ডিনারের খালি প্লেটগুলো তুলে, টেবিল পরিস্কার করে, গুড নাইট বলে চলে গেল
ইরফান। দরজাটা লক করতে করতে মিলি বলল "আহা রে বেচারা, এই ঠান্ডাতেও পর্যাপ্ত গরম
জামা নেই, গায়ে কম্বল জড়িয়ে ঘুরছে। পিকুর বয়সীই হবে ছেলেটা। কত কষ্ট করে রোজগার করছে।
আর কিই বা হাতি ঘোড়া মাইনে পায় এই হোটেলে?" ব্ল্যাঙ্কেটের তলায় ঢুকতে ঢুকতে
অর্ক সায় দিল " পুরো রাজ্যটারই খুব বাজে অবস্থা গো। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি
যে স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি কোনো সরকারই এদের কথা ভাবেনি। এদের মধ্যে ক্ষোভ থাকাটাই
স্বাভাবিক। আর ঠিক এই ক্ষোভটারই সুযোগ নেয় আমাদের পড়শী দেশ।"
এখন অফ সিজন বলে অনেকটা শান্তিতে ঘোরাফেরা করা যাচ্ছে। কাশ্মীরের এই নৈস্বর্গিক
রূপ দেখে সত্যিই মনে হয় 'ধর্তি পর জান্নাত' বা 'প্যারাডাইস অন আর্থ" কথাগুলো একেবারে
অবর্থ্য বর্ননা। নয় নয় করে খুব কম পর্যটক ও নেই, তবে চারিদিকে কেমন একটা থমথমে ভাব।
রাস্তায় ঘাটে, অলিতে গলিতে টহল দিচ্ছে সশস্ত্র সেনাবাহিনী। চেকিংয়ের পর চেকিং। এই প্রাকৃতিক
সৌন্দর্য আর স্হানীয় মানুষের সারল্য আর উষ্ণতার মাঝেও মিলির মনে শান্তি নেই। এই আপাত
সহজ সরল মানুষগুলোর মধ্যেই কেউ না কেউ উগ্রপন্থী হয়েছে, হচ্ছে বা হবে। সেনাবাহিনীর
জওয়ানগুলোর ওপরও মায়া হয়। কিরকম ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ওই ভারী ভারী বন্দুকগুলো নিয়ে।
পরিবারের থেকে কত দূরে, প্রতিকূল আবহাওয়ায়। তারপর আবার সর্বক্ষণ জীবনের অনিশ্চয়তা।
মিলির চিরকালই একটু আর্মি আর এয়ার ফোর্সের ওপর দুর্বলতা আছে। খুব শখ ছিল আর্মি বা এয়ার
ফোর্স অফিসার বিয়ে করার। বিয়ের একটা সম্মন্ধ ও এসেছিল একবার। কিন্তু মনে পুলক জাগার
আগেই মা নাকচ করে দিয়েছিল।
ঘুরতে ঘুরতে বেশ খিদে পেয়েছিল। একটা হোটেলে ঢোকা হল খেতে। মোটামোটি ফাঁকাই।
মালিক বছর তিরিশের এক তরুণ। নাম সরফরাজ। যেমন সুদর্শন চেহারা, তেমনি চোস্ত ইংরেজি।
শুনলে অবাক হতে হয়। বলল পর্যটকদের অভাবে ব্যবসা তেমন চলে না। "বাট নো জবস হিয়ার"।
যাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে তারা ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে। কথা বলতে বলতে অনেক চাপা ক্ষোভ
বেরিয়ে এল। ততক্ষণে ওর সঙ্গে যোগ দিয়েছে ওর আরেক বন্ধু রিজওয়ান। তার অত রাখঢাক নেই।
পরিস্কার বলল না আমরা ভারতের সাথে থাকতে চাই, আর না পাকিস্তানের সাথে।
"উই ওয়ান্ট আজাদী"। এখানকার সাধারণ মানুষ কেউ উগ্রপন্থা চায় না। আমরা শুধু
স্বাধীনভাবে আর স্বসন্মানে বাঁচতে চাই। অনেকবছর তো দেখলাম, ভারত সরকার আমাদের
কথা ভাবে না। তাই বলে পাকিস্থানকেও আমরা বিশ্বাস করি না। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলোর মাথা
চিবিয়ে বিপথে চালিত করছে নিজেদের স্বার্থে।
হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে হ্যান্ডিক্র্যাফ্টসের স্টলগুলোয় টুকিটাকি
কিনতে ব্যস্ত মিলি। অর্ক আর পিকু বাইরে ঘোরাফেরা করছে। অর্ক বোঝাচ্ছে ওর ছোটবেলায় দেখা
কাশ্মীরের সঙ্গে আজকের কত তফাত। দোকানগুলো প্রায় ফাঁকা বলেই কথা বলার অঢেল সুযোগ পাচ্ছে
মিলি। নিজে যেচে গায়ে পড়েই কথা বলছে, প্রশ্ন করছে। এই সাধারণ মানুষগুলোর সাথে কথা না
বললে ওর একটা ধারনা থেকে যেত কাশ্মীরি মানেই সবাই বুঝি পাকিস্তানের সমর্থক। এদের সাথে
যত কথা বলছে মিলি তত বুঝতে পারছে এরা কারুরই সমর্থক নয়, উগ্রপন্থার তো নয়ই। মিলির মাথায়
লেখা কিলবিল করছে। টাইটেল ও ভাবা হয়ে গেছে "দা মিসান্ডারস্টুড কাশ্মীর"।
ইরফানের জন্য একটা সোয়েটার কিনেছিল মিলি। দুদিনেই কেমন যেন একটা মায়া
পড়ে গেছে ছেলেটার প্রতি। সে তো কিছুতেই নেবে না। অনেক অনুরোধ করে, বাবা বাছা করে শেষে
তাকে রাজি করানো গেল। ম্যানেজার নেই আর সেই মুহূর্তে কাজও সেরকম কিছু নেই বলে ইরফান
একটু বসল গল্প করতে। একসময় ওদের অবস্থা ভালোই ছিল। ডাল লেকে ওদের হাউস বোট রমরম করে
চলত। নাশকতার লীলা শুরু হওয়ার পর থেকে পর্যটন কমতে শুরু করে আর সেই সঙ্গে ব্যবসাও।
ধার দেনা মেটাতো হাউসবোট বেচে দিতে হয়। এখন সেই হাউসবোটেই অন্যের অধীনে কাজ করে ওর
দাদা ইমরান। এরপর ইরফান যা বলল তার জন্য প্রস্তুত ছিল না মিলি। ভারতীয় সেনাবাহিনী যে
কতটা নির্মম আর পাশবিক হতে পারে ওর কোনো ধারণা ছিল না। স্পেশাল পাওয়ারের নাম করে ,
অনুসন্ধানের জন্য যখন তখন যাকে খুশি তুলে নিয়ে যায়। এরকমই এক রাতে ইরফানের নির্দোষ
বাবাকে তুলে নিয়ে যায়। আজ অবধি ওনার আর খোঁজ পাওয়া যায় নি। এটা কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা
নয়। বিনা প্রমানে তুলে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করাটা এখানে রোজকার ঘটনা।
বুকে ঝোলানো কালো কারের সাথে লাগানো পেন্ডেন্ট টা খুলতেই মিলি আর অর্ক
দুজনেই চোখের জল সামলাতে পারল না। কি অপূর্ব দেখতে মেয়েটিকে। ইরফানের বোন নূর। সত্যি
নূরই বটে। এই ফুলের মত মেয়েটাকে ধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে রেখে গেছিল জওয়ানরা। আজ ও মানসিক
ভারসাম্যহীন। তীব্র ঘৃণায় মিলির মনে হচ্ছিল বমি করে ফেলবে। কারেজ, শিভালরি, অনার সেনাবাহিনীর
এই সব মন্ত্র গুলো তাহলে সব মিথ্যে। তবু এত কিছুর পরেও কাশ্মীর ছেড়ে যেতে চায় না এরা
কেউ। এই ভালোবাসার, এই আবেগের কোনো মূল্য নেই কোনো সরকারের কাছে।
মিলির মনটা কদিন ধরেই কু ডাকছিল। ইরফান তো এল না। এমাসেই তো আসার কথা
ছিল। অনেক কষ্টে রাজি হয়েছিল কাশ্মীর ছাড়তে। ওদের এক ডিলারের আন্ডারে একটা কাজ জুটিয়ে
দিয়েছিল অর্ক। মাইনেও ভালো আর খাটতে পারলে আরো উন্নতির সুযোগ ও ছিল। এলোও না, ফোনে
কোনো খবরও দিল না। কিরকম একটা খটকা লাগছে। ওর সাথে যোগাযোগ ও করা যাচ্ছে না। বুরহান
ওয়ানির মৃত্যুর পর থেকে কাশ্মীর উত্তাল। বড় চিন্তা হচ্ছে ইরফানের জন্য। গত একবছরে কেমন
একটা মায়ার বাঁধন গড়ে উঠেছে ছেলেটার সাথে। মিলির হটাৎ মাথায় এল "আচ্ছা, অভিজিত
কে খবর নিতে বললে হয়না? সাংবাদিকরা তো সব খবর জোগাড় করতে পারে"। অভিজিত
কে ফোন করে জানা গেল পরদিনই ও কাশ্মীর যাচ্ছে কাজে। এর আগেও ও কয়েকবার কাশ্মীর স্টোরি
কভার করেছে। মিডিয়া ছাড়াও ওখানকার স্থানীয় অনেক মানুষজনের সাথেও ওর চেনা পরিচিতি আছে।
ইরফানের খবর বার করা ওর কাছে খুব কঠিন হবে না।
খবরের কাগজ আর টিভির পর্দায় আর চোখ রাখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন চ্যানেলে
প্যানেল বসিয়ে কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে আলোচনা। এই রাজনৈতিক কচকচানি আর সহ্য হচ্ছে না।
দোষটা কাদের? যারা বুরহান ওয়ানির মৃত্যুকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে নাকি প্রশাসনের, যারা
সেনাবাহিনীকে খোলা ছুট দিয়ে রেখেছে মানুষ মারার? এত বিশ্লেষণ করার মত বুদ্ধি মিলির
নেই। ওর মোটা মাথায় শুধু এটুকুই আসে "আচ্ছা, রক্তারক্তি না করে শান্তিপূর্ণভাবে
কি কিছু করা যায় না?" রোজ রোজ এই মৃত্যুর মিছিল আর ভালো লাগছে না। কদিনের মধ্যেই
ফোনটা এল অভিজিতের কাছ থেকে:
- খবর ভালো নয় রে অর্ক। মাইনে পেয়ে বাড়ির জন্য দোকান বাজার করে ফিরছিল
ইরফান। পথে জুলুস আর ইট ছোড়াছুড়ির মধ্যে পড়ে যায়। আর্মির পেলেট গানের গুলিতে ওর দুটো
চোখই নষ্ট হয়ে গেছে।
- আমি আসছি
-পাগলামি করিস না অর্ক। প্রেস কার্ড থাকা সত্ত্বেও আমরাই এখানে নিরাপদ
নই। তুই এসে কি করবি?
- আমি ইরফান কে কলকাতায় নিয়ে আসব, চিকিৎসা করাবো
- কতজনের ভার নিবি তুই? শয়ে শয়ে ইরফান এখানে হাসপাতালে শুয়ে কাতরাচ্ছে
- আমরা প্রত্যেকে যদি একজনকেও...
ফোনটা কেটে দিল অর্ক। কথা বলে নষ্ট করার সময় নেই এখন। টিকিটের জন্য ততক্ষণে
লগ ইন করে ফেলেছে....
মন ছুঁয়ে গেল ।
ReplyDelete