Sunday, September 24, 2017

কবিতা / বাটোয়ারা / গৌতম সেন


খোলা দুটো চোখ, দৃষ্টিপট ক্লিশে হয়ে আসে
সুখদুঃখের বাটোয়ারা বিরাট ফারাক প্রতিভাসে।

নীলাকাশে সুখে ভাসে ছাড়া ছাড়া শুভ্র মেঘের দল
কাশবনে হাওয়া দোল, ঝরে পড়া শিউলির ঢল -
রোদে বাজে উৎসবের সোনালী সানাই।

আনন্দ ভিড় করে ‘সব পেয়েছি’ সুখী মানুষের দলে
সামান্য আনন্দ সন্ধানে, কারো বা নিত্য লড়াই চলে
উৎসবের নামে খুশি হতে চায় যে সবাই।

হে আনন্দময়ী আজ তোর আগমনে, ওই বরাভয় দানে
আনন্দ সামান্য ছড়িয়ে দে দেখি আঁধার ঘরের কোণে,
যেখানে বছরভর খেলা করে অন্ধকারটা-ই।

উৎসব মাতুক এবারও যেমন মাতে খুশির হুল্লোড়ে ফি-বছর
দুঃখীদের একটু দেখিস, মনে রাখিস ওরাও যে সন্তান তোর।






ছোটগল্প / বচ্ছরকার দিন / -অরুণ চট্টোপাধ্যায়


কলিং বেলটা কির কির করে বেজে যাচ্ছে। দুমিনিটে প্রায় তিনবার বাজিয়েছে শ্যামলী। কিন্তু সাড়া এখনও মেলে নি। ফ্ল্যাট বাড়ির এই এক জ্বালা। কোনও ফাঁক ফোকর নেই এতটুকু। ভেতরে কী হচ্ছে বাইরে থেকে তার আঁচ পাওয়া বড় মুশকিল।  
বিকেল তিনটেয় কাজে আসে শ্যামলী। খুব একটা ব্যতিক্রম হয় না। আজও হয় নি। মা বলেছিল, আজ সন্ধ্যেবেলা একবার আসিস। কাজ আছে।
তার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে মা বলেছিল, কিছু লোক আসবে একটু কাজ আছে। চিন্তা কিছু নেই কিছু বাড়তি তোকে দিয়ে দেব এ মাসে।
এই সন্ধ্যেবেলায় আসাটা বড় গোলমালের। এর আগে যে বাড়িতে কাজ করত তার দাদা একদিন সন্ধ্যেবেলা আসতে বলেছিল। তার কিছু বাড়তি লোক আসবে। তবে চিন্তার কিছু নেই পুষিয়ে দেবে।
কলিং বেল টিপে দাঁড়িয়েছিল প্রায় তিন মিনিট। ফিরে যাবে ভাবছিল এমন সময় দরজা খুলে দিয়েছিল দাদা। তার সারা মুখে সাবান মাখান। দাড়ি কামাচ্ছে।
--কী কাজ দাদা?
--এত তাড়া কিসের? বস না একটু। দাড়িটা কামিয়ে নি।
দাদার পরণে একটা তোয়ালে জড়ান শুধু। আর কিছু নেই। বেশ পুরুষালি চেহারা। শক্তপোক্ত শরীর। বিয়ে হয় নি। মা নাকি মেয়ে খুঁজে পাচ্ছে না তার জন্যে। এমন শক্তপোক্ত ছেলের জন্যে বউ খুঁজে কেন পায় না সেটা শ্যামলীর মাথাতে আসে নি। কিন্তু ভেবেছিল বড় মানুষের জন্যে তো বড় ঘরের মেয়ে দরকার।
অন্য লোক আসা তো দূরের কথা। বাড়িতে দাদা ছাড়া আর কারুর কোনও সাড়া শব্দ নেই।
--কী করতে হবে দাদাবাবু? কথাটা বেশ ভয়ে ভয়ে পুনরাবৃত্তি করেছিল শ্যামলী।
বাথরুমে শাওয়ার খুলে চান করতে করতেই বাইরে বেরিয়ে এসেছিল দাদা। হাতে ছিল একটা সাবান। বলেছিল, পিঠে সাবানটা একটু ভাল করে ঘষে দিতে পারবি শ্যামলী? আজ এক বন্ধুর পার্টি আছে। একটু সেজেগুজে যেতে হবে।
একেবারে থ হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে শ্যামলী বলেছিল, মা কোথায় দাদা? তোমার সেই যাদের আসার কথা ছিল তারাই বা কোথায়?
--ছাড় না ওসব কথা। ওরা হয়ত কাজে আটকে গেছে। মা গেছে একটু বাইরে দরকারে। নে নে বাথরুমে এসে আমার গায়ে সাবান ঘষে দে তো ভাল করে। আরে চিন্তা কী আমি পুষিয়ে দোব রে বাবা।
শ্যামলী কি করবে ভাবছিল। এমন পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়ে নি। বাথরুম থেকে বাইরে বেরিয়ে তার হাত ধরে টান দিল দাদা। বলল, মাসে মাসে কত টাকা দিই সে খেয়াল আছে? এ কাজটা গেলে আবার এমন কাজ খুঁজে পেতে কত সময় লাগবে সে জ্ঞান আছে? আর পিঠে তো একটু সাবান ঘষে দেওয়া। এতেই জাত চলে যাবে নাকি?
তা জাতধর্মের মায়া করলে কী আর কেউ কাজের লোক হয়? তাই বলে কোনও বজ্জাত এসে জাত কেড়ে নিক সেটাই বা মেনে নেয় কী করে সে? কোন মেয়েই বা সহজে মেনে নিতে পারে? দৃঢ়ভাবে বলল, ও পারব না। আমি চলি দাদা। আমার মা ফিরবে এখুনি।
সবলে তাকে জাপটে ধরে বাথরুমের দিকে টানার চেষ্টা আর শ্যামলীর তরফ থেকে পালটা বাইরে যাবার লড়াই। দৌড়ে দরজার দিকে পালাতে গিয়েও প্রবল বাধা। কাছেই ডাইনিং টেবিল। পড়ে আছে ফলকাটা ছুরিটা। সেটাই তুলে নিয়েছিল শ্যামলী। তারপর—
সেবার নিজেকে বাঁচাতে পেরেছিল সে। বাড়িতে গিয়ে ভেবেছিল আর এমন বাড়িতে কাজ নয়। একজন পরামর্শ দিয়েছিল ক্লাবে গিয়ে সব কথা খুলে বলতে। থানায় ডায়রি করতে। কিন্তু সে রাজি হয়নি। পাঁচ বাড়ি কাজ করে খেতে হয়। বদনাম হলে সে খাবে কী? তাছাড়া এসব কেস ফেস অনেক ঝামেলা। অনেক কাঠখড় পোড়ান। উকিলরা সব অনেক টাকা খায় শুনেছে।
পরের দিন মায়ের কাছে বলতে গিয়েছিল আর সে কাজ করবে না। তার পাওনা গন্ডা যেন মিটিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু চিল চিৎকার করেছিল মা। সে নাকি চুরি করতে এসেছিল সন্ধেবেলা কেউ না থাকার সুযোগে। ছুরি দিয়ে হামলা করেছিল বাধা দিতে আসা ছেলেকে। তাই টাকা চাইলে গারদে যেতে হবে। পুলিশে কমপ্লেন করবে ওরা।
পাড়ার সেই বান্ধবী বলেছিল, আসলে কী জানিস মানুষের মধ্যে সবাই না হলেও বেশির ভাগ অমানুষ। তবে---
সেই দুঃস্মৃতি মাত্রই দুবছরের পুরোন। আজ তাই ভয়ে ভয়ে এসেছে। ক্যাঁট ক্যাঁট করে কথা বললেও এই মা খারাপ নয়। এই দাদার মধ্যেও সে তেমন কিছু দেখে নি। তাছাড়া দাদার একটা গোটা সংসার আছে। আছে সুন্দরী বউ আর তার চেয়ে সামান্য ছোট এক মেয়ে। কিন্তু সেই বান্ধবীর কথা মনে পড়ে গেল, সবাই না হলেও বেশির ভাগ মানুষ আর মানুষ নয় শ্যামলী। তবে—
দরজা খুলে দিল দাদা। দেখে চমকে গেল শ্যামলী। ঘরে আর সবাই আছে তো? আজ পুজোর দিন। বাইরে হয়ত সবাই চলে গেছে ঠাকুর দেখতে। তার চীৎকারে কেউ ছুটে আসবে বলে তো মনে হয় না।
--মা, শ্যামলী এসে গেছে। তোমরা সব তৈরি তো?
ভেতরে তবে লোক আছে। নিশ্চিন্ত হল শ্যামলী। ভেতর থেকে ‘হ্যাঁ হ্যাঁ তৈরি তৈরি।‘ বলতে বলতে মা এসে পড়ল। আর শ্যামলীকে দেখেই রেগে গেল বেশ, আচ্ছা শ্যামলী, তোর আক্কেল খানা কী বল তো? পুজোর দিনে কেউ এমন ময়লা পুরোন জামা পরে রাস্তায় বেরোয়?  
শ্যামলী চুপ করে ছিল। মা আবার দিল মুখ ঝামটা, তোকে যে পুজোর জামাকাপড়ের টাকা দিলুম সেটা কী করলি শুনি?  
শ্যামলী চুপ করেই আছে। তার ছল ছল চোখ।
--বল হতভাগী কী করলি সে টাকা? নাকি সিনেমা দেখে ফুর্তি করে উড়িয়ে দিলি? প্রেমিক টেমিক জুটেছে বুঝি?
--ভাইকে কিনে দিয়েছি মা। আর টাকা যা ছিল তাই দিয়ে মায়ের জন্যে একটা খুব কম দামের শাড়ি। আর আমার গত বছরেরটাই---
শ্যামলীর বাবা একটা চাকরি করত। ছোটখাট হলেও সম্মানের সঙ্গে বাঁচার উপযুক্ত। কিন্তু সেরিব্রাল অ্যাটাকে পঙ্গু হয়ে এখন তিন বছর বিছানায় শুয়ে। মা আয়ার চাকরি করে। এটা তো চাকরি নয়। মাঝে মাঝে লোক দরকার হলে তাকে নেয়। হাজিরা দিতে হয় রোজ। শ্যামলী তখন ক্লাস এইটে পড়ত। লেখাপড়ায় মন্দ ছিল না। ওর বাবার নাকি ওকে আই-এ-এস করার খুব ইচ্ছে ছিল। বলেছিল, জানি দুঃস্বপ্ন মা, কিন্তু তবু এসব স্বপ্ন দেখতে বড় ভাল লাগে।
ভাই ক্লাস সেভেনে পড়ে। তার পড়াটা বন্ধ করে নি শ্যামলী। সারাদিন ঘরের দরজা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিয়ে আসে। উল্টোদিকের লোকেরা খুব সহানুভূতিশীল। বলেছে, তুই যা শ্যামলী। তোর বাবাকে আমরা যতটা পারি দেখাশোনা করব।
মা আর দাদা মুখ চাওয়াচায়ি করছে। কেন যে কে জানে। কী এদের মতলব বোঝার চেষ্টা করেও বুঝতে পারল না শ্যামলী। দাদা বলল, আচ্ছা সে যা হয় হবে। দেখছি কী ব্যবস্থা করা যায়। মেয়েকে ডাক দিল। মেয়ে এল।
--রিণি গতবার মাসির দেওয়া চুড়িদার তোর বড় হচ্ছিল না? ওটা মনে হয়—
--দিচ্ছি বাবা। বলে রিণি ভেতরে চলে গেল।
মা পড়ল আবার দুর্ভাবনায়, কিন্তু এই ঝোড়ো কাকের মত হয়ে কী করে এ আমাদের সঙ্গে যাবে মনি? আহা মাথার চুলের অবস্থা দেখ। একটু তো শ্যাম্পু সাবান মাঝে মাঝে আমাদের থেকে চেয়ে নিতে পারিস নাকি? জানি আমরা পর লোক। কিন্তু তোর খাওয়া পরার একটা অংশ তো দিই রে হতচ্ছাড়ি!
একটু দূরে রান্নাঘরে ঠুক ঠাক করে রান্না করছিল বৌদি। তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল, এ নিয়ে আপনি ভাববেন না মা। আমি আছি কী করতে? আমার রান্না সব প্রায় শেষ। আমার ওপর ছেড়ে দিন না।
শ্যামলী কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে এটুকু বুঝতে পারছে যে এমন একটা ঘটনা ঘটছে বা ঘটতে চলেছে তাতে তার কিছুটা হলেও ভুমিকা আছে। খুব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু কি করতে হবে মা? কেন আসতে বলেছিলে? বৌদিকে রান্নায় সাহায্য করতে হবে? বেশ তো—
মা কিছু না বলে ভেতরে চলে গেল। তার অনেক কাজ। মুখে ব্যস্ততার চিহ্ন। হাসি মুখে কৃষ্ণা বলল, কিচ্ছু করতে হবে না। তুই আয় তো ভাই—
একটু পরেই বাথরুমের ভেতর থেকে শ্যামলীর চিৎকার, ও বৌদি চোখ যে জ্বলে গেল। পিঠে এত জোরে ঘষছ কেন? পিঠ ছড়ে যাবে যে?
--চুপ কর শ্যামলী। সারা বছর সাবান না মাখিস আজকের বচ্ছরকার দিনে একটু ভাল করে না  মাখলে হয়?
রিনির সেই জামায় দারুণ মানিয়েছে শ্যামলীকে। মা এসে মুগ্ধ হয়ে বলল, পোড়ারমুখীকে খুব সাজিয়ে দিয়েছ তো বৌমা? তা হ্যাঁরে তোর ভাইকে এখন বাড়িতে পাওয়া যাবে? আমাদের সঙ্গে গেলে তার আর তোদের দুজনেরই খুব ভাল লাগত।
সব যেন কেমন একটা আবছা স্বপ্নের মত লাগছে শ্যামলীর। একটু ভয় ভয় করছে। যদি স্বপ্নটা হঠাৎ ভেঙ্গে যায়? স্বপ্নের রেশ কাটিয়ে বলল, আপনি তো ওকে আনতে বলেন নি।
--হ্যা সেটা আমার ভুল বটে। খেয়াল ছিল না মা।  
---আর ও অবশ্য আসত না। ও এখন বন্ধুদের সঙ্গে পাড়ায় নেচে বেড়াচ্ছে।
--বেশ বেশ।
হালকা জলখাবার খেল সবাই। তারপর নিচে গিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়াল। একটা ছোট গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে ঠাকুর দেখার জন্যে। সামনে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠল রিনি। আর হাসিমুখে সোৎসাহে শ্যামলীকে ডাক, এস দিদি এস।
একটু কুন্ঠা শ্যামলীর। এগিয়ে এসে তার হাত ধরে গাড়িতে তুলে দিল রিনি। পেছনে বসল ওরা তিনজন। মা, দাদা আর বৌদি।
কটা ঠাকুর দেখার পর মা জিজ্ঞেস করলেন শ্যামলীকে, কেমন লাগছে রে হতচ্ছাড়ি?
কেমন করে বলবে তার কেমন লাগছে? আর বলার মত সুর কোথায় তার গলায়। আনন্দ আর দুঃখের সংমিশ্রণে গলা যে একেবারে বুজে গেছে হতচ্ছাড়ির। আর শুধু ভাবছে এমন যদি তাদের হত। কল্পনায় দেখছে একটা এমন ছোট গাড়ি যার পেছনের সিটে বাবা শুয়ে। মাথার কাছে বসে মা বাবাকে বলে বলে দিচ্ছে ঠাকুর আর প্যান্ডেলের বর্ণনা। সামনে সে আর তার ছোট ভাই কল কল করছে।
পুরোটা না হোক অর্ধেকটা তো হল মায়ের কল্যাণে। মা হাসিমুখে বলেছে, তুই বাড়ির কাজের লোক হলেও তুই এ পরিবারের একটা লোক তো বটে মা। বচ্ছরকার দিনটায় সকলকে সঙ্গে না নিলে কী আনন্দটা ভাল করে ভোগ করা যায় রে পোড়ারমুখী।
ফেরার সময় রেস্টুরেন্টে খাওয়া হল। শ্যামলীকে ওরা দেখে দেখে খাওয়াল।  
ফেরার পথে কিছু খাবার কিনল ওরা। শ্যামলীর হাতে সেটা তুলে দিয়ে মা বলল, বচ্ছরকার দিন। তোর মা বাবা ভাইদের দিয়ে দিস মা। তোর সব দুঃখ আমরা ঘোচাতে পারব না। কিন্তু আজকের দিনে সবাই একটু হাসুক এটা তো চাইতেই পারি বল? বল না রে হতচ্ছাড়ি!  
মায়ের কথাগুলোই তো এমনি কাট কাট। পাড়ার সেই বান্ধবীর কথাটা মনে এল তার। পাড়ার সেই বান্ধবী বলেছিল, আসলে কী জানিস মানুষের মধ্যে সবাই না হলেও বেশির ভাগ অমানুষ। তবে---
এই তবে কথাটার পরেও কিছু বলেছিল সে। সেটা তখন অতটা খেয়াল করে নি সে। আজ মনে পড়ল। বলেছিল, ‘তবে কিছু মানুষ এখনও আছে যারা খুব ভাল শ্যামলী। এত ভাল যে আগে থেকে ভাবাই যায় না।‘  



কবিতা / আসামী নম্বর ৩০৯ / পিনাকী দত্ত গুপ্ত




তিনশো নয়’ – ডাকটা আসতেই উঠে দাঁড়াতে হোলো
দুই হাত জোড় রেএকটু সামনের দিকে ঝুঁকে
বলতে হোলো হুজুরনাম রফিক মিয়াপেশায় কুমোর,
বাস মাচান তলা
আমার বাঁ চোখের ফাঁকা লাল গর্ত্তে চোখ বুলিয়ে হুজুর
অর্ডার দিলেন, “ওকে একটা কালো চশমা কিনে দিও
কাল মহালয়া বড় সাহেব আসবেন ”...


আজ সকাল থেকে ন্যাঙটো করে তল্লাসি চলেছে
সাহেব আসতেই ডাক পড়ল ৩০৯...
ওর চোখে চশমা কেন?”...
ওর বৌ চোখ আঁকার তুলি দিয়ে চোখটা গেলে দিয়েছে
একবার আপাদমস্তক দেখে সাহেব বললেন – অপরাধ?
আমি বৌটার পাছায় তিনবার লাথি মেরেছিলাম কারন
ষষ্ঠী থেকে অষ্টমী তিনটে মরদের সাথে শুয়েছিলো

বছর সাতেক হোলো আমি জেলের ৩০৯ নম্বর কয়েদি
মাঝেমাঝে মেয়েটার কথা মনে পড়ে
শুনেছি এখন ওদের পাকা বাড়ী মেয়েটার তিনটে বাবু
গোটা চার বিদেশী কুকুর আর বৌটার প্রোমোটার স্বামী
আজ মহালয়া আবার ন্যাংটো তে হোলো 
সাহেব এলেন,কালো বুট নাচিয়ে বললেন – নাম কি?
আমি বললাম, “৩০৯ শুয়োরের বাচ্চা



গল্প / এই শরতে / সোমা দে


আজ অনেক কাজ আরতির। অনেক বাজার নিয়ে এসেছে দাদাবাবু। বৌদি আর বাচ্চারা একটু আগেই স্কুলে চলে গেছে। আনাজ বাজার গুলোকে ধুয়ে একটা প্লাস্টিকের ওপর মেলে দেওয়া, মাছ কেটে ধুয়ে ভেজে ঝোল করা। তারপর রান্নাবাটি সম্পূর্ণ করে ঠাকুরের পুজো দেওয়া। এর মধ্যে আবার দাদাবাবু অফিস বেরোবে। তার টিফিন তৈরি করে দেওয়া। কোনদিকে যে যায় আরতি!  যদিও ঠিকে কাজের মেয়ে চাঁপা এসে ঘর মুছে, বাসন মেজে দিয়ে গেছে। না, তাড়াতাড়ি হাত চালায় আরতি।মাছের ঝোলটা আজ হালকা করে করতে বলে গেছে বৌদি।
তেলমশলা খুব কম দিয়ে তাই করার চেষ্টা করছে আরতি।বৌদির ছেলে আর দাদাবাবু প্রায়ই পেটের গণ্ডগোলে ভোগে।ঝোলের মধ্যে কয়েকটা থানকুনি পাতা কুচিয়ে ছেড়ে দেয় বৌদির কথামতো।

                                   সামনেই পুজো। বৌদিদের কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে। বাপরে! এরা তো দু'হাতে কিনেই চলে।দেখে মাঝে মাঝে গা টা শিরশির করে ওঠে আরতির। নিজের মেয়েটাকে একটু ভালো জামা সে কোনোদিন দিতে পারেনি;  এরা দ্যাখো কত কত টাকা দিয়ে দামী জামা কেনে। অথচ এমন হয়েছে দু'বার পড়ার পর আর পরেনি। বিশেষ করে বৌদির মেয়েটা। কি যেন ইংরাজী স্কুল কনভাটে(কনভেন্ট) পড়ে বলে খুব দেমাক। যেন পৃথিবীর সব জানে! সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসটা বন্ধ করে দেয় আরতি।
চালটা ফুটে গেছে, একটুখানি চাপা দিয়ে রাখলেই ভাতটা হয়ে যাবে। অন্য গ্যাসে ডাল হচ্ছে।মাছ ভালো করে বেছে ধুয়ে মাছের ঝোল চাপিয়ে দেয় সে।

                        দাদাবাবুর টিফিন রেডি করে টেবিলে ভাত বেড়ে দেয় সে। এই কাজটা খুবই যত্নের সাথে করে। দাদাবাবু মানুষটি ভালো। বৌদিও খারাপ    নয়, তবে বড্ড সতর্ক দৃষ্টি। ভাবতে ভাবতেই  দাদাবাবু  ডাক দেয় -"আরতিদি খেতে দাও।" খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর দাদাবাবু বেরিয়ে গেলেন আর বলে গেলেন -"আরতিদি, অপরিচিত লোকজন এলে দরজা খুলবে না।" এই কথাটা অবশ্য বৌদি আর দাদাবাবু প্রায় প্রতিদিনই বলে থাকে। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায় আরতি।এরপর সব কাজকর্ম সেরে স্নান করে পুজো করে আরতি। তারপর ওর নির্ধারিত ভাত -তরকারি খেয়ে একটু টানটান হয়ে জিরিয়ে নেয় মাদুরের ওপর।

মেয়েটার মুখটা মনে পড়ে । কিরকম আছে মেয়েটা? খেয়েছে? শরীর ঠিক আছে তো? পুরোনো ছবিগুলো ভিড় করে আসে মাথার ভেতর। আরতির স্বামী নিরাপদ মাইতি খুব পেটাতো আরতিকে। দুটো ছেলেকে রেখে মেয়ে সমেত আরতিকে তাড়িয়ে দেয় নিরাপদ। আরতির বাপের বাড়িতে রয়েছে মা আর দু'ভাই। বোনের কপালটা আরতির থেকে ভালো।
বর এরকম হতচ্ছেদ্দা করে না। তাড়িয়ে তো দেয়নি!

                             আরতির মায়ের কপালটাও চমৎকার। ছোটভাই পেটে থাকাকালীন প্রতিবেশী কাকুর বউকে নিয়ে ওর বাবা পুরো বেপাত্তা হয়ে যায়। আরতির মাও আর খোঁজার চেষ্টা করেনি।তার বর যে একটি বিশ্বাসঘাতক কাপুরুষ সে প্রমাণ বোধহয় এর আগেই সে পেয়েছিল। তাই এই পালানোর খবর শুনে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একদলা থুতু ছিটিয়ে সে বলেছিল-" যাক্, আপদ গেল।"

আরতি নতুন বিয়ের দিনই আবিষ্কার করলো বর পাঁড় মাতাল। তারপর দেখত প্রায় মাঝরাতেই বর বিছানায় থাকে না। ফিরে আসার পর জিজ্ঞাসা করলে উত্তর মিলত-"বাইরে গেছিলাম'। একদিন রাত্রে দেখতে না পেয়ে  আরতি খুঁজতে খুঁজতে বাইরে যায়। হঠাৎ গোয়ালঘরের পেছনে খড়ের গাদা থেকে হাপর ঠেলার মতো নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পেয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখে দুটি শরীর যেন এক হয়ে মিশে গেছে, একে অপরকে ছিঁড়ে খাচ্ছে। একজন ওর মাতাল স্বামী আর ওর 'ভালোমানুষ' জা। পরের দিন বিষ খায় আরতি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে প্রাণে না মরে হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে ঠাঁই হয় বাপের বাড়ি। আর তারপর যখন আবার সমাজ, সামাজিকতার দোহাই দিয়ে  আর অসহায়তা মিলে এক চর্বিতচর্বন প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেওয়া হলো আরতির সামনে যে -স্বামীর বাড়িই হিন্দু রমণীর শেষ আশ্রয়, আরতি ছেলে পুলে নিয়ে বাধ্য হলো স্বামীর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে। কিন্তু ফল এটাই হলো যে, দুটি ছেলেকে আরতির  কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে মেয়েসমেত আরতিকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো। বা, বলা যায় ফিরে যেতে বাধ্য হলো।

                    আর তারপর ভাগ্যের হাতে ঠোক্কর খেতে খেতে কাজের খোঁজে মেয়েটাকে মায়ের কাছে রেখে দিয়ে বাড়ির বাইরে যাওয়া।এই বাড়িতে আসার আগে আরো দু-তিন বাড়ি ছিল আরতি। শেষমেশ এখন এই বাড়িতে কিছুদিনের জন্য থিতু হয়েছে আরতি। ফাঁকা বাড়িতে এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মেয়েটার কথা মনে পড়লো। সামনের মাসেই পুজো। মেয়েটাকে, জামাইকে, জামাইয়ের মা-বাবা সবাইকেই তো দিতে হবে। বৌদি যদিও গতবছরই আরতকে দেওয়ার সাথে সাথে আরতির মেয়ে-জামাই, মাকে দিয়েছিল।

                    বছরে দু'বার বাড়ি  আসতে পারে আরতি। এক এই পুজোর ছুটি  আর এক হলো গরমের ছুটি , যখন ছেলেমেয়ের স্কুল বন্ধ থাকে।
উফ্, কতদিন পরে আবার মেয়েটাকে দেখতে পাবে। ছেলেগুলো তার থেকেও নেই। এই মেয়ের মুখ চেয়েই তো সে বেঁচে আছে।

গ্রামের শীতলা মন্দির, হলদি নদী, সবুজ মাঠ, কাশফুল বড় ডাকছে তাকে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। দেওয়ালে ঝোলানো মা দুর্গার বাঁধানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে পেন্নাম ঠোকে আরতি আর মনে মনে বলে-' মাগো, সবাইকে দেখো"।
কলিংবেল বেজে ওঠে, আরতি এগিয়ে যায় দরজার দিকে।

               

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া