একটা ঘর। মাত্র সাত ফুট
বাই আট ফুট। এ ঘরের একটা জানলা। সেটা বাইরে বাগানের দিকে। সেখানে বেশ কিছু বড় ছোট
গাছ। দিনের বেলা রোদ পুরো ঢুকতে পারে না। পাতা আর অজস্র ডালপালার ফাঁক দিয়ে অনবরত
লড়াই করতে করতে তার অস্তিত্বটুকু শুধু টিকিয়ে রাখে। সন্ধ্যের পর থেকে কেমন একটা গা
ছমছমে ভাব সেদিকে তাকালেই।
এই ঘরটা হল দোলনচাঁপার।
প্রতিদিন রাত্রে থাকার ঘর। আর দিনের বেলা পড়াশোনা থেকে শুরু করে সব কিছু করার ঘর।
তার জীবনের সঙ্গী। সর্বক্ষনের দোসর। ঠিক কবে থেকে এ ঘরে সে আছে ভাল করে মনে নেই
দোলনচাঁপার। শুধু জানে, জ্ঞান হবার পর থেকেই এই ঘর তার স্থায়ী ঠিকানা।
আজ ঊনিশ বছর সাত মাস হল
বয়েসটা। আজ যেন একটু সময় পেয়ে বয়েসের হিসেবটা করতে বসেছে দোলনচাঁপা। আজ যেন অনেক
কিছু হিসেবের কথা মনে আসছে তার। মনে পড়ছে অনেক অনেক দিনগুলোর কথা। অনেক বিনিদ্র
রাতের কথা। অনেক গা ছমছমে মুহূর্তের কথা।
মনে পড়ে একটা দিনের কথা।
মানে একটা রাতের কথা। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল তার। দেখেছিল মা নেই বিছানায়। ঘর
ছিল অন্ধকার। নাইট ল্যাম্প জ্বালাবার রেওয়াজ নেই এ বাড়িতে। তাই চোখে কিছুই দেখে নি
সে। কিন্তু বুঝেছিল অনুভূতিতে। স্পর্শ পায় নি মায়ের। পরিচিত গন্ধও ছিল না মায়ের
গায়ের।
হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে
বাবাকেও খুঁজেছিল বিছানায়। কিন্তু তাকেও দেখে নি। খানিক পরে অবশ্য বাবা ফিরে আসত।
কিন্তু মা আসত অনেক পরে। নিঃসাড়ে নিঃশব্দে পা টিপে টিপে। যেমনভাবে পা টিপে টিপে
চলে যেত ঠিক তেমনি ভাবে। অনুভূতিতে টের পেত বাবা এখনও জেগে। কিন্তু সে কোনও কথা
বলত না। বাবাও কোনও কথা বলছে না দেখে দোলনের বড় ভয় হত। তার সেই শিশু মনটা একটা
ভয়কে ছাড়া আঁকড়ে ধরার আর কাউকে পেত না। না বাবাকে, না মাকে।
দিনের বেলায় বাবাকে অনেক
গালমন্দ করত মা। করত অনেক হ্যানস্থা। কিন্তু বাবা চুপ করে থাকত। একটা শিশু হলেও
দোলনের তখন মনে হত যেন বাবার মুখটা প্রচন্ড কষ্টে একেবারে বেঁকে চুরে যাচ্ছে।
কিন্তু কেন এই ঝগড়া তা কিছুতেই বুঝতে পারত না সে। তার মনে হয়ত বাবাটাই খুব খারাপ
আর মা তাই তাকে বকে। বাবা দোষী আর তাই মুখ বুজে সে সব সহ্য করে।
কিন্তু মা কেন বাইরে চলে
যেত গভীর রাতে আর কোথায় চলে যেত তা সে জানত না। বাবা কোনদিন এক মুহূর্তের জন্যে
মাকে জিজ্ঞেস করে নি। বাবার মুখ দেখে মনে হয়ত সে যেন মাকে খুব ভয় করে। নিশ্চয় বাবা
খুব দোষ করত আর তাই খুব ভয়ে ভয়ে থাকত। দোলন নিজেও খুব ভয়ে ভয়ে থাকত। কে জানে সেও
যদি কোনও দোষ করে থাকে। সে ছেলেমানুষ দোষগুণের তো অত বোঝে না।
মা একবার খুব অসুস্থ হল।
সে সময় নিজে ইচ্ছে করেই মা পাশের ফাঁকা ঘরটায় থাকত। মা তাকে সহ্য করতে পারত না
একেবারে। তাই মায়ের অসুস্থতার সময় সে ঘরে যেতে পারত না দোলন।
মা বাবাকেও ঢুকতে দিত না
সে ঘরে। কিন্তু সে ঘরে কেউ আসত। দিনের বেলা তো বটেই মাঝ রাতে কার যেন গলা পাওয়া
যেত সে ঘর থেকে। একটা প্রশ্নচিহ্ন চোখে নিয়ে দোলন তাকাত বাবার দিকে। দেখত বাবার
মুখ শুকনো আর চোখ যেন ছলছল করছে।
তাদের বাড়িতে বেশি কেউ
আসত না। এমন কি কাজের লোকও না। একটু বড় হয়ে শুনেছে কেউ নাকি কাজ করতে চাইত না
এখানে। কেউ কেউ বলত কাক চিল বসতে নাকি পারত না এ বাড়ির ত্রিসীমানায়। বাবা কোথায়
যেন একটা ছোটমোট কাজ করত। আর করত সংসারের সব বড় বড় কাজ। এমন কি বেশির ভাগ সময়ে
রান্নাবান্না পর্যন্ত।
যখন থেকে জ্ঞান হয়েছিল
তখন থেকেই প্রতি রাতে মায়ের অনুপস্থিতি কেমনভাবে টের পেয়ে যেত। বাইরে জানলার দিকে
তাকাত। পাতা আর ডালের গোলোক ধাঁধা ভেদ করে একটু খানি চাঁদের আলো ভয়ে ভয়ে যেন ঢুকে
পড়েছে বাগানে। মৃদু বাতাসে গাছের পাতাগুলো দুলছে যখন, তখন তার মনে হচ্ছে যেন একরাশ
ছায়ামূর্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে গাছের নীচের জমাট অন্ধকারে।
ভয়ে কাঁটা হয়ে একবার
চিৎকার করে উঠেছিল। মা কিন্তু ছুটে আসে নি। বেশ কিছুক্ষন পরে ছুটে এসেছিল তার
বাবা। আলোটা জ্বেলে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, কি হয়েছে মা?
--বাবা খুব ভয় করছে। একা
থাকতে পারব না। দোলন বলেছিল, বাবা, মা কোথায় গেল?
বাবা কিছু বলতে যাচ্ছিল।
কিন্তু দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে খুব অস্থির। ছটফট করছে। তারপর দৌড়ে চলে গেল ওঘরে।
যাবার সময় শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে গেল একটু।
আবার একা সে। ঘরের ভেতরে
একটা নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। আর একটা জমাট বাঁধা ভয়। মা কিন্তু রাতে আর আসে নি। এ ঘটনা
সে লক্ষ করেছে বেশ কিছুদিন ধরেই। ও ঘরে এখন শোয় শুধু মা আর বাবা। কিন্তু তার মায়ের
মাঝে মাঝেই নাকি অসুখ করত। আর অসুখ করলে বাবার ওঘরে থাকা মানা ছিল। বাবা তখন তার
সঙ্গে এ ঘরে থাকত। আর মাঝে মাঝে কার যেন ফিসফাস আওয়াজে কান খাড়া করত। মাঝ রাতে ঘুম
ভেঙ্গে যাওয়া দোলন চুপ করে থাকত।
এমনিতে কিন্তু বাবা কখনই
আসে না রাত্রে। প্রথমে ভাবত বাবা কি তাকে একদমই ভালবাসে না? কিছুদিন পরে এ ভুল তার
ভেঙ্গেছিল। একদিন যখন বাবা এসে ছিল সেই মাঝরাতে। যখন সে খুব ভয় পেয়ে চিৎকার করে
উঠেছিল। কারণ সে সময় জ্যোৎস্না একটু একটু করে ঢোকার চেষ্টা করেছিল তার সেই ছোট্ট
ঘরটায়। জমাট বাঁধা অন্ধকারের সঙ্গে জ্যোৎস্নার সেই লড়াই ঘরের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল
একটা অদ্ভুত ভয়ের পরিবেশ। সামান্য বাতাসে গাছের পাতাগুলো নড়ছিল। দোলন তখন ছিল
মাত্র সাত বছরের।
বাবা এসেছিল। কিন্তু
বেশিক্ষন থাকতে পারে নি। যাবার সময় দোলনচাঁপার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, আমি আবার
আসব। এখন ঘুমিয়ে পড় মা।
কিন্তু আসে নি বাবা। কথা
রাখে নি। কিংবা কথা রাখতে পারে নি। তবে এটা ঠিক যে বাবা আসে নি। মর্গ থেকে এসেছিল
বাবার লাশ। একটা সাদা চাদরে মুড়ে। ক’দিন পরে সন্ধ্যায় খাকি পোশাকের পুলিশরা একটা
গাড়ি করে দিয়ে গেল।
এতসব তো তখন তার বোঝার
কথা নয়। যখন সে মাত্র ছ সাত বছরের ছিল। বাবার খুন হয়ে যাবার ঠিক পরের দিন খবর পেয়ে
দৌড়ে দৌড়ে এসেছিল তার বিধবা দিদা। মায়ের কোনও খোঁজ ছিল না। একটা মাত্র সাত আট
বছরের শিশুকে দেখতে তো হবে।
দিদার সামান্য যা কিছু
জমান ছিল তাই থেকে সে দুটো মানুষের খাবার জোটাত। অতিকষ্টে দোলনের পড়াশোনা করাত।
রাত এগারটা পর্যন্ত গল্প বলত দিদা। বলত, আয় শোন রূপকথার গল্প বলি। কি মজার গল্প
বলি। মন ভাল হয়ে যাবে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখবি বিরাট দেশের এক রাজপুত্র তোকে
পক্ষীরাজের পিঠে চাপিয়ে তোকে নিয়ে যাচ্ছে তার নিজের রাজ্যে-
বাধা দিয়েছিল দোলন, উঁহু,
ওসব গল্প নয়। আমাকে বল আমার বাবা মায়ের গল্প।
বাচ্চা বয়েসটা কোনরকমে
বাবা মায়ের গল্প ভুজুং ভাজুং দিয়ে চালাচ্ছিল বুড়ি। কিন্তু এখন অনেক বড় হয়ে গেছে
দোলন। এখন আর সত্যি কথা না বললে হয় না।
তার যখন সেই নয় দশ বছর
থেকেই তাই শুরু হয়েছিল দিদার মুখে বাবা মায়ের আসল গল্প। রোমহর্ষক এক উপাখ্যান যেন।
এও ছিল এক রূপকথা। একটা কু-রূপকথা যেন। বাবাকে ভালবেসেই বিয়ে করেছিল তার মা।
কিন্তু বিয়ের পর তাকে বিশেষ শারীরিক সুখ দিতে পারে নি তার বাবা। তাই নিত্য সুখের
সন্ধানে অভিসারে বেরোত সে গভীর রাতে। মেনে নিতে পারত না তার বাবা। কিন্তু শুধু
শরীরেই নয় মনের দিক থেকেও সে ছিল দুর্বল। তাই প্রতিবাদ করতে পারে নি।
শুধু নীরবে অনুসরণ করত।
দেখে আসত তার মা গভীর রাতে কোথায় যায়। তার মা যেত একজন স্থানীয় ব্যবসায়ীর কাছে।
টাকা আর যৌন ক্ষমতা দুই ছিল তার প্রবল। বাবা যে জানতে পেরেছে সেটা জানতে পেরেছিল
তার মাও। চিরদিনের জন্যে বাবাকে ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিল সেই ব্যবসায়ীর সঙ্গে।
সেই গভীর রাতে মাঝে মাঝে
বাবা আর মায়ের মধ্যে কিছু কথাবার্তা কানে আসত দোলনের। নিচু স্বর হলেও তাতে
উত্তেজনা মেশানো থাকত বেশ অনেকটাই। মাঝে মাঝে সেই উত্তেজনার আঁচ চলে আসত দোলনের
বন্ধ দরজার ভেতরে পর্যন্ত।
সবটা তো সে বুঝতে পারত
না। তবে মনে হত কোনও বিষয়ে খুব ঝগড়া হচ্ছে দুজনের। মা একটু গলার স্বরটা বাড়িয়ে
বলেছিল, আমাকে তো কিছুই দিতে পারলে না। অকর্মার ঢেঁকি একটা। আর এত হিংসে তোমার যে
অন্য কেউ কিছু দিক তাও সহ্য করতে পার না।
বাবা বলত, কি বলছ তুমি?
তোমায় কত ভালবাসি তুমি জান?
-ভালবাসা ধুয়ে ধুয়ে খাব
নাকি আমি? মায়ের গলায় ফুটে উঠেছিল তীব্র ব্যঙ্গ। এ ঘর থেকে বেশ বুঝতে পারছিল দোলন।
একটু পরেই ও ঘরের দরজা খোলার হাল্কা শব্দ।
-সত্যি সত্যি তুমি যাবে
তাহলে? বাবা বলেছিল। সেই গলাটা কেমন যেন কান্নামাখা ছিল বলে সেই বয়েসেই দোলন বুঝতে
পারত।
-কিন্তু তোর বাবা তোর
মাকে এত ভালবাসত যে সেই বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারে নি। কিন্তু প্রতিবাদ করতেও পারে
নি। শুধু অনুনয় করে বলেছিল সে যেন তাকে ত্যাগ না করে।
কিন্তু দু নৌকোয় পা দিয়ে
চলতে একেবারেই মন চায় নি দোলনের মায়ের। সে নাকি ছেলেমেয়ে একেবারেই চাইত না। বিয়ের
পর বাবাকে বলেছিলও সেকথা। কিন্তু শত সাবধানে থেকেও দোলন এসে গিয়েছিল এই পৃথিবীতে।
আর তার পর থেকেই বিষ নজরে দেখত মা বাবাকে। রাতদিন ঝগড়ার সেই ছিল সূত্রপাত।
দিদার কাছ থেকে গল্প
শোনার পরেও ঘুম আসে না দোলনচাঁপার। সত্তর বছরের বুড়িটা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু ক্লান্ত হয় না দোলনের দু’চোখের পাতা। জেগে জেগে দুঃস্বপ্ন দেখে সে। দেখে
পক্ষীরাজে চেপে নয়, পুলিশের গাড়িতে সাদা চাদরে ঢেকে স্ট্রেচারে চেপে শুয়ে আসছে তার
বাবা। যে তাকে আশ্বাস দিয়েছিল, ঘুমিয়ে পড় মা। আমি আবার আসব।
বাবাকে খুন করিয়ে ছিল তার
মা। সেই দিন রাতে যেদিন মেয়েকে অমন মিষ্টি আশ্বাস দিয়েছিল তার বাবা।
রোজ রাতের ঐ দুঃস্বপ্ন
তাকে গ্রাস করছে। দেহে সে সুন্দরী কিন্তু মন হয়ে গেছে বিষণ্ণ। অনেকে পরামর্শ দিল
মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে। কিছুদিন চিকিৎসা করার পর তিনি বললেন, এবার একটা
ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিন। আশা করি ভাল হয়ে যাবে।
বিয়েতে ঘোর অমত দোলনের।
মায়ের মেয়ে নাকি মায়ের মত হয়। তার বড় ভয় যাকে সে বিয়ে করবে সে যদি বাবার মত
ভালবাসার পাগল হয়? তারপর সে মায়ের মত তার নিজের জিঘাংসার ধারালো ছুরিতে – আর সে
ভাবতে পারছে না।
তা যদি নাও করে তবে
স্বামীর সঙ্গে প্রতি রাত যদি সেই বীভৎস রাতের মত তাড়া করে বেড়ায়? যে রাতকে সে এই
ঊনিশ বছর বয়েসেও ভুলতে পারছে না তাকে ভুলিয়ে দেবে এমন কোনও ভালবাসা আছে কি জগতে?
হয়ত নেই অথবা নেই তার ধারণা। একটা নিরীহ ছেলের জীবন কেন সে নষ্ট করে দেবে? তার
মায়ের পাপের সাজা দেবে বাবার মত আর এক ভালবাসার পাগলকে?
তার চেয়ে পাগলা গারদই হয়ত
তার উপযুক্ত স্থান। অথবা এই ঘরটা। সাত ফুট বাই আট ফুট এই ঘরটা। যার একটা মাত্র
জানলা দিয়ে বাইরে বাগানের গাছের ফাঁক দিয়ে গলে আসতে জ্যোৎস্না বড় ব্যথা পায়। ঐ এক
টুকরো জ্যোৎস্নাই থাক দোলনচাঁপার জীবনে।
তাই এই ঘরটুকুকে আজও সে
ছাড়তে পারে নি।
No comments:
Post a Comment