বসন্তে যেমন ফুল ফোটে তেমন ফুল ঝরে। কুদরতের নিয়মে যত ফুল ফোটে ঠিক তত ফুলই ঝরে। আল্লা তালার হিসেব চুলচেরা। শুধু কি ঝরে? ফুল কাঁদে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে পাতায় মুখ গুঁজে কাঁদে, রাত যখন নিঝুম হয় ফুলের চোখে জল জমে, রাত গড়ায় জল গড়ায়, ভোরের একটু আগে সেই জল মাটিতে ফেলে দেয় ফুল। আজানের সময় চোখে পানি রাখা গুনহা। ওই ফেলে দেওয়া জলটাই হল শিশির। এ সব কিতাবে নেই, আল্লাহতালার সব বানী হাদীসে নেই। নবীজি গাছের পাতায়, সবুজ ঘাসে,নীল আকাশে সব লিখে গেছেন। তুমি চাইলেই পড়তে পারো না চাইলে বানী তোমার কাছে ধরা দেবেনা।
এই যে চাঁদনী বাজারের রেল লাইনের ধারে পলাশডাঙার সারা মাঠ জুড়ে পলাশের মেলা, কুড়োও দেখি এক ধামা পলাশ? ওগুলো পলাশ নয় বুক চেরা রক্ত, পৃথিবীর যত ছেলে ভালোবাসায় ধোঁকাবাজি খেয়েছে সেই সব মেয়েদের বিয়ের দিনে বুকের গহীন থেকে যে দীর্ঘশ্বাস উঠেছে আর তা ফোঁটা ফোঁটা রক্ত শুষে আকাশে কয়েক দিন উড়ে তারপর ফাগুনমাসে পলাশ হয়ে ফুটেছে।আর মেয়েদের কান্নাগুলো হয়েছে শিমুল, কদিন বাদেই হালকা তুলো হয়ে বাতাসে ভাসে শিমুল। কুদরৎও জানে মেয়েদের রক্তের কিমৎ হালকা।
ফাগুনমাস এলেই শামিম সারাদিন ব্যস্ত। মাঠের পলাশ কুড়িয়ে জমাদিতে হবে ফ্যাক্টরিতে। লাল কমলা পলাশ থেকে রঙ বের করে কাপড় রাঙায় ওরা। আরো অনেক ফুল লাগে নীল অপরাজিতা, জবা, গাঁদা, কৃষ্ণচূড়া। তবে শামিম শুধু পলাশ কুড়োয়। তাজা পলাশ চাই বাবুদের, শুকনো পলাশে রঙ আসেনা।
শুনশান দুপুরে ঝিম ধরেছিল শামিমের, হঠাৎ সামনে দুধসাদা জামায় দাঁড়িয়ে মেয়ের দু হাত পাতা। ডাহুক দুপুর, খরখরে রোদ আর মাঠজুড়ে ছড়ানো লাল পলাশ মিলে মনে হয়েছিল বেহস্তের কোন হুর পরী। হাত ভরে পলাশ দিয়েও কোচড়ে করে আরো নিয়ে গিয়েছিল মেয়ে। তারপর ফি দুপুরে আসত সাদা পোশাকের মেয়ে, খিলখিল হাসিতে পলাশ আরো লাল হয়, দুজনের গল্প শুনতে শুনতে গাছ ঝেঁপে ফুল ফোটায়।
ফাগুন যায় আসে চৈত্র, পলাশ ফুরোয় শিমুল ফোটে। মেয়েটা তবুও আসে, শামিমের ফুলের ধামায় আর একটাও ফুল নেই, শুধু ফুলেল ভালোবাসা উপচে পরে। ভালোবাসার রঙ আসমানি।মেয়ের সাদা পোশাকে রঙ লাগেনা, আসলে শামিম জানে রামধনুর সব কটা রঙ মেয়েটা গায়ে মেখে নিয়েছে। সব রঙ মিলেই ত সাদা হয় হুরপরীর পোশাক।
কোকিল ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয় একদিন। সেদিন আসমানে কালি লাগে, আসমানের দিল আগুনে পুড়িয়ে কাল বৈশাখী নামে। মরসুমের প্রথম বৃষ্টি নামে, মাটি সোঁদা খুশবু ছড়ায় আর হুর পরী শামিম কে বলে পরের ফাগুনে যেদিন প্রথম পলাশ ফুটবে সেদিন শামিমের ছোট্ট ঘরে পলাশের সাজে সাজবে পরী।
ঝড় জল থামে.. কোকিল ভাঙা ডানায় কাতরায়, সাদা পরী ধীর পায়ে হেঁটে পলাশ মাঠ পেরোয়। গ্রীষ্ম যায় বর্ষা আসে গাঙভাসিতে ছোট্ট ঘরে পলাশের ফাগুনের স্বপ্ন দেখে শামিম। একদিন আসমানি নীল হয় শিমুলতুলোর মত মেঘ ভাসে। শামিম আর কোন ফুল কুড়োয়না, ফ্যাক্টরির কাজটা যায়। একা ঘরে বসে ভাবে হুর পরীর কথা। শীত শেষ হতে না হতেই শামিম সারাদিন বসে থাকে পলাশডাঙার মাঠে কবে কুঁড়ি ধরবে। একদিন গাছে কুঁড়ি আসে। এক সকালে শামিম দেখে পলাশ গাছ গুলো রক্তের মত লাল। কিন্তু পরী আসেনা। শামিম রোজ ধামা ভরে ফুল কুড়িয়ে বসে থাকে, সন্ধ্যের সময়ে গাঙের জলে ফুলগুলো ফেলে ক্লান্ত পায়ে বাড়ি ফেরে শামিম। একদিন আবার কাল বৈশাখী আসে কিন্তু সাদা পোশাকে পরী আসেনা, সেদিন থেকে পলাশডাঙার মাঠে যাওয়া বন্ধ করে শামিম। বৈশাখে একটা দোকানে কাজ নেয়।
আবার ফাগুন আসে, শামিমের আব্বার কাশি আর কমেনা, কথা কইতে হাঁফ ধরে। শহরে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে,টাকা কই? শামিম আবার পলাশডাঙার মাঠে যায়, ধামা ভরে রক্ত পলাশ কুড়োয়। আব্বা আর শামিম মিলে পলাশের মালা গাঁথে, দোল উৎসবের মেলা, পলাশের মালা খুব বিকোবে আজ, মেয়েরা খোঁপায় জড়িয়ে মেতে উঠবে নাচে,আকাশে উড়বে আবীর। পাঁচ টাকায় একটা মালা। সবুজ চুড়ি পড়া হাতে শামিম তুলে দেয় টাটকা পলাশ মালা। চমকে তাকায় হুর পরী। আজ পলাশ রাঙাশাড়িতে সিঁথিতে সিঁদুর মাথায় ঘোমটায় পরী মানবী । পরী আর চেনেনা শামিম কে শামিম ও পরীকে খুঁজে পায়না। খোঁপায় পলাশ মালা জড়িয়ে স্বামীর হাত ধরে মেলার ভীড়ে হারায় পরী। সেই রাতের ঝরে পলাশডাঙার গাছ গুলো সব পলাশ ঝরিয়ে শান্ত হয়ে আজান শোনে শুধু একটি গাছ যে আগে কোনদিনই ফুল দেয়নি দুটো রুদ্রপলাশ ফোটায়।
No comments:
Post a Comment