আজকাল কাফেতে যা ভীড়! তাতে এ অঞ্চলে সাইবার কাফে বলতে এই একটিই। “ডাটা অনলাইন এন্টারপ্রাইজ”। এই ডাটাটা ডাটা মানে তথ্য
নাকি দত্ত অর্থাৎ কোনও বাঙ্গালীর টাইটেল এ বিষয়ে বন্ধু মহলে অনেক চর্চা হয়েছে
কিন্তু উত্তর পাওয়া যায় নি। এ দোকানের মালিকের পূর্ব পুরুষদের কেউ বাঙ্গালী বলেও
শোনা যায় নি। কিন্তু ঠিক দত্ত না হলেও ডাট বলে পাঞ্জাবীতে একটা টাইটেল আছে। যেমন অভিনেতা
সুনীল ডাট।
এ ক’দিন রোজই তার নাম থাকছে
ওয়েটিং লিস্টে। আধঘন্টা একঘন্টা অপেক্ষা করে তবে মেশিন খালি পাচ্ছে কাজরি। পেলেও
কপাল দোষে সার্ভার ডাউন। সার্ভারের আর দোষ কি। তার ওপর চাপ আর কি কম পড়ছে? নেট ব্যাংকিং, মোবাইল, ডেবিট কার্ড তারপর পে-টি-এম, এ-টি-এম কত কত কি। মেশিন পাওয়া
যায় তো নেট পাওয়া যায় না। ইন্টারনেট লিংক পাওয়া যায় না। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট ধরে হ্যাং হয়ে
থাকছে মেশিন।
সবেমাত্র সাইট খুলেছে। গুগল খুলে সার্চ করতে যাবে এমন সময় নীলাদ্রি এসে
পাশে দাঁড়িয়েছে। ----হাই
কাজরি! টু উইকস অনলি। সে বলল, ফোর্টিনথ ফেব্রুয়ারির কথা
বলছি।
মেশিন থেকে মুখ না তুলে চোখের তারাটা সামান্য বাঁ দিকে ঘুরিয়ে আবার
সোজা করে নিল কাজরি। তারপর গুগলের পাতায় লিখতে লাগল এইচ-টি-পি ডব্লিউ-ডব্লিউ করে ওয়েব সাইটের
ঠিকানাটা। লিখতে লিখতেই বলল, সো হোয়াট?
--সো
হোয়াট মানে?
গিফট দিবি
না? সবই কি ভুলে যাস তুই?
--কিচ্ছু
ভুলি না। কাজরি চোখমুখে উপেক্ষার ভাব এনে নিজের কাজে মন দিল।
নীলাদ্রি অসহিষ্ণু ভীষণ। চঞ্চল হাতে কাজরির মাউসটা ধরে বলল, বল কি দিবি?
--তোকে
দিতে যাব কেন?
---দিতে
যাব কেন মানে?
ভ্যালেন্টাইন
ডে তে সারাদিন আমাদের মিলেনিয়াম পার্কে ঘোরার কথা ছিল না? তুই আমায় গিফট দিবি। আমিও দোব
অবশ্য। তবে এখন বলব না। সারপ্রাইস।
মাউসটা টেনে ছাড়িয়ে নিল কাজরি। নিজের কাজ করতে করতে বলল, কোনও কথা ছিল না।
--কথা
ছিল না মানে?
নীলাদ্রি তো
রেগে কাঁই। গলার উচ্চতা একটু বাড়াল। যা এখানে একটু বেমানান বটে। পাশের কিউবিকলসের
মেয়েটা পর্যন্ত কৌতূহলী ঘাড় একটু ঘোরাল এদিকে। তারপর আবার কাজ করতে শুরু করল।
---সিন
ক্রিয়েট করিস না নীল। আমি এখন বিজি। বিরক্ত হলেও ঠান্ডা গলায় বলল কাজরি।
---তোর
ব্যস্ততা মানে তো অনিন্দ্যকে চ্যাট করা। মানে ওর সঙ্গে প্রেম করা।
নীল! প্লিজ কন্ট্রোল ইওরসেলফ। যার
সঙ্গে খুশি প্রেম করব তোর তাতে কি?
রেগে কোনও কথা না বলেই বেরিয়ে গেল নীল। পাশের মেয়েটি বলল, খুব রেগেছে মনে হচ্ছে।
--ওসব
পিড়িংবাজ অনেক দেখেছি। ভ্যালেন্টাইন গিফট নেবে? ওঃ কত রে!
এরপর নেট সার্ফ করতে লাগল কাজরি। একটু চ্যাটিং না করলে হবে না। অবশ্য অকাজের
চ্যাটিং নয়। তার ক্লাস নোটের ব্যাপারে ডিটেলস একটু দরকার ছিল পিঙ্কা আর মণিমালার
সঙ্গে। যেটা ফোনে হবে না। একটা বইয়ের দরকারি কিছুটা অংশ ওরা স্ক্যান করে রেখেছে
সেটা পাঠাতে বলবে।
কিন্তু কাউকেই এখন পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এসব কাজ মোবাইলে ঠিক হয় না।
বাড়িতে কোনও মোবাইল এমন কি নেট পর্যন্ত নেই। অন্তত একটা ল্যাপটপ নেট কানেকশন আর
ওয়াইফাই থাকলেই চলে যেত। কিন্তু নেই।
কিন্তু কেউ নেই। খানিক্ষন এদিক ওদিক মাউস নিয়ে নাড়াচাড়া করে বিরক্ত হয়ে
উঠে পড়ে কাজরি। মনের ভেতরটা যেন কেমন খিঁচড়ে রয়েছে। নীলাদ্রির ঐ সিন ক্রিয়েট করাটা
মনে থেকে মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই। নিজেকে কি মনে করে ছেলেটা? প্রেমের সম্রাট নাকি
একচ্ছত্র অধিপতি? এভাবে
কাফের মধ্যে ঢুকে পড়ে –ছিঃ!
পাশের মেয়েটা মুখ একটু ঘুরিয়ে কাজরির মনের অবস্থাটা একটু আঁচ করার
চেষ্টা করল। তারপর কি-বোর্ডে
খট খট করতে করতে বলল, এখনকার
ছেলেরা খুব ইমপেসেন্ট হয়। বড্ড আনস্মার্ট আর অগোছালো। বলে একমুখ নীরবে হেসে নিল
মেয়েটি।
রাগে একেবারে গা-পিত্তি জ্বলে গেল কাজরির। মেয়েটির এই হাসিটায়। নিজের
পাঁঠাকে মানুষ কোন দিকে কাটবে সে সিদ্ধান্ত নেবার মালিক কেবল সে। তার লাভারকে
কেমনভাবে ব্যাঙ্গ করবে সে ভাবনা একমাত্র কাজরির। ঐ মেয়েটির নয়। আজ তার বয়ফ্রেন্ড
হোক বা না হোক এককালে ভাল তো বাসত সে নীলকে?
মেয়েটির এই হাসি যেন কাজরির উদ্দেশ্যেই। যেন তার প্রেমের সিলেকশনে
অপদার্থতার জন্যেই। তার দিকে একবার কটকটে চেয়ে কথা না বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেল
কাজরি কাফে ছেড়ে।
সময়ের আগেই বেরিয়ে পড়েছে তাই খানিক উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে ঢুকল একটা আউট
ফিটের দোকানে। পুজোয় দেওয়া বড়মাসির জিনস টা পড়েই রয়েছে। পরতে পারছে না ম্যাচিং করা
টপের অভাবে। কি করবে টপের কালারটা আর পছন্দ হচ্ছে না কাজরির। কালারটা পছন্দ করেছিল
নীলাদ্রিই। কিন্তু সে তো তখন তাকে ভালবাসত সে। আজ বাসে না। তাই এটা পরলে
নিজের মনকেই সে নিজে বলবে, কিরে কাজরি সেই তোর নীলাদ্রির কাছেই বশ্যতা স্বীকার করতে
হল নাকি?
এ হতে পারে না। নীল তার এক্স ছিল। এখন ধরা যাক ওয়াই হয়েছে। তাতে মেজাজ
তো আজ আরও খিঁচড়ে দিয়েছে। এখন আর সেটা পরা যায় না। ক’দিন ধরে ধর্মতলা, নিউ মার্কেট, গড়িয়াহাট চষে বেড়িয়েছে
মনের মত রং-এর জন্যে। কিন্তু পায় নি।
গত সপ্তায় হাতিবাগানে গিয়ে পড়েছিল আচমকাই। আর সেখানে একটা দোকানে সেই পছন্দমত রং-এর কাপড়টা পেয়ে গেছে
আচমকাই।
আজ একেবারে টপটা নিয়েই বেরোল দোকান থেকে। কারিগর অবশ্য কমপ্লিট করে রাখতে
পারে নি আজও। বলল, কি
করব দিদি ভ্যালেন্টাইনের বাজার বুঝতেই তো পারছেন। বাজার একেবারে তেতে হট হয়ে
রয়েছে। তবে যদি একটু বসতে পারেন তো করে দিই।
ঘন্টা দেড়েক ঠায় হত্যে দিয়ে বসে থেকে সেটা নিয়ে তবেই বেরোল কাজরি। কি
জানি কালকে আসবে বললে যদি ফেলেই রাখে? চোদ্দ তারিখ তো আর দেরি নেই একেবারে হাতের গোড়ায়।
দুপুরটা গড়িয়ে গেল। আজকে আর ইউনিভার্সিটির ক্লাস ফ্লাস করা হল না।
শীতটা বেশ কমে এসেছে। রোদের তেজটাও বেশ। ফেরার বাসেই উঠে পড়ল। বাড়ি ফিরেই আবার
মেজাজ বিগড়োল।
--কে
এসেছিস রে?
গোপাল? কোথায় থাকিস বাছা সারাদিন? আয় বাবা একটু পাশে বোস।
কাজরির ঠাম্মা। মানুষ নয় যেন একটা কাকাতুয়া। মাঝে মাঝে ভাবে কাজরি। সব
সময় বকে যাচ্ছে। আসলে চোখে একটু কম দেখে বলেই বোধহয় মুখে তার এত কথা। ঐ যে কথায়
বলে না এক অঙ্গ দুর্বল হলে অন্যটার ক্ষমতা বেড়ে যায়?
বিরক্তভাবে কথা না বলে ঠাম্মাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে আবার
থামতে হল। কেননা ঠাম্মা আবার ডেকেছে, ও গোপাল, আয় না। বোস না একটু পাশে।
কাজরি একটু থেমে বলল, কে তোমার গোপাল? আমি তোমার নাতনি। কাজরি গো কাজরি। আমায় কি মনে ধরে না নাকি
যে নামটা পর্যন্ত মুখে আনতে পার না?
--ও
তুই কাজি বুঝি?
তা চোখের যে
মাথা খেয়েছি দিদি।
--চোখের
মাথাফাতা নয় আসলে এটা তোমার একটা কাকাতুয়া মার্কা স্বভাব ঠাম্মা। ডাকছি তোমার
আদরের নন্দদুলাকে। আর গোপাল গোপাল কি কথা? কতবার বলেছি ওসব সেকেলে নামে
ডাকবে না ভাইকে?
কেন ওর
অর্ধেন্দু নামটা ধরে ডাকতে কি হয় শুনি?
ফোকলা দাঁতে বেশ মিষ্টি করে হাসল ঠাম্মা, দাঁতের মাথাও যে খেয়েছি দিদিভাই।
কড়াই ভাজার মত অত শক্ত নামটা মুখে আনি কি করে বল? গোপালটাই বেশ ডাক। আহা যেন কেষ্ট
ঠাকুরকে ডাকছি।
ঠাম্মা মাথায় হাত ঠেকাল বেশ ভক্তিভরে।
--থাকো
তোমার কেষ্ট ঠাকুরকে নিয়ে। যত্তো সব! ব্যস্তভাবে নিজের ঘরে চলে গেল কাজরি। আর ঠাম্মা ফ্যালফ্যাল
করে তাকিয়ে রইল যেন কি দোষ করেছে নিজেই যেন বুঝতে পারছে না এমনি ভাবে।
--মা
মা, টপটা পেয়েছি জানো? অনেক করে দেড় ঘন্টা ঠায়
টেলারিং শপে বসে থেকে তবে করিয়ে এনেছি। আজকে হবে
না বলে ফেলে রাখছিল।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে টপটা পরা হয়ে গেল কাজরির। একটা জিনস তো পরেই ছিল।
তার ওপরেই পরে ফেলল টপটা। পরেই হাসিমুখে মায়ের সামনে হাজির, বল তো আজ না হলে কি হত? চোদ্দ তারিখ আর কটা দিন
মা? কেমন হয়েছে বল তো?
মা তো প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ। টপের আর টপের মালকিনের। উজ্জ্বল হেসে
কাজরি বলল,
এটা মলয়ের পছন্দ
মা। মানে কালারটা। কেমন হয়েছে বল তো?
ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে কাজরি বলতে
লাগল, জানো তো সেই নীলাদ্রি
এসেছিল। কি সাহস!
কাফেতে ঢুকে একেবারে হাত ধরে টানাটানি। বলে ভ্যালেন্টাইন গিফট দিতে হবে। সারাদিন
ঘুরবে মিলেনিয়াম পার্কে। তারপরে আবার নাকি সেই নন্দনে।
কাজরির মা আর কি বলেন। চুপ করেই থাকেন। কাজরি এক স্পীডে বলে যায়, আমিও ঝেড়ে দিয়েছি একেবারে
স্কোয়ার কাট।
--তা
বেশ করেছিস। ভারতী মুচকি হাসল, বেশ করেছিস। তা এবার কার সঙ্গে ঘুরবি? পিংকা আর মণিমালা—
থামিয়ে দিল কাজরি, আরে ওদের তো নিজেদেরই একটা একটা করে আছে। মলয় কি আকাশ তো
মুখিয়েই আছে। তবে মলয়কে নেব না। ও কিচ্ছু খাওয়ায় না শুধু ফুচকা ছাড়া। বলে পেট ভরে
ফুচকা খাও আর কিছু খাবার দরকার হবে না। আরে বাবা সে তো আমিও জানি। একগাদা তেঁতুল
গোলা জলে পেট ঠেসে দিলে কি আর কিছু খাবার কথা মনে হয়। যেমন পাজি তেমনি চালাক
ছেলেটা।
--তোদের
এখন এই বেশ একটা হয়েছে। ভ্যালেন্টাইন ডে। আমাদের সময়ে এসব ছিল না। বেশ প্রশ্রয়ের
হাসি হাসে ভারতী। বয়েস এখন চল্লিশের বেশ কিছু ওপরে। দু দুটো ছেলেমেয়ের মা। একটা
মাঝারি সংসারের কর্তৃ। মনে যৌবন নেচে বেড়ালেও দেহে যে ভাটার টান দেখে বেশ বোঝা
যায়।
ওদিকে ঠাম্মা বেশ চেঁচামিচি জুড়েছে। অনেক্ষণ থেকেই চলছিল কানে আসছিল
দুজনেরই। কিন্তু কান না পাতার জন্যে সেগুলো ফিরে যাচ্ছিল। ভারতী গিয়ে বলল, কি হল মা? আপনার সব সময়
চেল্লামিল্লি আর ভাল লাগে না।
--বলি
আমার সঙ্গে ঠাট্টা? ঠাম্মা
তো রেগে একেবারে কাঁই, চোখে
দেখতে পাই না বলে ঠাট্টা! আমি খবরের কাগজ পড়তে পারি? আমায় যে দিয়ে গেল কাজি?
ভাঙ্গা দাঁতের জন্যে কাজরি উচ্চারণ করতে পারে না ঠাম্মা। বলে কাজি।
সকালে কলেজ যাওয়ার সময় বাংলা খবরের কাগজটা দুম করে ফেলে গিয়েছিল ঠাম্মার কোলে।
বলেছিল, সব সময় কাকাতুয়ার মত না
কপচে চুপ করে কাগজটা পড় তো ঠাম্মা। আমাদের কানগুলোকে একটু বিশ্রাম দাও।
সকালে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছিল নাতনি। তখন খানিক ভ্যাবাচ্যাকা
খেয়েছিল। কোলের ওপর যেটা পড়ল সেটা কি বস্তু তা ঠাওর হতে না হতেই কাজরি তো পগার
পার। বিকেলে সে বাড়ি ফিরতেই রাগটাও ফিরে এসেছে। এখন তার শোধ তুলছে বুড়ি।
কাজরিও এসেছিল মায়ের পিছু পিছু। বলল, ঐ ফোকলা দাঁতে আর ফক ফক কর না তো।
--তা
তো বটেই। বলি দে না দাঁতগুলো বাঁধিয়ে। কতবার তো বলেছি। তাহলে তো আর ফক ফক করতে হয়
না।
--কেন
বাদাম ভাজা খাবে নাকি ঠাম্মা? কাজরি ঠাট্টা করে হেসে উঠল। ভারতীও যোগ দিল।
--না
খেতে তো আর সাদ-আহ্লাদ যায় না? বুড়ি গজ গজ করতে
থাকে।
আসলে আগেকার দিনের হিসেবে বুড়ি হলেও আজকালের হিসেবে মোটেই বুড়ি বলা চলে
না সাতষট্টি বছরের ঠাম্মাকে। কিন্তু বুড়ি আখ্যা দিয়ে তার দাবিগুলোকে তো দমিয়ে রাখা
যায়।
--কখন
থেকে বলছি গোপালকে ডেকে দে। আমাকে নিয়ে একটু বাথরুমের দরজায় ছেড়ে আসবে। তা শুনলি
আমার কথা?
ডায়াবেটিসে সাতষট্টি বছরেই কাবু করেছে ঠাম্মাকে। দাঁত গেছে চোখ গেছে।
বাতে প্রায় পঙ্গু। প্রথম কিছুদিন চিকিৎসা হয়েছিল। কিন্তু ডাক্তার কোবরেজে
ব্যতিব্যস্ত ছেলে আর ছেলের বৌ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডায়াবেটিস তো বড় তেমন কোনও রোগ নয়।
ও একটু খাদ্যসংযম করলেই নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ভোরে এক কাপ নিমপাতা কি করলার রস।
ব্রেকফাস্টে একটা ক্রিম ক্র্যাকার আর এক মুঠো শুকনো খোলায় চিঁড়ে ভাজা। দুপুরে
একহাতা ভাত,
একটা রুটি
আর পেঁপে বেগুনের ঝোল। সারা সন্ধ্যেতে পেটে কিল মেরে বসে বসে ডিনারের সময় ঘুমিয়ে
পড়া। আর রাতে না ঘুমিয়ে বিছানায় শুয়ে ছেলে বৌকে খেতে না দেবার জন্যে শাপ শাপান্ত।
এই হল আপাতত বুড়ির রুটিন।
সকালে, বিকালে
আর রাত্রে অন্তত বার ছয়েক ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যেতে হয়। গোপাল ওরফে অর্ধেন্দুই
সেটা করে। ঠাম্মা
তো গোপাল অন্ত প্রাণ। স্নানের কাজটা বারান্দায় বসে নিজেকেই সারতে হয় ঠাম্মাকে। এক
গামলা জল বসিয়েই ছুটি ভারতীর। সংসারের নানা হ্যাপা। এসব সামলে এখন আবার বুড়ির
সেবা।
এক গামলা জলে কোনমতে চানটা সারে ঠাম্মা। তখন ভারতী টিভিতে রান্নার
রেসিপি আর নয় টেলিশপিং-এ শাড়ি দেখায় ব্যস্ত থাকে।
--ভুলে গেছি বাবা। কাজরি এবার একটু নরম গলায় বলল, তা তুমিও তো একটু
উঠতে টুটতে চেষ্টা করতে পার ঠাম্মা। এভাবে পরের ভরসায় কদিন থাকবে?
--থাকতুম না থাকতুম না। বুড়ি গজ গজ করে, চোখটা থাকলে ভরসা করতুম না।
তোরাও তো আর চশমাটা করিয়ে দিলি না।
ভারতী বলল, ওভাবে
বলবেন না মা। কতগুলো টাকা খরচ করে চোখ দেখিয়ে আনলুম সেটা বলুন?
কাজরি ফস করে বলে ফেলল, তুমি তো আর গল্প উপন্যাস পড়বে না ঠাম্মা।
বুড়ি তো খুব খাপ্পা হয়ে তার দিকে এমনভাবে দেখতে লাগল যেন চোখ দিয়ে
ঠিকরে পড়া আগুনে এক্ষুনি সে ভস্ম করে ফেলে আর কি।
ভারতী বলল, চশমাটা
রয়ে সয়ে হবে মা। ভাবছেন কেন? ছেলের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন। সিমলা মানালি যেতে আমাদের
কতগুলো টাকা বেরিয়ে গেল বলুন? আপনার ছেলে এল-টি-সিতে শুধু গাড়িভাড়াই পায়। আর বাকি খরচ? হোটেল খরচ কি কম পড়েছে
আজকাল? পুজোর সময় জিনিসের দাম যে
দশ গুণ করে বাড়ে তা কি বলে দিতে হবে তবে সে জানবে?
আসলে মাস কয়েক আগে ভারতী বলেছিল অঞ্জনকে, রোজই বুড়ি গজরায়। দাও না যাহোক
একটা সস্তা দরের চশমা। পঞ্চাশ একশ যা হয়।
--পঞ্চাশ
একশতে আজকাল চশমা দূরে থাক তার ডাঁটিও পাওয়া যায় না ভারতী। সাড়ে তিনশ চারশোর কমে
কিছুই নেই।
কথাটা নিয়ে আর বেশি কিছু উচ্চবাচ্চ করে নি ভারতী। চশমার
প্রেসক্রিপশনটাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বেশ কিছুদিন। তা প্রায় মাস তিন চার হল। অঞ্জন
চশমা কেনার মতি করলে তো ফ্যাসাদ। প্রেসক্রিপশন হারাবার হ্যাপাটা সামলাতে হবে
তাকেই। তাছাড়া ঐ কাজরির কথায় গল্প-উপন্যাস তো আর পড়বে না বুড়ি? ফালতু একটু নড়াচড়ার জন্যে কি
দরকার?
সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে সিমলা যাবার সময় মাস খানেকের মত মাকে কাজরির
ছোটকাকার বাড়ি রেখে এসেছিল অঞ্জন। হতে পারে সেই সময়ই প্রেসক্রিপশনটা এদিক ওদিক
হয়েছে। তখন নাকি ঠাম্মার খুব কষ্ট হয়েছিল। বুড়ি কাকাতুয়ার মত বারবার সেকথা বলত।
হয়ত বুড়ির বকুনির ঠেলাতেই মাথার ঠিক রাখতে না পেরে ভারতী হারিয়ে ফেলেছে।
তখন তো খুব রেগে গিয়েছিল ভারতী। বলেছিল, দেখুন মা আজকাল অনেক বৃদ্ধাশ্রম
হয়েছে। ইচ্ছে করলে আমরা অনায়াসে আপনাকে সেখানে রাখতে পারি। কিন্তু তেমন ছেলে নয়
আপনার। নই আমিও।
অর্ধেন্দু ওরফে গোপাল এসে হাজির। কাজরি হাসল খিলখিল করে, এবার যাও ওর কোলে চেপে
বাথরুমে।
মা মেয়ে চলে গেল। গোপাল বেশ যত্ন করে ধরে ধরে নিয়ে গেল ঠাম্মাকে। উচ্চ
মাধ্যমিক দেবে। পড়াশোনায় একেবারে মাঝারি। বাড়িতেই থাকে সর্বদা। কাজরি ওর নাম
দিয়েছে ঘরকুনো বলে। কারো সঙ্গে মেশে না বা কোনও অনুষ্ঠানে যায় না। ঠাম্মাই যা
গোপালের ভক্ত। নাহলে সে অন্য সকলের করুণা আর তাচ্ছিল্যের পাত্র।
মলয় বা আকাশ নয়। এবারে মিলেনিয়াম পার্কে সম্বিতের সঙ্গে ঘুরে বেড়াবে
কাজরি। সাড়ে ছ হাজার দিয়ে কাজরিকে একটা স্মার্ট ফোন কিনে দিয়েছে সে। মাকে কাজরি
বলেছে, দেখবে মা সামনের বছরে
সম্বিত আরও দামি উপহার দেবে বলেছে। ও একটা নতুন ব্যবসা ধরেছে।
নিজের বিছানায় বসে কি সব করছিল অর্ধেন্দু। ভারতী ঢুকতে একটু আড়াল করার
চেষ্টা করল। ভারতীর কৌতূহল বেড়ে গেল। উঁকি দিয়ে দেখল বেশ কিছু টাকা মানে দশ টাকা
পাঁচ টাকা আর কয়েন গুণছে।
--এই কিসের টাকা রে?
--আমার টাকা। অনেক দিন ধরে জমিয়েছি।
--জমিয়েছিস? ভ্রূ কুঁচকে ভারতী প্রশ্ন করল, কি করে জমালি শুনি?
বাড়ি থেকে অটো বা টোটো ভাড়া পায় সে স্কুলে যাওয়ার জন্যে। অটোয় যেতে ওর
নাকি ভাল লাগে না। কিছুদিন ধরে হেঁটেই যায় পথটা। মাকে জানায় নি। তাতে যদি
গাড়িভাড়াটা বন্ধ হয়ে যায়? ভারতি আবার প্রশ্ন করল, তা কত হল?
--সাড়ে তিনশর কিছু বেশি। ঠিকভাবে গুণলে মনে হয় চারশোর কিছু বেশিও হতে পারে।
--তা গুণছিস কেন? কি করবি? বরং বাবাকে দিয়ে দে ব্যাংকে তোর অ্যাকাউন্টে
জমা করে দেবে। ব্যাংক সুদ দেয় জানিস তো?
--না জমাবো না। গিফট কিনব। অর্ধেন্দুর মুখে লাজুক হাসি, ভ্যালেন্টাইন
গিফট।
ভারতী তো আর হেসে বাঁচে না। মায়ের মুখে কথাটা শুনে হো হো করে হেসে উঠল
কাজরিও। একটা ঘরকুনো ছেলে সাতজম্মে কারোর সঙ্গে মেশে না সে কিনবে ভ্যালেন্টাইন
গিফট? কার জন্যে কিনবে শুনি? ওর আবার প্রিয়জন কে? নাকি ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে
ছেলেটা?
--জানো মা এখন খুব অল্প বয়েসেই পেকে যাচ্ছে ছেলেগুলো। ওকে একটু চোখে
চোখে রেখো কিন্তু।
কাজরির কথাটা নীরবে সমর্থন করল ভারতীও। কি জানি বাবা। আজকাল এই ক্লাস
ইলেভেন টুয়েলভের ছেলেমেয়েগুলো খুব প্রেম টেম করে। কাগজে টিভিতে অনেক বাজে বাজে খবর
পাওয়া যায়। কাজরি তো ঠিক কথাই বলেছে।
চোদ্দ তারিখে সারাদিন খুব ঘোরাঘুরি হল কাজরির। রাত সাড়ে নটায় সম্বিতের
দেওয়া গিফট নিয়ে ফিরে সে খুব ক্লান্ত। তাছাড়া খুব খাওয়া দাওয়াও হয়েছে। এখন একটু
বিশ্রাম চাই। আরও বেশ কিছুক্ষণ থাকার কথা বলেছিল সম্বিত। কিন্তু বাবা আসবে রাত
দশটায়। এর মধ্যে না বাড়ি ঢুকলে খুব রাগারাগি করবে সে। মাকে একেবারে পাত্তা না
দিলেও বাবাকে কিন্তু খুব ভয় করে কাজরি। আসলে ভালবাসে খুব তাই তাকে রাগাতে ইচ্ছে
করে না একেবারে।
--কে রে কাজি এলি?
--কে রে কাজি এলি?
ঠাম্মাকে পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরের দিকেই চলে যাচ্ছিল সে। থমকে দাঁড়িয়ে
পড়ল। বুড়ি তাকে চিনতে পেরেছে? দিনের আলোতেই যে ভাল করে লোক চিনতে পারে না সে ভরা
রাত সাড়ে নটার সময় চিনল কি করে?
বেশ হাসি হাসি মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে ঠাম্মা। সারা মুখে রসিকতার
রেখা এঁকে তার দিকে আবার একটা প্রশ্নও ছুঁড়ে দিয়েছে, প্রেমের দিনটা কেমন কাটল
দিদিভাই?
ঘরে বড় আলোটা জ্বলছে। অন্যদিন তো নাইট ল্যাম্প ছাড়া আর কিছু জ্বলে না। ঠাম্মার
কোলে আজকের খবরের কাগজটা বড় করে পাতা। চোখে নতুন কেনা চশমা। একেবারে সদ্য নতুন।
ঝকঝকে।
অসাধারণ.........।।
ReplyDeleteঅসাধারণ
ReplyDelete