Friday, February 24, 2017

সত্যজিৎ ও রবীন্দ্রনাথ / উৎসব দত্ত


একজন মানুষ একসাথে কত রকমের প্রতিভা ধারণ করতে পারে , এবং সে প্রতিভাকে পূর্ণরূপে বিকশিত করতে পারে 

রবীন্দ্রনাথ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। রবীন্দ্র পরবর্তীকালে ঠিক এইরকম আর এক বাঙালী জন্ম নিলেন তাঁর নাম সত্যজিৎ। রবীন্দ্রনাথের মতই সত্যজিৎ রায় ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। সত্যজিৎ রায়ের জন্ম ১৯২১ সালে ২৩ এপ্রিল বিখ্যাত রায়চৌধুরী বংশে। তৎকালীন বাংলায় মেধা-মননে কেবল জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সাথেই তুলনা চলে এই রায়চৌধুরী পরিবারের। পিতামহ উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, পিতা সুকুমার রায়, পিসী লীলা মজুমদার- প্রত্যেকেই ছিলেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক। সত্যজিৎ ছিলেন একাধারে চিত্রকলা , সঙ্গীত চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ। শেষ জীবনে তিনি উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী প্রতিষ্ঠিতসন্দেশপত্রিকার সম্পাদনার কাজ করেছেন। ছিলেন জনপ্রিয় লেখক। প্রতিবছর পুজো সংখ্যায় তার কোন না কোন উপন্যাস প্রকাশ হত। ফেলুদা তাঁর তৈরি কালজয়ী চরিত্র যা তিনি পরে সিনেমায় এনেছিলেন। তিনি বেশ কয়েকটি বইয়ের মলাটের নকশাও এঁকেছেন। তার সৃষ্ট দুটি মুদ্রাক্ষরের আদল ( টাইপ ফেস) ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। এই ফেস দুটির

নামকরণ করা হয়েছেরে রোমানরে বিজারে।মজার কথা হচ্ছে , সত্যজিৎ রায় তথাকথিত চলচিত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেননি অথচ তিনি নিজেই চলচ্চিত্রের এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট সব প্রক্রিয়া তিনি নিজে হাতে করতেন। যেমন চিত্রনাট্য , চিত্রগ্রহণ , সম্পাদনা , সঙ্গীত, দৃশ্য সজ্জা পরিচালনা। ১৯৪৫ সালে সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথেরঘরে বাইরেউপন্যাসের চিত্রনাট্য লেখান। কিন্তু তখন ছবিটি নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। পরবরতিকালে তিনি নতুন করে চলচ্চিত্র-রূপ লিখে ছবিটি তৈরি করেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে তিনি কবিগুরুর তিনটি ছোটগল্প অবলম্বনে তৈরি করেন চলচ্চিত্রতিনকন্যা।একই বছর তিনি নির্মাণ করেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তথ্যচিত্ররবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।১৯৬৪ সালে তিনি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি করেনচারুলতা তবে এই ছবি তৈরি করতে গিয়ে তিনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গিও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখেন সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য সততা , নান্দনিকতা আর নৈতিকতা। যা রবীন্দ্রনাথের লেখারও প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিষয়গুলি সত্যজিৎ তার চলচ্চিত্রে রোপণ করেছেন গভীর নিষ্ঠায়। হেনরি মিকলি ১৯৮১ সালে সত্যজিৎএর চলচ্চিত্র সম্পর্কে লিখেছিলেন , ‘ তাঁর ছায়াছবিগুলির চিত্রভাষা থেকেই বোঝা যায় , তার কাছে চলচ্চিত্র নৈতিকতার বিষয়। তারা প্রকাশ করে হারানো পবিত্রতার জন্য স্মৃতিমেদুর ব্যাকুলতা , যে পবিত্রতা শিল্প প্রকাশের মুহূর্তেই ফিরিয়ে আনতে পারে কলকাতাবাসী এই মহান শিল্পী যে প্রাথমিকভাবে একজন মহান নীতিবাদী , সত্য নজর এড়াবে কি করে?’ রবীন্দ্রনাথের মত সত্যজিৎও বিশ্বাস করতেন , শিল্পীর কাজ হয় তার শিল্পের মাধ্যমে। গান্ধীজী একবার রবীন্দ্রনাথকে রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিতে বললে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন , ‘ আপনি সুতো কাটেন , আমি কথার জাল বুনি। যার যা কাজ।রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু তাঁর নিজের কাজ নিয়ে থেকেছেন অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হননি। সত্যজিৎও গভীর নিষ্ঠায় তার কাজটি করে গেছেন। কেউ তাকে প্রলোভিত করতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথের প্রায় সমস্ত গল্প , উপন্যাস, কবিতা , গানে মানুষের জয়গান গাওয়া হয়েছে। সত্যজিৎও তাই। তিনি ছিলেন গভীর মানবপ্রেমী। তাঁর এই দরদ ছিল ভালবাসায় সিক্ত। প্রসঙ্গে তাঁর অমর সৃষ্টিগুপি গাইন-বাঘা বাইনএর কথা বলতে হয়। পিতামহ উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরীর গল্প অবলম্বনে তৈরি তৎকালীন বাংলা চলচ্চিত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার ছবিগুপি-বাঘা ট্রিলজি’ (গুপি গাইন বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশে, গুপি বাঘা ফিরে এলো) এর মধ্যে প্রথম দুটি মুভি পরিণত হয়েছিল রীতিমতো ব্লুকবাস্টারে। আরেকটি অমর সৃষ্টি হচ্ছে তার নিজের তৈরি কালজয়ী চরিত্রফেলুদাকে চলচ্চিত্রে রূপদান (সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ) সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র জীবন ছিল ব্যতিক্রমী। পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর মিল রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছিলেন ১৯৩৯ সালে তাঁর জীবনের শেষাংশে। আর সত্যজিৎ অস্কার পেলেন তাঁর একেবারে মুমূর্ষু অবস্থায়। ১৯৯২ সালে মে, মৃত্যুর মাত্র ২৩ দিন আগে সত্যজিৎ লাভ করেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম পুরস্কার- সম্মানজনক অস্কার। তার আগে বিশ্বে মাত্র জন চলচ্চিত্র পরিচালক এই সম্মান পেয়েছিলেন- গ্রেটা গার্বো, ক্যারি গ্রান্ট, চার্লি চ্যাপলিন, জেমস স্টুয়ার্ট এবং আকিরা কুরোসাওয়া।তবে কোন নোবেল বা অস্কার দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বা সত্যজিৎকে মূল্যায়ন করা যায়না। তাঁদের যে কীর্তি সে কীর্তির মূল্যায়ন কোন পুরস্কারে হয়না। সে মূল্যায়ন হয় মানুষের ভালবাসায়। সে ভালবাসা তাঁরা পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতি সত্যজিৎএর ছিল গভীর শ্রদ্ধাবোধ। এই শ্রদ্ধার প্রমাণ পাওয়া যায় সত্যজিৎ নির্মিত তথ্যচিত্ররবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরপ্রারম্ভিক মন্তব্যে।১৯৪১ সালের আগস্ট তারিখে কলকাতা শহরে একজন মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। তাঁর মরদেহ ভস্মীভূত হয়েছে কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকার কোন আগুনে পুড়বে না। সে উত্তরাধিকার শব্দের , সঙ্গীতের , কবিতার , মননের , আদর্শের। তাঁর শক্তি আমাদের বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে অভিভূত করবে , অনুপ্রাণিত করবে। আমরা তাঁর কাছে বহু ঋণে ঋণী। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাই।কিংবদন্তিদের মৃত্যু হয়না। তাঁরা বেঁচে থাকেন তাদের কাজের মাধ্যমে। বাঙালী জাতি যতদিন থাকবে রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যজিৎ কে নিয়ে বাঁচবে।

No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া