Saturday, November 25, 2017

মহাকাশ বিজ্ঞান / সূর্যের আয়ু -/ -অরুণ চট্টোপাধ্যায়


সূর্য আমাদের জন্মদাতা। সূর্য আমাদের অন্নদাতা। সূর্য আমাদের পরিপালক, পরিপোষক। অর্থাৎ সূর্য একসঙ্গে আমাদের বাবা ও মা। এই ‘আমাদের’ কথাটার মানে মানুষ অর্থাৎ শুধু পৃথিবীর মানুষ নয়। সূর্যের অধীনস্থ সমস্ত গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণুপুঞ্জ আর যা কিছু আছে এই সৌরমন্ডলে।
সবাই জানেন আমাদের এই পৃথিবীটা কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল। শুধু পৃথিবী নয়, সৃষ্টি হয়েছিল একসঙ্গে ন’টি গ্রহ। প্লুটোকে, মতান্তরে, বামন গ্রহ হিসেবে ধরা হয় এর আরও তিনটি সহযোগী বামন গ্রহের সঙ্গে। যেমন করে পিতা আর মাতার দেহের অংশ একত্রিত করে জন্ম হয় সন্তানের ঠিক তেমন করেই সূর্যের দেহের একটি বৃহৎ টুকরো তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল গ্রহ উপগ্রহগুলি।  
এই জন্মকাহিনী নিয়ে আজ আমার এই প্রবন্ধ নয়। গ্রহমন্ডলীর পিতা বা স্রষ্টা সূর্যের সম্পর্কে, বেশি স্পষ্ট করে বলতে গেলে তার আয়ু নিয়েই আমার এই লেখা। অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে তার অস্তিত্ব কোনও সংকটে আছে কিনা অথবা তার কখনও কোনভাবে তার বিলীন হবার সম্ভাবনা আছে কিনা সেটা বলার জন্যে এই প্রবন্ধ। এটি সাধারণ এক আলোচনা বিশেষজ্ঞের মতামত নয়।
সূর্যের জন্মের পর থেকে কেটে গেছে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন বছর মানে প্রায় সাড়ে চারশ কোটি বছর (4.55 Billion years)। এক বিলিয়ন মানে হল একশ কোটি। বিগত এই সাড়ে চারশ কোটি বছর কি সূর্য একই রকম ছিল? কথায় আছে ‘জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে?’ এই প্রবাদ শুধুমাত্র মানুষ বা জীবিত প্রাণীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। প্রযোজ্য সমস্ত জাগতিক বস্তুর জন্যে।  
অর্থাৎ জন্মটার নিশ্চয়তা না থাকলেও মৃত্যুটা নিশ্চিত। যে কোনও জিনিসের সৃষ্টি নাও হতে পারে কিন্তু সৃষ্টি হলে তার এক সময় না এক সময় পরে ধ্বংস অনিবার্য। সে দু’দিন বাদে হোক বা দু’শ কোটী বছর বাদে হোক।  
আমার এ কথাটায় অনেকের মন খারাপ হয়ে যেতে পারে। কারণ সূর্যের একটা জন্ম যখন আছে তখন মৃত্যু বা ধরা যাক স্বাভাবিক মৃত্যুও একটা থাকতে পারে এই ভেবে। হ্যাঁ, বিজ্ঞানীরা অবশ্য তেমন আশংকাই প্রকাশ করেছেন। যেহেতু এ জগতে অবিনশ্বর কেউ নয়, তাই সূর্যের ক্ষেত্রেও এটা সমভাবে প্রযোজ্য হবে। সেও চিরস্থায়ী নয় মোটেই।
কিন্তু যে কোনও জিনিসের ধবংসের কথা বলতে গেলে তার জন্মের কথা কিছু বলতেই হয়। সূর্যের বয়স এখন মাত্র সাড়ে চারশ কোটি বছর (4.55 Billion years)। অর্থাৎ এর আয়ুর ঠিক মধ্য গগনে অধিষ্ঠান করছে এখন। ভর এক দশমিক নয় নয় গুণিত একের পিঠে তেত্রিশটা শূন্য দিলে যা হয় তত গ্রাম (1.99X10^33Gram)। ব্যাসার্ধ হল সাত লক্ষ কিলোমিটার (700,000 KM)। আলোক উজ্জ্বলতা (Luminosity) তিন দশমিক আট তিন গুণিত একের পিঠে ছাব্বিশটা শূন্য ওয়াট (3.83x10^26 watt)। সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা প্রায় দেড় কোটী ডিগ্রী সেলসিয়াস (15 million degrees Celsius বা 1.57x10^7K)। সারফেসের তাপমাত্রা পাঁচ হাজার সাতশত ঊনআশি কেলভিন(5779K) বা প্রায় ছয় হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস (6045 degree Celsius)। সূর্যের চারপাশে জ্বলন্ত গ্যাসের একটি আলোকিত উজ্জ্বল অংশ আছে এটিকে ছটা মন্ডল বা করোনা (corona) বলে যার তাপমাত্রা প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ কেলভিন (5x10^6K)।    
সূর্যের বিভিন্ন অংশের এত যে তাপমাত্রার ফিরিস্তি দেওয়া হল তার কারণ সূর্যের বিশাল ও দীর্ঘস্থায়ী শক্তির উৎস সম্পর্কে সকলকে একটা ধারণা দেওয়া। এই ধারণা না থাকলে সূর্যের আয়ু সম্পর্কেও পরিষ্কার ধারণা থাকবে না বলে আমার মনে হয়। একটি ছোট দেশলাই কাঠি এক ফুঁয়ে নিভে যায়। একটা মোমবাতি দমকা হাওয়ায় নিভে যায়। কিন্তু একটা মোটা সলতের বেশ বড় প্রদীপ বাতাসের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ টিকে থাকতে পারে। অর্থাৎ যে বস্তুর অভ্যন্তরে সঞ্চিত শক্তি (তাপ, বৈদ্যুতিক, যান্ত্রিক যে কোনও প্রকারের শক্তি হতে পারে) যত বেশি তার টিকে থাকার ক্ষমতাও তত বেশি।    
ওপরের চিত্রে স্কেলের যে ১ দাগটা আছে সেটা সূর্যের জীবনারম্ভের দাগ। অর্থাৎ এই সময় সূর্য সৃষ্টি হয়েছিল। কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল সেটি প্রসঙ্গান্তর। পরে কখনও সুযোগ পেলে বলা যাবে। সূর্যের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ হাইড্রোজেন যার থেকে তৈরি হচ্ছে হিলিয়াম নামক গ্যাসটি। সূর্যের অভ্যন্তরে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম উৎপাদিত হয় যে পদ্ধতিতে তাকে বলে ফিউশন পদ্ধতি (Fusion)। এই পদ্ধতিতে চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু মিলে একটি হিলিয়াম পরমাণু উৎপন্ন হয়। চারটি হাইড্রোজেন পরমাণুর মিলিত ভর হল 4.03130 AMU আর একটি হিলিয়াম পরমাণুর ভর হল 4.00268AMU (1AMU= one atomic mass unit= 1.67x10^27 kg.). সংযোজন শেষে বাড়তি ভর পড়ে থাকে 0.02862 AMU. আইনস্টাইনের সূত্র E=mc^2 অনুসারে এই বাড়তি ভর প্রচুর পরিমাণে শক্তিতে রূপান্তরিত হয় যা হল সূর্যের আসল শক্তি। কয়লার উনুনের মধ্যে যেমন গনগনে আঁচ দেখা যায় ঠিক তেমনই দেখা যায় সূর্যের মধ্যেও। সূর্য যে ক্রমাগত আলো আর তাপ বিকিরণ করে চলেছে সারা সৌরমন্ডলে, তার উৎস সূর্যের ভেতর নিয়ত ঘটে যাওয়া এই ফিউশন বিক্রিয়া।  
এখন, সৃষ্টির মুহূর্তে, সূর্য কিন্তু একটি পুরোপুরি তারা বা নক্ষত্র অর্থাৎ Star হয়ে ওঠেনি তখন তার মধ্যে ভর সবে কেন্দ্রীভূত হতে শুরু করেছে, তখনও ফিউশন সংঘটিত হয় নি। এর পর ফিউশন শুরু হয় আর ক্রমশ বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে তার মধ্যে সঞ্চিত তাপশক্তির পরিমাণও। বাড়তে থাকে তার তাপ বিকিরণের পরিমাণও। বাড়তে থাকে তার আকারও। একটি রুটি যেমন ফুলে বড় হয় তার মধ্যে সঞ্চিত গ্যাসের জন্যে বা এক কড়া দুধ যেমন ফুলে উথলে ওঠে তার মধ্যে ভরা বাতাসের উত্তাপে আয়তন বৃদ্ধির জন্যে, এও বেশ কতকটা তেমনই। উত্তাপে যে প্রচুর পরিমাণ গ্যাস তৈরি হয় অথচ সূর্যের মাধ্যাকর্ষণের (gravitation) কারণে যেগুলো মহাকাশে দূরে কোথাও ছিটকে চলে যেতে পারে না। এইভাবেই সূর্যের আকার দিনে দিনে বাড়তেই থাকে আর বাড়তেই থাকে। স্কেলে পরবর্তী ছবিগুলি লক্ষ করুন।   
এখন সূর্য রয়েছে স্কেলে ঠিক চার দশমিক পাঁচ দাগের কাছে। খেয়াল করুন এর পর থেকে দাগ যতই বেড়ে যাচ্ছে সূর্য ততই একটু একটু করে আয়তনে বাড়ছে। বাড়ছে তার উজ্জ্বলতা আর উত্তাপও। সূর্য হচ্ছে আরও রাগী। অর্থাৎ আগামী দিনগুলি বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি (Rise in global temperature) শুধুমাত্র পরিবেশ দূষণের কারণেই হবে না, হবে সূর্যের ক্রমাগত এই ‘রাগ বৃদ্ধির’ জন্যেও। কারণ বাড়ছে এর মধ্যে অনবরত ঘটে যাওয়া হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়ামের ফিউশন বা  সংযোজন বিক্রিয়ার সংখ্যা আর উৎপন্ন শক্তির পরিমাণও। এই চিত্র কাল্পনিক হলেও নিতান্ত মনগড়া নয়। বিজ্ঞানীরা আগাম হিসেব করে এটি তৈরি করেছেন। অর্থাৎ বিজ্ঞানের জটিল অংকের ফসল রয়েছে এই সিদ্ধান্তের মধ্যে।  
লক্ষ করে দেখুন, স্কেলে ঠিক যেখানে দশ লেখা আছে অর্থাৎ সময়ের হিসেবে যা প্রায় হাজার কোটী বছর, তখন সূর্যের কী ভয়ংকর রূপ আর আকার। সূর্যের বয়স যখন (হবে) বার দশমিক দুই বিলিয়ন বছর তখন সে হয়ে যাবে এর চেয়েও ভয়ংকর দৈত্যাকার। ভয়ংকর রকমের লাল আর বড়। এই ষ্টেজটিকে বলা হচ্ছে লাল দৈত্য বা Red Giant. এই সময় সূর্যের বাইরের স্তরগুলি আরও প্রসারিত হতে চাইবে। কিন্তু এর ভিতরের অংশটি অর্থাৎ কোর বা আঁটির ক্রমশ ঘটতে থাকবে সংকোচন। এই সময় সূর্য ক্রমশ ঠান্ডা হতে থাকবে আর আকারেও বড় হতে থাকবে।  
সূর্য যখন সবচেয়ে বড় আকার ধারণ করে লাল দৈত্য হবে তখন তার কোর বা ভেতরের অংশে আরও অনেক বেশি করে ফিউশন ঘটতে থাকবে। আরও বেশি করে তাপ ছড়িয়ে দিতে থাকবে। ফলে সে ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকবে। ভেতরে ক্রমশ জ্বালানী কমে আসার ফলে তাপের উৎপাদন ক্রমশ কমতে থাকবে। উৎপন্ন হিলিয়াম ক্রমশ বাইরে বেরিয়ে আসছে কিন্তু নতুন করে কোনও হিলিয়াম আর তৈরি হচ্ছে না। এখান থেকেই সূর্যের শেষের হবে শুরু। তাপ তো আর তৈরি হবেই না বরং ক্রমাগত ছড়িয়ে দিতে থাকার জন্যে সে আকারে ছোট হতেই থাকবে। অর্থাৎ যাকে বলে জ্বলে পুড়ে একেবারে খাক হয়ে যাওয়া। তারপর ছাইগুলো যেমন চুর চুর হয়ে বাতাসে মিশিয়ে যেতে থাকে তেমনই হবে সূর্যের দশা (প্ল্যানেটরি নেবুলা)। যেমন ধরা যাক একটি শুকনো গাছের গুঁড়িতে আগুন লাগানো হল। আগুন ক্রমশ বিস্তার লাভ করছে আর উত্তাপ বাড়ছে। ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে। এতই গরম চারপাশটা যে আগুনের সেই হলকা সহ্য করা যায় না। দাঁড়িয়ে থাকা অসহ্য। এরপর এক সময় সেই গাছের গুঁড়ির অভ্যন্তরে সঞ্চিত জ্বালানীর পরিমাণ (Fuel) কমতে থাকল। আগুন কমতে থাকল। উত্তাপ কমতে থাকল। কিন্তু গাছের গুঁড়ি ততক্ষণে পুড়ে একেবারে নিঃশেষ। চুর চুর হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল। আমাদের প্রিয় সূর্য ঠিক সেইভাবে মিলিয়ে যেতে থাকবে ক্রমশ। ধরুন না কেন ঠিক যেমন মৃত্যুর পরে আমরা মিলিয়ে যাই পঞ্চভূতে?       
এই প্রায় সাড়ে বার কোটী বছর (12.2 Billion years) অর্থাৎ যখন থেকে সূর্য লাল দৈত্য হতে শুরু করবে তখন থেকেই তার বাজবে মৃত্যুঘন্টাও। কিন্তু সে তো এখনও প্রায় সাত আটশ কোটি বছর দূরের কথা। একবার ভাবুন তো, ততদিন কি পৃথিবী নিজেই বেঁচে থাকবে কিংবা বেঁচে থাকবে কি সারা সৌরজগত সূর্যের ঐ মারাত্মক বর্ধমান তাপের ছটা সহ্য করে? গ্রহমন্ডলীর নিজেদের কোনও শক্তির উৎস নেই। তাই নেই তাদের অস্তিত্বরক্ষার কোনও ব্যবস্থাও। হয়ত সূর্যের ঐ লাল দৈত্যের অবস্থা আসার বহু আগেই সমগ্র সৌরজগৎ পুড়ে ছাই হয়ে মহাকাশে মিলিয়ে যাবে। লাল দৈত্য দেখার সুযোগ হয়ত মানুষের আর হবেই না।    
এসব নানা প্রশ্ন, প্রশ্ন হয়েই আপাতত ঝুলে থাক আমাদের কোতূহলের পর্দায়। মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন নেই। ভয় বা আশংকিত হবার কোনও প্রয়োজন নেই। কারণ ততদিন থাকব না আমরা কেউ—না এই লেখক না তার পাঠককুল। ভবিষ্যতের কথা লেখা হবে ভবিষ্যতের পাতায়। আর সে পাতা হয়ত কোনদিন খোলাই হবে না আমাদের সামনে।   


No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া