কলিং বেলটা কির কির করে
বেজে যাচ্ছে। দুমিনিটে প্রায় তিনবার বাজিয়েছে শ্যামলী। কিন্তু সাড়া এখনও মেলে নি।
ফ্ল্যাট বাড়ির এই এক জ্বালা। কোনও ফাঁক ফোকর নেই এতটুকু। ভেতরে কী হচ্ছে বাইরে
থেকে তার আঁচ পাওয়া বড় মুশকিল।
বিকেল তিনটেয় কাজে আসে
শ্যামলী। খুব একটা ব্যতিক্রম হয় না। আজও হয় নি। মা বলেছিল, আজ সন্ধ্যেবেলা একবার
আসিস। কাজ আছে।
তার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে
তাকিয়ে মা বলেছিল, কিছু লোক আসবে একটু কাজ আছে। চিন্তা কিছু নেই কিছু বাড়তি তোকে
দিয়ে দেব এ মাসে।
এই সন্ধ্যেবেলায় আসাটা বড়
গোলমালের। এর আগে যে বাড়িতে কাজ করত তার দাদা একদিন সন্ধ্যেবেলা আসতে বলেছিল। তার
কিছু বাড়তি লোক আসবে। তবে চিন্তার কিছু নেই পুষিয়ে দেবে।
কলিং বেল টিপে দাঁড়িয়েছিল
প্রায় তিন মিনিট। ফিরে যাবে ভাবছিল এমন সময় দরজা খুলে দিয়েছিল দাদা। তার সারা মুখে
সাবান মাখান। দাড়ি কামাচ্ছে।
--কী কাজ দাদা?
--এত তাড়া কিসের? বস না
একটু। দাড়িটা কামিয়ে নি।
দাদার পরণে একটা তোয়ালে
জড়ান শুধু। আর কিছু নেই। বেশ পুরুষালি চেহারা। শক্তপোক্ত শরীর। বিয়ে হয় নি। মা
নাকি মেয়ে খুঁজে পাচ্ছে না তার জন্যে। এমন শক্তপোক্ত ছেলের জন্যে বউ খুঁজে কেন পায়
না সেটা শ্যামলীর মাথাতে আসে নি। কিন্তু ভেবেছিল বড় মানুষের জন্যে তো বড় ঘরের মেয়ে
দরকার।
অন্য লোক আসা তো দূরের
কথা। বাড়িতে দাদা ছাড়া আর কারুর কোনও সাড়া শব্দ নেই।
--কী করতে হবে দাদাবাবু?
কথাটা বেশ ভয়ে ভয়ে পুনরাবৃত্তি করেছিল শ্যামলী।
বাথরুমে শাওয়ার খুলে চান
করতে করতেই বাইরে বেরিয়ে এসেছিল দাদা। হাতে ছিল একটা সাবান। বলেছিল, পিঠে সাবানটা
একটু ভাল করে ঘষে দিতে পারবি শ্যামলী? আজ এক বন্ধুর পার্টি আছে। একটু সেজেগুজে
যেতে হবে।
একেবারে থ হয়ে এদিক ওদিক
তাকিয়ে শ্যামলী বলেছিল, মা কোথায় দাদা? তোমার সেই যাদের আসার কথা ছিল তারাই বা
কোথায়?
--ছাড় না ওসব কথা। ওরা হয়ত
কাজে আটকে গেছে। মা গেছে একটু বাইরে দরকারে। নে নে বাথরুমে এসে আমার গায়ে সাবান
ঘষে দে তো ভাল করে। আরে চিন্তা কী আমি পুষিয়ে দোব রে বাবা।
শ্যামলী কি করবে ভাবছিল।
এমন পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়ে নি। বাথরুম থেকে বাইরে বেরিয়ে তার হাত ধরে টান দিল
দাদা। বলল, মাসে মাসে কত টাকা দিই সে খেয়াল আছে? এ কাজটা গেলে আবার এমন কাজ খুঁজে
পেতে কত সময় লাগবে সে জ্ঞান আছে? আর পিঠে তো একটু সাবান ঘষে দেওয়া। এতেই জাত চলে
যাবে নাকি?
তা জাতধর্মের মায়া করলে কী
আর কেউ কাজের লোক হয়? তাই বলে কোনও বজ্জাত এসে জাত কেড়ে নিক সেটাই বা মেনে নেয় কী
করে সে? কোন মেয়েই বা সহজে মেনে নিতে পারে? দৃঢ়ভাবে বলল, ও পারব না। আমি চলি দাদা।
আমার মা ফিরবে এখুনি।
সবলে তাকে জাপটে ধরে
বাথরুমের দিকে টানার চেষ্টা আর শ্যামলীর তরফ থেকে পালটা বাইরে যাবার লড়াই। দৌড়ে
দরজার দিকে পালাতে গিয়েও প্রবল বাধা। কাছেই ডাইনিং টেবিল। পড়ে আছে ফলকাটা ছুরিটা।
সেটাই তুলে নিয়েছিল শ্যামলী। তারপর—
সেবার নিজেকে বাঁচাতে
পেরেছিল সে। বাড়িতে গিয়ে ভেবেছিল আর এমন বাড়িতে কাজ নয়। একজন পরামর্শ দিয়েছিল
ক্লাবে গিয়ে সব কথা খুলে বলতে। থানায় ডায়রি করতে। কিন্তু সে রাজি হয়নি। পাঁচ বাড়ি
কাজ করে খেতে হয়। বদনাম হলে সে খাবে কী? তাছাড়া এসব কেস ফেস অনেক ঝামেলা। অনেক
কাঠখড় পোড়ান। উকিলরা সব অনেক টাকা খায় শুনেছে।
পরের দিন মায়ের কাছে বলতে
গিয়েছিল আর সে কাজ করবে না। তার পাওনা গন্ডা যেন মিটিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু চিল
চিৎকার করেছিল মা। সে নাকি চুরি করতে এসেছিল সন্ধেবেলা কেউ না থাকার সুযোগে। ছুরি
দিয়ে হামলা করেছিল বাধা দিতে আসা ছেলেকে। তাই টাকা চাইলে গারদে যেতে হবে। পুলিশে
কমপ্লেন করবে ওরা।
পাড়ার সেই বান্ধবী বলেছিল,
আসলে কী জানিস মানুষের মধ্যে সবাই না হলেও বেশির ভাগ অমানুষ। তবে---
সেই দুঃস্মৃতি মাত্রই
দুবছরের পুরোন। আজ তাই ভয়ে ভয়ে এসেছে। ক্যাঁট ক্যাঁট করে কথা বললেও এই মা খারাপ
নয়। এই দাদার মধ্যেও সে তেমন কিছু দেখে নি। তাছাড়া দাদার একটা গোটা সংসার আছে। আছে
সুন্দরী বউ আর তার চেয়ে সামান্য ছোট এক মেয়ে। কিন্তু সেই বান্ধবীর কথা মনে পড়ে
গেল, সবাই না হলেও বেশির ভাগ মানুষ আর মানুষ নয় শ্যামলী। তবে—
দরজা খুলে দিল দাদা। দেখে
চমকে গেল শ্যামলী। ঘরে আর সবাই আছে তো? আজ পুজোর দিন। বাইরে হয়ত সবাই চলে গেছে
ঠাকুর দেখতে। তার চীৎকারে কেউ ছুটে আসবে বলে তো মনে হয় না।
--মা, শ্যামলী এসে গেছে।
তোমরা সব তৈরি তো?
ভেতরে তবে লোক আছে।
নিশ্চিন্ত হল শ্যামলী। ভেতর থেকে ‘হ্যাঁ হ্যাঁ তৈরি তৈরি।‘ বলতে বলতে মা এসে পড়ল।
আর শ্যামলীকে দেখেই রেগে গেল বেশ, আচ্ছা শ্যামলী, তোর আক্কেল খানা কী বল তো? পুজোর
দিনে কেউ এমন ময়লা পুরোন জামা পরে রাস্তায় বেরোয়?
শ্যামলী চুপ করে ছিল। মা
আবার দিল মুখ ঝামটা, তোকে যে পুজোর জামাকাপড়ের টাকা দিলুম সেটা কী করলি শুনি?
শ্যামলী চুপ করেই আছে। তার
ছল ছল চোখ।
--বল হতভাগী কী করলি সে
টাকা? নাকি সিনেমা দেখে ফুর্তি করে উড়িয়ে দিলি? প্রেমিক টেমিক জুটেছে বুঝি?
--ভাইকে কিনে দিয়েছি মা।
আর টাকা যা ছিল তাই দিয়ে মায়ের জন্যে একটা খুব কম দামের শাড়ি। আর আমার গত
বছরেরটাই---
শ্যামলীর বাবা একটা চাকরি
করত। ছোটখাট হলেও সম্মানের সঙ্গে বাঁচার উপযুক্ত। কিন্তু সেরিব্রাল অ্যাটাকে পঙ্গু
হয়ে এখন তিন বছর বিছানায় শুয়ে। মা আয়ার চাকরি করে। এটা তো চাকরি নয়। মাঝে মাঝে লোক
দরকার হলে তাকে নেয়। হাজিরা দিতে হয় রোজ। শ্যামলী তখন ক্লাস এইটে পড়ত। লেখাপড়ায়
মন্দ ছিল না। ওর বাবার নাকি ওকে আই-এ-এস করার খুব ইচ্ছে ছিল। বলেছিল, জানি
দুঃস্বপ্ন মা, কিন্তু তবু এসব স্বপ্ন দেখতে বড় ভাল লাগে।
ভাই ক্লাস সেভেনে পড়ে। তার
পড়াটা বন্ধ করে নি শ্যামলী। সারাদিন ঘরের দরজা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিয়ে আসে।
উল্টোদিকের লোকেরা খুব সহানুভূতিশীল। বলেছে, তুই যা শ্যামলী। তোর বাবাকে আমরা যতটা
পারি দেখাশোনা করব।
মা আর দাদা মুখ চাওয়াচায়ি
করছে। কেন যে কে জানে। কী এদের মতলব বোঝার চেষ্টা করেও বুঝতে পারল না শ্যামলী।
দাদা বলল, আচ্ছা সে যা হয় হবে। দেখছি কী ব্যবস্থা করা যায়। মেয়েকে ডাক দিল। মেয়ে
এল।
--রিণি গতবার মাসির দেওয়া
চুড়িদার তোর বড় হচ্ছিল না? ওটা মনে হয়—
--দিচ্ছি বাবা। বলে রিণি
ভেতরে চলে গেল।
মা পড়ল আবার দুর্ভাবনায়,
কিন্তু এই ঝোড়ো কাকের মত হয়ে কী করে এ আমাদের সঙ্গে যাবে মনি? আহা মাথার চুলের
অবস্থা দেখ। একটু তো শ্যাম্পু সাবান মাঝে মাঝে আমাদের থেকে চেয়ে নিতে পারিস নাকি?
জানি আমরা পর লোক। কিন্তু তোর খাওয়া পরার একটা অংশ তো দিই রে হতচ্ছাড়ি!
একটু দূরে রান্নাঘরে ঠুক
ঠাক করে রান্না করছিল বৌদি। তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল, এ
নিয়ে আপনি ভাববেন না মা। আমি আছি কী করতে? আমার রান্না সব প্রায় শেষ। আমার ওপর
ছেড়ে দিন না।
শ্যামলী কিছুই বুঝতে পারছে
না। তবে এটুকু বুঝতে পারছে যে এমন একটা ঘটনা ঘটছে বা ঘটতে চলেছে তাতে তার কিছুটা
হলেও ভুমিকা আছে। খুব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু কি করতে হবে মা? কেন আসতে
বলেছিলে? বৌদিকে রান্নায় সাহায্য করতে হবে? বেশ তো—
মা কিছু না বলে ভেতরে চলে
গেল। তার অনেক কাজ। মুখে ব্যস্ততার চিহ্ন। হাসি মুখে কৃষ্ণা বলল, কিচ্ছু করতে হবে
না। তুই আয় তো ভাই—
একটু পরেই বাথরুমের ভেতর
থেকে শ্যামলীর চিৎকার, ও বৌদি চোখ যে জ্বলে গেল। পিঠে এত জোরে ঘষছ কেন? পিঠ ছড়ে
যাবে যে?
--চুপ কর শ্যামলী। সারা
বছর সাবান না মাখিস আজকের বচ্ছরকার দিনে একটু ভাল করে না মাখলে হয়?
রিনির সেই জামায় দারুণ
মানিয়েছে শ্যামলীকে। মা এসে মুগ্ধ হয়ে বলল, পোড়ারমুখীকে খুব সাজিয়ে দিয়েছ তো বৌমা?
তা হ্যাঁরে তোর ভাইকে এখন বাড়িতে পাওয়া যাবে? আমাদের সঙ্গে গেলে তার আর তোদের
দুজনেরই খুব ভাল লাগত।
সব যেন কেমন একটা আবছা
স্বপ্নের মত লাগছে শ্যামলীর। একটু ভয় ভয় করছে। যদি স্বপ্নটা হঠাৎ ভেঙ্গে যায়?
স্বপ্নের রেশ কাটিয়ে বলল, আপনি তো ওকে আনতে বলেন নি।
--হ্যা সেটা আমার ভুল বটে।
খেয়াল ছিল না মা।
---আর ও অবশ্য আসত না। ও
এখন বন্ধুদের সঙ্গে পাড়ায় নেচে বেড়াচ্ছে।
--বেশ বেশ।
হালকা জলখাবার খেল সবাই।
তারপর নিচে গিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়াল। একটা ছোট গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে ঠাকুর দেখার
জন্যে। সামনে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠল রিনি। আর হাসিমুখে সোৎসাহে শ্যামলীকে ডাক, এস দিদি
এস।
একটু কুন্ঠা শ্যামলীর।
এগিয়ে এসে তার হাত ধরে গাড়িতে তুলে দিল রিনি। পেছনে বসল ওরা তিনজন। মা, দাদা আর
বৌদি।
কটা ঠাকুর দেখার পর মা
জিজ্ঞেস করলেন শ্যামলীকে, কেমন লাগছে রে হতচ্ছাড়ি?
কেমন করে বলবে তার কেমন
লাগছে? আর বলার মত সুর কোথায় তার গলায়। আনন্দ আর দুঃখের সংমিশ্রণে গলা যে একেবারে
বুজে গেছে হতচ্ছাড়ির। আর শুধু ভাবছে এমন যদি তাদের হত। কল্পনায় দেখছে একটা এমন ছোট
গাড়ি যার পেছনের সিটে বাবা শুয়ে। মাথার কাছে বসে মা বাবাকে বলে বলে দিচ্ছে ঠাকুর
আর প্যান্ডেলের বর্ণনা। সামনে সে আর তার ছোট ভাই কল কল করছে।
পুরোটা না হোক অর্ধেকটা তো
হল মায়ের কল্যাণে। মা হাসিমুখে বলেছে, তুই বাড়ির কাজের লোক হলেও তুই এ পরিবারের
একটা লোক তো বটে মা। বচ্ছরকার দিনটায় সকলকে সঙ্গে না নিলে কী আনন্দটা ভাল করে ভোগ
করা যায় রে পোড়ারমুখী।
ফেরার সময় রেস্টুরেন্টে
খাওয়া হল। শ্যামলীকে ওরা দেখে দেখে খাওয়াল।
ফেরার পথে কিছু খাবার কিনল
ওরা। শ্যামলীর হাতে সেটা তুলে দিয়ে মা বলল, বচ্ছরকার দিন। তোর মা বাবা ভাইদের দিয়ে
দিস মা। তোর সব দুঃখ আমরা ঘোচাতে পারব না। কিন্তু আজকের দিনে সবাই একটু হাসুক এটা
তো চাইতেই পারি বল? বল না রে হতচ্ছাড়ি!
মায়ের কথাগুলোই তো এমনি
কাট কাট। পাড়ার সেই বান্ধবীর কথাটা মনে এল তার। পাড়ার সেই বান্ধবী বলেছিল, আসলে কী
জানিস মানুষের মধ্যে সবাই না হলেও বেশির ভাগ অমানুষ। তবে---
এই তবে কথাটার পরেও কিছু
বলেছিল সে। সেটা তখন অতটা খেয়াল করে নি সে। আজ মনে পড়ল। বলেছিল, ‘তবে কিছু মানুষ
এখনও আছে যারা খুব ভাল শ্যামলী। এত ভাল যে আগে থেকে ভাবাই যায় না।‘