দিয়া নিজের সৃষ্টির দিকে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে তাকিয়ে
থাকত , তার গর্ব হত, এই সুন্দর মেয়ে দুটি তারই , নিজের সমস্ত স্বপ্ন উজাড় করে এই
মেয়ে দুটিকে সে তৈরী করেছে, । তাদের স্কুলে যাওয়া, একটু একটু করে
বড় হয়ে ওঠা, রাত জেগে ওদের পড়ানো, রেজাল্ট বার হবার সময় তীব্র উত্তেজনা সব কিছু সে অন্তর দিয়ে অনুভব করেছে। বড়
মেয়ের স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে এবার কলেজে যাবে, গোখেল স্কুলে আর্টস গ্রুপে
প্রথম হয়েছে, ভর্তি হল লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে , তার সাথে স্ট্যটিস্টিক্স আর
ম্যাথেমেটিক্স নিয়ে, বি এ পরীক্ষার রেজাল্ট বার হল মেয়ে তার ইউনিভারসিটিতে
থার্ড হয়েছে আর নিজের কলেজে প্রথম । কলেজ থেকে আড়াই হাজার টাকা পুরস্কার আর অনেক বই
উপহার স্বরূপ পেয়েছে ।সন্তানের প্রত্যেকটা জয়ের সোপান মনে হয়েছিল দিয়ার নিজের
সোপান , সে যেন একটু একটু করে তার তৈরী ওই সোপান দিয়ে উঠে আসছে।
দিয়ার মনে পড়ে সে যখন ছোট ছিল তখন সে খুব হীনমন্যতায়
ভুগত ,তার মনে হত সে নিজে নিজে কিছুই পারবেনা, কারণ তার বাবা সব সময় তাকে আড়াল
দিয়ে রাখত , কেউ কিছু বললেই বাবা বলতেন ও তো ছোট ও পারবে কি করে? সে যখন ক্লাস সেভেন এইটের
ছাত্রী সে তার অনেক বন্ধুরা বাসে ট্রামে স্কুলে যেত আর সে যেত স্কুল বাসে, কোন কারণে স্কুলবাস না আসলে তার স্কুল যাওয়া হতনা , বাবা বলতেন কি করে যাবে ট্রামে
বাসে করে? দিয়া হয়ত বলত আমার অনেক বন্ধুরাতো যায় কি হবে গেলে ? বাবা গম্ভীর হয়ে বলতেন তর্ক
করেনা, ট্রামে বাসে চলতে গেলে শরীর অনেক মজবুত করতে হয় , বাবার ভয়ের জন্য দিয়ার শৈশব
যৌবনটা যেন এক বদ্ধ কৌটার মধ্যে আটকে গিয়েছিল, অভিমানে তার দুচোখ দিয়ে জল পড়ত
কেন এই অবিচার? সবাই যা পারে সে কেন তা পারবেনা ? কিন্তু বাবার মুখের ওপর কোন কথা বলতে পারতনা। শুধু
ট্রামে বাসে করে যেতে হবে বলে ক্লাস ইলেভেনে তার নিজের অত্যন্ত ভালো স্কুল ছেড়ে বাড়ীর কাছের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, এটা তার জীবনের এক বিরাট ক্ষতির
কারণ। তাও দিয়া কলেজে অনার্স নিয়ে ভালো ভাবেই পড়ছিল কিন্তু বি এ ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হবার
দুদিনের মধ্যে তার বিয়ে হয়ে যায় এক সংস্কারাচ্ছন্ন ব্যাবসায়ী পরিবারে যেখানে তার
জীবনের সব আলোগুলো একটু একটু করে নিভে যায়, অথচ তার দিল্লীতে ভালো
ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের সাথে সম্বন্ধ প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিল,কিন্তু ববা বললেন দিল্লীতে গিয়ে
ও একা একা সব কিছু কি করে করতে পারবে? কিন্তু দিদির ক্ষেত্রে বাবার এতো কড়া নিয়ম ছিলনা, দিদি যাদবপুর থেকে এম এ পাস করেছে , একা একা বাসে করে ইউনিভার্সিটতে যেত , বন্ধুদের সাথে সিনেমায় যেত, কফিহাউসে মোগলাই খেত, তার বিয়েও হয়েছিল ভালো
ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের সাথে। এই দিদি দিয়ার মায়ের মতন ,দিয়ার অন্তরের দুঃখ অনুভব করতে
পারত । কিন্তু দিদি চলে গিয়েছিল অনেক দূরে সুদূর আমেরিকা । একমাত্র চিঠি ছাড়া আর কোনও যোগাযোগের পথ ছিলনা। সংসারের বিরাট ঝামেলা সামলে চিঠি লেখার সময় তার কাছে
খুব কমই থাকত, তাই চিঠিও লেখা হতনা। এক এক সময় দিয়ার মনে হত তারই দিদি আমেরিকায় প্যান্ট পড়ে
চাকরি করছে আর সে পায়ে আলতা দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বর্ধমানে গুরুবাড়ী যাচ্ছে, কত তফাত দুই বোনে। বাবার ওপর তীব্র অভিমানে তার দু চোখ দিয়ে জল বার হত
কিন্তু তা আপনি শুকিয়ে যেত কেউ দেখতে পেতনা। চতুর্দিকে পারবেনা পারবেনা শুনে শুনে
দিয়ার মনে হত সত্যি সে কিছু পারবেনা। বিয়ের পর তার স্বামীও বলত তুমি এই ঘর কন্যার
কাজ রান্নাবান্না এই সবই ভালো পারবে আর কিছু তোমার দ্বারা হবেনা । দিয়ার অনেক বন্ধুদের অল্প বয়েসে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল কিন্তু বিয়ের পর তারা স্বামী
শ্বশুরবাড়ীর ইচ্ছায় সহযোগিতায় বি এ ,এম এ পাস করে নিজেদের পায়ের তলায় মাটি
শক্ত করে নিয়েছিল । কিন্তু দিয়া সংসারে কারও কাছে কোনও সহযোগিতা পায়নি, আর কেউ তো দূরের কথা স্বামীর কাছেও না । তার সোনার বসন্তের দিনগুলি কেটে যেত
ঘোমটার আড়ালে , রান্নাঘরের তেলকালির মধ্যে।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment