখা দিনগুলো এক বিশাল তরণী বাইতে বাইতে চলছিল।মাঝে মাঝে মনে হত এ যেন এক অজানা পারাবার, এই পারাবা্রের মধ্যে একটা বিশাল তরী সে একলা বেয়ে চলছে। সে জানে যতক্ষণ সে দিতে পারবে ততক্ষণই ভালো , যে মুহুর্তে সে বলবে ,পারবে না তখনই শ্বশুরের মুখের ছবি অন্য রকম হয়ে যাবে।এইভাবেই ভয় দ্বিধা দ্বন্দে তার দিনগুলি কেটে যাচ্ছিল, আর বলি দিচ্ছিল নিজের সমস্ত স্বপ্নের।
দিয়ার বিয়ে হয়েছিল ১৯৮২ সালে, সেই সময়েও মেয়েদের দিয়ে এরকম জোয়াল টানিয়ে নিত অনেক শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা। বউ হয়ে এসেছ যখন, তখন জোয়াল তো টানতেই হবে, অবশ্যই ব্যাতিক্রম তো আছেই।
ক্রমশঃ


কবিতা / ভাবনার ছানাপোনারা ভেতরপাড়াতে তোলপাড় / প্রজ্ঞা পারমিতা



 
অকারণ, ধুঁকপুঁক  
অবিরাম ।
এক  জীবনে সবাইরে যায় নাকি চেনা ?

প্রশ্রয় ! প্রেমের প্রশ্রয়। 
উষ্ণতার দুটো নগ্ন দেহ থাকে মগ্ন।
মাঝে মাঝেই সমর্পনের ইচ্ছে জাগে।

লন্ডভন্ড এক লহমায়
সমস্ত লজ্জা উবে যায় কর্পূরের মত
নিরাভরণ দেহের উত্তাপে বিলীন হয়।
দুর্বল মুহূর্তে একান্তে অভিলাষ,
নিরালায় দুঃখ বিলাস
স্মৃতিমেদুর হয় শিহরণ ;

সেই জং ধরা টিনের ট্রাঙ্কে এখনো
সব কামনা বাসনা  বন্দী।
প্রেমের বন্যাতে অকপটে দ্বিধাহীন স্বীকারোক্তি ?

 নাভিশ্বাসে
 বাথটাবে
 বর্ণিল প্রজাপতির কোমল ডানাতে
জোনাকির অল্পনাতে
ঝিলের মাছের নৃত্যে
গন্ধরাজের সুবাসে
কৃষ্ণচূড়ার লালিমাতে
আরো অনেক কিছুতেই
আমি ও  খুঁজছি তোমায়।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য।
উম্মুক্ত পা এর পাতাতে স্পর্শে
নীল খাতার পাতায় 
ইতিউতি পড়ে থাকা চুম্বনে 
আকাঙ্ক্ষার চরমে -
গগনচুম্বী কামনারা  চাঙ্গা
পথটা পিচ্ছিল
নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করার দায়বদ্ধতা।
অনেক প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ করা চরম অভিলাষ।


কবিতা / একা / সোমা দে

                        


ঠিক এভাবেই তুমি ফিরে আসো বারবার, 
আর খেয়ালী জলতরঙ্গে
ভেসে ওঠে গদ্যময় সময়।
বাঘবন্দী খেলা ছেড়ে
অস্থির প্রাণ খুঁজে নেয় ,
নিঃশব্দ অরণ্যকে।
বোধহীন কথায় তৈরি হয় আরেক কবিতা!
যেখানে তোমার আমি 
ছড়ি ঘোরায়-একা,
 একেবারে একা!




কবিতা / চ্যালেঞ্জ / বৈশাখী দাস



পথ ছুটেছে পাল্লা দিয়ে,চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে....
..."হারাস আমায়.....!"
হার মানিনি,ছুট-ছুট-ছুট,নোনতা পরত
ক্লান্ত জামায়।
চাতক ঠোঁটে বৃষ্টি চাওয়ার সান্ত্বনাতে
ইলশেগুঁড়ি...
জল খুঁড়েছি,ফোস্কা হাতের বেশ ক'গাছা
গুঁড়িয়ে চুড়ি।
আধফোটা ভাত,নিভিয়ে চুলো,রইল প'ড়ে
খেলনা হেঁশেল,
বিজ্ঞাপনী সাফল্যদের ভার আর ধারে
পিষ্ট বিকেল।
কলম বেয়ে নেমেইছে স্রোত রাত্রিজাগা
হরফগুলোর।
পোক্ত হাতে ভাগ্যলিখন, সাফাই-ঝাড়াই
ময়লাধূলোর।
কাজল মোছা চোখের দোসর আজ পুরু এক
কাঁচ কারাগার,
কালোর ভীড়ে রূপোর তারও সংখ্যালঘু
থাকছে না আর।
পথ ছুটছে আজও একই, রাখছে চ্যালেঞ্জ,
কই আর থামে?
খুঁড়িয়ে তবুও ছুট-ছুট-ছুট, যতক্ষণ না
রাত্রি নামে....


সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া