আজ অনেক কাজ আরতির। অনেক বাজার নিয়ে এসেছে দাদাবাবু। বৌদি আর বাচ্চারা একটু আগেই স্কুলে চলে গেছে। আনাজ বাজার গুলোকে ধুয়ে একটা প্লাস্টিকের ওপর মেলে দেওয়া, মাছ কেটে ধুয়ে ভেজে ঝোল করা। তারপর রান্নাবাটি সম্পূর্ণ করে ঠাকুরের পুজো দেওয়া। এর মধ্যে আবার দাদাবাবু অফিস বেরোবে। তার টিফিন তৈরি করে দেওয়া। কোনদিকে যে যায় আরতি! যদিও ঠিকে কাজের মেয়ে চাঁপা এসে ঘর মুছে, বাসন মেজে দিয়ে গেছে। না, তাড়াতাড়ি হাত চালায় আরতি।মাছের ঝোলটা আজ হালকা করে করতে বলে গেছে বৌদি।
তেলমশলা খুব কম দিয়ে তাই করার চেষ্টা করছে আরতি।বৌদির ছেলে আর দাদাবাবু প্রায়ই পেটের গণ্ডগোলে ভোগে।ঝোলের মধ্যে কয়েকটা থানকুনি পাতা কুচিয়ে ছেড়ে দেয় বৌদির কথামতো।
সামনেই পুজো। বৌদিদের কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে। বাপরে! এরা তো দু'হাতে কিনেই চলে।দেখে মাঝে মাঝে গা টা শিরশির করে ওঠে আরতির। নিজের মেয়েটাকে একটু ভালো জামা সে কোনোদিন দিতে পারেনি; এরা দ্যাখো কত কত টাকা দিয়ে দামী জামা কেনে। অথচ এমন হয়েছে দু'বার পড়ার পর আর পরেনি। বিশেষ করে বৌদির মেয়েটা। কি যেন ইংরাজী স্কুল কনভাটে(কনভেন্ট) পড়ে বলে খুব দেমাক। যেন পৃথিবীর সব জানে! সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসটা বন্ধ করে দেয় আরতি।
চালটা ফুটে গেছে, একটুখানি চাপা দিয়ে রাখলেই ভাতটা হয়ে যাবে। অন্য গ্যাসে ডাল হচ্ছে।মাছ ভালো করে বেছে ধুয়ে মাছের ঝোল চাপিয়ে দেয় সে।
দাদাবাবুর টিফিন রেডি করে টেবিলে ভাত বেড়ে দেয় সে। এই কাজটা খুবই যত্নের সাথে করে। দাদাবাবু মানুষটি ভালো। বৌদিও খারাপ নয়, তবে বড্ড সতর্ক দৃষ্টি। ভাবতে ভাবতেই দাদাবাবু ডাক দেয় -"আরতিদি খেতে দাও।" খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর দাদাবাবু বেরিয়ে গেলেন আর বলে গেলেন -"আরতিদি, অপরিচিত লোকজন এলে দরজা খুলবে না।" এই কথাটা অবশ্য বৌদি আর দাদাবাবু প্রায় প্রতিদিনই বলে থাকে। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায় আরতি।এরপর সব কাজকর্ম সেরে স্নান করে পুজো করে আরতি। তারপর ওর নির্ধারিত ভাত -তরকারি খেয়ে একটু টানটান হয়ে জিরিয়ে নেয় মাদুরের ওপর।
মেয়েটার মুখটা মনে পড়ে । কিরকম আছে মেয়েটা? খেয়েছে? শরীর ঠিক আছে তো? পুরোনো ছবিগুলো ভিড় করে আসে মাথার ভেতর। আরতির স্বামী নিরাপদ মাইতি খুব পেটাতো আরতিকে। দুটো ছেলেকে রেখে মেয়ে সমেত আরতিকে তাড়িয়ে দেয় নিরাপদ। আরতির বাপের বাড়িতে রয়েছে মা আর দু'ভাই। বোনের কপালটা আরতির থেকে ভালো।
বর এরকম হতচ্ছেদ্দা করে না। তাড়িয়ে তো দেয়নি!
আরতির মায়ের কপালটাও চমৎকার। ছোটভাই পেটে থাকাকালীন প্রতিবেশী কাকুর বউকে নিয়ে ওর বাবা পুরো বেপাত্তা হয়ে যায়। আরতির মাও আর খোঁজার চেষ্টা করেনি।তার বর যে একটি বিশ্বাসঘাতক কাপুরুষ সে প্রমাণ বোধহয় এর আগেই সে পেয়েছিল। তাই এই পালানোর খবর শুনে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একদলা থুতু ছিটিয়ে সে বলেছিল-" যাক্, আপদ গেল।"
আরতি নতুন বিয়ের দিনই আবিষ্কার করলো বর পাঁড় মাতাল। তারপর দেখত প্রায় মাঝরাতেই বর বিছানায় থাকে না। ফিরে আসার পর জিজ্ঞাসা করলে উত্তর মিলত-"বাইরে গেছিলাম'। একদিন রাত্রে দেখতে না পেয়ে আরতি খুঁজতে খুঁজতে বাইরে যায়। হঠাৎ গোয়ালঘরের পেছনে খড়ের গাদা থেকে হাপর ঠেলার মতো নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পেয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখে দুটি শরীর যেন এক হয়ে মিশে গেছে, একে অপরকে ছিঁড়ে খাচ্ছে। একজন ওর মাতাল স্বামী আর ওর 'ভালোমানুষ' জা। পরের দিন বিষ খায় আরতি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে প্রাণে না মরে হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে ঠাঁই হয় বাপের বাড়ি। আর তারপর যখন আবার সমাজ, সামাজিকতার দোহাই দিয়ে আর অসহায়তা মিলে এক চর্বিতচর্বন প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেওয়া হলো আরতির সামনে যে -স্বামীর বাড়িই হিন্দু রমণীর শেষ আশ্রয়, আরতি ছেলে পুলে নিয়ে বাধ্য হলো স্বামীর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে। কিন্তু ফল এটাই হলো যে, দুটি ছেলেকে আরতির কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে মেয়েসমেত আরতিকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো। বা, বলা যায় ফিরে যেতে বাধ্য হলো।
আর তারপর ভাগ্যের হাতে ঠোক্কর খেতে খেতে কাজের খোঁজে মেয়েটাকে মায়ের কাছে রেখে দিয়ে বাড়ির বাইরে যাওয়া।এই বাড়িতে আসার আগে আরো দু-তিন বাড়ি ছিল আরতি। শেষমেশ এখন এই বাড়িতে কিছুদিনের জন্য থিতু হয়েছে আরতি। ফাঁকা বাড়িতে এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মেয়েটার কথা মনে পড়লো। সামনের মাসেই পুজো। মেয়েটাকে, জামাইকে, জামাইয়ের মা-বাবা সবাইকেই তো দিতে হবে। বৌদি যদিও গতবছরই আরতকে দেওয়ার সাথে সাথে আরতির মেয়ে-জামাই, মাকে দিয়েছিল।
বছরে দু'বার বাড়ি আসতে পারে আরতি। এক এই পুজোর ছুটি আর এক হলো গরমের ছুটি , যখন ছেলেমেয়ের স্কুল বন্ধ থাকে।
উফ্, কতদিন পরে আবার মেয়েটাকে দেখতে পাবে। ছেলেগুলো তার থেকেও নেই। এই মেয়ের মুখ চেয়েই তো সে বেঁচে আছে।
গ্রামের শীতলা মন্দির, হলদি নদী, সবুজ মাঠ, কাশফুল বড় ডাকছে তাকে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। দেওয়ালে ঝোলানো মা দুর্গার বাঁধানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে পেন্নাম ঠোকে আরতি আর মনে মনে বলে-' মাগো, সবাইকে দেখো"।
কলিংবেল বেজে ওঠে, আরতি এগিয়ে যায় দরজার দিকে।
No comments:
Post a Comment