Thursday, March 23, 2017

চিলেকোঠা ই-ম্যাগ




                            সম্পাদক-অলোক চৌধুরী
                            চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন
                            সহায়তা- নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয়...অলোক চৌধুরী

আজ সম্পাদকীয় লিখতে বসে শুধু বারবার মনে হচ্ছে প্রকৃতির এই খামখেয়ালির কথা। হঠাৎ ঠাণ্ডার রেশ কেটে গিয়ে তপ্ত দিনের হাতছানি। ক’দিন পরেই চিলেকোঠার বসন্ত উৎসব বেলুড়মঠ-দক্ষিণেশ্বর ঘিরে। তবে কি চিলেকোঠার সদস্যরা গরমে কষ্ট পাবে। সেদিন বেলুড়মঠে ছিল শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের সপ্তাহব্যাপী জন্মতিথি উদযাপন দিবস। প্রায় দুলাখ ভক্ত সমাগমে চিলেকোঠার পঞ্চান্ন জন সদস্যের ভাবধারা মিলেমিশে একাকার। যদিও রোদের তেজ বেশ তীব্র। ভাবছিলাম এক সপ্তাহ পরেই তো দোল। তখন তো রোদের তেজ আরও বাড়বে। কিন্তু ক’দিনের মধ্যেই বঙ্গোপসাগর, আসাম আর ঝাড়খণ্ডের মাথায় জমে থাকা নিম্নচাপ আবহাওয়া একেবারে পালটে দিল। শুরু হল বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি আর তার সাথে ফিরে এল শীতের আমেজ। যেখানে স্বাভাবিকের থেকে চার ডিগ্রী বেশী হয়ে গিয়েছিল, এক ধাক্কায় তা নেমে এল স্বাভাবিকের থেকে চার/পাঁচ ডিগ্রী নীচে। সদ্য মুকুল থেকে বেরিয়ে আসা ফলন্ত আমগাছের শাখে আবার শোনা গেল কোকিলের কুহু ডাক। বাজারটাও এখন বেশ স্থিতিশীল। তবে সুখের পাশেই থাকে দুঃখের হাতছানি। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে এক মর্মান্তিক মোটর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন আমাদের সবার প্রিয় সঙ্গীত শিল্পী কালিকাপ্রসাদ। বাংলা লোকগীতির জগতে এ এক অপূরণীয় ক্ষতি। এইতো গত বাইশ তারিখে, ওই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতেই সকাল দশটা নাগাদ একটি গরম বিটুমিন ভর্তি ট্যাঙ্কার উলটে গেল হাওড়া থেকে পাটনা যাবার পথে সাতজনের একটি পরিবারের নতুন কেনা গাড়ির উপরে। সাধের গাড়ি মুহূর্তে মিশে যায় রাস্তায়। বেশ কিছুক্ষণ একটি বাচ্ছার গলা শোনা যাচ্ছিল, ‘আঙ্কেল বাঁচাও’ ধ্বনি। কিন্তু উপস্থিত জনগণের নীরব দর্শক হয়ে ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। এক লহমায় শেষ হয়ে গেল একটি পরিবার। বড় মর্মান্তিক। প্রায় প্রতিদিনই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। আমাদের সচেতনতা এবার একটু বাড়ানো দরকার। এই লেখার ফাঁকে জানিয়ে রাখি, আমাদের পশ্চিমবঙ্গে জেলার সংখ্যা এখন ২১টি। আগামী ৪ঠা এপ্রিল এবং ৭ই এপ্রিল ২২তম ও ২৩তম জেলার মর্যাদা পাচ্ছে যথাক্রমে ঝাড়গ্রাম এবং আসানসোল।
 চিলেকোঠা ওয়েবজিন এগিয়ে চলেছে আপন দায়িত্ব মাথায় নিয়ে। আপনারা লেখা পাঠান, লেখা পড়ুন। আপনার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকে এই ওয়েব ম্যাগাজিন পড়তে সাহায্য করুন। মতামত লিখে লেখককে সমৃদ্ধ করুন। আজ এই পর্যন্ত। সবাই ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।

স্বপ্নস্বরূপ - ৪ ন ন্দি নী সে ন গু প্ত


 বসন্ত হায়রে! এই ইঁট- কাঠ- কংক্রিটের শহরে বসন্ত কোথায়? সারা শহর খুঁজলে একটা পলাশ গাছ দেখতে পাওয়া যায়? এক-আধটা অলীক স্বপ্নের মত শিমূল বা রুদ্রপলাশ জেগে থাকে কারণ, সে গাছগুলোর যে ভারি কড়া জান।   শহরের শত অনাদরেও তারা বেঁচে থাকে- আর হ্যাঁ, রঙ ছড়ায়। তখন কার কথা মনে পড়ে? মনে পড়ে, ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও’; মনে পড়ে ‘লাগলো যে দোল!’ দোলা লাগে বসন্তের, দোলা লাগে উদাসী দক্ষিণ হাওয়ায়। সব কথা যে তাঁকে ঘিরেই। বোলপুরগামী ট্রেন-বাস  ভিড়ে ঠাসা দোলপূর্ণিমার সময়হুজুগ? হ্যাঁ, বাঙ্গালী হুজুগে, তাতে সন্দেহ নেই। তবুও ত, হুজুগেও যদি তাঁকে মনে পড়ে, ক্ষতি কি?   
বসন্ত যে শুধুমাত্র শীতের অবসান ঘটিয়ে পৃথিবীর আবর্তনের মধ্য দিয়ে ঋতুবদলের কথা বলে, তা নয়। বসন্ত যেন এক নতুন সময়ের আহ্বান। এমন তো নয় যে বাঙালিজাতি রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের আগে বসন্ত উৎসব পালন করত না! অবশ্যই করত। সেই দোলযাত্রা এখনো আছে। বাঙ্গালীর অন্তরের জিনিস হয়েই আছে। বৈষ্ণবরা বিশেষ মর্যাদায় পালন করেন এই উৎসব। কিন্তু ধর্মের গণ্ডী ছাড়িয়ে এই উৎসবের যে শোভন- শালীন রূপ, তা সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের মননের  আশ্রয়ের বাইরে কল্পনাতীত। রাজস্থানের হোলি উৎসবের যে রূপ দেখিয়েছেন কবি ‘হোরিখেলা’ কবিতায়, রোমাঞ্চিত হয়নি সেই বর্ণনা পড়ে, এমন বাঙালি কমই আছে। কিন্তু সেই উৎসবের সুর বড়ই উচ্চগ্রামে বাঁধা। এমনকি কবিতার নাটকীয় ঘটনা শেষ হয় লড়াই এবং প্রতিশোধে। এ যে শুধুই মধুবনের ফুল উৎসব নয়।    
কেউ বা রবীন্দ্র-প্রভাবিত শান্তিনিকেতনের ধাঁচে পালিত বসন্ত উৎসবকে বলবেন আরোপিত ন্যাকামি। বলবেন এই উদযাপনে প্রাণের স্পন্দনের স্বাভাবিক প্রকাশ কোথায়? কিন্তু তার আগে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন স্বাভাবিক প্রকাশ বলতে আমরা ঠিক কি বুঝবো। বর্তমান সময়ে সমাজে বিভিন্ন স্তরে নারীমানুষ যত এগিয়ে আসছে, তত তাকে বাধাপ্রাপ্ত হতে হচ্ছে। দোল উৎসবের দিনে নারীর সম্ভ্রমহানি, পশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা- এটাই কি উল্লাসের স্বাভাবিক প্রকাশ? তাহলে  মেনে নেওয়া ভালো স্বাভাবিক প্রকাশের প্রয়োজন নেই। তাহলে বাঙ্গালী নাহয় বন্ধ করুক বসন্তের উদযাপন। তিনি যে  পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন দোল উৎসব উদযাপনের, থাক না সেটুকু সেখানেই তার সমস্ত অস্বাভাবিকত্ব নিয়ে বাঁধা পড়ে। এ জাত যে এখনো নারীকে সম্মান দিতে শেখে নি, শেখে নি দুর্বলের পাশে দাঁড়াতে। সে জাতি বসন্তের উদযাপন করবে কি ভাবে? এই বিকৃতিকে কবিই বলে গিয়েছিলেন, ‘পরস্পরকে মলিন করাই তার লক্ষ্য, রঙিন করা নয়।’

তিনি কবি। বসন্তে প্রকৃতির শোভা তার মত করে আর কে বলতে পারে? সেই অপার সৌন্দর্যের মধ্যে আনন্দের সন্ধান করতে গেলে তার ভাষা ধার করা ছাড়া আমাদের বিশেষ উপায় থাকে না। এই সুন্দরকে তিনি বর্ণনা করেন...  ‘বসন্তকালে লতাগুল্মের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে কুঁড়ি ধরিয়া ফুল ফুটিয়া পাতা গজাইয়া একেবারে যে মাতামাতি আরম্ভ হয়,  আম্রশাখায় মুকুল ভরিয়া উঠিয়া তাহার তলদেশে অনর্থক রাশিরাশি ঝরিয়া পড়ে, ইহা আনন্দের প্রাচুর্যকিন্তু আবার শুধুই  সুন্দরকে উপভোগ করা, শুধু আনন্দস্বরূপকে উপলব্ধি করা, তাও কিন্তু এই উদযাপনের মূল সুর নয়। কবি    আমাদের নিয়ে যেতে চান আরও গভীর অবগাহনে। বসন্ত উৎসবের অনুভব তার কথায়... ‘এ উৎসব তো শুধু আমোদ করা নয়, এ তো অনায়াসে হবার জো নেই । জরার অবসাদ, মৃত্যুর ভয় লঙ্ঘন করে তবে সেই নবজীবনের আনন্দে পৌঁছনো যায়’  হ্যাঁ, বাধাবিপদ সবকিছুকে পিছনে রেখে তবেই হয় বসন্তের প্রকৃত উদযাপন। কবির অনুভবে বসন্তের উদযাপন শুধুই ঋতুর বরণ নয়, নয় রঙের উৎসব, এ যেন এক বিপ্লব! কবি দেখতে পান এই লীলা বারেবারে। ‘ফাল্গুনী’ নাটকে বাউল বলে ওঠে, ‘যুগে যুগে মানুষ লড়াই করেছে, আজ বসন্তের হাওয়ায় তারই ঢেউ যারা মরে অমর, বসন্তের কচি পাতায় তারাই পত্র পাঠিয়েছে হ্যাঁ,  সমাজের পুরাতন, জীর্ণ যা কিছু ফেলে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মানুষের যে আত্মবলিদান, যে ত্যাগ, সে সবকিছুই যেন বসন্তের দক্ষিণ সমীরণে এসেছে ফিরে নতুন দিনের বার্তা নিয়ে।  এত পলাশ- শিমুলের সমারোহ শুধুই যে রঙের খেলা নয়! বসন্ত-পূর্ণিমায় সুন্দরের আবাহনে ‘পঞ্চমে বাঁশি বাজবে, পুষ্পকেশরের ফাগ উড়বে, আলোয় ছায়ায় হবে গলাগলি সেই দক্ষিণের কুঞ্জবনেহ্যাঁ, আলোয়- ছায়ায় মিলে যাওয়ার কথা। ভুলে যেতে হবে অগৌরবের দিন। সেইদিন আসবে কবির অনুভবের সেই বসন্তের প্রকৃত উদযাপন, যেদিন আমরা  পরাভূত করতে পারবো সমাজের অশুভ শক্তিকে। উদযাপনের প্রাণশক্তির প্রকাশ হিসেবে আর কেউ কাউকে মলিন করা বা পাঁকে টেনে নামানোর খেলায় মেতে উঠবে না।      

কবিতা.........পর্দার পিছনে.........অনুপম দাশশর্মা



                          প্রতিষ্ঠানের ধারাল নখ যে কী ভয়ংকর হয়

                          সে কথা জানে ফল্গুস্রোতের হিমবাহক

                          বরফের ছুরি রক্তচক্ষু নিয়ে কড়া নাড়ে

                          কলমের রংহীন দরজায়


                           বিরুদ্ধতার অনমনীয় তেজ হয় নিস্প্রদীপ

                          নুয়ে পড়ে অমান্যের ঘাড়

                          বুক চাপা নিঃশ্বাসে

                          যে কথা থেকে যায় সাহসের গর্ভগৃহে

                          ফোটে না কখনও

                          দূর থেকে ছায়া নড়ে একলব্যের

                          অজস্র আঘাতের অক্ষর চিহ্ন ফুটে উঠতে

                          দেখা যায় কবিদের ছান্দিক বক্ষে!

ছোট গল্প......মালিক......অরুণ চট্টোপাধ্যায়

লোকটাকে দেখেই আমার কেমন সন্দেহ হয়েছিল। এটা পাগল যদি না হয় আমি পাগলের বেটা। আরে বাপু এখন বাজে একটা চল্লিশ। প্যাসেঞ্জারটাকে স্টেশনে লোড করে আমি নিজেকে একটু লোড করে নেব ভাবছি এমন সময় এই বেয়াড়া উৎপাত কার ভাল লাগে ভাই?
এমন সময় বৌটা রান্না করে গালে হাত দিয়ে এফ এম শোনে। ঐ যে রেডিও মিরচি নাকি বলে গুরু। তা আমার এ সময় বৌয়ের হাতের বেগুন ভাজা আর কলমি শাকের চচ্চড়ি মাখা ভাত খেতে মন যাবে নাকি দিলখুশের দোকানের ঝাল চানাচুরের সঙ্গে হাসানের ঠেকের ঐ দিশি মাল ভাল লাগবে? অমন দিশি মাল এ চত্বরে কোথায় আছে শুনি? অমৃত – জাস্ট অমৃত গুরু। হাতে পড়ে গেলে চাটতেই সময় লেগে যায়
কিন্তু লোকটা আমার নেশায় দিব্বি কাঠি মেরে দিল। কোথা থেকে এসে ধড়াম করে রিক্সোয় উঠে পড়ল। আমার পুরোন রিক্সাটা যেন ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ককিয়ে উঠল
এমন বেয়াড়া মাল আমি কখনও দেখি নি। পোশাকের ছিরি দেখ। একটা সরু সাদা পাজামার সঙ্গে ছাই রঙ্গের খদ্দরের পাঞ্জাবী। উস্কোখুস্কো বড় বড় চুলের সঙ্গে কালো শোঁয়াপোকা মার্কা গোঁফ। চোখে একটা মোটা ফ্রেমের চশমা আর তার ভেতর দিয়ে ঘোলাটে দৃষ্টি। কোথায় যাবে তা বলে নি। আমি প্যাডেলে পা দিতেই চেনটা মড়মড় করে উঠল। যেন জিজ্ঞেস করতে চাইল কোথায় যেতে হবে তাকে। প্যাডেলে দ্বিতীয় চাপটা দেবার আগে আমি প্রশ্নটা চোখে নিয়ে পেছনে তাকালাম। উত্তর পেলে সামনে তাকিয়ে গতি বাড়াব রিক্সার
তা নবাব পুত্তুরের হুঁশই নেই দেখছি। গন্তব্যটা বলার কোনও তাড়াও নেই। সোজা তাকিয়ে আছে সামনে। একটু বিড়বিড় করছে বটে। আমার মত রিক্সাওয়ালারা না হয় বাড়িতে বৌয়ের হাতে ভাত খাবার চেয়ে ঠেকে বসে দিশি মাল গলায় ঢেলে মাতাল হতে ভালবাসে। কিন্তু তাই বলে এই ভদ্দরলোকের ব্যাটা –  
- হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। বেশ ক’ বোতল টেনেছে নাকি?
চোখ ফিরিয়ে নিলাম। বেশিক্ষণ ওভাবে থাকলে তো এক্সিডেন্ট হবার সম্ভাবনা। মর গে যা। আমার কি। বলে তো ভাল না বললে আরও ভাল। রিক্সায় যত পাক ঘুরবে আমার মিটার তত চড়বে। তা হাসানের ঠেকটা না হয় এবেলা চুলোয় গেল। মালকড়ি কিছু বেশী এলে ওবেলা নয় পুষিয়ে নেওয়া যাবে
আমি রিক্সা টানছি আর লোকটা বিড়বিড় করে যাচ্ছে। হঠাৎ চিল্লিয়ে উঠে বললে, আরে কোথায় যাচ্ছ? এতক্ষন লাগছে কেন?
আমি লাল চোখ করে পেছন ফিরে বললুম, কোথায় যাবেন বলেছেন কি? যাবেন কোথায়?
লোকটা কেমন যেন হয়ে গিয়ে বলল, এই ২৭ নম্বর ব্রজবিহারী লেন
এদিকে না ফিরেই বিরক্ত হয়ে বললুম, সে সব তো কবে চুকে বুকে গেছে স্যার। তা অন্তত মিনিট দশেক আগে
লোকটা আরও বিরক্ত হল, চলে গেল? চলে গেল? তুমি কেমন লোক হে? বললে না? রিক্সা চালিয়েই যাচ্ছ?
এবার মনে হল এটাকে ২৭ নম্বর ব্রজবিহারীতে ক’বার দেখেছি বটে। দেখেছি মানে বন্ধ গেটটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। কি যেন নিজের মনে ভাবছিল সব। মনে একবার হয়েও ছিল যে ২৭ নম্বরটায় আসতে একবার হাঁক পাড়ি। কিন্তু মনের মধ্যে লোভটা আমায় হাঁক পাড়তে দিল না কিছুতেই। মরুক না লোকটা কিছু ঘুরে? তাতে আমার তো কিছু দোষ নেই? আমি তো জিজ্ঞেস করেছিলুম সেই প্রথমেই। এ বরং ভালই। আমার মিটার একটু চড়ে তো চড়ুক
লোকটা আর ক’বার হা হুতাশ করল। যেন খুব দেরি হয়ে গেছে। মনে হল যেন শুঁড়ীখানায় ঢুকতে খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে ভেবে মরছে লোকটা। আগের নেশাটা তেমন জমে নি বোধহয়। আবার করবে। মন বলল, হরি হরি। কত কি আর দেখতে হবে গোপলা রিক্সাওলাটাকে!
কিন্তু হঠাৎ মনে হল ২৭ নম্বর ব্রজবিহারী তো শুঁড়িখানা নয়? একটা বড় খুব পুরোন বাড়ি। শুনেছি ওর মালিক বিরাট বড়লোক। পূর্বপুরুষ জমিদার ছিল। কোলকাতায় থাকে।  যেমন অনেক পাড়াগেঁয়ে জমিদারের বংশধর গাঁয়ের বাড়িগুলো খালি রেখে শহরে গিয়ে ইমারত তুলে বাস করে তেমন আর কি  
ওখানে তো কেউ থাকে না। তা এই বদখচ লোকটা ওখানে কি মতলবে? কেস খাওয়া আদমি নাকি? পালিয়ে বেড়াচ্ছে? ডাকাতি বা  খুনের আসামী নয় তো? নাকি রেপ কেস? আজকাল তো ওটা খুব হচ্ছে
- এই ঘোরাও, ঘোরাও। রিক্সা ঘোরাও। লোকটা খড়খড়ে গলায় বলল, কত দেরি করে দিলে বল তো?
একে তো হাসানের ঠেকের নেশা আমার মাথায় চড়েছে। তার ওপর এই গরম মেজাজ। আমার মেজাজটাও গেল চড়ে। প্যাডেল করা বন্ধ করে দিয়ে রিক্সা দিলাম হঠাৎ থামিয়ে। চেন আর প্যাডেল মড়মড় করে উঠল। বললাম, নামুন তো মশাই রিক্সা থেকে। পয়সা মিটিয়ে দিন আমার। অন্য রিক্সা দেখে নিন। রিক্সায় ওঠা ইস্তক জিজ্ঞেস করে চলেছি কোথায় যাবেন কোথায় যাবেন। বলেছেন একটি বার?
লোকটার মেজাজও বেশ দেখার মত হল। বেশ ফুঁসছে। নেমে কাঁপতে কাঁপতে পকেট থেকে পয়সার ব্যাগটা বার করতে করতে বলল, আমিও দেখে নেব তোমায়
- যান যান মশাই। আপনার মত কত লোককে আমিও দেখেছি
লোকটা হঠাৎ কিছু না বলে আমার দিকে হাঁ করে দেখতে লাগল। আমি তো অবাক। মেজাজ তার মুহূর্তে বদলে গেল। একেবারে পেস্ট্রির মত নরম। এমন মেজাজ তো কোনও পাঁড় নেশাখোরের মত নয়?
- বড় বিপদে পড়েছি ভাই। এখন অন্য রিক্সায় যেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। আশপাশে দেখছিও না তো একটা। আমার বড্ড ভুল হয়ে গেছে। হাতদুটো ধরার উপক্রম, আমাকে ২৭ নম্বরটায় পৌঁছে দাও ভাই। বাড়তি ভাড়া যা চাইবে আমি দিয়ে দেবো
আমার বুকের পাটা তো তখন মহৎ হবার আনন্দে একেবারে যেন ফেটে পড়তে চাইল। তাকে উঠিয়ে নিয়ে আমি আবার প্যাডেলে মারলাম একটা মোক্ষম চাপ। এবার খুব উৎসাহের সঙ্গে। দশ মিনিটের রাস্তাটা পাঁচ মিনিটে একেবারে উড়িয়ে নিয়ে চলে এলাম ২৭ নম্বরে। হাসানের ঠেকে এবেলা না হয় নাই যাওয়া হবে। এবেলা না হয় রান্না সেরে গালে হাত দিয়ে রেডিও মিরচি শোনা বৌয়ের কাছে একটু তাড়াতাড়িই যাব। অন্যদিন কলমি শাকের চচ্চড়ি দিয়ে ভাতের গ্রাস যেমন লাগে আজ নিশ্চয় একটু ভাল লাগবে। কেন জানি না এই লোকটা এত করুণ ভাবে আমার কাছে সাহায্য ভিক্ষা করছে সেটা আমাকে বড় তৃপ্তি দিচ্ছে
কিন্তু কি অভদ্র লোক রে বাবা। রিক্সভাড়া মাত্র কুড়িটা টাকাও রাখে না পকেটে? এ পকেট ও পকেট হাতড়ে শেষে বলে কিনা, সরি ভাই। পার্সটা মনে হয় ভেতরে ফেলে এসেছি। আমি এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি টাকাটা
লোকটা সেই যে ভেতরে গেল তো গেলই। আসার আর নাম নেই। ভারি অভদ্র লোক তো। পাঁচ সাত আট মিনিট কেটে যায়। আমার মেজাজ চড়ছে। আমি ভাবছি আমার পাওনার সঙ্গে ওয়েটিংটাও জুড়ে দেব কিনা। কিন্তু এই বাড়িতে কি হয় তা দেখার কৌতূহল হচ্ছে। একটা উঁচু পাঁচিল আর বেশ বড় ঢাকা গেট দিয়ে বাড়ীটা বাইরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করা। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কি হছে
লোকটাকে আসতে না দেখে বেশ সন্দেহ হচ্ছে এবার। ডাকাত নাকি? না সন্ত্রাসবাদী? এখানে ঘাপটি মেরে বোমা বানায় ? জিনিসটা একটু দেখব নাকি?
একটু এগিয়েছি। বড় গেটটা সামান্য ফাঁক। সেখান থেকে চোখ রেখেছি। ভেতরে বেশ কিছু লোকের ছোটাছুটি। ঐ যে একজন এদিকেই আসছে
সেটা এল না। কিন্তু অন্য একজন বাইরে এসে বলল, দাদা আপনার ভাড়াটা –
শুধুই বলল কথাটা। টাকাটা কিন্তু বাড়াল না। হাতের গোঁজায় তেমন কিছু চোখেও তো পড়ল না। আমি বেশ বিরক্ত হয়ে বললুম, মশাই কুড়ি টাকা ভাড়ার জন্যে কুড়ি মিনিট দাঁড়িয়েই রইলাম। এ কিরকম ব্যাভার আপনাদের?
লোকটা এগিয়ে এসে খুব মোলায়েম গলায় বলল, সরি দাদা একটু দেরি হল। কিন্তু আমাদের দাদা মানে শুভেন্দু স্যার আপনাকে একবার ডাকছেন ভেতরে
এ কি রে মাইরি! আমাকে করছে আপনি আজ্ঞে? আমাকে – যে একটা ময়লা ফুলপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জির ওপরে তেলচিটে গামছা পিঠে লাগিয়ে রিক্সা চালায় তাকে করছে আপনি আজ্ঞে? নক্সাবাজি আর কি। গরিবের টাকাটা মেরে দেবার ধান্দা আর কি। আমি মাথা নাড়লুম, ভেতরে গিয়ে টাকা ফাকা নিয়ে আসতে পারব না। আপনি মশাই এনে দিন
আমার আপত্তি ধোপে টিকল না। দেখি আরও ক’জন বেরিয়ে এসেছে। সবাই বেশ মিহি সুরে বলছে, একটু ভেতরে চলুন না দাদা। আপনার কিছু খারাপ হবে না। বরং দেখবেন ভালই হবে
কোন এক দাদা নাকি বলেছিল, ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়। তা আমার তো কাড়ার মধ্যে আছে এই ময়লা ফুলপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জিটা। তা কাড়ার হলে নে কেড়ে নে। ফাউ হিসেবে একটা তেলচিটে গামছা সঙ্গে নিয়েই যদি খুশি হোস তো হ
কিংবা মনে হল এটা একটা পাগলা গারদ। আজকাল পাগল বেড়ে গেছে কিন্তু তাদের জন্যে গারদ তেমন হয় নি। এরা সস্তায় এই বাড়ি খানা পেয়ে বানিয়েছে সেটা
আমি পড়েছি মহা ফাঁপরে। যাব কি যাব না ভাবার আগেই এদের তোয়াজে গলে জল হয়ে গিয়ে ভেতরে ঢুকতেই হল
- স্যার। রিক্সাওলা দাদা এসেছে
এতক্ষনে ভেতরটা ভাল করে দেখার ফুরসৎ হল। ভেতরে ওই যে লোকটা। আমার রিক্সার আধ-পাগলা সওয়ারী। কি করছে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাদের যেন কি সব নির্দেশ দিচ্ছে। হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলল, আমি টাকাটা পাঠিয়ে দিতে পারতাম ভাই কিন্তু তোমাকে আমার খুব দরকার। আমার একটা বড় উপকার করে দিতে হবে। না বললে কিন্তু হবে না
হাফ-পাগল লোকটা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে একেবারে আদর করতে লাগল যেন। রেগে আগুন হব কি গলে একেবারে জল হবার দশা আমার। মন বলল, একটা সামান্য রিক্সাওলা হয়ে এদের কি উবগারটা করতে পারবি বাপ যে এরা তোকে এমন জামাই আদর করছে?
ভেতরে ক্যামেরা ট্যামেরা দেখে বেশ মালুম হচ্ছে এখানে কোনও সিনেমার স্যুটিং টুটিং হচ্ছে। তা আমাকে কি দরকার? হয়ত আমার রিক্সায় কোনও জিনিস কোথাও পাঠাবে। একটু কম পয়সায় বড় কোনও জিনিস আর কি। কিন্তু তার জন্যে এত কাকুতি মিনতি? মনটা তো মানতে চাইছে না কিছুতেই
আর একজন এগিয়ে এল। বলল, তোমাকেই এখন আমাদের সবচেয়ে দরকার ভাই। ঐ যে উনি এলেন তোমার রিক্সায় উনি এই ফিল্মের ডিরেক্টর শুভব্রতবাবু
অবাক হয়ে ভাবি ফিল্মের ডিরেক্টররা তো সব দামী মটরগাড়ি চড়েন। তা ইনি আমার রিক্সায় কোন পুন্য করতে পা রেখেছিলেন তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ মনে হল তাই তো – বাড়ীটা ঢাউস হলেও রাস্তাটা তো বেজায় সরু। মটরগাড়ি এখানে ঢুকতেই পারে না। গলিতে ঢোকার মুখে মাধ্যমিক ইস্কুলের মাঠে বেশ ক’টা বাস মোটর দেখেছিলাম না? এখন মনে হচ্ছে এই সিনেমা কোম্পানীর গাড়িগুলোই সেখানে গ্যারেজ হয়েছে
- কিন্তু কি জান, লোকটা বলল, টাকায় পোষায় নি বলে আমাদের হিরো স্যুটিং ছেড়ে চলে গেছে। গল্পের হিরো একটা রিক্সাওলা। কম টাকায় এত খাটনির কাজ পোষাবে না বলে আমাদের হিরো শাওন কুমার চলে গেছে। সে অনেক টাকা চেয়েছিল কিন্তু প্রডিউসার দিতে রাজি নয়। আর একজন প্রডিউসার এগিয়ে এসেছিল কিন্তু সে ক্রিকেট জুয়ায় অনেক টাকা পেয়েছে। আমাদের ডিরেক্টর সাহেব খুব সৎ মানুষ তিনি রাজি হন নি
 এগিয়ে এলেন ডিরেক্টর সাহেব। হেসে বললেন, একেই বলে হাতে চাঁদ পাওয়া। তোমার রিক্সায় উঠেই বুঝেছি তুমি হিরো হবার উপযুক্ত।
আমি তো আকাশ কেন তার থেকেও কোনও উঁচু জায়গা যদি থাকে তো সেখান থেকে পড়ি। আমি একটা মালখোর চার পয়সার রিক্সাওলা। লেখাপড়ায় ক’ অক্ষর গোমাংস। আমি কিনা হিরো হব? পকেটের ভেতর হাত গলিয়ে কাটলুম এক রামচিমটি। তারপর  নিজেই কাতরে উঠে বললুম, কি – কিন্তু –
সবাই ঘিরে ধরেছে আমায়। অনুনয় বিনয়। কাকুতি মিনতি। জানা গেল হিরো না পাওয়া গেলে এ সিনেমা হবে না। তখন এরা মানে ছবি করার এই লোকগুলো সব মাইনে না পেয়ে না খেয়ে মরবে
- না কোর না ভাই। এখন এতগুলো মানুষের মুখে অন্ন উঠতে পারে যদি তুমি রাজি থাক
হাসব নাকি কাঁদব? আমি গোপলা রিক্সাওলা – দিন গেলে সাকুল্যে দেড়শ কি একশ সত্তর আশি টাকা পাই কোনও মতে। যার মধ্যে ওই সত্তর আশি টাকা হাসানের ঠেকের জন্যে রেখে আমার বৌ শান্তির হাতে তুলে দিই সংসারের শান্তির জন্যে। আমার দুটো বাচ্চা আর মা মিলে জনা পাঁচেকের আহার জোটায় সে। সে কি না আজ একটা গোটা সিনেমার হিরো? মুখ দিয়ে অট্টহাসিখানা বেরোতেই ডিরেক্টর সাহেব পিঠ চাপড়ে বললেন, এমন একটা হাসির সিন তোমার কিন্তু আছে গোপলা। আর তেমনি হেসে তুমি প্রমাণ করে দিলে ভুল লোককে আমি বাছি নি   

কবিতা...নীরবতা মানে ভোর......শ্যামশ্রী চাকী





                                         ইঁট পিচ আর তার ওপর ঝুরোবালি

                                         চাপা পড়া মাটি আর কাঁহাতক বল

                                        বাতাসের কানে ফিসফাস চোরা গলি

                                         জমা জঞ্জাল ঘুরপথ তেল কল

                                        উড়ো ধুলো রোজ ঢাকছে হৃদয়পুর

                                         বৃষ্টি নামাও ফরিস্তা আসমানি

                                         এতটুকু জল কলতলা চানঘর

                                        শালিকের ডানা জমা প্রেম আলসেমি

                                        এ শহর জানে রঙ মানে প্রজাপতি

                                       এ শহর জানে বিকেলের এলোচুল

                                       এ শহর লেখে নিষিদ্ধ রূপকথা

                                       এ শহর জানে নীরবতা মানে ভোর ।।

কবিতা......ব্যতিক্রম......গৌতম সেন



                                              ছায়াবৃত ফালি চাঁদ কাব্যময় নয়, চোখে দেখা
                                              পঞ্চমীর চাঁদ- সে আগামী পূর্ণিমার প্রতিশ্রুতি।
                                              রূপ সপূর্ণতা পায় সময় ব্যবধানে। অপেক্ষা
                                              গূঢ় শব্দ, এক স্তব্ধ উপলব্ধি - শান্ত অনুভুতি।

                                              ভাসে পূর্ণিমাতে পূর্ণচন্দ্র দেহ, আলোক দাক্ষিণ্যে
                                              ছড়ায় বনজোৎস্না। মদালসা পূর্ণমাসী ক্ষণ
                                              দান করে যৌবন, সাজে ধরা কি অধরা লাবণ্যে!
                                              হুতাশ মন উচাটন, জ্যোৎস্না বিধ্বস্ত জীবন।

                                              অমাবস্যা চরাচর এ বিশ্ব আঁধার ঘেরাটোপে
                                             অন্ধ যাপন নিয়মের ঘানি টেনে ক্লান্তি-কাতর
                                             তবু জোছনা পায় না প্রবেশাধিকার অন্ধকুপে,
                                             প্রেমহীন পিলসুজ বুকে শিখা কাঁপে থরথর।

                                             ঘরেতে আগল, অঙ্গে শিকল কুটিল হাসি হাসে,
                                             ঝড়ের আভাষে নিষেধের নামাবলি মরে ত্রাসে।

অনুগল্প............লক্ষ্মীর কৃপায়...... সুজয় চক্রবর্তী




কালো ময়রা মদ খায়। সকাল সন্ধের ব্যাপার নেই। তবে তাকে মাতলামি করতে দেখেনি কেউ। আজ একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। একেবারে বেঁহুশ যাকে বলে।কালো ময়রা মিষ্টি তৈরি করে না। তবে তার মধ্যপ্রদেশের বাড়বাড়ন্তের জন্য তাকে সবাই 'ময়রা' বলে ডাকে। কিন্তু সে যে কি করে, কে আছে তার ---- কিছুই জানা যায় না। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে কালো। তার প্লাষ্টিকের চটি জোড়া এদিকওদিক ছড়িয়ে রয়েছে। পরনের লুঙ্গিটা উঠে গিয়ে ডান পায়ের দগদগে ঘা'টা দেখা যাচ্ছে। দু-একটা মাছিও বসছে সেখানে। প্লাটফর্মে দাঁড়ানো প্রায় সকলের চোখই কালোর দিকে। ডান পাশে কাত হতে গিয়ে কালোর বুক পকেট থেকে মোবাইল, ছোট একটা ডাইরি আর কিছু খুচরো পয়সা শব্দ করে গড়িয়ে পড়লো নিচে। ভিড়ের মধ্য থেকে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক বললেন, ' আরে, এগুলো জি.আর.পির হাতে দেওয়া দরকার, না হলে কখন যে হাপিস হয়ে যাবে, কে জানে!' কিন্তু কেউই নিজের অমূল্য সময় নষ্ট করে পুলিশের কাছে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলো না। মোবাইল, ডাইরি, খুচরো পয়সাগুলো নিজের কাছে রাখলো লক্ষ্মীমাসি। স্টেশন চত্বরে পনেরো বছর ধরে ভিক্ষে করছে সে। বিধবা। দুকুলে কেউ নেই। গোটা স্টেশন চত্বরটাই তার সংসার। কালোকে দু-একবার স্টেশন চত্বরে দেখেছে সে। তবে পরিচয় নেই।কালো মাতাল হলেও তালের ঠিক আছে। চিৎ হতে যাচ্ছিল, জামার পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল না পেয়ে খোঁজাখুঁজি করতে শুরু করলো। ইতিমধ্যে ভিড়টাও কিছুটা পাতলা হয়েছে। লক্ষ্মী দূর থেকে কালোর ভাবসাব দেখে মুচকি হাসলো। তারপর কালোর কাছে গিয়ে সবকিছু তুলে দিল। কপালে হাত ঠেকিয়ে কৃতজ্ঞতা জানালো কালো। লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করলো, 'তুমার বাড়ি কুথায়? ' হাতের ইশারায় লক্ষ্মীকে পাশে বসতে বললো কালো। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো লক্ষ্মীর দিকে। আবার প্রশ্ন করলো লক্ষ্মী, ' এসব ছাইপাঁশ খাও কেন? ' জবাবে তির্যক হাসি দিল কালো।সেদিনের পর থেকে লক্ষ্মীমাসিকে আর স্টেশন চত্বরে দেখা যায়নি। এমনকি ভিক্ষে করতেও দেখেনি কেউ। কোনও দিন।লক্ষ্মী যেখানে বসতো, এখন সেখানে খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, বইপত্র নিয়ে যে লোকটা বসে, তার প্রায় পঞ্চাশোর্ধ বয়স। কাঁচা-পাকা চুল। গায়ের রঙ কালো। একটা সময় তাকেই নাকি সবাই 'কালো ময়রা' বলে ডাকতো।

কবিতা...বিছুটি ...প্রজ্ঞা পারমিতা ভাওয়াল...।




পশলা বৃষ্টি ভিজতে  গিয়ে
চোখে চোখ পড়েছিল অজান্তেই ;
মেঘ যেদিন করছিলো খেলা
সিঁড়ি দিয়ে  নামছিলে  ভোরবেলা।

এক আকাশ ঝলসানো  রোদ্দুরে দেখা  হঠাৎ আবার,
আচমকা ,শুকোতে দেয়া শাড়ির মাঝে
কাঠফাটা রোদে চৌরঙ্গী তে।
কেউ কাউকে  না দেখার খেলা চললো বেশ কিছু দিন।

তারপর একদিন লিফ্ট এর ছোট্ট বাক্সে শুধু দুজন ;
ভেঙে গেলো মৌনতা।
কিছুটাতো সৌজ্যন্যতা ,
তারপর আরো কাছাকাছি ,পাশা পাশি।

নন্দন, লেক, নলবন, পার্ক, কিছু সিঁড়ি ,কিছু বেঞ্চি ;
ফুচকা,ফুটপাথের চা,বাদাম  আর চীনে কেঁচোর তৃপ্তি,
পেঁয়াজি ,বেগুনী,ডেভিলের আমেজ পেরিয়ে
মাতলা মন উন্মাদ শরীরী মিলনে।

দিনক্ষণ ঠিক করে সমাজের চোখ  রাঙানি এড়াতে
চার দেয়ালের স্বাক্ষর রাখলো বিবাগী মন।
দ্রুত পেরিয়ে গেলো পথ অনেকক্ষণ ,
বুঝতে বুঝতে হারিয়ে গেলো হিসেবে নিকেশ।

ছল করার দিন হয় শুরু;
লোকসানে যোগফল মেলাতে  বিপন্নতার দিন শুরু।
ভাঙ্গনের দিন শুরু। 
নিষ্ঠা, সততা, শৃঙ্খলাবিশ্বাসের ,তামাশার দিন শুরু।।।

নন্দনে   প্রাক্তন এর লাইন ,লেক  দীঘি হয়ে যায় ,
ফুচকাতে মিষ্টি জল দই ,সিঁড়ি শুধু ওঠা আর নামা ,
বেঞ্চে শুকনো পাতা, কাঠবেড়ালি আর পাখির ছড়াছড়ি
প্রেম গড়াগড়ি দিতে দিতে মুচকি হাসে। বিছুটি পাতা দূর থেকে হাসে।

  

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া