Sunday, June 25, 2017

স্বপ্নস্বরূপ - ৭ -- ন ন্দি নী সে ন গু প্ত





এলো আষাঢ়। দাবদাহক্লান্ত দিনের প্রতীক্ষার অবসানে আসে বর্ষা। এ ঋতুর  আবাহনমন্ত্র কবি লিখেছেন বিশেষ যত্নে। বলেছেন, সে আসে ‘নয়ন স্নিগ্ধ  অমৃতাঞ্জন পরশে’। তাকে প্রণাম জানাই। হে জগতের হিতকারী ঋতু, প্রণাম জানাই তোমাকে। যে ঋতুর আবাহনের মধ্যে নিহিত আছে জগতসংসারের ক্ষুন্নিবৃত্তির কথা, নিহিত আছে ফসল ফলাবার মন্ত্র, তাকে প্রণাম জানাতেই হয়। কবি সেই কারণেই বিশেষভাবে প্রণাম জানিয়েছেন বর্ষাকে। তবে আষাঢ় শব্দটির সাথে ‘আষাঢ়ে’ এই বিশেষণটিও যে জড়িয়ে আছে। কবির প্রাণে বেজেছিল সে কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘কবিশেখর কালিদাস যে  আষাঢ়কে আপনার মন্দাক্রান্তাচ্ছন্দের অম্লান মালাটি পরাইয়া বরণ করিয়া লইয়াছেন তাহাকে ব্যস্ত লোকেরা ‘আষাঢ়ে’ বলিয়া অবজ্ঞা করে’  হয়তবা সেই ব্যথা ঢাকতে গিয়ে বাধ্যতামূলকভাবেই কবি আমাদের চেনালেন আষাঢ়ের স্বরূপ। বেজে উঠল,
‘রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের ’পরে-
নবতৃণদলে বাদলের ছায়া পড়ে
‘বিপুল’ শব্দটির সুরের চলনের মধ্য দিয়ে শুধু খোলা প্রান্তর নয়, আষাঢ়ের আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘেদের বিস্তার ধরা পড়ল। ঐ একটা শব্দের মধ্য দিয়ে কবি যেন বন্দী করে ফেললেন আষাঢ়কে। আষাঢ় মানে যে খরাক্লান্ত হৃদয়ের সহস্রাব্দব্যাপী এক প্রতীক্ষার অবসান,  সেই বোধ এলো যখন বহুযুগের ওপার থেকে আষাঢ় আকাশে নয়, মনে আসার কথা বলেন কবি। আষাঢ়ের বজ্রপাত শুধু এক প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, সে যেন মণিমাণিক্যে গাঁথা এক অপরূপ মালা।  
সজলঘন প্রকৃতির রূপের বিচিত্র বর্ণনা শুধু নয়, কবির মনে আষাঢ় যেন নিয়ে আসে একাকীত্বের বিষণ্ণতা, বিপন্নতা। একা হয়ে যাবার ভয়, কোনও প্রিয়মানুষকে হারিয়ে ফেলার ভয় খেলা করে বেড়ায় বিপুল জলধারায়। এক অদ্ভুত আর্তি মিশে থাকে আষাঢ়ের সাথে, যখন উচ্চারিত হয়, ‘ওগো, আজ তোরা যাস নে গো তোরা/ যাস নে ঘরের বাহিরে’।
একইসঙ্গে আষাঢ় টেনে বের করে নিয়ে আসে আমাদের অন্তরের শৈশবকে। আমাদের সবার মনেই যেন বর্ষার জমা জলে ভেসে বেড়ায় সেই কাগজ-নৌকাখানি। ‘বর্ষার চিঠি’ প্রবন্ধে নিজের শৈশবের স্মৃতিচারণ করছেন রবীন্দ্রনাথ... ‘মনে পড়ে, বর্ষার দিন আমাদের দীর্ঘ বারান্দায় আমরা ছুটে বেড়াতেম বাতাসে দুমদাম করে দরজা পড়ত, প্রকাণ্ড তেঁতুলগাছ তার সমস্ত অন্ধকার নিয়ে নড়ত, উঠোনে একহাঁটু জল দাঁড়াত, ছাতের উপরকার চারটে টিনের নল থেকে স্থূল জলধারা উঠোনের জলের উপর প্রচণ্ড শব্দে পড়ত ও ফেনিয়ে উঠত, চারটে জলধারাকে দিক্‌হস্তীর শূঁড় বলে বনে হত।’         

বর্ষার আগমনের উচ্ছ্বাস মানুষকে ভুলিয়ে দিতে পারে সব প্রয়োজনীয় কাজ। অতি গম্ভীর মানুষের মুখেও হাসি এনে দিতে পারে জলধারার উচ্ছলতা। মরুর দেশ, অনাবৃষ্টির দেশ, তারা কি দুর্ভাগা! তারা দেখেনি প্রকৃতির এই স্নেহের দান, দেখেনি এই উৎসবের আয়োজন। তাকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে অজস্র কবি পাঠিয়েছেন আহ্বান। সব আহ্বানের মধ্যে কোনওদিন মলিন হয়ে যাবেনা বিশ্বকবির উপলব্ধি... ‘সকল কাজের বাহিরের যে দলটি যে অহৈতুকী স্বর্গসভায় আসন লইয়া বাজে কথার অমৃত পান করিতেছে, কিশোর আষাঢ় যদি আপন আলোল কুন্তলে নবমালতীর মালা জড়াইয়া সেই সভার নীলকান্তমণির পেয়ালা ভরিবার ভার লইয়া থাকে, তবে স্বাগত, হে নবঘনশ্যাম, আমরা তোমাকে অভিবাদন করি। এসো এসো জগতের যত অকর্মণ্য, এসো এসো ভাবের ভাবুক, রসের রসিক, আষাঢ়ের মৃদঙ্গ ঐ বাজিল, এসো সমস্ত খ্যাপার দল, তোমাদের নাচের ডাক পড়িয়াছে।’          

3 comments:

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া