Thursday, August 24, 2017

একটি ছোট গল্প / পিকুর স্বপ্ন /নারায়ণ রায়।




ছোটবেলায় পিকুরা ছিল বেশ গরীব। সাতজনের সংসার বাবার সামান্য বেতনের উপর নির্ভরশীল। সেই সাত বছরের পিকু বাবার সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে দেখত, কি সুন্দর ছোট্ট শহর ! রাস্তার দু'ধারে ছোট ছোট দোকানগুলি কত রকমের রঙ্গীন পসরায় সাজানো। কাচের বয়ামে থরে থরে রাখা সাধারন গুলি লজেন্স, লেবু লজেন্স থেকে শুরু করে রঙ্গীন কাগজে মোড়া চকোলেট। পিকুর খুব ইচ্ছে হ'ত অমন সোনালী রাংতায় মোড়া চকোলেট একটা খেয়ে দেখতে, ওগুলো নিশ্চই খেতে খুবই সুস্বাদু হবে।


সেই সময়ে একটা ভালো চকলেটের দাম বড়জোর আট আনা, কিন্তু চাইলে বাবা বলতেন ওসব খেতে নেই। খেলে পেটের অসুখ হয়, দাঁত পচে যায় ইত্যাদি। পিকু অবাক হয়ে ভাবতো যে জিনিস খেলে পেটের অসুখ হয় কিম্বা দাঁত পচে যায়, সে জিনিস দোকানদাররা বিক্রি করে কেন? আবার ঐ দোকান থেকেই তো বাবা তেল মশলা ডাল কেনে? সেগুলো খেয়ে তো আমাদের পেটের অসুখ করে না কিম্বা দাঁত পচেও যায় না? আর এই না পাওয়া থেকে সেই সাত বছর বয়সে শিশু পিকুর মনে একটা জেদ চেপে গিয়েছিল। একদিন পিকু মনে মনে ঠিক করল, পড়াশোনা করে চাকরি পেলে জীবনের প্রথম মাসের বেতনের পুরো টাকাটা দিয়ে প্রচুর চকোলেট কিনবে আর সে একা একা সব খাবে। বাবা চাইলে একটাও দেবে না। এর পর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। দিদিদের বিয়ে হয়ে গেছে। ভাইরাও সবাই কিছু না কিছু উপার্জন করছে।


স্কুল কলেজের পড়া শোনা শেষ করে গ্রামের ভোদাই পিকুও একদিন কলকাতায় একটা চাকরি পেল। কিন্তু কি আশ্চর্য? সে আজও ভোলেনি সেই চকোলেটের কথা। শিশু পিকু বুঝতো না যে এক মাসের বেতনে এক বস্তা চকোলেট হয়, অতো চকোলেট খাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তবে প্রথম মাসের বেতন পেয়ে ২৪ বছরের পিকু ঠিক করল অন্তত আজ একটা খুব ভাল চকোলেট খেয়ে জীবনের প্রথম বেতন পাওয়ার দিনটি সেলিব্রেট করবে। যেমন কথা তেমনই কাজ। জীবনের প্রথম মাসের বেতন পাওয়ার উন্মাদনা আর তার সঙ্গে সন্ধ্যে ছ'টার অফিসপাড়ার কলকাতার ফুটপাথের ভীড়। ধর্মতলার একটা ফুটপাথের ধারের একটা ছোট্ট দোকান থেকে একটা বেশ ভাল মিল্কবার কিনে তার মোড়কটি ছিঁড়ে সবে মুখে এক কামড় দিয়েছে এমন সময় একজন ব্যক্তির কনুই-এর ধাক্কায় মিল্কবারটি ছিটকে গিয়ে পড়ল একেবারে ফুটপাথের একপাশে। আর গ্রামের ভোদাই পিকু বোকার মত তাকিয়ে দেখল যে একেই বলে কলকাতা শহর !! যার হাতের ধাক্কায় ওর জীবনের এত বড় স্বপ্নটি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল সে দেখেও না দেখার ভান করে দৌড়ে একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়ল।


পিকু এক দৃষ্টিতে আধ খোলা আধ কামড়ানো মিল্কবারটির দিকে তাকিয়ে যখন কি করবে ভেবে উঠতে পারছে না ঠিক তখনই একটা বছর সাতের অত্যন্ত জীর্ন চেহারার মলিন বসনের ছেলে কোথা থেকে দৌড়ে এসে মিল্কবারটি হাতে তুলে নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর মিল্কবারটি সমেত হাতটা তুলে পিকুকে ফেরত দিতে চাইল। পিকু ওর হাতটা ধরে টানতে টানতে ফুট পাথের এক পাশে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালো। ছেলেটি ভয় পেয়ে ভ্যাঁ করে কাঁদতে শুরু করল। ঠিক এই সময়ে ছেলেটির চেয়ে বছর খানেকের ছোট ওই রকমই জীর্ন চেহারার মলিন বসনের একটি মেয়েও কোথা থেকে দৌড়ে এসে ছেলেটির হাত থেকে মিল্কবারটি কেড়ে নেওয়ার জন্য কান্না-কাটি শুরু করলো। ওদের নিজেদের মধ্যে কান্না-জড়ানো কথা থেকে পিকু বুঝতে পারলো মেয়েটি ওই ছেলেটিরই বোন। তখন সে ছেলেটির হাত থেকে মিল্কবারটি নিয়ে পকেটে রেখে দিল এবং পাশের দোকান থেকে ঐ একই রকম আরও দুটি মিল্কবার কিনে মোড়কটা একটু করে খুলে ওদের দুজনের হাতে দিয়ে পরম আদরে ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “তোরা দুজনে এই চকোলেট দুটো পুরোটাই এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবি আর বলবি কেমন খেতে? আমি তোদের এই খাওয়া দেখব।”


বাচ্চা দুটি কেমন যেন ঘাবড়ে গেল। রাস্তায় বাবুদের কাছে কিছু চাইলে তারা তো বকা ঝকা করে এমনকি মারধোরও করে কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন বাবু এই ভাবে দামী চকোলেট কিনে দিয়ে আদর করে বলেনি “তোরা খা আর আমি তোদের খাওয়া দেখব।” বাচ্চাদুটির চোখে জল। কিন্তু যে মুহুর্তে তারা চকোলেটে কামড় দিল এক স্বর্গীয় আনন্দে ভরে গেল তাদের মুখমন্ডল। আর ভাইবোন পরস্পরকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কি সুন্দর খেতে তাই না ? ইস কি মিষ্টি।” তাদের খাওয়া যখন প্রায় শেষ সেই সময়ে একজন অতি শীর্ন দেহের মহিলা হন্ত দন্ত হয়ে দৌড়ে এসে চিৎকার করে বলতে লাগলো, “আরে পিকু তুই বোনকে নিয়ে এতদুর চলে এসেছিস, আর আমি তোদের সেই কখন থেকে খুঁজে চলেছি।”


পিকু ভদ্রমহিলাটিকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার ছেলের নাম কি বললে?” 
মহিলাটি বলল, “আজ্ঞে, আমার ছেলে নাম পিকু।”
পিকু আরও জিজ্ঞেস করল, “ওর বয়স কত?”
মহিলাটি বলল, “আজ্ঞে সাত বছর।”
বা্চচাদুটির মায়ের উপস্থিতিতে পরম নিশ্চিন্ত হয়ে পিকু আস্তে আস্তে তার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো। কিছুটা গিয়ে একটা ডাস্ট-বীন দেখতে পেয়ে সেই পড়ে যাওয়া মিল্কবারটি পকেট থেকে বের করে ডাস্ট-বীনে ছুড়ে ফেলে দিল।।


1 comment:

  1. ছেলেবেলায় কত বাবা মা তাঁদের ছেলেমেয়েদের এমনকি সামান্য ইচ্ছাটুকুও পূর্ণ করতে পারে না। অনেক সময় ছেলেমেয়েরা ভুলে যায় কিন্তু বাবা মায়ের মনে সেই দুঃখ গেঁথে থাকে আর মাঝে মাঝে পীড়া দিতে থাকে। এক্ষেত্রে সেই শিশু অবশ্য নিজের দুঃখকে মনে রেখেছিল। আর সেই দুঃখের স্মৃতি তাকে উৎসাহিত করেছে সহমর্মী করেছে অপরাপর একটি শিশুর দুঃখ সাময়িকভাবে দূর করতে। বেশ যত্ন করে লেখা হয়েছে। ভাল লাগল।

    ReplyDelete

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া