Friday, February 24, 2017
সম্পাদকীয় / অলোক চৌধুরী
সম্পাদকীয়
বসন্ত এসেই গেল। কবি বলেছিলেন, “ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত”। না, এবারে ফুল ফুটেছে অঢেল। নানাদিকে ফুলের সম্ভার। আমগাছ পল্লবভারে নত, সুরভিত। সেখানে এখন মৌমাছির গুনগুন। তারই ফাঁকে ভোরেরবেলায় কোকিল কুহুস্বরে জানান দেয়; বসন্ত
এসে গেছে, উঠে পড় সব। হালকা শীতের আমেজ গায়ে মেখে কুহু ডাক শুনতে শুনতে খুশীতে ভরে যায় মন। বাতাসে আজ রঙের উচ্ছ্বাস, খুশীর
রঙে ভরপুর। আর বসন্ত মানেই তো রঙের উৎসব। আর ক’দিন পরেই তো দোল। আবিরে আবিরে মেতে উঠবে সবাই। চিলেকোঠাও তার সদস্যদের নিয়ে আগামী ৫ ই মার্চ মেতে উঠবে রঙের উৎসবে। সারাদিনের খুশীকে মনের কোণে একটু ঠাঁই দেবে। যাতে সেই পাথেয় দিয়ে আগামী দিনগুলো আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। নতুনরূপে চিলেকোঠা ই-ম্যাগ
এগিয়ে চলেছে সবার হাত ধরে। আসুন, আপনিও
আপনার নিজের মনগ্রাহী লেখা গল্প কবিতা, নিজের
আঁকা বা ক্যামেরায় তোলা ছবি দিয়ে ভরিয়ে তুলুন ই-ম্যাগের পাতা।
আপনার মূল্যবান সৃষ্টি স্থান করে নিক পাঠকদের মনের আঙিনায়। সমস্ত পাঠককে জানাই বাসন্তিক শুভেচ্ছা। ভালো থাকুন সবাই।
স্বপ্নস্বরূপ - ৩ / ন ন্দি নী সে ন গু প্ত
এই ত সবে ফেব্রুয়ারি মাস পড়ল। চারিদিকে বেশ
‘ভ্যালেনটাইন’ আবহ। না, রবীন্দ্রনাথের সময়ে ত এমনটি ছিল না। প্রেম নিয়ে এত ভাবনা
তথা বিপণন কোনটাই জীবনযাপনের অন্তর্ভুক্ত ছিলনা। তবুও রবীন্দ্রনাথের গানে বা কবিতায় আমরা দেখতে পাই নিরবচ্ছিন্ন
প্রেমের ভাবনা। না, আমি কিন্তু ঈশ্বরপ্রেমের প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। বহু রবীন্দ্রগানে বা কবিতায়
এই উত্তরণ আছে, যেখানে তিনি প্রিয়কে ‘দেবতা’ অথবা প্রিয়াকে ‘দেবী’র আসনে বসিয়েছেন।
কিন্তু সেসব কিছুর বাইরে যে জাগতিক প্রেম, সেই বিশেষ প্রবাহকে রবীন্দ্র-রচনার
মধ্যে বারে বারে দেখতে পাই। যা সুন্দর, তা প্রেমময়। বারে বারে এই বার্তা আমরা পাই তার
লেখায়, তার গানে।
সুন্দরকে আমরা কিভাবে অনুভব
করি? অবশ্যই জাগতিক জিনিসের মধ্যে। প্রিয়দর্শনে মনে যেমন উৎফুল্ল ভাব আসে, সুন্দর
ফুল, সুন্দর দৃশ্য দেখলেও যে তেমনটিই হয়, একথা হয়ত বা তিনিই ভাবিয়ে তুলেছিলেন
বাঙ্গালী জাতিকে। কোনও সন্দেহ নেই এই ভাবনায় পাশ্চাত্যশিক্ষার বিশেষ প্রভাব আছে, কিন্তু
সংসারের আঙিনার বাইরে নারী-পুরুষের স্বাধীন প্রেমের কথা হয়ত বা তিনিই প্রথম
বলেছিলেন। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে রাধা পূজিতা হলেও ‘কলঙ্কিনী’। কিন্তু তার লেখার
নারীচরিত্রেরা অনেকখানি স্বাধীন। তার
লেখায় প্রেমকে চিরকালীন এক মহিমার আসনে বসিয়েছেন, কখনও লাঞ্ছনা করে নামিয়ে
আনেন নি নর্দমার পাঁকে। কখনও কখনও অবশ্য তার লেখায় প্রেমের প্রকাশ অবাস্তব বলে মনে
হয়, মনে হয় সত্যিই কি জাগতিক জীবনে প্রেমের এতখানি মর্যাদা? ঠিক এই জায়গাতেই কবি
জিতে যান। এই আশাবাদকে জিতিয়ে দিতে চাওয়া এক অদম্য মনোভাবে কবি জীবনের অতি তুচ্ছ,
সাধারণ জিনিসের মধ্য দিয়েও প্রেমকে চিরনশ্বর করে তোলেন। না, প্রেমের পাত্রপাত্রী নয়, প্রেম নিজেই
হয়ে ওঠে আনন্দস্বরূপ। ঈশ্বরবিশ্বাসীদের কাছে যেভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অমলিন,
প্রেমের ক্ষেত্রেও তাই। শুধু তফাতটা এই, যে কবি অবিশ্বাসীদেরও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে
জানেন।
বৈষ্ণব ধর্মে যে প্রেম
রাধা-কৃষ্ণের প্রণয় থেকে শুরু হয়ে লীন হয়ে যায় চরম আধ্যাত্মিকতায়, কবি ঠিক সেইখান
থেকে আবার শুরু করেন যাত্রা। সেই মধুর ভাবটিই সতত দেখতে পাই তার রচনায়। রূপ-
অরূপের দ্বন্দ্ব, প্রেম বিষয়ে নারী-পুরুষের ভিন্ন ভিন্ন ভাবনা সবকিছুই যেন
‘বিরহ-মিলন মিলে গেল আজ সমান সাজে’।
‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থের
অনেক কবিতায় আমরা দেখি জাগতিক প্রেমের এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস। মনে হয় সময়ের থেকে
অনেকখানি এগিয়ে ছিলেন কবি। সেসময়ে অনেক সমালোচকদের- এমনকি কবির অনুরাগীদেরও বলতে
শোনা গিয়েছিল, ‘কবি ওইধরনের কবিতাগুলি না লিখলেও পারতেন’। কিন্তু তিনি যে
জীবনশিল্পী, তাই মানবজীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যে জাগতিক এবং শরীরী প্রেম,
তা বর্জিত হয় নি তার লেখনীতে।
প্রেম ব্যতীত যে স্ত্রী বা পুরুষ কোনওভাবেই
সম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে না, একথা শুধু সঙ্গীত বা কবিতার মাধ্যমে নয়- তিনি এমনকি
দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে যান তার প্রবন্ধাবলীর মধ্যেও। তিনি বলেন...
‘আমাদের দেশে
পরিবার আছে, কিন্তু সমাজ নাই তাহার এক
প্রধান কারণ স্ত্রীলোকেরা পরিবারের মধ্যে বদ্ধ, সমাজের মধ্যে ব্যাপ্ত নহে। স্ত্রীলোকের প্রভাব কেবলমাত্র পরিবারের পরিধির মধ্যেই
পর্যাপ্ত। পরিবারের বাহিরে আর মানব সমাজ নাই, কেবল পুরুষ সমাজ আছে। কেবল পুরুষে পুরুষ গড়িতে পারে না। এমন-কি পুরুষ প্রকৃতি গড়িয়া তুলিতে স্ত্রীলোকেরই বিশেষ আবশ্যক। কারণ, স্ত্রীলোকেই চাহে, পুরুষ পরিপূর্ণ রূপে পুরুষ হউক। পুরুষের উন্নত আদর্শ স্ত্রীলোকের হৃদয়েই বিরাজ
করিতে পারে। স্ত্রীলোকের জন্যই পুরুষদিগকে বিশেষরূপে পুরুষ হওয়া আবশ্যক।... ‘
একটু ভেবে দেখলে
দেখতে পাই, পরিস্থিতির কিছুটা বদল হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। নারীমানুষের ব্যাপ্তি
ক্রমেই পরিবারের সীমা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে
সমাজের বিভিন্ন স্তরে। কিন্তু কবির কল্পনায় তিনি পুরুষের যে রূপ দেখে গিয়েছেন, তা কবে সাধিত হবে? হয়তো এক অনির্বচনীয়
প্রেম এসে কোনও একদিন বদলে দেবে সমাজের গঠন, কবির কল্পনামাফিক আমরা পাবো নতুন পথের
সন্ধান। কবি আবার উচ্চারণ করবেন... ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি... ‘
পলাশ ফাগুনের গল্প. / শ্যামশ্রী চাকী
বসন্তে যেমন ফুল ফোটে তেমন ফুল ঝরে। কুদরতের নিয়মে যত ফুল ফোটে ঠিক তত ফুলই ঝরে। আল্লা তালার হিসেব চুলচেরা। শুধু কি ঝরে? ফুল কাঁদে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে পাতায় মুখ গুঁজে কাঁদে, রাত যখন নিঝুম হয় ফুলের চোখে জল জমে, রাত গড়ায় জল গড়ায়, ভোরের একটু আগে সেই জল মাটিতে ফেলে দেয় ফুল। আজানের সময় চোখে পানি রাখা গুনহা। ওই ফেলে দেওয়া জলটাই হল শিশির। এ সব কিতাবে নেই, আল্লাহতালার সব বানী হাদীসে নেই। নবীজি গাছের পাতায়, সবুজ ঘাসে,নীল আকাশে সব লিখে গেছেন। তুমি চাইলেই পড়তে পারো না চাইলে বানী তোমার কাছে ধরা দেবেনা।
এই যে চাঁদনী বাজারের রেল লাইনের ধারে পলাশডাঙার সারা মাঠ জুড়ে পলাশের মেলা, কুড়োও দেখি এক ধামা পলাশ? ওগুলো পলাশ নয় বুক চেরা রক্ত, পৃথিবীর যত ছেলে ভালোবাসায় ধোঁকাবাজি খেয়েছে সেই সব মেয়েদের বিয়ের দিনে বুকের গহীন থেকে যে দীর্ঘশ্বাস উঠেছে আর তা ফোঁটা ফোঁটা রক্ত শুষে আকাশে কয়েক দিন উড়ে তারপর ফাগুনমাসে পলাশ হয়ে ফুটেছে।আর মেয়েদের কান্নাগুলো হয়েছে শিমুল, কদিন বাদেই হালকা তুলো হয়ে বাতাসে ভাসে শিমুল। কুদরৎও জানে মেয়েদের রক্তের কিমৎ হালকা।
ফাগুনমাস এলেই শামিম সারাদিন ব্যস্ত। মাঠের পলাশ কুড়িয়ে জমাদিতে হবে ফ্যাক্টরিতে। লাল কমলা পলাশ থেকে রঙ বের করে কাপড় রাঙায় ওরা। আরো অনেক ফুল লাগে নীল অপরাজিতা, জবা, গাঁদা, কৃষ্ণচূড়া। তবে শামিম শুধু পলাশ কুড়োয়। তাজা পলাশ চাই বাবুদের, শুকনো পলাশে রঙ আসেনা।
শুনশান দুপুরে ঝিম ধরেছিল শামিমের, হঠাৎ সামনে দুধসাদা জামায় দাঁড়িয়ে মেয়ের দু হাত পাতা। ডাহুক দুপুর, খরখরে রোদ আর মাঠজুড়ে ছড়ানো লাল পলাশ মিলে মনে হয়েছিল বেহস্তের কোন হুর পরী। হাত ভরে পলাশ দিয়েও কোচড়ে করে আরো নিয়ে গিয়েছিল মেয়ে। তারপর ফি দুপুরে আসত সাদা পোশাকের মেয়ে, খিলখিল হাসিতে পলাশ আরো লাল হয়, দুজনের গল্প শুনতে শুনতে গাছ ঝেঁপে ফুল ফোটায়।
ফাগুন যায় আসে চৈত্র, পলাশ ফুরোয় শিমুল ফোটে। মেয়েটা তবুও আসে, শামিমের ফুলের ধামায় আর একটাও ফুল নেই, শুধু ফুলেল ভালোবাসা উপচে পরে। ভালোবাসার রঙ আসমানি।মেয়ের সাদা পোশাকে রঙ লাগেনা, আসলে শামিম জানে রামধনুর সব কটা রঙ মেয়েটা গায়ে মেখে নিয়েছে। সব রঙ মিলেই ত সাদা হয় হুরপরীর পোশাক।
কোকিল ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয় একদিন। সেদিন আসমানে কালি লাগে, আসমানের দিল আগুনে পুড়িয়ে কাল বৈশাখী নামে। মরসুমের প্রথম বৃষ্টি নামে, মাটি সোঁদা খুশবু ছড়ায় আর হুর পরী শামিম কে বলে পরের ফাগুনে যেদিন প্রথম পলাশ ফুটবে সেদিন শামিমের ছোট্ট ঘরে পলাশের সাজে সাজবে পরী।
ঝড় জল থামে.. কোকিল ভাঙা ডানায় কাতরায়, সাদা পরী ধীর পায়ে হেঁটে পলাশ মাঠ পেরোয়। গ্রীষ্ম যায় বর্ষা আসে গাঙভাসিতে ছোট্ট ঘরে পলাশের ফাগুনের স্বপ্ন দেখে শামিম। একদিন আসমানি নীল হয় শিমুলতুলোর মত মেঘ ভাসে। শামিম আর কোন ফুল কুড়োয়না, ফ্যাক্টরির কাজটা যায়। একা ঘরে বসে ভাবে হুর পরীর কথা। শীত শেষ হতে না হতেই শামিম সারাদিন বসে থাকে পলাশডাঙার মাঠে কবে কুঁড়ি ধরবে। একদিন গাছে কুঁড়ি আসে। এক সকালে শামিম দেখে পলাশ গাছ গুলো রক্তের মত লাল। কিন্তু পরী আসেনা। শামিম রোজ ধামা ভরে ফুল কুড়িয়ে বসে থাকে, সন্ধ্যের সময়ে গাঙের জলে ফুলগুলো ফেলে ক্লান্ত পায়ে বাড়ি ফেরে শামিম। একদিন আবার কাল বৈশাখী আসে কিন্তু সাদা পোশাকে পরী আসেনা, সেদিন থেকে পলাশডাঙার মাঠে যাওয়া বন্ধ করে শামিম। বৈশাখে একটা দোকানে কাজ নেয়।
আবার ফাগুন আসে, শামিমের আব্বার কাশি আর কমেনা, কথা কইতে হাঁফ ধরে। শহরে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে,টাকা কই? শামিম আবার পলাশডাঙার মাঠে যায়, ধামা ভরে রক্ত পলাশ কুড়োয়। আব্বা আর শামিম মিলে পলাশের মালা গাঁথে, দোল উৎসবের মেলা, পলাশের মালা খুব বিকোবে আজ, মেয়েরা খোঁপায় জড়িয়ে মেতে উঠবে নাচে,আকাশে উড়বে আবীর। পাঁচ টাকায় একটা মালা। সবুজ চুড়ি পড়া হাতে শামিম তুলে দেয় টাটকা পলাশ মালা। চমকে তাকায় হুর পরী। আজ পলাশ রাঙাশাড়িতে সিঁথিতে সিঁদুর মাথায় ঘোমটায় পরী মানবী । পরী আর চেনেনা শামিম কে শামিম ও পরীকে খুঁজে পায়না। খোঁপায় পলাশ মালা জড়িয়ে স্বামীর হাত ধরে মেলার ভীড়ে হারায় পরী। সেই রাতের ঝরে পলাশডাঙার গাছ গুলো সব পলাশ ঝরিয়ে শান্ত হয়ে আজান শোনে শুধু একটি গাছ যে আগে কোনদিনই ফুল দেয়নি দুটো রুদ্রপলাশ ফোটায়।
কবিতা / টান যাঁর থাকে / অনুপম দাশশর্মা
.
টান যাঁর থাকে সে শত টানাটানির মধ্যেও
টেনে রাখে হাত
স্নায়ুর উদ্দামতা নয়, সামান্য আঙুলের ছোঁয়া
সেখানে পরম সাধ
.
এই যে ফিরেছে বসন্ত, কোকিলের শিসে
এখন অ-সুখেও কঠিন মন
হঠাৎ পলাশকে ভালোবাসে
.
টান যাঁর থাকে সে বিক্ষত সংসারেও
ফাঁকা বারান্দায় সাধনায় বসে
তখন নিয়মের বাঁধ ভাঙ্গে,
কুরুপ্রাঙ্গন থেকে নেমে আসে পার্থ
.
সমস্ত চরাচরে রঙিন পালকে একে একে
ঊর্বশীরা আসে....দুটি আত্মার
মিলনের অভিলাষে....
সত্যজিৎ ও রবীন্দ্রনাথ / উৎসব দত্ত
একজন মানুষ একসাথে কত রকমের প্রতিভা ধারণ করতে পারে , এবং সে প্রতিভাকে পূর্ণরূপে বিকশিত করতে পারে
রবীন্দ্রনাথ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। রবীন্দ্র পরবর্তীকালে ঠিক এইরকম আর এক বাঙালী জন্ম নিলেন তাঁর নাম সত্যজিৎ। রবীন্দ্রনাথের মতই সত্যজিৎ রায় ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। সত্যজিৎ রায়ের জন্ম ১৯২১ সালে ২৩ এপ্রিল বিখ্যাত রায়চৌধুরী বংশে। তৎকালীন বাংলায় মেধা-মননে কেবল জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সাথেই তুলনা চলে এই রায়চৌধুরী পরিবারের। পিতামহ উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, পিতা সুকুমার রায়, পিসী লীলা মজুমদার- প্রত্যেকেই ছিলেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক। সত্যজিৎ ছিলেন একাধারে চিত্রকলা , সঙ্গীত চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ। শেষ জীবনে তিনি উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনার কাজ করেছেন। ছিলেন জনপ্রিয় লেখক। প্রতিবছর পুজো সংখ্যায় তার কোন না কোন উপন্যাস প্রকাশ হত। ফেলুদা তাঁর তৈরি কালজয়ী চরিত্র যা তিনি পরে সিনেমায় এনেছিলেন। তিনি বেশ কয়েকটি বইয়ের মলাটের নকশাও এঁকেছেন। তার সৃষ্ট দুটি মুদ্রাক্ষরের আদল ( টাইপ ফেস) ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। এই ফেস দুটির
রবীন্দ্রনাথ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। রবীন্দ্র পরবর্তীকালে ঠিক এইরকম আর এক বাঙালী জন্ম নিলেন তাঁর নাম সত্যজিৎ। রবীন্দ্রনাথের মতই সত্যজিৎ রায় ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। সত্যজিৎ রায়ের জন্ম ১৯২১ সালে ২৩ এপ্রিল বিখ্যাত রায়চৌধুরী বংশে। তৎকালীন বাংলায় মেধা-মননে কেবল জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সাথেই তুলনা চলে এই রায়চৌধুরী পরিবারের। পিতামহ উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, পিতা সুকুমার রায়, পিসী লীলা মজুমদার- প্রত্যেকেই ছিলেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক। সত্যজিৎ ছিলেন একাধারে চিত্রকলা , সঙ্গীত চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ। শেষ জীবনে তিনি উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনার কাজ করেছেন। ছিলেন জনপ্রিয় লেখক। প্রতিবছর পুজো সংখ্যায় তার কোন না কোন উপন্যাস প্রকাশ হত। ফেলুদা তাঁর তৈরি কালজয়ী চরিত্র যা তিনি পরে সিনেমায় এনেছিলেন। তিনি বেশ কয়েকটি বইয়ের মলাটের নকশাও এঁকেছেন। তার সৃষ্ট দুটি মুদ্রাক্ষরের আদল ( টাইপ ফেস) ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। এই ফেস দুটির
নামকরণ করা হয়েছে‘রে রোমান’
ও ‘রে বিজারে।
’ মজার কথা হচ্ছে , সত্যজিৎ রায় তথাকথিত চলচিত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেননি অথচ তিনি নিজেই চলচ্চিত্রের এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট সব প্রক্রিয়া তিনি নিজে হাতে করতেন। যেমন চিত্রনাট্য
, চিত্রগ্রহণ , সম্পাদনা , সঙ্গীত,
দৃশ্য সজ্জা ও পরিচালনা। ১৯৪৫ সালে সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথের
‘ঘরে বাইরে’
উপন্যাসের চিত্রনাট্য লেখান। কিন্তু তখন ছবিটি নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। পরবরতিকালে তিনি নতুন করে চলচ্চিত্র-রূপ লিখে ছবিটি তৈরি করেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে তিনি কবিগুরুর তিনটি ছোটগল্প অবলম্বনে তৈরি করেন চলচ্চিত্র
‘তিনকন্যা।’ একই বছর তিনি নির্মাণ করেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তথ্যচিত্র
‘ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
’ ১৯৬৪ সালে তিনি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি করেন ‘চারুলতা ।’
তবে এই ছবি তৈরি করতে গিয়ে তিনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গিও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখেন । সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য সততা
, নান্দনিকতা আর নৈতিকতা। যা রবীন্দ্রনাথের লেখারও প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ বিষয়গুলি সত্যজিৎ তার চলচ্চিত্রে রোপণ করেছেন গভীর নিষ্ঠায়। হেনরি মিকলি ১৯৮১ সালে সত্যজিৎএর চলচ্চিত্র সম্পর্কে লিখেছিলেন , ‘ তাঁর ছায়াছবিগুলির চিত্রভাষা থেকেই বোঝা যায় , তার কাছে চলচ্চিত্র নৈতিকতার বিষয়। তারা প্রকাশ করে হারানো পবিত্রতার জন্য স্মৃতিমেদুর ব্যাকুলতা , যে পবিত্রতা শিল্প প্রকাশের মুহূর্তেই ফিরিয়ে আনতে পারে কলকাতাবাসী । এই মহান শিল্পী যে প্রাথমিকভাবে একজন মহান নীতিবাদী , এ সত্য নজর এড়াবে কি করে?’ রবীন্দ্রনাথের মত সত্যজিৎও বিশ্বাস করতেন , শিল্পীর কাজ হয় তার শিল্পের মাধ্যমে। গান্ধীজী একবার রবীন্দ্রনাথকে রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিতে বললে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন , ‘ আপনি সুতো কাটেন
, আমি কথার জাল বুনি। যার যা কাজ। ’ রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু তাঁর নিজের কাজ নিয়ে থেকেছেন । অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হননি। সত্যজিৎও গভীর নিষ্ঠায় তার কাজটি করে গেছেন। কেউ তাকে প্রলোভিত করতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথের প্রায় সমস্ত গল্প , উপন্যাস,
কবিতা , গানে মানুষের জয়গান গাওয়া হয়েছে। সত্যজিৎও তাই। তিনি ছিলেন গভীর মানবপ্রেমী। তাঁর এই দরদ ছিল ভালবাসায় সিক্ত। এ প্রসঙ্গে তাঁর অমর সৃষ্টি
‘গুপি গাইন-বাঘা বাইন’ এর কথা বলতে হয়। পিতামহ উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরীর গল্প অবলম্বনে তৈরি তৎকালীন বাংলা চলচ্চিত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার ছবি
‘গুপি-বাঘা ট্রিলজি’
(গুপি গাইন বাঘা বাইন,
হীরক রাজার দেশে, গুপি বাঘা ফিরে এলো)। এর মধ্যে প্রথম দুটি মুভি পরিণত হয়েছিল রীতিমতো ব্লুকবাস্টারে। আরেকটি অমর সৃষ্টি হচ্ছে তার নিজের তৈরি কালজয়ী চরিত্র
‘ফেলুদা’কে চলচ্চিত্রে রূপদান (সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ)। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র জীবন ছিল ব্যতিক্রমী। পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। এ ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর মিল । রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছিলেন ১৯৩৯ সালে তাঁর জীবনের শেষাংশে। আর সত্যজিৎ অস্কার পেলেন তাঁর একেবারে মুমূর্ষু অবস্থায়। ১৯৯২ সালে ২ মে,
মৃত্যুর মাত্র ২৩ দিন আগে সত্যজিৎ লাভ করেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম পুরস্কার-
সম্মানজনক অস্কার। তার আগে বিশ্বে মাত্র ৫ জন চলচ্চিত্র পরিচালক এই সম্মান পেয়েছিলেন- গ্রেটা গার্বো, ক্যারি গ্রান্ট, চার্লি চ্যাপলিন, জেমস স্টুয়ার্ট এবং আকিরা কুরোসাওয়া।তবে কোন নোবেল বা অস্কার দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বা সত্যজিৎকে মূল্যায়ন করা যায়না। তাঁদের যে কীর্তি সে কীর্তির মূল্যায়ন কোন পুরস্কারে হয়না। সে মূল্যায়ন হয় মানুষের ভালবাসায়। সে ভালবাসা তাঁরা পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতি সত্যজিৎএর ছিল গভীর শ্রদ্ধাবোধ। এই শ্রদ্ধার প্রমাণ পাওয়া যায় সত্যজিৎ নির্মিত তথ্যচিত্র ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ প্রারম্ভিক মন্তব্যে। ‘ ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট তারিখে কলকাতা শহরে একজন মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। তাঁর মরদেহ ভস্মীভূত হয়েছে কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকার কোন আগুনে পুড়বে না। সে উত্তরাধিকার শব্দের
, সঙ্গীতের , কবিতার , মননের
, আদর্শের। তাঁর শক্তি আমাদের বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে অভিভূত করবে , অনুপ্রাণিত করবে। আমরা তাঁর কাছে বহু ঋণে ঋণী। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাই।
’ কিংবদন্তিদের মৃত্যু হয়না। তাঁরা বেঁচে থাকেন তাদের কাজের মাধ্যমে। বাঙালী জাতি যতদিন থাকবে রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যজিৎ কে নিয়ে বাঁচবে।
Subscribe to:
Posts (Atom)
সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া
সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

-
ধর্ম আমায় ধারণ করেছে আগুন করেছি বর্ম ... দেখতে পাচ্ছ এই দাবানলে জ্বলছে অস্থি , চর্ম ? দেখতে পাচ্ছ উড়ছে ফিনিক্স , চাঁ...
-
শত চেষ্টা করে যখন একটা কাঠও জোগাড় করা গেল না , তখন নদীর চরে গর্ত খুঁড়ে অভাগীকে শোয়ানো হল । যে খড়ের আঁটি জ্বেলে কাঙালি মায়ের মুখে আগুন...
-
বিষাদের মেঘ ছেয়েছে আকাশে বৃষ্টি বুঝি আসন্ন— বাতাসের চোখ ছল ছল ভাসে প্রতীক্ষা কার জন্য? ওগো মেয়ে তুমি কার কথা ভাবো, সে কি ...
-
শুকনো বকুল চললি কোথায় ? গ্রহণলাগা দুপুরবেলা লাল মাটি পথ একলা চলা - রুদ্রপলাশ মোড়ের মাথায় ? কি বললি ? আজ বিকেলে মোরগ লড়াই ...
-
হাইবারনেশানে যাই যখন তখন তার অবগাহনে ডুবে যেতে। ফিরে যাই সেই মাতোয়ারা দিনগুলোতে জীবনের জরদ্গভ প্রাচীর ডিঙিয়ে অদ্ভুত এক লুকোচুর...
-
ছাদের কার্ণিশ ঘেঁষে রোজ খেলে মরে, একাকী দেয়ালে খেয়ালে বা অখেয়ালে... হেসে কুটে একাকার। মাথা নেড়ে নেড়ে অবাধ...
-
ওকি বৃষ্টির শব্দ ? নাকি পায়ের থেকে নূপুর খুলে হাতে নিয়ে তোর দৌড়ে আসার শব্দ ; যদি তাই হয় তবে এখন কেন ? এখন তো অনেক রাত , ব...
-
নগ্ন দেহ তাতেই লেপা থাকে সংসারের দারিদ্র; রাশি রাশি অর্থ লাগি রং আর হাসি ঠোঁটে গুঁজে , দিনের পর দিন শরীরের তল্লাশি করায় মাতাল নেশ...
-
জীবনের পথ দিয়ে চলতে চলতে দিয়ার ক্লান্ত অবসন্ন মন্ ঘরের জানলায় চোখ রেখে আকাশটাকে দেখতে চাইত । কিন্তু তার আকাশটা হারিয়ে যেত , অভিমানে ...