Friday, June 23, 2017

মায়ের ডায়েরী থেকে -পিয়ালী গাঙ্গুলি





এই শোন, এখন রাখছি, তোকে পরে ফোন করব আমি এখন হনুমানের লেজ তৈরি করেছি গৈরিকা কিছুই হয়ত বুঝল না ভাবলাম যখন ফোন করব, তখন বলব কথা বলব কি করে? ,সন্দেশের তো আর তর সইছে না এই মুহূর্তে সে হনুমান হাতে বেলুনের গদা আমি আমার সুতির ওড়না দিয়ে তার লেজ বানাচ্ছি এবার তাতে আমায় নকল আগুন লাগিয়ে দিতে হবে তাই দিয়ে তিনি লঙ্কা কান্ড করবেন

এখন নিজেই নিজেকে দুষি কি মরতে যে দেড় বছর বয়সে মহালয়া দেখিয়েছিলাম আর মহিষাসুরমর্দিনীর গল্প শুনিয়েছিলাম সেই থেকে শুরু দেড় বছর বয়স থেকেই সন্দেশ অনর্গল কথা বলে, গোটা বাক্য গঠন করে উচ্চারণ গুলো একটু ভুল হত, কিন্ন, বিন্নু এসব বলত প্রথমবার মহালয়া দেখে সে কি উত্তেজনা! মা দুগ্গা, অসুর, লায়ণ, বাপরে- চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে উত্তেজনায় ওর উৎসাহ দেখে আমিও ওকে পৌরাণিক কাহিনী শোনাতে লাগলাম অমর চিত্র কথাও পড়ে শোনাতাম নিজের জ্ঞানের ভান্ডার তো সীমিত, তাই যখন তখন গুগলকে স্মরণ করতে হত কি করব? গল্প বলা ছাড়া দস্যু ছেলেকে শান্তভাবে বসিয়ে রাখার আর কোনো উপায় নেই

এরপর আবার মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা ছেলে রাইমস শিখবে বলে তার বাবা ডি টু এইচ কিডস চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে দিয়েছে সেখানে প্রায় সারাদিনই মাইথোলজি চলে ছেলে আমার ক্রমশ মাইথোলজি বিশারদ হয়ে উঠেছে ওইটুকু ছেলে, তার কার্টুনে উৎসাহ নেই সারাদিন সে কখনো রাম, কখনো রাবন, কখনো কৃষ্ণ বা হনুমান, আবার কখনো গনুদাদা বা মহাদেব মহাদেবের জন্য তার জেঠু বেনারস থেকে ডমরু নিয়ে এসেছে, পাড়ার মেলা থেকে মহাদেবের গলার রাবারের সাপ কেনা হয়েছে সেসব নিয়ে তিনি প্রায়ই মহাদেবের মত তান্ডব নৃত্য করেন তবে তার সবচেয়ে পছন্দ কিন্তু গনুদাদাকে খুব ইচ্ছা কৈলাশে যাওয়ার অনেক কষ্টে ঠেকিয়ে রেখেছি বলেছি কৈলাশে খুব ঠান্ডা বা বা ব্ল্যাক শিপ আগে তিন ব্যাগ উল আনুক, তাই দিয়ে সোয়েটার বুনে তারপর আমরা যাব এই রে... আবার কি করেছে শাশুড়ি আমার নাম ধরে চেঁচাচ্ছে

সারাদিন পর এই আবার লেখার সুযোগ পেলাম এটুকু নিয়েই বেঁচে আছি দিনদিন হতাশার ঘন, কালো মেঘ মনের মধ্যে চেপে বসছে এই একাকীত্বের জীবনে শেষ আশা ছিল ছেলে ভেবেছিলাম ছেলে আমার সঙ্গী হবে তা তো হলোই না, উল্টে এখন ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তা সবরকম শাসনের বাইরে চলে যাচ্ছে সন্দেশ এই তো তখন সবকটা জলের বোতল খুলে মেঝেতে জল ঢালছিল ঠাম্মা বারণ করেছিল বলে ঠাম্মাকে ঘুঁষি মেরেছে আর বিছানা ঝাড়ার ঝাঁটা নিয়ে এসেও মেরেছে আমি থাকতে না পেরে দু ঘা লাগিয়ে দিলাম সারাদিন আমিও আর পেরে উঠি না সোফার মাথায় হাঁটছে, দিনে একশো বার কুশানগুলো ছুঁড়ে ফেলছে, গাড়ি ধোয়ার পাইপ বারান্দা থেকে টেনে আনছে, মডিউলার কিচেনের হ্যান্ডেল বেয়ে উঠে গ্যাসের বার্নার অন, অফ করছে, ছুরি নিয়ে নিচ্ছে একদিন তো প্রায় পায়ের উপর গ্যাসের সিলিন্ডার ফেলে দিয়েছিল 

এই অবধি পড়ে সন্দেশ ডায়েরীটা বন্ধ করে বুকের ওপর রাখল মনে মনে বলল "তোমায় এত জ্বলিয়েছি মা?" ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জল বার করে খেয়ে আবার ডায়েরীটা খুলল কতবছর পর যেন মাকে আবার কাছে পেল সেই যে একবার বোর্ডিং স্কুলের ছুটিতে বাড়ি এল, দেখল মা নেই মা নাকি মারা গেছে বড় হওয়ার পর বলা হয়েছিল মানসিক অবসাদ থেকে আত্মহত্যা বোর্ডিং স্কুলের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও মা ছাড়া বাড়িটা যেন অসম্পূর্ণ সেদিন ছাদে গিয়ে একা একা অনেকক্ষণ কেঁদেছিল না হয়, ব্যাড বয়, তাই ওকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয়েছে কিন্তু বোর্ডিংয়ে আরো তো অনেক ব্যাড বয় আছে, ভগবান তো ওদের মায়েদের কেড়ে নেন না কি এমন বেশি অন্যায় করল? সবাই বলে প্রিয়জনেরা মারা গেলে আকাশে তারা হয় সর্বক্ষণ আমাদের আগলে রাখে সেদিন থেকে আকাশের তারাদের মধ্যে মাকে খোঁজে, কিন্তু কোনোদিন ঠাওর করতে পারে নি কোনটা ওর মা কতদিন, কত রাত হাত পা ছুঁড়ে কেঁদেছে "মা তুমি ফিরে এসো, আমি তোমায় আর একটুও বিরক্ত করব না" ঠিক যেমন ছোটবেলায় মা রেগে গিয়ে ঘরে বন্ধ করে দিলেই চেঁচাত "আর কব্বো না, ভালো হয়ে থাকবো, কথা শুনব" মায়ের মৃত্যুর পরে মায়ের কোনোরকম স্মৃতিই রাখতে চায় নি বাবা বা দাদু ঠাম্মা, মায়ের প্রসঙ্গই তোলা হত না কোনদিন সন্দেশের পাগল মা যেন একটা ট্যাবু

আবার পড়া শুরু হল "ছেলে আমার দুগ্গা ঠাকুরের দশ হাতে কি কি অস্ত্র আছে জানে, বিষ্ণুর শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম, ব্রহ্মার কমন্ডুল, অমৃত মন্থন, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি অনেক কিছু জানে এত কিছু জানে শুনে লোকে গদগদ হয় ভরপুর বিনোদন কাউকে সে রাবণ হয়ে পুষ্পক রথে করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, কখনো বা কৃষ্ণর মত আঙুলে করে গোবর্ধন পর্বত তুলছে আবার কারুর হাত ধরে কিষ্কিন্ধা নিয়ে চলেছে বারান্দা থেকে কথা বলে বলে পাড়াশুদ্ধু লোকের সাথে ভাব দুদিন রাস্তায় না বেরোলে পাড়ার দোকানদাররা বলে "বৌদি ওকে অনেকদিন দেখিনি, ওকে একটু নিয়ে আসুন না? ভারী মজা লাগে ওর মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলো শুনতে" লোকের সামনে হাসি বটে কিন্তু পৌরাণিক কাহিনী শোনানোর যে এরকম ভয়ংকর ফল হতে পারে কেউ দুঃসপ্নেও ভাবতে পারবে না

এত পৌরাণিক আর দেব দেবীর গল্পের মধ্যে আমার ছেলের মগজে একমাত্র প্রভাব বিস্তার করেছে অস্ত্রসস্ত্র সারাদিন তার মুখে তীর, ধনুক, ত্রিশূল, খড়গ, কুঠার, গদা,বল্লম এইসব সারাক্ষণ সে সবাইকে ত্রিশূল ছুঁড়ে দিচ্ছে বা খড়গ বা কুঠার দিয়ে বধ করে দিচ্ছে অনেকের মত ছেলের বাবাও বলে আমি হাইপার হচ্ছি, এসব পাসিং ফেজ, কেটে যাবে হয়ত এসব শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারতাম যদি না এই একরত্তি ছেলের এত রাগ আর জেদ হত যেটা চাই তো চাইই আমি মোটেই প্রশ্রয় দিই না, ওর বাবা বা দাদু ঠাকুমাও নয় তবুও ছেলে এইরকম ওর মনের মত কিছু না হলেই দেওয়ালে মাথা ঠুকছে, মেঝেতে গড়াগড়ি দিচ্ছে অথবা বলছে "আমি মরেই যাব" কোত্থেকে যে এসব শিখছে জানি না আমি উচ্চশিক্ষিত মা নই, চাকরি বাকরিও আমার দ্বারা হয়নি সংসার নিয়েই দিনরাত কেটে যায় চেয়েছিলাম ছেলেটাকে ভালো মানুষ তৈরি করব শরীরের ওপর অনেক রাসায়নিক অত্যাচারের পর সন্দেশকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পেরেছি আর তারপর তো রাতজাগা, হিসু, হাগু ইত্যাদি তা নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই, সব মায়েরাই করে থাকে কিন্তু সবকিছুর পরেও ওই একরত্তি ছেলে যখন কথায় কথায় বলে "তুমি খুব বাজে মা, তোমার মত মা চাই না, তুমি চলে যাও, তুমি মরে যাও" চোখের জল তখন বাঁধ মনে না ছোট, এসবের মানেই বোঝেনা এইজাতীয় সান্ত্বনা আমার মনের দহন কমাতে পারে না মনে হয় নিস্ফল জীবন, কার জন্য বেঁচে থাকব?

আমি চটকদার, চাকুরিরতা মা হয়ত হতে পারি নি কিন্তু নিজের স্বল্প জ্ঞান আর বিবেচনা দিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করি সন্দেশকে ভালোভাবে মানুষ করার এতটুকু বয়সেই সন্দেশ অজস্র গল্প জানে শুধু রূপকথা নয়, ঐতিহাসিক গল্প, এমনকি অনেক কিশোর সাহিত্যও আমি ওকে ওর উপযোগী করে বলি আর সবসময় চেষ্টা করি গল্পের শেষে একটা শিক্ষামূলক বা ইতিবাচক দিক তুলে ধরতে ওকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য নিত্য নতুন খেলা উদ্ভাবন করি কখনো বা তিনি মাথায় তোয়ালের ব্যান্ডেনা বেঁধে জলদস্যু আবার কখনো সেই তোয়ালে মুড়েই সেলুনে চুল, দাড়ি কাটছেন আমরা মা ছেলে আবার আফ্রিকার জঙ্গলেও চলে যাই আমাদের চাদরের তাঁবুর বাইরে ঘোরা ফেরা করে সব হিংস্র জানোয়ার 

মায়ের লেখাগুলো পড়ে সন্দেশের আবার নতুন করে অনেক কিছু মনে পড়ে গেল স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া অনেক কিছু মৃদু হাসি খেলে গেল ঠোঁটের কোনায় ডায়েরীটা বন্ধ করে মায়ের গোদরেজের আলমারিটা খুলল ভেতরে আর যা যা আছে খালি করতে হবে এবারেই সব জিনিসপত্র বেচে ফ্ল্যাট খালি করে রেখে যাবে, পরের ছুটিতে এসে ফ্ল্যাট টা বিক্রি করে দেবে ফ্ল্যাট টা বাবা ওর নামে লিখে দিয়েছে কিন্তু কলকাতায় ফ্ল্যাট রেখে আর কি করবে? কলকাতার সাথে আর ওর কিসের যোগাযোগ? বাবা তার হাই ফ্লাইং দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে আমেরিকায় সেটেল্ড স্কাইপে কথা হয় মাঝে সাঝে সন্দেশ নিজেও বিদেশে, প্রতিষ্ঠিত ভালোই আছে গুমড়ে গুমড়ে মরল শুধু বেচারি মা ইশ, তখন যদি আরেকটু ম্যাচিউর হত, একটু বুঝতে পারত মায়ের কষ্ট তাহলে হয়ত মাকে এভাবে চলে যেতে হত না
আলমারি থেকে কোচকানো মচকানো অবস্থায় বেরলো মায়ের লেখার খাতগুলো আর বেশ কয়েকটা ওয়াটার কালার রঙ উঠে গেছে, ভাঁজ পরে গেছে হ্যান্ডমেড পেপারে মনে পড়ল, মা লিখত বটে খুব শখ ছিল ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার সে আর হয়ে ওঠেনি সন্দেশ খাতগুলো আলাদা করে সরিয়ে রাখল এগুলো সঙ্গে করে নিয়ে যাবে প্রতিটা লেখা পড়ে দেখবে মায়ের লেখার মধ্যে দিয়ে নিশ্চয়ই মাকে আরেকটু বেশি চিনতে পারবে আলমারিতে জামাকাপড় বিশেষ কিছু নেই মায়ের আলমারি ভর্তি যা আছে তা হল মায়ের প্রাণাধিক প্রিয় সফ্ট টয়ের কালেকশন যেগুলো ছোটবেলায় মা ওকে দিয়েছিল আর সেগুলোর চোখ, নাক, মুখ সব ঘুচিয়েছিল আর একটা ফাইল বেরলো, মায়ের মেডিক্যাল ফাইল সেসব দেখে আর কি হবে? তার চেয়ে বরং ডায়েরীটাই শেষ করা যাক

সারাদিন দোষারোপ শুনতে আমার আর ভালো লাগে না ছেলের বাঁদর হওয়ার সমস্ত দায়ভার আমার ছেলের বাবা উঁচুদরের চাকরি করে, এসব ছোটখাটো ব্যাপারে মাথা ঘামানোর সময় নেই তার আমি তো সারাদিন বাড়িতেই থাকি, তাহলে করি টা কি? ছেলেটাকেও মানুষ করতে পারি না? স্কুল থেকেও রোজ কমপ্লেন আসে ছেলে অবাধ্য, মুখে মুখে কথা বলে, মারকুটে, লেখাপড়া করে না, সমস্ত জিনিস ভেঙে চুরে নষ্ট করে - এর জন্য একশো ভাগ দায়ী আমি একটু কাগজ বা বই নিয়ে বসলেই হল, শ্বশুর বা শাশুড়ি চিৎকার করে ওঠে "ছেলেটাকে দ্যাখো কি করছে ওকে ঘরে আটকে রাখো" আচ্ছা, আমার কি একটুও নিজের মত বাঁচার অধিকার নেই?  আমি শুধুই কারুর স্ত্রী বা মা? শুধু কর্তব্য করে যাব আর বিনিময়ে কি পাব? অসম্মান আর অমর্যাদা? - নাহ, আর পড়তে পারল না সন্দেশ ক্রমশ মনে হচ্ছে মায়ের মৃত্যুর জন্য ওই দায়ী এখনো লাঞ্চ হয়নি তাও এই ভরদুপুরে পেগ সাজিয়ে বসল মনের সমুদ্রে সুনামি এসেছে কি মনে হল হঠাৎ, মেডিক্যাল ফাইল টা খুলল অন্যান্য কাগজপত্রের সাথে একটা মেন্টাল হসপিটালের এডমিশন ফর্ম মায়ের নামে মৃত্যুর সালে তবে কি মা মারা যাওয়ার আগে এসআইলামে ছিল?

নীল ঝলমলে আকাশ চাঙ্গি এয়ারপোর্ট থেকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের বিমান আকাশে ডানা মেলল শরৎকাল মা দুর্গার মত সন্দেশ বাড়ি আসছে তবে মায়ের কাছে চিরতরে সন্দেশের মা এখনো বেঁচে আছেন হ্যাঁ, মানসিক ভারসাম্যহীন এতবছর তার থেকে এই সত্যটা গোপন করা হয়েছিল, তারই ভালোর জন্য নাকি পাগল মা থাকার চেয়ে মা না থাকা ভালো সাইকেয়াট্রিক পেশেন্টের হাত থেকে আইনি ছুটকারা পেতে বাবারও বিশেষ অসুবিধে হয়নি সে যাকগে, মায়ের সাথে আর বঞ্চনা নয় মা চেয়েছিল ছেলে বড় হয়ে মায়ের সঙ্গী হবে আজ থেকে সন্দেশ সে স্বপ্ন পূরণ করবে সে হবে মায়ের সঙ্গী, আমৃত্যু গুডবাই সিঙ্গাপুর, গুডবাই সিং ডলার


No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া