Thursday, January 25, 2018

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া


সম্পাদকীয় / গৌতম সেন



বছর শেষের ঋতু শীতকে ভাগ বাটোয়ারা করে নিল পুরাতন ও নূতন। এভাবেই চিরকাল পুরোনো বছর হয় বিদায় নতুনকে পথ ছেড়ে দিয়ে। ২০১৮ – এল নতুন সাজে, নতুন কলেবরে। প্রথম মাসের অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই বেশ শীতল। নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে পুরো বাংলাই বেশ কয়েক বছর পর জমজমাট শীতের সম্মুখীন হ’ল।
এ সময়টা বলা যেতে পারে ছোটবড় নানা উৎসবের মরশুম। মকর সংক্রান্তি, গঙ্গাস্নান। ঘরে ঘরে পিঠে-পায়েসের সৌরভ – নতুন চাল আর নতুন গুড়ের গন্ধে। তার অব্যবহিত পরেই এল সরস্বতী পুজোর উৎসব। বিদ্যাদেবীর আরাধনা, এ তো বাঙালির আর এক সনাতন উৎসবানন্দ।
আমাদের এই ই-ম্যাগ প্রকাশ যখন পাবে, তার মধ্যেই আমরা পালন করে এসেছি এমন কিছু উৎসব, আর আগামী দিনগুলোতে আবার ছুটির অবকাশ, ২৬শে জানুয়ারি – প্রজাতন্ত্র দিবস। সাহিত্য পিপাসু বাঙালিমনের অতি প্রিয় অনুষ্ঠান – কলকাতা বইমেলাও এসে গেল দোরগড়ায়। আমাদের সদস্য-সদস্যার লেখা বেশ কিছু নতুন বই প্রকাশ পাবে সে বইমেলা প্রাঙ্গনে। তাঁদের জানাই আগাম অভিনন্দন।
এবার আসি চিলেকোঠার সদস্য-সদস্যাদের এক আসন্ন জমায়েতের কথায়। ইতিমধ্যে প্রায় সকলেই অবগত হয়েছেন আগামী ২৭ শে জানুয়ারি, শনিবার কলকাতায় প্রিন্সেপ ঘাটে এক সুন্দর মিলন উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে, যে যাত্রার শুভারম্ভ হবে দমদম স্টেশন থেকে চক্ররেলে। অনেকেই তাঁদের সম্মতি জানিয়েছেন, যোগদান নিমিত্ত ধার্য চাঁদাও জমা করেছেন। এখনও যারা ভাবছেন, এগিয়ে আসুন। চলে আসুন প্রিন্সেপ ঘাটে এই জমায়েতে। এ সুন্দর জমায়েত সব দিক থেকে সাফল্যমণ্ডিত হোক আমাদের সকলের সহৃদয় সহযোগীতার মাধ্যমে।
প্রতিবারের মতই এ সংখ্যায় কবি ও লেখক বন্ধুদের বেশ ভাল ভাল রচনা প্রকাশ পেয়েছে। এ জন্য চিলেকোঠা অ্যাডমিন সকলের কাছে কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানাচ্ছে।
আবহাওয়ার গতি-প্রকৃতি জানাতে শুরু করেছে শীতের চলে যাওয়া প্রায় এগিয়ে এল। আগামী বসন্তের হাওয়া বইতে শুরু হবে আর কিছুদিন বাদেই, আবার বাঙালি মেতে উঠবে সে ঋতুর উৎসবে। সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন সবাই – এই শুভকামনা জানিয়ে এখন তবে ইতি টানা যাক সম্পাদকীয়ের।


স্বপ্নস্বরূপ - ১৪ ,/ ন ন্দি নী সে ন গু প্ত


      গতপর্বেই বলেছিলাম ভেদবুদ্ধির উর্ধ্বে উঠবার কথা রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে বলে গিয়েছেনকিন্তু সেকথা উপলব্ধি করা আমাদের বুদ্ধিতে একেবারেই কুলোয়নি। হ্যাঁ, খুব দুঃখের সাথেই একথা বলছি যে আমরা তার লেখা বা কর্মকাণ্ড থেকে কোনও শিক্ষাই নিতে পারিনি। পারলে আমাদের দেশে জাতধর্ম নিয়ে এত ভুল ভাবনার স্বার্থাণ্বেষী বীজের গাছ এখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারতো না।   
না, তিনি সত্যিই ‘হিন্দুত্ব’ কে শুধুমাত্র একটা ধর্ম বলে দেগে দেননি। বলেছেন, ‘হিন্দু ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি জাতিগত পরিণাম। ইহা মানুষের শরীর মন হৃদয়ের নানা বিচিত্র ব্যাপারকে বহু সুদূর শতাব্দী হইতে এক আকাশ, এক আলোক, এক ভৌগোলিক নদনদী অরণ্য-পর্বতের মধ্য দিয়া, অন্তর ও বাহিরের বহুবিধ ঘাতপ্রতিঘাত-পরম্পরার একই ইতিহাসের ধারা দিয়া আজ আমাদের মধ্যে আসিয়া উত্তীর্ণ হইয়াছে' উদাহরণস্বরূপ বলি, যখন এই লেখা লিখছি, হয়তো বা সেই মুহূর্তে মাঘমাসে শ্রীপঞ্চমী তিথিতে বন্দিতা হচ্ছেন বাগদেবী। পূজার আয়োজনে গ্রামের কোনও ইস্কুলে যে মেয়েটি ফলমূল কেটে নৈবেদ্য সাজাচ্ছে, সাজাচ্ছে  ফুল দিয়ে পূজার অর্ঘ, -কারো যেন প্রশ্ন করার সাহস না হয় তার জাতধর্ম নিয়ে এরকম ভারতবর্ষের ছবিই কবি দেখেছিলেন। তবে এই স্বপ্নের ছবি খণ্ডিত, সর্বব্যাপী নয়। এখনো এই দেশে এরকম জায়গার অভাব নেই, যেখানে গ্রামে দলিতদের জন্য আলাদা কূপ এবং দিনের বেলা নিচুজাতের ছায়া মাড়ানো পাপ। হিন্দু বর্ণাশ্রমের প্রধান চার বর্ণের বাইরের এই বর্ণকে সরকারীভাবে সংরক্ষণের আওতায় রাখা হলেও বর্তমান জটিল জীবনযাত্রায় অর্থই প্রধান চালিকাশক্তি। ফলে অনগ্রসর জাতি কোথাও কোথাও আরও অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।   

পৃথিবীতে অনেক দেশেই অর্থনৈতিক মেরুকরণ এখন এক চরম আকার ধারণ করতে চলেছে। এর ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিলোপ আসন্ন। এই বিশাল বিভেদের পাশাপাশি যোগ হয়েছে ধর্মভিত্তিক মেরুকরণ, যা বিভিন্ন স্বার্থাণ্বেষী গোষ্ঠীর নিজেদের অস্তিত্ব জিইয়ে রাখার কৌশল।  আমরা ভুলে গিয়েছি শতাধিক বর্ষ আগে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ পথে নেমে জাত-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের হাতে রাখি পরিয়েছিলেন। সে কাজ হয়তো বা কারো কাছে মনে হয়েছিল অতিরিক্ত নাটকীয় গিমিক, কিন্তু তার সেই উচ্চারণ, ‘বঙ্গদেশটি ভাঙলে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান -সকল মানুষের বঙ্গদেশই ভাঙবে। কেবল হিন্দুর বঙ্গদেশ ভাঙবে না' সেই কথা কেউ অস্বীকার করতে পারেনি। না, বাংলা ভাগ আটকানো যায়নি। যদিও কবি নিজের জীবদ্দশায় দেখে যান নি এই ভাঙন।

ভাঙন দেখে না গেলেও তিনি জানতেন বিপদ কোথায়। বলেছিলেন, ‘শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না; অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে'   হিন্দু-মুসলমানের মাঝের প্রভেদ সেই ব্রিটিশ আমল থেকে ইংরেজ শাসকরা নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে। দুঃখের বিষয় এখন স্বজাতির দ্বারা শাসিত হয়েও, ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হবার সত্তর বছর পরেও সম্পূর্ণরূপে বেরিয়ে আসতে পারিনি এই বিভেদ থেকে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বারে বারে মাথাচাড়া দিয়েছে অসন্তোষ। নিজেরাই আহ্বান করে নিয়ে এসেছি ‘শনি’।

ভেদ মোছা যায়না। প্রকৃতির নিয়মে, সমাজের নিয়মে, কালের নিয়মে ভেদ অতি স্বাভাবিক বস্তু। সকল রকম বৈচিত্র ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির বলেই তা সুন্দর বলে মনে হয় আমাদের চোখে। ভেদ নিন্দনীয় নয়, নিন্দনীয় হল ভেদবুদ্ধি। নিন্দনীয় হল তজ্জনিত বঞ্চনা, অন্যায়, অবিচার, যা যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশে চলে আসছে। আবার নতুন করে মনে করবার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে যে কবি বলে গিয়েছিলেন যিনি বর্ণভেদের অতীত, তিনি শুভবুদ্ধি দ্বারা আমাদের সংযুক্ত রাখুন। কবি এই ভেদবুদ্ধিকে ভূত তাড়ানোর মত তাড়িয়ে দেবার কথাও বলেছিলেন। সমাধানের পথ হিসেবে বলে গেছেন বলপ্রয়োগ বা কণ্ঠপ্রয়োগ নয়, অর্থাৎ দাদাগিরি বা গলাবাজি করে এখন আর এই ‘ভেদবুদ্ধি’ র ভূত ভাগানো সম্ভব নয়। কবি বলেছেন,
‘কথায় তো শোধ হয় না দেনা,  গায়ের জোরে জোড় মেলে না
           
গোলেমালে ফল কি ফলে জোড়াতাড়ার ছাঁদে ॥...’
হ্যাঁ, এই জোড় মেলাতে, ভেদবুদ্ধি তাড়াতে শুভবুদ্ধি প্রয়োজন, হিতবুদ্ধি প্রয়োজন। কর্মের দ্বারা, বিশ্বাসের দ্বারা, পারস্পরিক শ্রদ্ধার দ্বারা হয়তো বা সম্ভব। স্বপ্ন দেখেছিলেন কবি, আমাদেরও দেখিয়েছিলেন। অপেক্ষায় আছি আজো...
        ‘এসো হে আর্য, এসো অনার্য,
              হিন্দু মুসলমান।
       এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ,
              এসো এসো খৃস্টান।
                   এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন
                    ধরো হাত সবাকার,
                   এসো হে পতিত করো অপনীত
                    সব অপমানভার।
              মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা
              মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা,
              সবারে-পরশে-পবিত্র-করা
                    তীর্থনীরে।
              আজি ভারতের মহামানবের
                    সাগরতীরে



তুচ্ছাতিতুচ্ছ / অনুপম দাশশর্মা

কবি পরিচিতি-আমি অনুপম দাশশর্মা খুব ছোটবেলা থেকে সাহিত‍্যের প্রতি আকর্ষণ। আজ কাব‍্যজগতে নিজের একটি পরিচিতি দেওয়াতে সফল হয়েছে। মূলতঃ কবিতা লিখি। ছুঁয়ে যাই জীবনের নানান ওঠাপড়ার দিকগুলো শব্দের শরীরে।
লেখালেখির শুরু স্কুল জীবন থেকে। দুটি কাব‍্যগ্রন্থ প্রকাশিত। পালকের ঘরবাড়ি, কুয়াশায় কার্নিশ। প্রকাশিত ২০১২ আর ২০১৬সালে, কলকাতা বইমেলায়।


-------------------------------------------------------------------

সময়ের এই যে ধাবমানতা, এখানে-
পিছিয়ে থাকে মানুষের কন্ঠ
পাখির উড়ান থেকে সুরকির পথ
জীবন টের পায়না আলোকের কম্পন 
আকাশ ভেঙে ঝরে পড়ে শব্দক্রোধ 
সবুজ আত্মসাৎ করা নরশিয়রে।
তুমিও কী চূড়ান্ত উদাসী নও!
তুলে নাওনি কি হাতে প্রগতির রাত্রিকাল?
ওগো মহাকাল, বেহুঁশ এই ভ্রমবিলাস,
প্রলোভনের চক্রব‍্যূহ, করে দাও পঞ্চকোষে বিলীন
একটি উদ্ভিদের জন্ম দাও মৃত নক্ষত্রের ছাই থেকে
বসে থাক ক্ষয়িঞ্চু সভ‍্যমন
তুচ্ছ টিলার উপর....

-কথারকুচি / বুবুসীমা চট্টোপাধ্যায়



কবি পরিচিতি-''সাদামাটা জীবনকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঠিক  মাটির কাছটিতেই  থাকতে ভালবাসার  মানুষ বুবুসীমা চট্টোপাধ্যায় । জন্মসূত্রে  রাণীগঞ্জের   গ্রামবাংলায়  সবুজের বুকে বড় হওয়া এবং   সাহিত্য - নাটক - আবৃত্তিচর্চা  চালিয়ে যাওয়া  শিক্ষা  গ্রহনকরা  বাংলার শিক্ষক  বাবার হাত ধরে।  । বিবাহসূত্রে  একদিন কলকাতায়  একটুকরো  ভালোবাসার শিকড় খুঁজে পেতেই নূতনকরে সবকিছু ফিরে পাওয়া আবার । হারিয়ে যাওয়া বলে কিছু হয়না সব গচ্ছিত থাকে কোথাও না কোথাও।  জীবন যখন যা দিয়েছে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা ছাড়া জীবন দেখা যায়না তা সে সুখ-বা দুঃখ , সময়- বা অসময় যায় আসুক না কেন আর ভালোবাসায় বিশ্বাসী বুবুসীমা ।   আঞ্চলিক কবিতা তাঁর জন্মলগ্ন থেকেই ঈশ্বরের আশীর্বাদ স্বরূপ পাওয়া তাই আঞ্চলিক  লেখাতে এবং আবৃত্তিতে  একটা ছোট্ট ভালোবাসার স্বীকৃতি পাওয়া   নিয়মিত  দূরদর্শনে এবং বেতারে । বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি ছাড়াও  বুবুসীমা চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ ''মর্জি ময়ূখ '' ভীষণ জনপ্রিয় ; তাছাড়াও '' ভোরের খামখেয়ালী '' নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন মনের তাগিদে ,   যেখানে নামী লেখক-লেখিকাদের সাথে নতুনদের লেখালেখি নিয়মিত ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে প্রকাশ করেন। রান্না- ঘরকন্না - সেবা সবকিছু সেরে প্রতিটি নারীর একটুকরো সময় একদম নিজের ভালোবাসার সময় যদি বের করতে পারে তবে সে জয় করবেই; বুবুসীমা চট্টোপাধ্যায় সেইটুকুই করে । তাঁর মূলমন্ত্র ---     [সব শুঁয়োপোকা প্রজাপতি হবে আমি থাকি সাই আশাতে ...]''
-------------------------------------------------------------------


তোমার গল্প অনেক বলেছি তাঁকে 
তাঁর গল্প তুমি কি শুনেছো কিছু ?
তোমার বাড়ির বকুল ঝরা গলি 
কুচিকুচি কথা সেখানে রেখেছি কিছু...।।

তুলে নিতে পারো ইচ্ছে হলেই তুমি  
না নিলেও কিছু আসে যায় না তো আমার,
কথারা যখন কবিতা হয়ে ফোটে 
নরম ঘাসে সব কবিতায় তোমার...।।

তোমার গানে ঘুম ভেঙে গেল  যেই- 
তাঁকেই আগে শোনাতে ইচ্ছে হল 
আমি তো আমিই কারোর মতই নই 
তবুও কেন কবিতা লিখতে বলো ?

ঠাণ্ডা পড়েছে জাঁকিয়ে এবার বুঝলে ! 
বেলা হলে আজ রেলকলোনিতে যাবো  
যে আসবে বলে রাখা ছিল দুটো কম্বল
আসলো না আজ সে ওখানেই দিয়ে দেবো।। 

আমার কবিতা বড্ড সেকেলে জানো ?
ওরা বলে সব- 'জাতে উঠবে না দেখো '   
জাত বা বেজাত বোঝে নাকি এই বুদ্ধু ?
ওদের জড়িয়ে একটু আদর খাবো ।।

তুমি কিন্তু গানে গানে এসো রোজ -
তোমার কথা বলেছি আমার তাঁকে, 
 
তোমার বাড়ির ডালিয়া ফুটছে যখন 
আমি আর সে দাঁড়িয়ে দেখবো ছাতে ।।

হঠাৎ পাওয়া / গৌতম সেন


আত্মকথনে, স্বীয় লেখনীর হাত ধরে নিজ পরিচিতিকরণ খুব একটা সহজ কাজ নয়। তবে অভিনব বটে কোনও সন্দেহ নেই। মনের ভিতর হাতড়াতে হাতড়াতে প্রথম যে সহজবোধ্য বিষয় মনে এল, তাকেই আঁকড়ে ধরে কটা কথা বলতে পারি মনে হয় – তা হ’ল আমি লিখি তবে কি লিখি, কখন লিখি, সে ব্যাপারে বললেই খানিকটা সহজ হবে এ কাজ। আমি সামান্য যা লেখালেখি করি – তা আমার মরজি হলে বা কারও আরজি এলে। মানে লেখার তাগিদ অনুভব করলে বা কারো কাছ থেকে লেখা পাঠানোর তাগাদা পেলে।
এভাবেই লিখে চলেছি এখনো – তবে আমার ভাতৃপ্রতিম তরুণ সম্পাদকেরা অনেকেই জানেন তাদের লিটল্‌ ম্যাগাজিন বা মিনি পত্রিকায় বহু লেখা দিয়েছি তাদের অনুরোধে, আবার এও জানেন লেখা চেয়ে পাঠানোর শেষ তারিখ পেরিয়ে গেলেও আমার লেখা পাঠানো হয়ে ওঠে না – এ ক্ষেত্রে অকপট স্বীকারোক্তির সুরে বলি – হয়ত তাগাদা এসেছে, কিন্তু তাগিদ অনুভবে্র অভাব বা কোনও বাহানা নয়, সত্যিকারের সময়াভাব হেতু কথা রাখতে পারি না।
তবু আশার কথা এই, এখনও লিখছি সে কবিতাই হোক বা গদ্য সাহিত্য। লিখে চলেছি...
          




টিভি বন্ধ, রান্নাঘরের ব্যস্ততার বাধ্যতামূলক ছুটি। রিনির আজ অগাধ অবসর। অরিন্দম অফিসের কাজে গেছে ব্যাঙ্গালোর দিন সাতেকের জন্য। ছেলে ঋতম সদ্য পাড়ি জমিয়েছে সুদূর আমেরিকার মিশৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও পড়বে বলে – গবেষণার কাজে। এই মুহূর্তে রিনি একেবারেই একা। কোনদিন এমন একটা পরিস্থিতি আসবে ওর ভাবনাতেও আসে নি। কিন্তু সাময়িক এই একাকিত্বের মাঝে নিজেকে পেয়ে, অবচেতন মনে একটা অজানা হালকা খুশির আমেজ অনুভব করে সে। খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সেখানে তখন মিষ্টি কুয়াশা ভেজা সোনালী রোদ। হাতে এককাপ চা। টবে সদ্য ফোটা তাজা লাল গোলাপ। বহুদিন পরে আজ সময় পেয়েছে সকালকে উপভোগ করার। রুটিনমাফিক সাজানো কাজের ভিড় থেকে এ যেন তার হঠাৎ পাওয়া ছুটি।
ফোনটা হাতে তুলে নিল। তৃণাকে একবার ডেকে নেবে ভাবলো, যদি সে আসে তো দিনটা বেশ পুরোনো সময়ের ফ্লাসব্যাকে ফিরে যাওয়া যাবে। তৃণা আর রিনি দুজনে কলেজ আর ইউনিভারসিটি এক সঙ্গে কাটিয়েছে বেশ কয়েকটা বছর। প্রাণের বন্ধুত্ব ছাড়াও এক অনাকাঙ্খিত দন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিল ওরা দুজনেই। অর্ণবের কথা ভেসে উঠল মনে। অর্ণব অকপটে স্বীকার করেছিল যে সে তাদের দুজনকেই ভালবাসে, রিনি সেটা বুঝতে পারত, ভালও লাগত, কিন্তু এও জানত এর কোন পরিণতি অসম্ভব। মিশত সে খুব স্বাভাবিকভাবেই, মনের ভালবাসা মনেই গোপন রেখে। অথচ তৃণা আপ্রাণ চেষ্টা করত অর্ণবকে একেবারে নিজের মত করে পেতে। নানারকম ভাবে ও অর্ণবকে ইম্প্রেস করার উপায় উদ্ভাবন করত। রিনির মাঝে মাঝে রাগ যে হত না তৃণার ওপর তা নয়। অর্ণব ছিল একেবারে অন্য ধাতুতে গড়া। বোহেমিয়ান স্বভাব। ও শুধু তাদের বলত, ‘কেন রে দুজনকে বুঝি ভালবাসা যায় না?’ তৃণা জোরগলায় বলত –‘না-ভালবাসায় কোন সতীনের জায়গা হয় না!’ আর রিনি এইসব কথার কোনও যুক্তি খুঁজে না পেলেও মুখে কিছুই বলত না।
রিনির ফোন পেয়ে তৃণা একবাক্যে রাজী হয়ে গেল। জানালো সে আসছে। রিনি তাকে এও বলে দিল নিপাট গপ্প-গুজব করে সময় কাটাবে তারা, খাওয়া দাওয়ার পাট বাইরে। রোজকার থেকে একটু অন্য রকম। মনের মত একটা দিন কেমন করে সাজাবে মনে মনে ভাবতে থাকে রিনি। তৃণার আসতে কিছুটা সময় আছে, এই ফাঁকে ঘরদোর গুছিয়ে নিতে শুরু করে।
হঠাৎ দরজায় বেল বেজে ওঠে। এত তাড়াতাড়ি তো তৃণার আসার কথা নয়, তবে কে এল – ভাবতে ভাবতে দরজা খোলে। চমকে ওঠে সে, একি অর্ণব দাঁড়িয়ে! অর্ণব ঝড়ের মত ঘরে ঢুকে পড়ল নিজেই। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ ও হতভম্ব রিনির মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এল –‘তুমি!’


Wednesday, January 24, 2018

"প্রতিশোধ" / রীনা রায়।


লেখক পরিচিতি - আমি রীনা রায়, বর্তমানে আসানসোলের বাসিন্দা।
লেখালেখির শুরু এই ফেসবুকেতেই।কয়েকজনের অনুপ্রেরণায় এই জগতে প্রবেশ।পড়ার আগ্রহ ছিল ছোট থেকেই, কিন্তু নিজে কোনদিন কলম ধরবো ভাবিনি।বেশ কিছু লেখা নানারকম পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে।
এখন লিখতে ভালো লাগে, তাই লিখি। অন্যেরা ভালো বললে প্রেরণা পাই। সমালোচনা হলে  ভুলগুলো শোধরানোর চেষ্টা করি।
সংসারের সব দায়িত্ব পালন করে যেটুকু সময় পাই, লেখালেখির মধ্যে ডুবে থাকি। আমার এই ভাললাগার জায়গাটায় পাই মুক্তির আনন্দ।


----------------------------------------------


মদির দুচোখে মোহময়ী হাসি ঝরিয়ে রঞ্জিতা বলে ওঠে, "নাইট ইজ টু ইয়ং ডার্লিং অ্যান্ড উই টু"
পলাশ দু হাতে রঞ্জিতাকে জড়িয়ে ধরে, 'ইয়েস, মাই সুইটহার্ট!'
রঞ্জিতা বোঝে, তার এতদিনের পরিশ্রম সাকসেসফুল ।
পলাশ তাকে চিনতে পারেনি। দিদির মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতেই হবে।

প্রত্যন্ত গ্রামের খুবই সাধারণ অবস্থার মধ্যেই বড় হচ্ছিল দুইবোন, সুজাতা আর রঞ্জিতা।বাবার আদরের সুজা ও রঞ্জা। সুজাতা ছিল খুব শান্ত ও ভীতু স্বভাবের। কারুর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু একবার চোখ তুলে তাকালে ওর টানাটানা গভীর চোখদুটো অনেক কথা বলে দিত। টুকটুকে ফর্সা, একঢাল কালো চুলের অধিকারিণী সুজাতাকে নিঃসন্দেহে পরমাসুন্দরী বলা যায়, অপরদিকে রঞ্জিতা ঠিক উলটো প্রকৃতির, কি চেহারায় বা চলনবলনে। অনেকদূরের কলেজে গিয়ে পড়াশোনা করে দুজনেই গ্রাজুয়েশনটা করেছিল। বাবার আর সাধ্যে কুলোয়নি যে হোস্টেলে রেখে পড়াবে।
সেখানেই দিদির সাথে পলাশদার পরিচয়, প্রেম এবং বিয়ে।
কিন্তু পলাশদার স্বরূপ দিদি জেনেছিল বিয়ের পর।
দিদির রূপকে কাজে লাগিয়ে নিজের ব্যবসার উন্নতি করতে চেয়েছিল।দিদিকে বাধ্য করতো ওর ক্লায়েন্টদের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে, এছাড়া নানারকম শারীরিক অত্যাচার, সহ্য করতে না পেরে দিদি সুইসাইড করেছিল, মারা যাওয়ার আগে রঞ্জাকে সব জানিয়েছিল, কিন্তু প্রমাণাভাবে পলাশদাকে শাস্তি দেওয়া যায়নি।

সেদিন ট্রেনে যেতে যেতে একটা ছোট্ট খবর পড়ে রঞ্জা মুচকি হাসলো।
''কলকাতার উপকণ্ঠে আজ সকালে একটি হোটেলে বিখ্যাত ব্যবসায়ী পলাশ মজুমদারকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। অনুমান করা হচ্ছে, পানীয়ের সাথে বিষপ্রয়োগই মৃত্যুর কারণ। সঙ্গের সঙ্গিনীর খোঁজ পাওয়া যায়নি", রঞ্জা মনে মনে বললো, আর খোঁজ পাওয়াও যাবেনা! 
এতদিনে আমার যাত্রা সম্পূর্ণ হল, আবার আমি আমার প্রিয় গ্রামে ফিরে যাচ্ছি! 
আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হল, আকাশের গায়ে যেন দিদির হাসিমুখ, দিদি যেন শান্তি পেলো এতদিনে! 


রিভুর ঘুড়ি / উৎসব দত্ত

লেখক পরিচিতি -বারুইপুরের বাসিন্দা পেশায় শিক্ষক উৎসব ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিন এবং ব্লগজিনের সাথে যুক্ত। শিক্ষকতা ও লেখালিখির পাশাপাশি সংগীত এবং বাড়ির পোষ্যদের সাথে সময় কাটাতে ভালবাসেন।






--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------




বিকেল হলেই লাটাই আর ঘুড়ি নিয়ে মাঠে ছুট। শরতের নীল আকাশ। লাটাইটা দুহাতের আঙ্গুলের ফাঁকে রাখা। আকাশের দিকে তাকালে সাদা তুলোর মতো মেঘের মাঝে হলুদ ঘুড়িটাকে ছোট থেকে আরও ছোট দেখাচ্ছে। অন্যদিনের মতো আজ একটুও গোঁত্তা খাচ্ছেনা। ঠিক যেন মনে হচ্ছে ওই নীল আকাশের দিকে জোরে আরও জোরে ছুটে চলেছে ঘুড়িটা। সন্ধে হতে যায়। এবার বাড়ি ফেরার পালা। ঘুড়ি গোটাতে হবে। ছোট্ট রিভু ঘুড়ির সুতোটা কেটে দিয়ে বলল ‘যা আমার মায়ের কাছে যা। মা ক্যামন আছে জেনে আয়’






দোলনচাঁপার রাত / অরুণ চট্টোপাধ্যায়



একটা ঘর। মাত্র সাত ফুট বাই আট ফুট। এ ঘরের একটা জানলা। সেটা বাইরে বাগানের দিকে। সেখানে বেশ কিছু বড় ছোট গাছ। দিনের বেলা রোদ পুরো ঢুকতে পারে না। পাতা আর অজস্র ডালপালার ফাঁক দিয়ে অনবরত লড়াই করতে করতে তার অস্তিত্বটুকু শুধু টিকিয়ে রাখে। সন্ধ্যের পর থেকে কেমন একটা গা ছমছমে ভাব সেদিকে তাকালেই।
এই ঘরটা হল দোলনচাঁপার। প্রতিদিন রাত্রে থাকার ঘর। আর দিনের বেলা পড়াশোনা থেকে শুরু করে সব কিছু করার ঘর। তার জীবনের সঙ্গী। সর্বক্ষনের দোসর। ঠিক কবে থেকে এ ঘরে সে আছে ভাল করে মনে নেই দোলনচাঁপার। শুধু জানে, জ্ঞান হবার পর থেকেই এই ঘর তার স্থায়ী ঠিকানা।
আজ ঊনিশ বছর সাত মাস হল বয়েসটা। আজ যেন একটু সময় পেয়ে বয়েসের হিসেবটা করতে বসেছে দোলনচাঁপা। আজ যেন অনেক কিছু হিসেবের কথা মনে আসছে তার। মনে পড়ছে অনেক অনেক দিনগুলোর কথা। অনেক বিনিদ্র রাতের কথা। অনেক গা ছমছমে মুহূর্তের কথা।
মনে পড়ে একটা দিনের কথা। মানে একটা রাতের কথা। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল তার। দেখেছিল মা নেই বিছানায়। ঘর ছিল অন্ধকার। নাইট ল্যাম্প জ্বালাবার রেওয়াজ নেই এ বাড়িতে। তাই চোখে কিছুই দেখে নি সে। কিন্তু বুঝেছিল অনুভূতিতে। স্পর্শ পায় নি মায়ের। পরিচিত গন্ধও ছিল না মায়ের গায়ের।
হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে বাবাকেও খুঁজেছিল বিছানায়। কিন্তু তাকেও দেখে নি। খানিক পরে অবশ্য বাবা ফিরে আসত। কিন্তু মা আসত অনেক পরে। নিঃসাড়ে নিঃশব্দে পা টিপে টিপে। যেমনভাবে পা টিপে টিপে চলে যেত ঠিক তেমনি ভাবে। অনুভূতিতে টের পেত বাবা এখনও জেগে। কিন্তু সে কোনও কথা বলত না। বাবাও কোনও কথা বলছে না দেখে দোলনের বড় ভয় হত। তার সেই শিশু মনটা একটা ভয়কে ছাড়া আঁকড়ে ধরার আর কাউকে পেত না। না বাবাকে, না মাকে।
দিনের বেলায় বাবাকে অনেক গালমন্দ করত মা। করত অনেক হ্যানস্থা। কিন্তু বাবা চুপ করে থাকত। একটা শিশু হলেও দোলনের তখন মনে হত যেন বাবার মুখটা প্রচন্ড কষ্টে একেবারে বেঁকে চুরে যাচ্ছে। কিন্তু কেন এই ঝগড়া তা কিছুতেই বুঝতে পারত না সে। তার মনে হয়ত বাবাটাই খুব খারাপ আর মা তাই তাকে বকে। বাবা দোষী আর তাই মুখ বুজে সে সব সহ্য করে।
কিন্তু মা কেন বাইরে চলে যেত গভীর রাতে আর কোথায় চলে যেত তা সে জানত না। বাবা কোনদিন এক মুহূর্তের জন্যে মাকে জিজ্ঞেস করে নি। বাবার মুখ দেখে মনে হয়ত সে যেন মাকে খুব ভয় করে। নিশ্চয় বাবা খুব দোষ করত আর তাই খুব ভয়ে ভয়ে থাকত। দোলন নিজেও খুব ভয়ে ভয়ে থাকত। কে জানে সেও যদি কোনও দোষ করে থাকে। সে ছেলেমানুষ দোষগুণের তো অত বোঝে না।
মা একবার খুব অসুস্থ হল। সে সময় নিজে ইচ্ছে করেই মা পাশের ফাঁকা ঘরটায় থাকত। মা তাকে সহ্য করতে পারত না একেবারে। তাই মায়ের অসুস্থতার সময় সে ঘরে যেতে পারত না দোলন।  
মা বাবাকেও ঢুকতে দিত না সে ঘরে। কিন্তু সে ঘরে কেউ আসত। দিনের বেলা তো বটেই মাঝ রাতে কার যেন গলা পাওয়া যেত সে ঘর থেকে। একটা প্রশ্নচিহ্ন চোখে নিয়ে দোলন তাকাত বাবার দিকে। দেখত বাবার মুখ শুকনো আর চোখ যেন ছলছল করছে।
তাদের বাড়িতে বেশি কেউ আসত না। এমন কি কাজের লোকও না। একটু বড় হয়ে শুনেছে কেউ নাকি কাজ করতে চাইত না এখানে। কেউ কেউ বলত কাক চিল বসতে নাকি পারত না এ বাড়ির ত্রিসীমানায়। বাবা কোথায় যেন একটা ছোটমোট কাজ করত। আর করত সংসারের সব বড় বড় কাজ। এমন কি বেশির ভাগ সময়ে রান্নাবান্না পর্যন্ত।

যখন থেকে জ্ঞান হয়েছিল তখন থেকেই প্রতি রাতে মায়ের অনুপস্থিতি কেমনভাবে টের পেয়ে যেত। বাইরে জানলার দিকে তাকাত। পাতা আর ডালের গোলোক ধাঁধা ভেদ করে একটু খানি চাঁদের আলো ভয়ে ভয়ে যেন ঢুকে পড়েছে বাগানে। মৃদু বাতাসে গাছের পাতাগুলো দুলছে যখন, তখন তার মনে হচ্ছে যেন একরাশ ছায়ামূর্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে গাছের নীচের জমাট অন্ধকারে।  
ভয়ে কাঁটা হয়ে একবার চিৎকার করে উঠেছিল। মা কিন্তু ছুটে আসে নি। বেশ কিছুক্ষন পরে ছুটে এসেছিল তার বাবা। আলোটা জ্বেলে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, কি হয়েছে মা?
--বাবা খুব ভয় করছে। একা থাকতে পারব না। দোলন বলেছিল, বাবা, মা কোথায় গেল?
বাবা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে খুব অস্থির। ছটফট করছে। তারপর দৌড়ে চলে গেল ওঘরে। যাবার সময় শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে গেল একটু।
আবার একা সে। ঘরের ভেতরে একটা নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। আর একটা জমাট বাঁধা ভয়। মা কিন্তু রাতে আর আসে নি। এ ঘটনা সে লক্ষ করেছে বেশ কিছুদিন ধরেই। ও ঘরে এখন শোয় শুধু মা আর বাবা। কিন্তু তার মায়ের মাঝে মাঝেই নাকি অসুখ করত। আর অসুখ করলে বাবার ওঘরে থাকা মানা ছিল। বাবা তখন তার সঙ্গে এ ঘরে থাকত। আর মাঝে মাঝে কার যেন ফিসফাস আওয়াজে কান খাড়া করত। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া দোলন চুপ করে থাকত।
এমনিতে কিন্তু বাবা কখনই আসে না রাত্রে। প্রথমে ভাবত বাবা কি তাকে একদমই ভালবাসে না? কিছুদিন পরে এ ভুল তার ভেঙ্গেছিল। একদিন যখন বাবা এসে ছিল সেই মাঝরাতে। যখন সে খুব ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠেছিল। কারণ সে সময় জ্যোৎস্না একটু একটু করে ঢোকার চেষ্টা করেছিল তার সেই ছোট্ট ঘরটায়। জমাট বাঁধা অন্ধকারের সঙ্গে জ্যোৎস্নার সেই লড়াই ঘরের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল একটা অদ্ভুত ভয়ের পরিবেশ। সামান্য বাতাসে গাছের পাতাগুলো নড়ছিল। দোলন তখন ছিল মাত্র সাত বছরের।
বাবা এসেছিল। কিন্তু বেশিক্ষন থাকতে পারে নি। যাবার সময় দোলনচাঁপার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, আমি আবার আসব। এখন ঘুমিয়ে পড় মা।
কিন্তু আসে নি বাবা। কথা রাখে নি। কিংবা কথা রাখতে পারে নি। তবে এটা ঠিক যে বাবা আসে নি। মর্গ থেকে এসেছিল বাবার লাশ। একটা সাদা চাদরে মুড়ে। ক’দিন পরে সন্ধ্যায় খাকি পোশাকের পুলিশরা একটা গাড়ি করে দিয়ে গেল।  

এতসব তো তখন তার বোঝার কথা নয়। যখন সে মাত্র ছ সাত বছরের ছিল। বাবার খুন হয়ে যাবার ঠিক পরের দিন খবর পেয়ে দৌড়ে দৌড়ে এসেছিল তার বিধবা দিদা। মায়ের কোনও খোঁজ ছিল না। একটা মাত্র সাত আট বছরের শিশুকে দেখতে তো হবে।
দিদার সামান্য যা কিছু জমান ছিল তাই থেকে সে দুটো মানুষের খাবার জোটাত। অতিকষ্টে দোলনের পড়াশোনা করাত। রাত এগারটা পর্যন্ত গল্প বলত দিদা। বলত, আয় শোন রূপকথার গল্প বলি। কি মজার গল্প বলি। মন ভাল হয়ে যাবে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখবি বিরাট দেশের এক রাজপুত্র তোকে পক্ষীরাজের পিঠে চাপিয়ে তোকে নিয়ে যাচ্ছে তার নিজের রাজ্যে-
বাধা দিয়েছিল দোলন, উঁহু, ওসব গল্প নয়। আমাকে বল আমার বাবা মায়ের গল্প।
বাচ্চা বয়েসটা কোনরকমে বাবা মায়ের গল্প ভুজুং ভাজুং দিয়ে চালাচ্ছিল বুড়ি। কিন্তু এখন অনেক বড় হয়ে গেছে দোলন। এখন আর সত্যি কথা না বললে হয় না।
তার যখন সেই নয় দশ বছর থেকেই তাই শুরু হয়েছিল দিদার মুখে বাবা মায়ের আসল গল্প। রোমহর্ষক এক উপাখ্যান যেন। এও ছিল এক রূপকথা। একটা কু-রূপকথা যেন। বাবাকে ভালবেসেই বিয়ে করেছিল তার মা। কিন্তু বিয়ের পর তাকে বিশেষ শারীরিক সুখ দিতে পারে নি তার বাবা। তাই নিত্য সুখের সন্ধানে অভিসারে বেরোত সে গভীর রাতে। মেনে নিতে পারত না তার বাবা। কিন্তু শুধু শরীরেই নয় মনের দিক থেকেও সে ছিল দুর্বল। তাই প্রতিবাদ করতে পারে নি।
শুধু নীরবে অনুসরণ করত। দেখে আসত তার মা গভীর রাতে কোথায় যায়। তার মা যেত একজন স্থানীয় ব্যবসায়ীর কাছে। টাকা আর যৌন ক্ষমতা দুই ছিল তার প্রবল। বাবা যে জানতে পেরেছে সেটা জানতে পেরেছিল তার মাও। চিরদিনের জন্যে বাবাকে ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিল সেই ব্যবসায়ীর সঙ্গে।
সেই গভীর রাতে মাঝে মাঝে বাবা আর মায়ের মধ্যে কিছু কথাবার্তা কানে আসত দোলনের। নিচু স্বর হলেও তাতে উত্তেজনা মেশানো থাকত বেশ অনেকটাই। মাঝে মাঝে সেই উত্তেজনার আঁচ চলে আসত দোলনের বন্ধ দরজার ভেতরে পর্যন্ত।
সবটা তো সে বুঝতে পারত না। তবে মনে হত কোনও বিষয়ে খুব ঝগড়া হচ্ছে দুজনের। মা একটু গলার স্বরটা বাড়িয়ে বলেছিল, আমাকে তো কিছুই দিতে পারলে না। অকর্মার ঢেঁকি একটা। আর এত হিংসে তোমার যে অন্য কেউ কিছু দিক তাও সহ্য করতে পার না।
বাবা বলত, কি বলছ তুমি? তোমায় কত ভালবাসি তুমি জান?
-ভালবাসা ধুয়ে ধুয়ে খাব নাকি আমি? মায়ের গলায় ফুটে উঠেছিল তীব্র ব্যঙ্গ। এ ঘর থেকে বেশ বুঝতে পারছিল দোলন। একটু পরেই ও ঘরের দরজা খোলার হাল্কা শব্দ।
-সত্যি সত্যি তুমি যাবে তাহলে? বাবা বলেছিল। সেই গলাটা কেমন যেন কান্নামাখা ছিল বলে সেই বয়েসেই দোলন বুঝতে পারত।


-কিন্তু তোর বাবা তোর মাকে এত ভালবাসত যে সেই বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারে নি। কিন্তু প্রতিবাদ করতেও পারে নি। শুধু অনুনয় করে বলেছিল সে যেন তাকে ত্যাগ না করে।
কিন্তু দু নৌকোয় পা দিয়ে চলতে একেবারেই মন চায় নি দোলনের মায়ের। সে নাকি ছেলেমেয়ে একেবারেই চাইত না। বিয়ের পর বাবাকে বলেছিলও সেকথা। কিন্তু শত সাবধানে থেকেও দোলন এসে গিয়েছিল এই পৃথিবীতে। আর তার পর থেকেই বিষ নজরে দেখত মা বাবাকে। রাতদিন ঝগড়ার সেই ছিল সূত্রপাত।
দিদার কাছ থেকে গল্প শোনার পরেও ঘুম আসে না দোলনচাঁপার। সত্তর বছরের বুড়িটা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ক্লান্ত হয় না দোলনের দু’চোখের পাতা। জেগে জেগে দুঃস্বপ্ন দেখে সে। দেখে পক্ষীরাজে চেপে নয়, পুলিশের গাড়িতে সাদা চাদরে ঢেকে স্ট্রেচারে চেপে শুয়ে আসছে তার বাবা। যে তাকে আশ্বাস দিয়েছিল, ঘুমিয়ে পড় মা। আমি আবার আসব।
বাবাকে খুন করিয়ে ছিল তার মা। সেই দিন রাতে যেদিন মেয়েকে অমন মিষ্টি আশ্বাস দিয়েছিল তার বাবা।
রোজ রাতের ঐ দুঃস্বপ্ন তাকে গ্রাস করছে। দেহে সে সুন্দরী কিন্তু মন হয়ে গেছে বিষণ্ণ। অনেকে পরামর্শ দিল মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে। কিছুদিন চিকিৎসা করার পর তিনি বললেন, এবার একটা ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিন। আশা করি ভাল হয়ে যাবে।
বিয়েতে ঘোর অমত দোলনের। মায়ের মেয়ে নাকি মায়ের মত হয়। তার বড় ভয় যাকে সে বিয়ে করবে সে যদি বাবার মত ভালবাসার পাগল হয়? তারপর সে মায়ের মত তার নিজের জিঘাংসার ধারালো ছুরিতে – আর সে ভাবতে পারছে না।
তা যদি নাও করে তবে স্বামীর সঙ্গে প্রতি রাত যদি সেই বীভৎস রাতের মত তাড়া করে বেড়ায়? যে রাতকে সে এই ঊনিশ বছর বয়েসেও ভুলতে পারছে না তাকে ভুলিয়ে দেবে এমন কোনও ভালবাসা আছে কি জগতে? হয়ত নেই অথবা নেই তার ধারণা। একটা নিরীহ ছেলের জীবন কেন সে নষ্ট করে দেবে? তার মায়ের পাপের সাজা দেবে বাবার মত আর এক ভালবাসার পাগলকে?
তার চেয়ে পাগলা গারদই হয়ত তার উপযুক্ত স্থান। অথবা এই ঘরটা। সাত ফুট বাই আট ফুট এই ঘরটা। যার একটা মাত্র জানলা দিয়ে বাইরে বাগানের গাছের ফাঁক দিয়ে গলে আসতে জ্যোৎস্না বড় ব্যথা পায়। ঐ এক টুকরো জ্যোৎস্নাই থাক দোলনচাঁপার জীবনে।
তাই এই ঘরটুকুকে আজও সে ছাড়তে পারে নি।





ফিরতে চাওয়া লোকটি / সোমা দে



ফিরতে চায় লোকটি।
চার চাকায়, ধোপদুরস্ত পোশাকে অমলিন,
ঠোঁটে চারমিনার, 
অনেক পথ পরিক্রম করেছে সে।
নিরলস  বাতাস ছুঁয়ে গেছে কেশ, 
সকলকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছিল লোকটি।
এখন ফিরতে চায় সে।
মাটির উঠোন থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল তার।
তারপর আস্তে আস্তে ইঁটের গাঁথনি, পাকা রাস্তার সঙ্গে সেও পা রাখতে শুরু করে রঙ্গীন সিঁড়িতে।
হ্যাঁ, একেবারে পারছিল না সে,
কিন্তু ধীরে ধীরে গরম আগুনের মধ্য দিয়ে যেতে পেরেছে সে।
বদলে এসেছে সাফল্যের শিখর।
লেলিহান আগুনের মতো সভ্যতার বিস্ময় জড়িয়ে  ধরেছে তাকে।লোকটিও মাঝে মাঝে ভাবত সে কি এই পৃথিবীর রাজা?
আজ সময়ের কাছে ন্যুব্জ লোকটি। সব পাওয়া হয়ে গেছে তার-বিলাসবহুল ঝাঁ চকচকে জীবন, স্বপ্নের উড়ান, নরম লোভনীয় রমণীদেহ সব সব পেয়েছে সে। কিন্তু ভালোবাসা?  না,শুধু এই জিনিসটাকেই জয় করতে পারল না সে। কেউ তাকে ভালোবাসেনি। লোকটি জানে সে ব্যবহৃত হয়েছে। তার প্রাচুর্যতায় প্রজাপতিরা কাছে এসেছে, কিন্তু তাকে আদর করে ভালোবেসে ছোঁয়নি কেউ!

আজ সে ক্লান্ত। সব ফিরিয়ে দিতে চায় লোকটি।মায়ের মুখ বড়ো মনে পড়ে তার। এইসময় ভীষণ শারীরখারাপ করে লোকটির। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে।

তার একলা আকাশ কানে কানে বলে-
"চল, যাবি আমার সাথে?"
দিক হারানো নদী বলে-
 "আর একটিবার আয় না আমার পাড়ে!"
সবুজ বাতাস তাকে ছুঁয়ে বলে-
"কিরে হাঁটবি না আর মেঠো পথে?"
সে দেখে, দু'হাত বাড়িয়ে মা ডাকছেন-
"আর একবার আসবি বাবা?"

দু'হাতে মাথা চেপে বসে থাকা লোকটি উঠেদাঁড়ায় এবার। প্রাণপণ শক্তিতে ছুটতে থাকে সে।
 না, ফিরতে হবে তাকে এবার।
ফিরতেই হবে।


LOVE AND DEATH / Durba Mitra



Romyani was just trying to hold her head scarf against the high-speed wind. A storm was brewing somewhere. The sky was dark, heavy and threatening. All the people on the street were running helter-skelter to find some shelter.
For Romyani – holding on to her scarf seemed to be on top priority !
Brishoketu was just starting his sedan car – when this girl stumbled on his bonnet. He got out and steadied the girl – “ Are you ok ?”
The girl – holding on to her scarf – just nodded.
Brishoketu asked her again – “Can I drop you somewhere?”
She nodded again.
He put her inside and locked the passenger door.
The storm was in full swing.
The girl was just indicating the ways by hand gestures. After a while she signalled him to stop. Getting out – she just folded her hands in gratitude and waved.
Putting the car in reverse gear, Brishoketu noted down the address of the house in his mind.
Next day he had to leave the town on an official tour – returned after 3 weeks. Thinking for quite some times – he had gone to that house and rang the bell.
The door opened slowly – showing a lady’s sad and long face.
Brishoketu tried to explain that he wants to meet that girl once again. The lady broke down in tears, asking him to come inside.
Brishoketu started to squirm on the sofa – unsure of his next step.
Eventually , she had calmed down and said that the girl – her only child – was admitted in the Cancer Hospital – in an advanced state of throat cancer. That day – she had adamantly gone out in the storm – to say adieu to her Mother Superior of the Convent School – where she had studied and had been teaching in the primary section. She could not speak for the last 7 weeks – only could use hand gestures.
Her name was Romyani – she had told her parents by writing about the gentleman dropping her home. She had requested her dad to thank him somehow. They could not imagine how to get in touch with the gentleman.
Brishoketu sat down with his head buried in his palms. Meanwhile her dad had returned from the hospital. Her mom tried to explain the scenario. He had some tears which did not roll down his cheeks.
Brishoketu knelt down before the couple – asking for their permission to marry their daughter.
They were visibly stunned – how it can be viable at all ?
Brishoketu just wrote down all her hospital details.
Taking a week’s leave from his office, Brishoketu arranged for everything as fast  as possible.
One fine morning, he took a bunch of yellow roses and visited the hospital cabin of Romyani.
She had been put into ventilator – all sorts of pipes and tubes and machineries around her face and arms, eyes are closed.
Oh God – she is so beautiful ! Just like an angel !!
Brishoketu just pulled the bedsheet a bit – forbidden to touch her body for fear of infection.
She opened her eyes – superb – enlarged them on seeing Brishoketu’s face above her !
-“Will you marry me, please?” – Brishoketu  asked, choking on tears.
Her eyes looked shocked – and then they smiled. Her left hand fingers moved – all body parts were saying  - yes-yes-yes !
Brishoketu went out to bring in the whole bunch of people – including the Director of the hospital.
Within a few minutes, everything had been set up – everybody had taken their place for the wedding to commence.
Her father, Brishoketu’s mom and the Director had signed as the witnesses. Her left thumb impression had been put on the paper. The Registrar of the Marriage had announced them to be legally wed couple.
Everybody had vacated the chamber – leaving Brishoketu alone with his bride. Both of them are simply glowing with happiness and pride.
Next day at 4.35 a.m., Romyani had left for her heavenly abode – her fingers holding tightly onto her husband’s.    






সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া