চিলেকোঠা। এই শব্দটা
উচ্চারণের সাথে সাথে যেকোনো বাঙালির মনে জেগে ওঠে এক অদ্ভুত স্মৃতিমেদুরতা। অবশ্য
এখনকার এই কাচ-কাঠ-কংক্রিটের ফ্ল্যাটবাড়ি আর হাউসিং কমপ্লেক্সে ভর্তি বদলে যাওয়া
শহরে সেই সাবেক কায়দায় বানানো বাড়ির ছাদের ঘরে চিলেকোঠার নষ্ট্যালজিয়া খুঁজে পাওয়া
ভারি মুস্কিল। তবে অতীতে তো এমনটি ছিল না। বহুযুগ ধরেই, এমনকি রবীন্দ্রনাথের
জীবনেও বিশেষ কিছু উল্লেখযোগ্য স্মৃতি ছিল চিলেকোঠা বা ছাদের ঘর নিয়ে। চিলেকোঠা
মানেই সামনে অনেকখানি জায়গা যেখানে আকাশ নেমে আসে। ছোট ঐ ঘর অনেক তরঙ্গ নিয়ে আসে।
ছোট একটু স্থানের মধ্যে ধরে রাখে নানা রঙের অনুভূতি।
‘ছেলেবেলা’ প্রবন্ধে দেখতে
পাই কবির সাথে তার বৌঠাকরুনের রান্নাবাটি খেলার জায়গা ছিল ঐ চিলেকোঠা। না,
পাঠক/পাঠিকারা এর মধ্যে দয়া করে কোনও কলুষ খুঁজতে যাবেন না। নেহাত শিশুবয়সের
দেওরের সাথে এক বালিকাবধূর রান্নাবাটি খেলার মধুর রসটি যারা আহরণ করতে অক্ষম,
তাদের জন্য এ লেখা নয়।
বৌঠাকরুনের আপন জায়গা ছিল ছাদের ঘর। সেখানে রবির অবাধ
গতায়াত। পুতুলের বিয়ের প্রধান অতিথি কে? রবি। বৌঠাকরুনের হাতের রান্না প্রথমে কে
চেখে দেখবে? রবি। রবির দিনের রঙটাই বদলে যায় পান্তাভাতে ‘লঙ্কার আভাস’ দিয়ে
চিংড়িমাছের চচ্চড়ি মেখে যখন বৌঠাকরুন পরিবেশন করেন। এই নিষ্কলুষ বন্ধুত্বের
ছেলেমানুষি যে এখনকার কালের মানুষের ঠিকঠাক হজম হবেনা, রবি কি সেই ইঙ্গিত
পেয়েছিলেন? নাহলে তিনি কেনই বা বলবেন...
“এ কালের মেয়েদের হাসি পাবে, তাঁরা বলবেন,
নিজের ছাড়া সংসারে কি পরের দেওর ছিল না কোনোখানে। কথাটা মানি। এখনকার কালের বয়স
সকল দিকেই তখনকার থেকে হঠাৎ অনেক বেড়ে গিয়েছে। তখন বড়ো ছোটো সবাই ছিল ছেলেমানুষ!”
বৌঠাকরুন আস্তে আস্তে সাজিয়ে নিয়েছিলেন ছাদের সামনের জায়গাটুকু। বাগান করেছিলেন
সেখানে। মাতৃহারা বালক রবিও যেন সেই বাগানের ফুলের মতই লাভ করেছিল জ্যোতিদাদা আর
বৌঠাকরুনের স্নেহসান্নিধ্য। সকালে পূর্বদিকের চিলেকোঠার ছায়ায় কফিপান করতে করতে
জ্যোতিদাদা পড়ে শোনাতেন নতুন নাটকের খসড়া। বিকেলে গানের সুরে পিয়ানোর সঙ্গতে ভেসে
যেত চিলেকোঠার সামনের আকাশটুকু।
বৌঠাকরুন বধূবেশে বাড়িতে আসার আগে থেকেই শিশু রবির
বিশেষ পছন্দের জায়গা ছিল চিলেকোঠার সামনের ছাদটুকু। রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, “আমার
জীবনে বাইরের খোলা ছাদ ছিল প্রধান ছুটির দেশ। ছোটো থেকে বড়ো বয়স পর্যন্ত আমার নানা
রকমের দিন ঐ ছাদে নানা ভাবে বয়ে চলেছে। আমার পিতা যখন বাড়ি থাকতেন তাঁর জায়গা ছিল
তেতালার ঘরে। চিলেকোঠার আড়ালে দাঁড়িয়ে দূর থেকে কতদিন দেখেছি, তখনো সূর্য ওঠে নি,
তিনি সাদা পাথরের মূর্তির মতো ছাদে চুপ করে বসে আছেন, কোলে দুটি হাত জোড়করা। মাঝে
মাঝে তিনি অনেক দিনের জন্য চলে যেতেন পাহাড়ে পর্বতে, তখন ঐ ছাদে যাওয়া ছিল আমার
সাত-সমুদ্দুরপারে যাওয়ার আনন্দ।”
একান্তের ঐ ছাদের ঘর যে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল তার
জীবনে, সে কথা আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, কারণ রবীন্দ্রনাথ –সৃষ্ট বেশ ক’টি
গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বাস করে ছাদ সংলগ্ন ঘরে। ‘যোগাযোগ’ এর কুমুদিনী নিজের মনকে
প্রস্তুত করে নেবার জন্য ছাদের কোণে গিয়ে বসে। ‘ঘরে বাইরে’র বিমলা যখনই নিজের সঙ্গে
বোঝাপড়া করতে চায়, তখন খোলা আকাশের নিচের ছাদটাই আশ্রয়। ‘চোখের বালি’ মহেন্দ্রর
জীবনও অদ্ভুতভাবে আবর্তিত হয় খোলা আকাশের পাশে ছাদের ঘরের শয়নকক্ষ ঘিরে। ‘শেষের
কবিতা’র অমিত যখন তার প্রেয়সী বন্যার সাথে ঘর বাঁধবার স্বপ্ন দেখে, তখন গেরস্থালি
গুছিয়ে নেবার জন্য ছাদের পাশের চিলেকোঠা ঘর ভাড়া নেওয়া তার প্রথম পছন্দ। ‘গোরা’
উপন্যাসে দেখতে পাই সুচরিতার মাসি হরিমোহিনীর ঠাঁই হয়েছে চিলেকোঠার ঘরে। সংসারের
মূল অন্দরমহলের বাইরে খোলা আকাশের সঙ্গে লাগোয়া এই ঘরটিকে অতি অবশ্যই লেখক এক
বিশেষ মর্যাদার জায়গায় রেখেছেন। বাইরের সঙ্গে ভিতরের সংযোগ স্থাপন করে অনেক কাল
ধরে মানুষের জীবনে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে চিলেকোঠা।
Type a message...
No comments:
Post a Comment