আত্মকথনে, স্বীয় লেখনীর হাত ধরে নিজ পরিচিতিকরণ খুব একটা সহজ কাজ নয়। তবে অভিনব বটে কোনও সন্দেহ নেই। মনের ভিতর হাতড়াতে হাতড়াতে প্রথম যে সহজবোধ্য বিষয় মনে এল, তাকেই আঁকড়ে ধরে কটা কথা বলতে পারি মনে হয় – তা হ’ল আমি লিখি তবে কি লিখি, কখন লিখি, সে ব্যাপারে বললেই খানিকটা সহজ হবে এ কাজ। আমি সামান্য যা লেখালেখি করি – তা আমার মরজি হলে বা কারও আরজি এলে। মানে লেখার তাগিদ অনুভব করলে বা কারো কাছ থেকে লেখা পাঠানোর তাগাদা পেলে।
এভাবেই লিখে চলেছি এখনো – তবে আমার ভাতৃপ্রতিম তরুণ সম্পাদকেরা অনেকেই জানেন তাদের লিটল্ ম্যাগাজিন বা মিনি পত্রিকায় বহু লেখা দিয়েছি তাদের অনুরোধে, আবার এও জানেন লেখা চেয়ে পাঠানোর শেষ তারিখ পেরিয়ে গেলেও আমার লেখা পাঠানো হয়ে ওঠে না – এ ক্ষেত্রে অকপট স্বীকারোক্তির সুরে বলি – হয়ত তাগাদা এসেছে, কিন্তু তাগিদ অনুভবে্র অভাব বা কোনও বাহানা নয়, সত্যিকারের সময়াভাব হেতু কথা রাখতে পারি না।
তবু আশার কথা এই, এখনও লিখছি সে কবিতাই হোক বা গদ্য সাহিত্য। লিখে চলেছি...
টিভি বন্ধ, রান্নাঘরের ব্যস্ততার বাধ্যতামূলক ছুটি। রিনির আজ অগাধ
অবসর। অরিন্দম অফিসের কাজে গেছে ব্যাঙ্গালোর দিন সাতেকের জন্য। ছেলে ঋতম সদ্য পাড়ি
জমিয়েছে সুদূর আমেরিকার মিশৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও পড়বে বলে – গবেষণার কাজে। এই
মুহূর্তে রিনি একেবারেই একা। কোনদিন এমন একটা পরিস্থিতি আসবে ওর ভাবনাতেও আসে নি।
কিন্তু সাময়িক এই একাকিত্বের মাঝে নিজেকে পেয়ে, অবচেতন মনে একটা অজানা হালকা খুশির
আমেজ অনুভব করে সে। খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সেখানে তখন মিষ্টি কুয়াশা ভেজা
সোনালী রোদ। হাতে এককাপ চা। টবে সদ্য ফোটা তাজা লাল গোলাপ। বহুদিন পরে আজ সময়
পেয়েছে সকালকে উপভোগ করার। রুটিনমাফিক সাজানো কাজের ভিড় থেকে এ যেন তার হঠাৎ পাওয়া
ছুটি।
ফোনটা হাতে তুলে নিল। তৃণাকে একবার ডেকে নেবে ভাবলো, যদি সে আসে তো
দিনটা বেশ পুরোনো সময়ের ফ্লাসব্যাকে ফিরে যাওয়া যাবে। তৃণা আর রিনি দুজনে কলেজ আর
ইউনিভারসিটি এক সঙ্গে কাটিয়েছে বেশ কয়েকটা বছর। প্রাণের বন্ধুত্ব ছাড়াও এক
অনাকাঙ্খিত দন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিল ওরা দুজনেই। অর্ণবের কথা ভেসে উঠল মনে। অর্ণব
অকপটে স্বীকার করেছিল যে সে তাদের দুজনকেই ভালবাসে, রিনি সেটা বুঝতে পারত, ভালও
লাগত, কিন্তু এও জানত এর কোন পরিণতি অসম্ভব। মিশত সে খুব স্বাভাবিকভাবেই, মনের
ভালবাসা মনেই গোপন রেখে। অথচ তৃণা আপ্রাণ চেষ্টা করত অর্ণবকে একেবারে নিজের মত করে
পেতে। নানারকম ভাবে ও অর্ণবকে ইম্প্রেস করার উপায় উদ্ভাবন করত। রিনির মাঝে মাঝে
রাগ যে হত না তৃণার ওপর তা নয়। অর্ণব ছিল একেবারে অন্য ধাতুতে গড়া। বোহেমিয়ান
স্বভাব। ও শুধু তাদের বলত, ‘কেন রে দুজনকে বুঝি ভালবাসা যায় না?’ তৃণা জোরগলায় বলত
–‘না-ভালবাসায় কোন সতীনের জায়গা হয় না!’ আর রিনি এইসব কথার কোনও যুক্তি খুঁজে না
পেলেও মুখে কিছুই বলত না।
রিনির ফোন পেয়ে তৃণা একবাক্যে রাজী হয়ে গেল। জানালো সে আসছে। রিনি
তাকে এও বলে দিল নিপাট গপ্প-গুজব করে সময় কাটাবে তারা, খাওয়া দাওয়ার পাট বাইরে।
রোজকার থেকে একটু অন্য রকম। মনের মত একটা দিন কেমন করে সাজাবে মনে মনে ভাবতে থাকে
রিনি। তৃণার আসতে কিছুটা সময় আছে, এই ফাঁকে ঘরদোর গুছিয়ে নিতে শুরু করে।
হঠাৎ দরজায় বেল বেজে ওঠে। এত তাড়াতাড়ি তো তৃণার আসার কথা নয়, তবে কে
এল – ভাবতে ভাবতে দরজা খোলে। চমকে ওঠে সে, একি অর্ণব দাঁড়িয়ে! অর্ণব ঝড়ের মত ঘরে
ঢুকে পড়ল নিজেই। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ ও হতভম্ব রিনির মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এল
–‘তুমি!’
No comments:
Post a Comment