Friday, December 23, 2016


সম্পাদকীয়...অলোক চৌধুরী











বাতাসে হিমের পরশ নিয়ে শীত এসে গেল । পারদ নামছে আসতে আসতে । নতুন 

গুড়ের গন্ধ, অঢেল টাটকা সব্জী আর কমলালেবু শীতের বাজার জমিয়ে বসেছে । টাকার অপ্রতুলতা সত্ত্বেও ভিড় বাড়ছে নিক্কো পার্ক, ইকো পার্ক, চিড়িয়াখানায় । নানা জায়গায় গান মেলা, বইমেলা, গ্রামীণ মেলায় মানুষের ভিড় । নন্দন চত্ত্বর জমজমাট । নিতান্তই অনিচ্ছাকৃতভাবে দু’মাস বন্ধ থাকার পর এই শীতের আমেজ গায়ে মেখে  প্রকাশিত হল নবকলেবরে চিলেকোঠার মাসিক ওয়েব ম্যাগাজিন, “চিলেকোঠা ই-ম্যাগ” এই নাম নিয়ে  রবীন্দ্রনাথের গানে সুর মেলাই সবাই...

আর নাই যে দেরী, নাই যে দেরী ।।
সামনে সবার পড়ল ধরা   তুমি যে, ভাই, আমাদেরই ।।
হিমের বায়ু-বাঁধন টুটি   পাগ্‌লাঝোরা পাবে ছুটি,
উত্তরে এই হাওয়া তোমার   বইবে উজান কুঞ্জ ঘেরি ।।
নাই যে দেরী, নাই যে দেরী ।


আবার আপনাদের লেখা নানান কবিতায়, গল্পে সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে সবার প্রিয় “চিলেকোঠা ই-ম্যাগ”
আগের মতই আমাদের এই “চিলেকোঠা ই-ম্যাগ”-এ  থাকছে নানান বিভাগ । আপনারা লেখা পাঠান, সবার লেখা পড়ুনআর আপনার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকেও পড়তে সাহায্য করুন । সবাই নিজস্ব মতামত লিখে লেখক লেখিকাদের উৎসাহিত করুন । সুস্থ থাকুন সবাই । 

স্বপ্নস্বরূপ .........নন্দিনী সেনগুপ্ত

স্বপ্নস্বরূপ - ১
নন্দিনী সেনগুপ্ত
প্রথমেই বলে রাখি আমি রবীন্দ্র- বিশেষজ্ঞ নই। না, সাহিত্য আমার বিষয় নয়। আর পাঁচটা বাঙ্গালী মানুষের মত আমার অনুভবে এবং বোধে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে ফেরার জন্যই হয়ত এই লেখা। তিনি আছেন। কিভাবে আছেন কি করে বলি? তাকে জানার ব্যাকুলতা আছে, সেটুকুই সম্বল। 
এই সবে পৌষ মাস পড়ল। শিশু বা কিশোরীবেলায় যখনি স্কুলে বা পাড়ায় রবীন্দ্রজয়ন্তী করবার সময় ঋতুরঙ্গ করা হত, তখন অবধারিতভাবে শীতের জন্য যে গান বাছা হত, সেটা ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে’ অথবা ‘শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন’। শিশুকালে এই দুটি গানে গলা মেলায় নি বা নৃত্যের তালে হাত-পা দোলায় নি, সাধারণ বাঙালি বাড়িতে এমন মানুষ বোধ হয় পাওয়া মুস্কিল। কিন্তু আরও মুস্কিল থাকত অন্য জায়গায়। রবীন্দ্র-জয়ন্তী মানেই ত বৈশাখ মাস। ওইরকম গরমে পৌষমাসের কথা ভেবে গান গাওয়া বা নৃত্য পরিবেশন করা সত্যিই কঠিন কাজ বলে আমার মনে হয়। নেহাত শিশুরা অত বুঝে উঠতে পারেনা, অতএব বিদ্রোহ করে না। বড়রা যেরকম শিখিয়ে দেন বা করতে বলেন তারাও সেটাই করে থাকে। বেশ উৎসব-উৎসব একটা ব্যাপার চলতে থাকে সবাইকে ঘিরে। আসলে ওই দুটি গানের মধ্যে কবিও যে উৎসবের ভাবটিই ধরবার চেষ্টা  করেছেন। অঘ্রাণের শেষের সুপক্ক ফসলে পরিপূর্ণ মাঠের কথা, কিংবা শিরশির করে একযোগে গাছগুলির পাতা খসিয়ে দেওয়া, এসব কিছুই যেন এক উৎসবের অঙ্গ। প্রকৃতির ঋতুবদলের উৎসবে মানুষকে সামিল করে নেওয়া যেন এই দুটি গানের অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার। শীতের শীতলতার মাঝে প্রকৃতি এবং মানুষের সেতুবন্ধন এবং উৎসবের মাঝে একে অপরকে আপন করে নিয়ে উষ্ণতা খুঁজে ফেরবার ইচ্ছেগুলোই ব্যক্ত হয়ে ওঠে এইধরনের সঙ্গীতে।
কিন্তু শীত মানেই যে শুধু উৎসব নয়। তিনি কবি, সত্যদ্রষ্টা, তাই তার গানে শীতের রিক্ত রূপের বর্ণনা থাকবে না, এ অসম্ভব। যখন শুনতে পাই... ‘শীতের বনে কোন ষে কঠিন আসবে বলে, শিউলিগুলি ভয়ে মলিন’, তখন বুঝি সেই নিষ্ঠুর ঋতুর রূপ। কবি ছাড়া আর কে পারবেন এই অনুভবের গভীরতা বুঝিয়ে দিতে? পাতায়-ঘাসে কোনও চঞ্চলতা যে আর তার সয় না, সে কথা যে তিনি না বললে জানতে পারতাম না! তিনি তার লেখায়, গানে বারে বারে যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, কিভাবে বুঝে নিতে হয় প্রকৃতির হৃদয়ের কথাখানি। শীতের আগমনে হাওয়ায় ভেসে বিলীন হয়ে যায় কাশের গুচ্ছের উচ্ছ্বসিত হাসি, কথা দিয়ে এমন ছবি  তিনি ছাড়া আর কে পারেন আঁকতে?
 কবির বিলেতবাসের প্রথমদিকের স্মৃতিতে দেখতে পাই তার সতেরো বছর বয়সে  শীতের এক অদ্ভুত রূপ প্রত্যক্ষ করার কথা। কবি বলছেন, “...  বাহিরে গিয়া দেখিলাম, কনকনে শীত, আকাশে শুভ্র জ্যোৎস্না এবং পৃথিবী সাদা বরফে ঢাকিয়া গিয়াছে। চিরদিন পৃথিবীর যে মূর্তি দেখিয়াছি, এ সে নয় - এ যেন একটা স্বপ্ন,   যেন আর কিছু সমস্ত কাছের জিনিস যেন দূরে গিয়া পড়িয়াছে, শুভ্রকায় নিশ্চল তপস্বী যেন গভীর ধ্যানের  আবরণে আবৃত। অকস্মাৎ ঘরের বাহির হইয়াই এমন আশ্চর্য বিরাট সৌন্দর্য আর কখনো দেখি নাই।”
কবি তার জীবনে পরবর্তীকালে বহুবার নানা দেশে ভ্রমণ করেছেন, দেখেছেন বিভিন্ন দেশে শীতঋতুর বিচিত্র রূপ, কিন্তু প্রথম দেখা এই বরফপাত যে তাঁকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই।  
মানুষের সমস্ত জীবন যেমন শেষ বেলায় বার্ধক্যে এসে পূর্ণতা পায়, কবির অনুভবে শীতও যেন তেমন ধ্যানগম্ভীরসবকিছু ভরিয়ে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে নিজে হয় শূন্য, রিক্ত। কবির বেশ কিছু লেখায় দেখি  এই ঋতু যেন সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীর মত নিজেকে সরিয়ে রেখেছে দূরে; হয়ত মানুষে মানুষে উষ্ণতার বন্ধন খুঁজে নেবার দিচ্ছে এক সুযোগ, সে নিজেও জানে একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে তার এই জরাগ্রস্ত শরীর। বসন্তের জন্য স্থান ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হবে তাকে।


পাগলি............অনুপম দাশ শর্মা

.....পাগলি.....

অনুপম দাশশর্মা

শৈশবের পুতুল খেলা

যৌবনেতে পতি,

কেউ বা আরো ছোট থেকে

ঈশ্বরেতে মতি

.
কেউ বা থাকে সহজসিধে

ভীষণ নিরাসক্ত,

আবার কেউ বিলাসমোহে

উদ্দাম মদমত্ত

.
দৃষ্টি ফেলো দুরে,

ঘেরাটোপের বন্দি ওরা

মরছে মাথা ঠুকে

.
মনের চাবি হারিয়ে গেছে

চেতনা দিগভ্রান্ত,

হাসপাতালে ধুঁকছে ওরা-

পাগলাগারদ শ্রান্ত !!!

আমার নতুন বছর............রুমুন চক্রবর্তী

  • আমার নতুন বছর
    রুমুন চক্রবর্তী
    • কালের নিয়ম মেনে আবার একটা বছর বিদায় নিতে চলেছে। বিদায় কালে তার ঝুলি ভরে সাথে নিয়ে যাবে কিছু না পাওয়ার কষ্ট, কিছু কান্না, কিছু প্রাপ্তিসুখ, কিছু হাসি, কিছু অঙ্গীকার, কিছু বিশ্বাসভঙ্গতা, কিছু বিনিদ্র রাতের কাহিনী আর কিছু আশা পূরণের সকাল।
      চলতি বছর চলে যাওয়ায় আমরা কেউই যে খুব একটা হতাশ হই বা দুঃখ পাই, তা কিন্তু কখনো মনে হয়নি আমার। বরং লক্ষ্য করেছি আমরা সবাই কম-বেশি খুশিই হই নতুন বছরের আগমনে। তা না হ’লে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে এত সব আয়োজনে মেতে উঠতাম নাকি?
      ২৫শে ডিসেম্বর অর্থাৎ বড়দিন আসা মানেই নতুন বছরকে আমন্ত্রণ জানানোর তোড়জোড় শুরু। যদিও এটা খৃষ্ট ধর্মে বিশ্বাসী মানুষদের একটা মহোৎসব, কিন্তু সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষও সমান উৎসাহে পালন করেন বড়দিন ও ইংরেজি নতুন বছরের আগমনী উৎসব।
      নতুন পোশাক, গির্জায় যাওয়া, আত্মীয় বন্ধুদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ, একে অপরকে সুন্দর সুন্দর উপহার দেওয়া, কেক, পেস্ট্রি, চকলেট ও রকমারি খাওয়াদাওয়া --- কত আয়োজন! আলোয় আলোয় সেজে ওঠে শহর। বাড়িতে বাড়িতে রাখা হয় সুসজ্জিত ‘ক্রিস্টমাস ট্রি’, বারান্দায় ঝোলানো হয় ঝকমকে ‘স্টার’। প্রায় সকলেই নিজের নিজের সাধ্যমত সামিল হন এই আনন্দে। সশরীরে দেখা করে বা ফোনে আমরা একে অন্যকে ‘মেরি ক্রিস্টমাস’ এর শুভেচ্ছা জানাই। আজকাল তো আবার ইন্টারনেটের সুবিধে হওয়ায় ঘরে বসেই দেশের যেকোনো প্রান্তে থাকা বন্ধু বা আত্মীয়কে পৌঁছে দিই তাঁদের পছন্দের উপহার ও শুভেচ্ছাবার্তা। তবে একটা জিনিস বদলায়নি। আমি দেখেছি আজও ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বিশ্বাস করে বড়দিনের আগের দিন রাতে তারা যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন বৃদ্ধ ‘স্যান্টাক্লজ’ হরিণে টানা স্লেজ গাড়ি চেপে আসে। তারপর চুপিচুপি এসে একটা মোজার মধ্যে তাদের জন্য উপহার স্বরূপ তাদের প্রিয় খেলনা ও চকলেট রেখে যায়। তাই পরদিন সকালে চোখ খুলে এই কুঁচোকাঁচারা প্রথমেই খোঁজ করে ওই মোজার। এই বিশ্বাস ও প্রাপ্তির আনন্দ - দুটোই অতি প্রাচীন। কত প্রজন্ম ধরে যে এই রীতি চলে আসছে তা হয়ত কেউই ঠিক মত বলতে পারব না।
      পরিনত মানুষদের নতুন বছর নিয়ে উন্মাদনার কারণ বোধহয় ইতিবাচক চিন্তা। যারা বিদায়ী বছরে ভালো ছিলাম তারা ভাবি এ’বছরে আরও বেশি ভালো হবে সব কিছু, আর যারা ভালো ছিলাম না তারাও ভাবি এ’বছর সময় বদলে যাবে, দুঃসময়ের মেঘ কেটে গিয়ে সুদিন আসবে। এইভাবেই প্রতিবার একবুক আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নতুন বছরে পা রাখি সবাই। তারপর পাওয়া না পাওয়ার দাঁড়িপাল্লা সামলাতে সামলাতে কখন যে আস্ত একটা বছর পেরিয়ে যায় তা বুঝতেই পারি না। বছরের শেষ দিনে কেউ বলি, বাব্বা বাঁচা গেল, বছরটা বড্ড খারাপ কাটল। কেউ আবার উল্টো সুরে বলি, ইশ্‌... এ’বছরটা কি ভালোই না কেটেছে! ঠাকুর করেন সামনের বছরটাও যেন এমনই ভালোয় ভালোয় কেটে যায়।
      এসবের বাইরেও আমার কাছে নতুন বছরের অন্য গুরুত্ব আছে। পুরনো বছরের শেষ দিনে পিছন ফিরে শুধু পাওয়া না পাওয়ার হিসেবে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখিনা বা নতুন বছর আমার জীবনে বিরাট কোন পরিবর্তন আনবে এমন অলীক আশাও করি না। তবে একটা বছর পেরিয়ে যেতে যেতে আমায় যে অল্প হলেও বদলে দিয়ে যায়, সেটা বিলক্ষণ বুঝি। অনুভব করি, পুরোনো বছর চলে যাওয়ার সাথে ছেলেমানুষি কমে গিয়ে আরও একটু পরিনত হয়েছি। দৃষ্টিভঙ্গি বদলে জীবন ও মানুষকে আরেকটু বেশি চিনতে শিখেছি। ক্ষমা করার প্রবণতা বেড়েছে। বুঝতে শিখেছি মনের কোণে কটু স্মৃতি জমিয়ে রাখলে যন্ত্রণা বাড়ে বই কমে না।
      আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে অল্প বদলে যেতে দেখে কপালে আরও দুশ্চিন্তার ভাঁজ দুই একটা বাড়ে। চুল আগের চেয়ে একটু পাতলা হওয়া মন খারাপ করায়। রগের পাশে রূপোর ঝিলিক খুঁজে না পেলেও গায়ের রঙ আর চামড়ার ঔজ্জ্বল্য কমে যাওয়া বুঝিয়ে দেয় সেই দিনটার দিকে সন্তর্পণে পা ফেলে এগিয়ে চলেছি যে দিনটা একদিন আগাম জানান না দিয়েই আসবে আমাদের সবার জীবনে। সেদিন সে না অপেক্ষা করবে পুরনো বছর যাওয়ার শোক পালনের না করবে নতুন বছর আগমনের উল্লাসের।
      এটাই শাশ্বত।
      তবুও এভাবেই খুশির ডালি সাজিয়ে নতুন বছর এসেছে, আসছে, আবারও আসবে বারে বারে।
      (সমাপ্ত)
    • Today

কবিতা......তিলক কুমার ভট্টাচার্য



সম্পর্ক
তিলক কুমার ভট্টাচার্য

আগে ভাঙবে,

এটা ভাবতে ভাবতেই
সুমেরীয় বরফ আজ প্রস্তরীভূত।

অক্ষরের মালা গেঁথে গয়না
গয়না গড়ছে কবি,
অক্ষরকর্মী আমি সীমায় সংযত।
' কলঘরে চিলের কান্না' আর
তার অসহায় চিল চিৎকার
শুনেছিলেন সেদিনের সে কবি,
আট বাই দশে ডানা ঝাপটানো
আটপৌরে তেলচিটে মন

আজও এঁকে চলে দিগন্তের ছবি।

গল্প.........সুজয় চক্রবর্তী

লুঙ্গি প্যান্টের জীবন

সুজয় চক্রবর্তী

পাছায় একটা আধলা ইঁঁট দিয়ে দুপা ফাঁক করে বসে আছে নিত্য। কাজে যায়নি। ওর সামনে দিয়ে একটা ডেঁয়োপিঁপড়ে চলে যাচ্ছে  নিজের ছন্দে। নিত্য সেটাকে পায়ের তলায় পিষে মারতে যাবে, অমনি ভোম্বলের গলা, " বাবা, আমার কিন্তু কালকেই লাগবে। আর দুটো শ্যাম্পুর পাতা।"
নিত্য ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ ব্যাজার করে বললো, " আচ্ছা, এখন যা, দেখছি।" ঘাড়েমাথা সোজাসুজি হওয়ার সময়টুকু,
পিঁপড়েটা এরমধ্যেই নিত্য'র নাগালের বাইরে। দুর্বল তো সব সময় পালানোরই চেষ্টা করে! সব যুগে।
নিত্য একটা বিড়ি ধরায়। তারপর উঁকি মারে  ছেলেবেলার দিকে । কাদামাটি মাথায় ঘষে ঝপাং করে লাফ মারলো ইছামতীর জলে। নিত্য একা না। বিজু, উৎপল, নীলু। তারপর মাথা মুছে রোদে শুকোনো মিনিট দশ। ব্যস, চুল ফুলে ফেঁপে হাওয়ায় উড়ছে তখন। শ্যাম্পু-ট্যাম্পুর বালাই ছিল না। আর সাবান! তখন লাল লাইফবয় সাবান ঘষে জামাও কেচেছে, আবার গায়েও মেখেছে। একমাত্র কোনও অনুষ্ঠান বাড়িতে যাওয়ার আগেই মা ডাক দিত, " নিত্য, এদিকে আয়, সেন্ট দে জামায়।" তখনই দিত। তার আগে না। আর ওর বড় ছেলে ভোম্বল, বাড়ির বাইরে বেরোলেই কি যে গায়ে লাগায় আজকাল, ছ্যাঁঁক ছ্যাঁক করে আওয়াজ হয়!
সকাল থেকে তুমুল বৃষ্টি হয়েছে। রিক্সা বার করেনি নিত্য। বাড়ি থাকলে এটা ওটা নিয়ে অশান্তি হবেই। এ জানা কথা। তাই বৃষ্টি একটু কমতেই কলপাড়ের এই ফাঁকা জায়গাটায় এসে বসেছে নিত্য।  বাড়ি থাকলে বেশিরভাগ সময়টা এখানেই ও বসে থাকে ইট পাছায় দিয়ে। ঘরে থাকলে ছেলেদুটো'র নানান কিসিমের বায়নার কথা শুনতে শুনতে একঘেয়ে লাগে ওর। তখনই কলতলায়। একটার পর একটা বিড়ি টেনে যায় নিত্য। এই সময় ও বিড়বিড় করে কি যেন বলেও। বোঝা যায়, নিত্য চিন্তা করছে। দিয়েছে, একটা সময় ছেলেদুটো যা চেয়েছে, সব না পারলেও ওর সাধ্যমত ও দিয়েছে। এখন পারছে না।
রিক্সা স্ট্যান্ডের প্রায় সবাই এখন টোটো কিনে ফেলেছে। কেনেনি নিত্য। কেনেনি মানে কিনতে পারেনি। জমানো টাকা কিছুই নেই। জমাতে গেলে তো ব্যাঙ্কে যেতে হয়। টাকা রাখতে হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত নিত্য ব্যাঙ্কে যায়নি। টাকা থাকলে তো যাবে! ব্যাঙ্কের সামনে কতো লোককে নামিয়ে দিয়েছে। কতোদিন। কিন্তু ব্যাঙ্কের  ভেতরে ঢোকেনি কখনও। তবে একটা সমিতি করতো। মাসে মাসে তিনশো টাকা। রোজ দশ করে দিত। সেই সমিতিও ঝাড় খেয়ে গেছে। সমিতি নাকি চিটফান্ডের ব্যবসা খুলে বসেছিল। নিত্য'র হিসেবে ও পুরো পাঁচ হাজার টাকা পেত। কিন্তু সমিতি ওকে কাঁচকলা দেখিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। সতীশদাকে ধরেছিল পরে। ও বলেছিল, " তুমি একটু ওয়েট করো, তোমার টাকা পেয়ে যাবা।"
নিত্য আর ওয়েট করেনি। ও জানে ও টাকা আর পাবে না।
টোটোকে অনেকে টুকটুক বলে। ব্যাটারিতে চলে বলে ওর খরচাও কম। টোটো আসাতে রিক্সা মার খেয়ে গেছে। আর যাদের রিক্সা আছে, তারা সবাই নিত্য হয়ে গিয়েছে। সময় বাঁচছে, আরামে যাওয়া যাচ্ছে, পয়সাও কম লাগছে। পাবলিক তো এটাই চায়। নিত্য কয়েকবার ভেবেছেও ভাড়ায় টোটো চালাবে। বাজারে প্রবোধ তোকদারের পাঁচটা টোটো খাটছে। নিত্য শুনেছে আরও পাঁচটা নামাবে সামনের মাসে। কিন্তু মন সায় দেয়নি। মধুও বারণ করেছে। হাজার হোক, রিক্সাটা তো তার নিজের! যাও না যাও কারও কৈফিয়ত দেওয়া লাগবে না। আর ভাড়ায় টোটো চালানোতে তো হ্যাপাও আছে। তুমি সারাদিন কি পেলে না পেলে মালিক দেখবে না। সন্ধে হলেই তার হাতে গুঁজে দিতে হবে দেড়শো টাকা! এর চেয়ে রিক্সাই ভালো। স্বাধীন।
স্ট্যান্ডেও নিত্য যখন একা থাকে, বেশিরভাগ সময়টাই বিড়ি টানে। আগে এতো বিড়ি খেতো না। ইদানীং বেড়েছে। বছর খানেক। আগে যখন সবার রিক্সা ছিল, টোটো যখন আসেনি, তখন দিনে তিনশ' সাড়ে তিনশ' নিয়েও বাড়ি ফিরেছে নিত্য। এখন দেড়শ'ও হয় না। কালই তো সত্তর হয়েছিল!
বউ মধুকে সব কথা বলে নিত্য। কেন তার রোজগার ইদানীং কমে গেছে তা জানে মধুও। কিন্তু ছেলে দুটো বুঝলে তো! সব সময় কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করলে মধুরও কি আর মাথার ঠিক থাকে! দিয়েছিল, সেদিন গরম খুন্তির  ছ্যাঁকা দিয়েছিল ছোটটার পায়ে। ফোস্কা পড়ে, ঘা হয়ে একাকার অবস্থা। সেই ঘা শুকাতেই তো লাগলো পনেরো দিন। ছেলেগুলোর চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে যখন মুখ থুবড়ে পড়ে নিত্য, একমাত্র তখনই বউ মধুর মুখ আর মিষ্টি থাকে না। খিচিয়ে ওঠে। যেমন আজ উঠেছে।
---- আমার তো কোনও শখ-আহ্লাদের কথাই বলি না। ওরাও কি মুখে লাগাম দেবে এবার?  জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না! বুঝলে?
ছেলেদুটোর সামনে মধু একথা বললো! ভীষণ রাগ হল নিত্য'র। সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে কোথাও পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে নিত্য। আগে মধু এতো মুখরা ছিল না। হবেই বা কেন, হা করা লাগতো না। সব হাতের কাছে পেয়ে যেত। তখন নিত্য রাগ দেখালেও এক গাল হেসে নিত্য'র কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতো মধু। এখন তার কথার ঝাঁঝ কতো!
বড়ো ছেলেটা সপ্তাখানেক ধরে বলে যাচ্ছে, ওর একটা বডি অয়েল চাই। নিত্য আজ দেবো, কাল দেবো বলে চালিয়ে যাচ্ছিল সাতদিন ধরে। কিন্তু টাকা যোগাড় করে উঠতে পারছিল না। পারবে কি করে! সত্তর টাকার রোজগারে যদি পঞ্চাশ টাকা ভাগ বসায়, তাহলে তো না খেয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই।  ধারে জিনিস কিনতো বিপ্লবের দোকান থেকে। অনেক জমে আছে সেখানেও। তবু কাল গিয়েছিল। ভোম্বলের জন্যই।  বডি অয়েল আনতে।
----- বিপ্লবদা, আর দুদিন দেরি করো, সব শোধ করে দেবো।
মুখে বললো নিত্য, কিন্তু কি করে শোধ দেবে সে নিজেও জানে না। বিপ্লব ওর কথায় আর কান দেয়নি।
----- ওসব রাখো। আগের টাকা শোধ করে দাও। যা লাগে নিয়ে যেও।
চলে এসেছিল।
অসময়ের মধ্যে দিয়েও কিভাবে চললে সংসারটা ঠিকঠাক চলে, তা জানে মধু।  কোনও বাজে খরচ ও করে না। আর তাই, নিত্য'ও বাজে খরচ করার সাহস পায়নি এযাবৎ। 'যারাই রিক্সা চালায়, একটুআধটু মালটাল খায়',---- একথা নিত্য'কে বলা যাবে না। কেননা নিত্য'র নেশা বলতে ঐ এক, বিড়ি। চা খায় দিনে চার-পাঁচ বার। কিন্তু ওটাকে তো আর নেশা বলা যাবে না। চা সবাই খায়। তবে সঙ্গদোষে যে নিত্য পড়েনি, তা নয়। ভোলার বিয়েতে একবার বাংলা খেয়ে চুর হয়ে ঘরে ফিরেছিল নিত্য। মধু তখন মিছরির ছুরি চালিয়েছিল মুখে। দ্বিতীয় বার আর মাল খাওয়ার নাম করেনি সে। নিজে হাতে সংসারের সমস্ত খরচ চালিয়েছে মধু। এখনও। একটু একটু করে জমিয়ে ঘর গুছিয়েছে। আলমারি। শোকেস। টেবিল ফ্যান। একটা কালার টিভিও কিনে ফেলেছে। সেকেন্ডহ্যান্ড। মাসে মাসে টাকা দিয়ে। সুবীরের টিভি সারাইয়ের দোকান থেকে।
ছেলে দুটোকে হাইস্কুলে ভর্তি করেছে মধু। ওরা একটু পড়াশোনা করুক। মানুষ হোক। নিত্য'র সেসবে চোখ দিতে হয়নি। দেখতে দেখতে বড়োটা নাইনে, ছোটটা ফাইভে। বড়ো ছেলেটার পড়াশোনা হবে। মধু বোঝে। তাই লেগে আছে। ওরই তো যত বন্ধু-বান্ধব। বাড়িতেও আসে ওরা। ছেলেগুলো খুব ভালো। কোনও অহংকার নেই!          দীপন ছেলেটা তো একদম অন্যরকম। মধুর খুব ভালো লাগে। ওর বাবার যে পেট্রল পাম্প আছে, তা দেখলে বোঝা যায় না। বাড়িতে আসলে মধুরই বরঞ্চ লজ্জা লাগে, কোথায় বসতে দেবে, কি খেতে দেবে। ওদের সঙ্গে মিশে বড়োটার একটু সাজগোজের  ঝোঁক হয়েছে। গতবারই তো  পুজোতে হাঁটুর কাছে সাদা ছোপ্ দেওয়া জিন্স চেয়ে বসলো ভোম্বল। নিত্য তা দিয়েওছিল। তাছাড়া, আজ এর জন্মদিন, কাল ওর দিদির বিয়ে, এসবে নেমন্তন্ন রক্ষা করাও আছে। সব নিত্য'র একার পক্ষে সম্ভব না বলে বাড়িতে বসে না থেকে ঠোঙা বানানো শুরু করেছে মধু। সপ্তাহে সেখান থেকে কিছু আসেও। আসলে মধুও তো গরীব ঘরের মেয়ে। কষ্টটা ও বোঝে। কষ্ট কি সেও কম করেছে! ওর বাবা শ্যামল একটা সময় ধাবায় কাজ করতো। পাঞ্জাবি ধাবা। পরে লরির খালাসি হয়েছিল। চারজনের সংসার টেনে নিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছিল বাবা।  দিদির বিয়ে হয়ে গেল ক্লাস এইটেই। দুইবোনেরই চোখে পড়ার মতো চেহারা তখন।      ব্যস্, বাবা-মা ওর জন্যও ছেলে দেখা শুরু করলো। ক্লাস সিক্সে ওঠার পরই পড়াশোনায় ছেদ পড়লো মধুরও। পয়সার অভাবে পড়াশোনা হল না। অভাবটা ও বোঝে। তুলনায় নিত্যরা ছিল একটু ভালোর দিকে। চন্ডীতলা বাজারে ছিল নিত্য'র বাবার সব্জির দোকান। বিক্রিবাটা ভালোই হতো। বাবার দোকানে নিত্যও বসতো। ওদের দোকানেই সবজি কিনতে আসতো মধুর বাবা শ্যামল।কখনও বাবার সঙ্গে মধুও যেতো বাজারে। সেই থেকে আলাপ। তারপর দে ছুট, একসাথে।
নিত্য'কে বুঝিয়েছে মধু, " যারা তুমার বাঁধাধরা প্যাসেঞ্জার ছিল, ওদের কাছ থেকে টোটো যা নেচ্ছে, তার থেকে এট্টু কম নাও। দেখবা, আবার সব ঠিক।"
নিত্য এখন মধু'র ফর্মুলা মেনে চলছে। বেশ কিছুদিন ধরেই। গতকাল ষষ্ঠীকে একপ্রকার বাড়ি থেকেই তুলে নিয়ে এসেছে সে। ষষ্ঠী নিত্য'র ডেলি প্যাসেঞ্জার ছিল। ইদানীং টোটোয় সওয়ার হচ্ছিল। আগে রোজ দশটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে দীপকের পানের দোকানের সামনে দাঁড়াতো ষষ্ঠী। তারপর মুখে একটা পান গুঁজে এদিকওদিক তাকাতো।  ঠিক কৃষ্ণচূড়া গাছটা, নয়তো শৈলেনের ফার্মেসীর সামনে রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো নিত্য। শুধুমাত্র তার জন্যই। মুখে একগাল হাসি। ষষ্ঠীর অফিস যাওয়ার টাইমটায় নিত্য কোনও ভাড়া নিত না। ষষ্ঠীকে ব্লকে পৌঁছে দিয়ে তারপর স্ট্যান্ডে দাঁড়াতো নিত্য। বেশ কিছু দিন ধরে নিত্যকে দেখলেই ষষ্ঠী সরে পড়তো। টোটোয় উঠতো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে। ভাড়া কম।
নিত্য সেদিন ওকে দেখতে পেয়েই কাছে এগিয়ে গেল।
----- দাদা, অনেকদিন থেকে আপনি আমার প্যাসেঞ্জার। এখন টোটোয় চড়ছেন, খারাপ লাগে। আচ্ছা, এবার থেকি টোটোয় যা ভাড়া দেন, আমারেও তাই দেবেন।
নিত্য'র কথায় ষষ্ঠী অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল।
---- না না, মাত্র দু-পাঁচ টাকা বাঁচানোর জন্য আমি টোটোয় উঠবো কেন? আসলে ঐ কদিন একটু তাড়া ছিল। ঠিক আছে, তুই যখন বলছিস তোর গাড়িতেই যাবো।
----- আপনি রেডি হয়ে আমার  মুবাইলে শুধু একটা মিস কল দেবেন। আমি বাড়ির সামনে দাঁড়ায় থাকবো।
গতকাল কথামতো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল নিত্য। এক পা-ও হাঁটতে হয়নি ষষ্ঠীর।
নিত্য যে ভাঁড়া কম নিয়ে ইদানীং রিক্সা চালাচ্ছে, তা কি করে যেন চাওর হয়ে গিয়েছিল  স্ট্যান্ডে। সেদিন একটা ভাড়া খেটে যখন সে স্ট্যান্ডে এল, খোঁচা মারলো সঞ্জয়, " নিত্যদার  প্যাসেঞ্জার আবার হচ্ছে তালে!"
---- সবই তো জানো। বলার কি আছে!
নিত্যকে গম্ভীর দেখে সঞ্জয় একটা সিগারেট ধরালো। তারপর টোটোর গ্লাস মুছতে মুছতে  বললো, " একটা সময়  ভাড়ায় না পুষালি যেতে না, এখন পুষাচ্ছে তো?"
---- আরে গান্ডু, তুই তোর কাজটা কর না। পুষাচ্ছে নাকি সেটা আমি বুঝে নেবো।
লুঙ্গির গিঁট খুলে বিড়ি বার করলো  নিত্য। সঞ্জয় আর ঘাঁটানোর সাহস পেল না। একটা ভাড়া পেয়ে চলে গেল।
অনেক দিন বাড়িতে মাছ নিয়ে যায়নি নিত্য। আগে সপ্তাহে দুদিন পরিমলের বাঁধা খদ্দের ছিল সে। কাটা মাছ চার থেকে পাঁচ পিস। কখনও রুই, কখনও কাতলা। বাড়ি যাওয়ার সময় রিক্সার সিটের নিচে রাখতো প্যাকেটটা। তারপর দুপুরবেলায় মধুর হাতের মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে একটু টিভি ছেড়ে দিত। আবার ঠিক তিনটে বাজলেই স্ট্যান্ডে। সেসব বহুদিন হয় না। মানে যবে থেকে টোটো এসেছে।
(২)
---- বেশ হয়েছে। এবার দ্যাখ কেমন লাগে? ফুটানি! সব বেরোয় যাবে।
শংকরের চায়ের দোকানের টিভিতে খবরটা দেখেই বিকাশকে দাঁত ক্যালাতে ক্যালাতে কথাগুলো বললো নিত্য। বিকাশও নিত্য'র দলে। বাবা কানাকড়িও রেখে যায়নি। আর শ্বশুরও দেনেওয়ালা না। তাই আর রিক্সা ছেড়ে টোটো ধরতে পারেনি। তবে রেলের মাঠে যখন গদাই হাত সেট করছিল টোটোতে, তখন বিকাশও স্বপ্ন দেখেছিল টোটো কেনার। কোথা থেকে, কিভাবে কিনবে সেকথা ভাবেনি। গদাই ওকেও দু-একবার চালাতে দিয়েছিল। টোটোয় উঠে হ্যান্ডেল ধরতেই কেমন বাবু বাবু লেগেছিল বিকাশের। এখন তো যারা টোটো চালায়, সবাই-ই প্যান্টশার্ট পরে। লুঙ্গি রিক্সায়ালারা পরে। ও আর নিত্য পরে। সঞ্জয় তো যখন টোটো চালায়, চোখে সানগ্লাস দেয়। হেব্বি লাগে বিকাশের। কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মধ্যের ফারাকটা বুঝে কেন্নো হয়ে চুপ করে যায়। স্ট্যান্ডে ও আর নিত্যই যেন রিক্সার ঐতিহ্যটাকে ধরে রেখেছে।
---- কি হল নিত্যদা,অনেকদিন পর দাঁত বের করলে দেখলাম!
---- এমনি নাকি? খবরটা দেখলি না, টোটো বে-আইনি ঘোষণা করার কথা ভাবছে হাইকোর্ট! জনস্বার্থ মামলা হয়েছে।
---- তাই নাকি! তালি যারা টোটো কিনলো?
---- আবার কি, রিক্সা চালাবে। প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরবে।.... শালা, ভদ্দরলোক সাজছিল সব!
বিকাশ কি বুঝলো কে জানে, নিত্য খবরটা দেখে খুশি। খুশি মানে খুব খুশি। আবার সব আগের মতো! পরিমলের থেকে মাছ নেওয়া শুরু হবে। ভোম্বলের বডি অয়েলটা কিনে দেবে। বিপ্লবের মুদির দোকানের সব টাকা শোধ করে দেবে। মধু আর খিঁচিয়ে উঠবে না। নরম সুরে কথা বলে পাশে এসে বসবে। টিভিতে পটল কুমার গানওলা দেখে বলবে, " বলো তো পটল মেয়ে না ছেলে?"
একসাথে সবাই গামলায় মুড়ি চানাচুর মেখে খাবে । ছোটছেলেটা ঝম করে মাথা থেকে একটা পাকা চুল তুলে বলবে, " বাবা, তুমি কিন্তু বুড়ো হয়ি যাচ্ছো!" অমনি মধু নিত্য'র দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলবে। মন মেজাজ ভালো না বলে অনেকদিন ইয়েও  হয়নি। মধু অপেক্ষা করে আছে। এদিকে অনেকদিন ধরে সিদ্ধ খেয়ে খেয়ে মুখে স্বাদ জিনিসটা যে কি ভুলতে বসেছে সবাই। আবার মাংস- মাছ, মিষ্টি-সিঙাড়ার স্বাদ পাবে জিভগুলো। আবারও অসাবধানে লুঙ্গির গিঁট খুলতেই খুচরো পড়বে ঝনঝন করে। ছোটটা টুপ করে সরিয়ে নেবে দু-একটা। তারপর কুড়ানো শেষ হলে নিজেই বলবে, " বাবা, আমি কিন্তু কোনও পয়সা নিই নি!" কথা শুনে মৃদু ধমক দেবে মধু। তারপর স্বীকার করবে, " একটা নিয়ছি।" দেখা যাবে হয়তো পাঁচ টাকার কয়েন সেটা। নিত্যই তখন বলবে, " থাক্, ও তো আর খায় না। জমাচ্ছে জমাক।" এইভাবে পয়সা জমিয়ে ও পুজোতে খরচ করে। বেশ কিছুদিন হল ছেলেটা আর পয়সা-টয়সা চায় না।
বাড়িতে আজ সন্ধের মধ্যেই চলে এসেছে নিত্য। রাত করেনি। ওকে আসতে দেখে অবাক হয়েছে মধু। শরীর-টরীর খারাপ করলো না কি! রিক্সাটা জামরুল গাছটার নিচে দাঁড় করিয়ে ঘরে ঢুকলো নিত্য। অন্যদিন মুখটা কালো করে থাকে। আজ বেশ চনমনে মনে হল। টিভিটা চলছিল। স্টার জলসা।
নিত্য বললো, " মধু, কোনও খবরের চ্যানেলে দ্যাও তো।"
---- ঘরে ঢুকেই খবর! দাঁড়াও অ্যাডটা দিক।
খাটের উপর পা তুলে বসলো নিত্য। মধুর সন্দেহ হল। এত তাড়াতাড়ি আসে না। তারপর ঢুকেই খবর!
---- কেন কিসের খবর?
---- এবিপি আনন্দ, ২৪ ঘন্টা যেকোনও একটাতে দ্যাও।
---- এ ন্যাও, অ্যাড দিয়েছে।
মধু নিজেই রিমোট ঘুরিয়ে একটা খবরের চ্যানেলে দিল।
---- কই, কিছুতো বুঝতি পারছি না।
---- দাঁড়াও, দাঁড়াও। ঐ দ্যাখো দেখাচ্ছে।
মধু দেখলো ব্রেকিং নিউজে দেখাচ্ছে। স্ক্রিনের নিচ দিয়ে চলে যাচ্ছে লেখাটা ----  'হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা :  বে-আইনি টোটোর বিরুদ্ধে রাজ্যকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ।'
---- বুঝলে কিছু?
---- না।
---- এবার থেকে আর টোটো রাস্তায় দেখা যাবে না। টোটো বন্ধ করে দেবে সরকার।
---- কেন?
---- টোটোতে যাতায়াত করা বিপদজনক। চারিদিক খোলা,  যাত্রী-নিরাপত্তা নেই। সামান্য ঘা  লাগলেই যখন তখন উলটে যেতে পারে।
---- কিন্তু এতো পয়সা খরচা করে যারা টোটো কিনলো, তাদের কি হবে?
----- তাদের খোঁজ নিয়ে আমাদের কি লাভ? আমাদের কেউ খোঁজ নিয়েছে এতদিন? বড়োলোকি চাল এবার ঘুচে যাবে!
----- তাহলে সঞ্জয়, মদন ওরা?
----- আবার রিক্সা ধরবে। সিগারেট ফুঁকা?.....সব বিড়িতে আসবি, দাঁড়া।
---- তোমার কি আনন্দ হচ্ছে? এটা ঠিক না।
----- না, আনন্দ না। সবাই করে কম্মে খাক। আমি আর বিকাশই বা বাদ যাবো কেন?
----- ওদের টোটো কেনার ক্ষমতা ছিল, কিনেছে। এতে ওদের তো দোষের কিছু দেখি না।
----- সবই ঠিক। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে ওরা এমন ঠ্যাস মেরে মেরে কথা বলছিল, যা শুনলি তুমারও গা পিত্তির জ্বলে যাবে।
---- ঠিক আছে, তুমি কি এখুন চা খাবা?
----- করো।
নিত্য হাত-পা ধুতে গেল কলপাড়ে।
(৩)
"বীরপাড়ায় এক আমবাগানে গতকাল রাতে এক ব্যক্তির ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মৃতের নাম প্রকাশ সরকার। বয়স ৪৫। তিনি বীরপাড়া চা বাগানের কর্মী ছিলেন। চা বাগান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর প্রকাশবাবু হালে টোটো চালাচ্ছিলেন। স্থানীয় ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে তিনি এই টোটো কেনেন। টোটো বে-আইনী ঘোষণা করার খবরে খুব মুশড়ে পড়েছিলেন তিনি। ওদিকে বড়ো মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েইছিল। দুপুরে খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া সারাদিন টোটো চালাতেন তিনি। ইদানীং প্রকাশবাবু বাড়িতেও কারও সাথে খুব একটা কথা-টথা বলতেন না। মানসিক দিক থেকে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন। তার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে বর্তমান।"
দুপুরে বাড়িতে এসে খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে অনেকদিন পর টিভিটা ছেড়ে বসেছিল নিত্য। খবরটা দেখে খানিকক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে থাকলো। অস্ফুটে বলে ফেললো, " আহা, বেচারী!"
বাসনমেজে একটু আগেই ঘরে ঢুকেছে মধু। নিত্যকে ওভাবে 'আহা' করতে দেখে তারও মনখারাপ হয়ে গেল।
---- ইস্, মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়িছিল! দুটো মেয়ে! বউটা এখন তিনটে বাচ্চা নিয়ে যাবে কোথায় ?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিত্য বললো, "হুঁ, খুব খারাপ খবর।"
---- দেখলে, একটাই খবর, তোমারে খুশি করলিও, ঐ লোকটাকে খুশি করতি পারিনি। ধারে টোটো কিনিছিল। না চালাতি পারলি টাকা শোধ করবে কি করে, সামনে মেয়ের বিয়ে, এই সব চিন্তায় লোকটা মারা গেল!
মাথা নিচু করে ফেললো নিত্য। লজ্জায়। সে তো এতো কিছু বোঝেনি। কিন্তু এটা ঠিক নিত্য এটা জানতো, শিক্ষিত বেকার যুবক থেকে, অন্য পেশা ছেড়ে আসা কত লোকও আজকাল টোটো চালাচ্ছে রাস্তাঘাটে, বাজারে গলিতে। তবু ওর যত রাগ হত, যারা রিক্সা ছেড়ে টোটো চালাচ্ছিল, তাদের উপর। রাগ হত সঞ্জয়ের উপর, বক্সীর উপর। স্ট্যান্ডে দাঁড়ালে ঐ দুজনই তো সবচেয়ে বেশি খোঁচা মেরে কথা বলতো। কিসের এতো অহংকার! তারা নিত্য'র চেয়ে বেশি রোজগার করে বলে!  কই আগে নিত্য যখন ডেলি তিনশো সাড়ে তিনশো কামাতো, তখন তো কাউকে সে লাটসাহেবি চাল  দেখায়নি! অহংকার। এই অহংকার জিনিসটা যাদের ভেতর আছে, তাদের দুচোখে দেখতে পারে না নিত্য।
---- জানো মধু, খুব খারাপ লাগছে আরেকজনের কথা ভেবে।
---- কে?
---- বিকাশ। এই তো কিছুদিন আগে ও পাঁচ হাজার, ওর দাদা পাঁচ হাজার আর এদিকসেদিক থেকে ধার দিনা করে রবীনকে টোটো কিনে দিয়েছিল। রবীন ওদের জামাই। একমাত্র বোন শ্যামলী কতদিন পড়েছিল ওর আর ওর দাদার ঘাড়ে। বাচ্চা নিয়ে। জামাইটা কোনও কাজবাজ করতো না। কুঁড়ে। টোটো কিনে দেওয়ার পর সংসারে না কি মতিগতি এসেছিল। কামায় করছিল ভালো। ও প্রায় বলতো, " নিত্যদা, বাপ্-মা মরা বোনটা  চোখের জল ফ্যালে না, এটা দেখে যে কি আনন্দ হয়,  তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না।" আমি বুঝতাম বিকাশের কথাটা, বোন তো আমারও ছিল! ব্যস্, জামাইটা যদি বসে যায়, ওর বুনের চোখের জল তো আবারও ঝরবে! তখন....
বুঝেছি, সেদিন দীপকের চায়ের দোোকানে খবরটা দেখে ওকে দু-চার কথা বলিছিলাম। ও কিন্তু মোটেই খুশি হয়নি। ওর জায়গায় আমি থাকলে আমিও তো তাই করতাম!....হয়নি, আমার ওটা উচিত হয়নি।"
নিত্য এরকমই। মধুও সেটা জানে। কোনও অন্যায় করলে, আজও বাড়ি এসে সেকথা স্বীকার করে ও।
" ইস্, এটা না করলেেই পারতাম।" একথা একমাত্র নিত্যই বলতে পারে। অনুশোচনাবোধ ওর মধ্যে প্রবল। এমনই যদি সব মানুষের মধ্যে থাকতো!  নিত্যকে বর হিসেবে পাওয়াটাও তো ভাগ্যের!
মধু বললো, " শোনো, কিছু প্যাসেঞ্জার তো এখুনও আছে, যারা টোটো না, রিক্সাতেই চড়ে। তুমি যেমন হাতে পাচ্ছো, দ্যাখবা তাই দিয়েই আমাদের সংসারটা দিব্যি চলে যাবে। ঠোঙার অর্ডারটা এট্টু বেশি নেবো। ভোম্বলও এখুন আমার সাথে হাত লাগায়। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর ভোম্বলও সব বোঝে। ঐ-ই তো সেদিন বলছিল, " মা, বাবাকে ব'লো আমার বডি অয়েল লাগবে না।" তোমার আর অত চিন্তা করতি হবে না।"
ঘাড় নাড়ে নিত্য। ছেলেদুটো তার অবস্থা বোঝে, এই ভেবে আনন্দ হয়। আর এমন বউ পাওয়াও তো চাড্ডিখানি কথা না! নিত্য এটাও বুঝেছে, পরের সর্বনাশ চেয়ে কেউ কখনও ভালো থাকতে পারে না।
রিক্সার প্যাডেলে পা রাখলো  নিত্য।
স্ট্যান্ডে বিকাশকে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখলো নিত্য। রিক্সাটা পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে বিকাশকে বললো, " কতক্ষণ" ?
---- এই আধা ঘন্টা হল।
---- ভাড়া মেরেছিস?
---- একটা। ঐ বাজার পর্যন্ত।
---- ও...
---- বিড়ি আছে?
---- আছে।
নিত্য বিড়ি বার করে দেয়। বিকাশ বিড়ি ধরায় ।
---- তুমি খাবা না? ---- একটু আগেই খেলাম।
বিড়িতে টান দিয়ে বিকাশ বললো, " আবার সেই এক সমস্যা।"
---- কিসের?
---- ঐ যে টোটো বে-আইনি.... বোনটার কথা ভাবছি।
---- ওসব ভাবিস না। বে-আইনি বললেই হল! কতো লোক এর সাথে যুক্ত বলতো!
---- হুঁ, আমাকেও মালতী তাই  বলছিল।
মালতী বিকাশের বউ। অঙ্গনওয়ারিতে কাজ করে।
---- সবাই-ই তাই বলছে। বে-আইনি! ওরম গাড়ি তৈরির পারমিশন দিল কেন সরকার? তখন ভাবা উচিত ছিল।
---- সেই।
এর ভেতরে একটা প্যাসেঞ্জার পেয়ে নিত্য চলে গেল।
আজও সন্ধের মধ্যেই বাড়িতে ঢুকলো নিত্য। রিক্সাটা জামরুল তলায় রেখেই হাঁক পাড়লো, " মধু, মধু।"
কাগজে আঠা দিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মধু। বাইরে এসে দেখলো নিত্য এসে গেছে।
---- বলো, কি হল?
---- যে কোনও একটা খবরের চ্যানেলে দ্যাও, তো। খবরটা দ্যাখাচ্ছে।
---- আবার কি?
---- দ্যাও-ই না।
চব্বিশ ঘন্টা অন করতেই খবরটা দেখলো হেডলাইনে।
" টোটো বন্ধে সহানুভূতির বার্তা রাজ্যের"।
--- মানে?
কৌতূহলী প্রশ্ন মধুর।
---- হাইকোর্টের নির্দেশ মেনেও টোটোর সঙ্গে যারা যুক্ত সেইসব পরিবারের কথা চিন্তা করে সরকার তাদের অন্য কাজে যুক্ত করা যায় কি না ভাবছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন নবান্নে। কালকে মন্ত্রীসভার বৈঠক।
---- ইস্, তাই! এই খবরটা যদি আগে হত, হয়তো বীরপাড়া চা বাগানের ঐ লোকটা বেঁচে যেতো!
---- একদম ঠিক বলেছো। রোজগারের পথই যদি বন্ধ হয়ে যায়, মানুষ তখন হয় শকুন হয়ে মড়া খোঁজে, নয়তো নিজেই মড়া হয়ে অপেক্ষা করে শকুনের।
---- তুমি বিকাশকে একটা ফোন করো। ও একটু শান্তি পাবে।
---- আমি খবরটা শুনে রাস্তাতেই বিকাশকে ফোন করেছি। ও-ও নিশ্চয় এতক্ষণ খবরটা দেখে থাকবে।
---- এবারে সত্যিই এট্টু হাল্কা লাগছে।
---- আমারও। সবাই দুটো খেয়েপরে শান্তিতে থাকলেই তো ভালো লাগে।
---- ঠিক।
পড়া ফেলে ছোট ছেলেটা কোন ফাঁকে এসে বসেছে মধু আর নিত্য'র মাঝখানে। চুপচাপ ছিল। এবার সে মুখ খুললো, " বাবা, তুমার পাকা চুল তুলে দেবো, কতো করে দিবা? "
ওর কথা শুনে মধু, নিত্য কি বলবে ভেবে পেল না, দুজনেই হেসে ফেললো।
           -------------------



Monday, December 19, 2016

ধারাবাহিক গল্প............পারমিতা চ্যাটার্জী

দিয়ার ডায়েরীর  ২য় পর্ব

পারমিতা চ্যাটার্জী
দিয়ার মনের ঘরের জানলাটা প্রায় বন্ধ হয়েই গেছে মাঝে মাঝে ঝড়ের হাওয়ায় হঠাত নড়ে ওঠে, কালবৈশাখীর দমকা হাওয়া ঢুকে মনটা এলোমেলো করে দেয়, মনের অঙ্গনে সবুজ গাছগুলোতে জল ঢালার চেষ্টা করে, হয়তো অনেকদিনের অনভ্যাসের গলাটা গেয়ে ওঠে তার প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতের দু কলি,
' ...
“যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে
জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে।।
সব যে হয়ে গেল কালো, নিবে গেল দীপের আলো,
আকাশ পানে হাত বাড়ালেম কাহার তরে?
ঠিক সেই সময় কেউ দিয়ার মনের দরজা ছেড়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়, রাগত গলায় বলে ওঠে, ' কি ব্যাপার তুমি এখানে কি করছ? নীচে কত লোক এসেছে তেমায় সবাই খু্ঁজছে, যাও এখনি নীচে যাও',
দিয়া জানে তার স্বপ্নে সিঁড়ি ভেঙে গুড়িয়ে গেছে, তবু কি সে একটু অবকাশ পেতে পারেনা, এইতো সবাইকে গরম লুচি ভেজে আলুরদম করে খাইয়ে এলো, সবে গা ধুয়ে সন্ধ্যা বাতি দিয়ে মেয়েদের নিয়ে একটু বসেছে, তার মনের উঠোনের কোণে এখনও যে গাছগুলো সবুজ আছে তাতে একটু জল দিতে, তা নইলে যে গাছগুলো শুকিয়ে এবার খড় হয়ে যাবে।
কি আর করা যাবে নীচে অনেক লোক এখন উত্তর দিতে গিলে আরও দেরী হয়ে যাবে, তাই মনের রাগ মনেই চেপে রেখে রেখে মেয়েদের পড়তে বসিয়ে নীচে নেমে আসতে হল।
নীচে এসে দেখে তার তিন শ্বশুর লাইন দিয়ে বসে আছে 

রানাঘাট থেকে তাদের মাসতুত ভাইয়ের মেয়ে জামাই এসেছে, কর্তা বেড়িয়ে মাছ মাংস মিষ্টি সব নিয়ে এলো, অতিথি নারায়ণ, তাদের ত্রুটি হওয়া চলবেনা, আাবার একপ্রস্ত লুচি ভাজা হল,আলু বেগুন ভেজে মিষ্টি দিয়ে তাদের দেওয়া হল, কাজের একটা মেয়ে ছিল রেবতী বলে তার সাথে গিয়ে তিন তলা থেকে বিছানা নামিয়ে এনে একতলায় সোবার ব্যাবস্থা করে দেওয়া হল, এদিকে মেয়েদের পরীক্ষা ওদের পড়তে বসিয়ে দিয়ে এসেছে, বাড়ীতে পনেরো দিন হল ঠাকুর নেই, এতোগুলো লোকের রান্না সমানে করে যাচ্ছে দিয়া তার মধ্যে নিত্য পূজা, অসুস্থ শ্বশুরের নিয়মিত সেবা, বাকী যে দুজন অবিবাহিত জ্যাঠশ্বশুর আছে তাদের এক এক সময় এক এক রকম খাওয়া তার মধ্যে মেয়েদের পড়াশোনা সব করতে গিয়ে দিয়ার মনে হল মনের উঠোনে যে সবুজ গাছ গুলো এখনও বেঁচে ছিল তা বোধ হয় এবার সত্যি শুকিয়ে খড় হয়ে গেল, আর বোধহয় তাদের বাঁচিয়ে রাখা যাবেনা, কিন্তু দিয়ার অদম্য প্রয়াস তাদের একটু হলেও বাঁচিয়ে রাখতেই হবে সব কর্তব্যের মাঝে।

প্রতিদিনের কর্তব্য অকর্তব্যের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে দিয়া যেন সংসারের এই বিপুলতায় ক্রমশ হারিয়ে যেতে লাগল, এক এক সময় নিজের মনের দরজাটা নিজেই বন্ধ করে, অশান্ত মনটা একটু আশ্রয় খুজে বেড়ায় একটু ভালোবাসার আশ্রয়, বাপেরবাড়ী গেলে বাবা মা ঘিরে রাখে তাদের অসীম স্নেহ আর ভালোবাসার সিক্ত রসে, কিন্তু তার মধ্যেও একটা শাসনের সুর যেন থেকেই যায়, গায় মাথায় হাত বুলিয়ে মা ওই এক কথাই বলেন, মানিয়ে নিতে হয় মা, কত মেয়ের কত যন্ত্রণা কত কষ্ট তবু তো... তারা যুদ্ধ করে চলে, মা কে শুধু একটা কথা বলেনি দিয়া, আগামীর দিয়ারা আজকের দিয়াদের সব অপমানের প্রতিশোধ নেবে, তারাই জবাব দেবে নারী শক্তি কত তীব্র কত শক্তিশালী কতদিন আর তাদের দাবিয়ে রাখবে, এবার তো রুখে দাঁড়াবার সময় হয়ে গেছে। ওই অত্যাচারী বেশীর ভাগ বৃদ্ধ শ্বশুররা তাদের বার্দ্ধক্যের সুযোগ নিয়ে কত মেয়ের সুন্দর সোনালী জীবন অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছেন তার কোন ইয়ত্তা নেই, দিয়াও তার ব্যাতিক্রম নয়।
তবু দিয়া ফাগুন সন্ধ্যায় দক্ষিণের বারন্দায় দাঁড়িয়ে কল্পনার সাগরে সাঁতার কাঁটত, মনে মনে ভাবত একদিন হয়ত পূর্ণিমার চাঁদ তার জানলায় হাসবে, বারন্দার কোণে যূথি ফুলের গন্ধ ভাসবে, আধো জাগরণ আধো তন্দ্রার ঘোরে তার মনের মানুষ কাছে আসবে, সব কালো ঘুচে গিয়ে নতুন ভোরের আলোয় সে স্নান করবে,
সত্যি কি এই স্বপ্ন সফল হয়েছিল দিয়ার জীবনে? শুনি দিয়া কি বলে, দিয়া বলছে মাঝরাত্রি অবধি মেয়েদের পড়ার প্রশ্ন উত্তর লিখে ওদের মাথার কাছে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি, ভোর হতে না হতে দরজায় ধাক্কা, দরজা খুলে দেখি শ্বশুর মশাই দাঁড়িয়ে আছেন, আমায় বললেন উঠে পড় গুরুদেব এসেছেন না? চা করতে হবে তো? হ্যা বাবা এখুনি আসছি বলে কোন রকমে বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে বাসি কাপড় বদলে রান্নাঘরে ঢুকলাম, তাড়াতাড়ি করে গুরুদেবের ভালোপাতার চা করে টিপটে ভিজিয়ে প্লেটে নানারকম বিস্কুট সাজিয়ে উনার পূজা শেষ হবার 
অপেক্ষায় বসে রইলাম, কখন তিনি দরজা খুলবেন, দরজা খুলে গুরু শিষ্যকে চা দিয়ে বেড়িয়ে দেখলাম আরও দুজন শ্বশুর মশাই মানে দুজন অবিবাহিত জ্যাঠশ্বশুর তারাও এসেও উপস্থিত হয়েছে, ততদিনে দুই সন্তানের মা সময় অনেকটা গড়িয়ে গেছে, ভালোবাসার পাবার আকাঙ্খাও ডুবে গেছে অতৃপ্ত স্বপ্ন সাগরে, তাই অন্তরের সুপ্ত বাসনা সুপ্ত থেকে গেল, স্বপ্ন ঘরের দরজাটায় আপাতত তালা লাগিয়ে পরবর্তী হুকুম তামিলের জন্য তৈরী হলাম। বড় মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে ছোট মেয়ের দুধের বোতল ফোটাতে গিয়ে বোতলটা গলে গেল, বড়ননদ গুরুদেব এসেছেন বলে সপরিবারে বাপেরবাড়ী আছে, বৌদি মধ্যবিত্ত বাড়ীর মেয়ে তাকে যখন যা ইচ্ছে তাই বলে অপমান করা যায়, আমাাকে তাই বলতে একটিও দ্বিধা করলনা যে ' বাবার পয়সা গুলো কি ভাবে নষ্ট হয়, একটু দেখে ফোটাতে পারিস না বোতলটা গলে গেল', তখন বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেছে আগের মতন সব সহ্য করে নিতে পারিনা, বিশেষ করে যখন জানি বেশ কিছু দধের বোতল আর দুই মেয়ে আর আমার জন্য প্রচুর প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমার দিদি আমার বাবা মায়ের হাত দিয়ে আমেরিকা থেকে পাঠিয়েছে, তাই আমিও উত্তর দিয়েদিলাম এগুলো আমার দিদি পাঠিয়েছে, বাবার পয়সায় কেনা নয়, যাই হোক এই ভাবেই প্রতিটা দিন যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল।

                                                                 ক্রমশ---


ধারাবাহিক গল্প.........নারায়ণ রায়

আমার না বলা কথা (5)
নারায়ণ রায়

এই তেঁতুলিয়া গ্রামে থাকার সময় আমার ইছামতী নদীর সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়। সেদিন আমার মনে হয়েছিল যে একটা নদীরও যেন প্রান আছে। তারও যেন সুখ আছে দুখ আছে, আনন্দ আছে অনুভুতি আছে। এই দেখি ভাঁটার সময় নদীর শীর্ন প্রবাহ উত্তর থেকে দক্ষিনে প্রবাহিত, আবার কিছুক্ষন পরেই জোয়ার এসে স্ফীত নদীর দুকুল ভাসিয়ে দক্ষিন থেকে উত্তরে ধাবিত। কত রকমের নৌকো, তার কত রকমের যাত্রীসেই যুগে ওই সব এলাকায় জলপথই ছিল যোগাযোগের একমাত্র পথ। তখনও বসিরহাট থেকে তেঁতুলিয়া বাস চালু হয়নি, তাই নদী পথই এক মাত্র ভরসা।
জন্মের পরেই ২১ দিনের মাথায় ষষ্ঠী পুজোয় মা তার সন্তানকে নিয়ে এসে নদীতে চান করে নবজাতকের মাথা নদীর জলে ধুয়ে নিয়ে যেত। এলাকায় কোন বিয়ে হলে, বিয়ের দিন সকালে বাড়ির বউরা লাইন দিয়ে শাঁখ বাজিয়ে নদী থেকে ঘট ভরে জল নিয়ে যায়, আবার বিয়ের পরদিন ওই নদী পথেই সানাই-তাসা বাজিয়ে পাড়ার মেয়ে অশ্রু সজল নয়নে শ্বশুর বাড়ি যায়। পুজোর শুরুতে পুরোহিত মশাই ঐ নদীতেই কলাবৌ কে স্নান করিয়ে নিয়ে যায় আবার দশমীর দিন ঐ নদীতেই মাকে চোখের জলে ভাসিয়ে দেয়। আর সর্বংসহা নদীর যেন এসবে কোন হেল দোল নেই। ওই বয়সে একটা জিনিস দেখে আমার খুব মজা লাগতো, সেটা হল নদীতে বাঁশ নিয়ে যাওয়া। কোন নৌকো নেই হাজার হাজার বাঁশ একত্রিত হয়ে ভেসে চলেছে, তার এক কোণে একটা ছাউনি। যেন একটা চলন্ত দ্বীপের মধ্যে একটি ঘর। আর দ্বীপটির উপর লোকজন ঘোরাঘুরি করছে, রান্না বান্না হচ্ছে। তখন মনে হত ইস্ ওরা কত সুখী, আমি যদি ওদের মত ভাসতে ভাসতে কোন নীলপরী বা লালপরীর দেশে চলে যেতে পারতাম যেখানে পড়াশোনা নেই শুধু আনন্দ আর আনন্দ!
তবে নদী মানেই শুধু আনন্দ নয়। নদী বহুল এলাকায় প্রায় সব শ্মশানগুলি নদীর ধারে। আর এই ইছামতীর ধারেই সেই বয়সেই আমি জীবনে প্রথম দেখেছিলাম কি ভাবে একটি মানব দেহ প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুন্ডে ধীরে ধীরে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়।
তখন নদীতে খুব বেওয়ারীশ লাশ ভেসে আসতো, সেগুলি আমাদের বাড়ির কাছে কোন গাছের শিকড় বা কোন কিছুতে আটকে গেলে বিশ্রী গন্ধে পুরো এলাকার লোক ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ত। বাবার অফিসের কেউ তখন নাকে মুখে গামছা বেঁধে একটা বাঁশ নিয়ে ঐ লাশ টাকে দূরে ঠেলে দিত। কত রকমের মৃতদেহ, নারী, পুরুষ, শিশু, কোনটা চিত হয়ে কোনটা উপুড় হয়ে, কোনটা সদ্য মৃত, কোনটা আবার এতটাই বিকৃত যে নারী, পুরুষ নাকি শিশু বোঝাই যায় না।
কখনো কখনো নদীতে একটা আদ্ভুত দৃশ্য দেখতাম। সেইযুগে ওই সব অঞ্চলের লোকেরা কেউ সাপে কামড়ানো মানুষের সৎকার করত না। একটা অদ্ভুত সংস্কারের বশবর্তী হয়ে মৃতদেহ একটা কলা গাছের ভেলায় বিছানা করে শুইয়ে দিয়ে, চাদর ঢাকা দিয়ে, মশারী খাটিয়ে, এমন ভাবে ভাসিয়ে দিতেন যেন মনে হত, পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোতে ঘুমোতে কেউ তার গন্তব্য স্থানের দিকে চলেছেন।
তেঁতুলিয়ার আর একটা জিনিস আমি আজও ভুলতে পারিনি সেটা হ, ওই বিলবল্লির খাল দিয়ে তাল গাছের ডিঙ্গিতে চড়ে যাতায়াত করা। শহরতলিতে যেমন প্রত্যেক মধ্যবিত্তের বাড়িতে একটা করে সাইকেল থাকে ঠিক তেমনই ওই এলাকায় প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতে একটা করে তাল গাছের ডিঙ্গি নৌকো বাড়ির কাছে ঘাটে বাঁধা থাকতো। আর সেটা চেপেই সবাই এখানে ওখানে যাতায়াত করে নিজের কাজকর্ম সেরে নিতেন। আমাদের প্রাইমারী স্কুলের পাশেই ছিল হাইস্কুল, সেই স্কুলের অনেক ছাত্রই ঐ রকম নিজে নিজে ডিঙ্গি বেয়ে স্কুলে আসতো। আমার বাবার এক সহকর্মী হরিপদদা ওই রকম ডিঙ্গি বেয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। হরিপদ দা একবার আমাকে তার ডিঙ্গিতে চাপিয়েছিলেন কিন্তু ডিঙ্গিটা এত নড়বড় করছিল যে মনে হচ্ছিল এই বোধহয় ডুবে যাবে। তার পর থেকে আমি আর কোন দিন চাপিনি।
তখন ঐ সুদুর গ্রামাঞ্চলে সাধারন মানুষ বরফ কাকে বলে জানতোই না। সাধারনত জেলেরা মাছ ধরে দিনে দিনেই স্থানীয় হাটে বিক্রি করে দিত। তবে ইলিশ মাছ ধরতে অনেক দূরে যেতে হত তাই দিনে দিনে বিক্রি করা সম্ভব নয়। সেজন্য ইলিশ মাছ কেটে নুন হলুদ মাখিয়ে একটা কলসির মধ্যে রেখে মুখটা ভালো করে বন্ধ করে রাখতো। দশ পনের দিন বা এক মাস পরে যখন ফিরতো তখন আমরা ওই নৌকো থেকেই ওদের কাছ থেকে মাছ কিনতাম। ওইগুলোকে নোনা ইলিশ বলতো, এক টাকায় ৫/৬ পিস দিত। মা প্রথমে মাছটা কিছুক্ষন গরম জলে ডুবিয়ে রেখে ওর নুন হলুদটা ধুয়ে নিতেন তার পর রান্না করতেন সেই স্বাদ যেন এখনো মুখে লেগে আছে। তখন ৮/৯ বছর হল ভারত সদ্য স্বাধীন হয়েছে এবং দ্বিখন্ডিত হয়েছে। তবে তখনো ভারত আর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সীমানায় কোন কড়াকড়ি ছিল না।
তেঁতুলিয়া থেকে সামান্য দূরে গেলেই সীমান্ত। একবার বাবার সঙ্গে তাঁর এক সহকর্মীর বাড়িতে গিয়েছিলাম। কলা পাতায় মুড়ি আর বাতাসা খেতে দিয়েছিলেন তার পর গাছ থেকে ডাব পেড়ে ডাবের জল। ভদ্র লোকের নাম ছিল হাজারি বাবু। কথা প্রসঙ্গে জানলাম যে মাত্র আধ মাইল দূরে ঐ গ্রামটাই পাকিস্তান। আমাদেরকে কিছুতেই ভাত না খাইয়ে ছাড়বেন না তাই তিনি তার ছেলেকে পাঠাবেন পাকিস্তানের ঐ গ্রাম থেকে মুরগী কিনে আনতে। অমনি আমিও বায়না ধরলাম যে আমিও দাদার সঙ্গে ফরেন দেখতে যাব। কয়েক পা গিয়েই দেখলাম, ঠিক রাস্তার ধারে যেমন মাইল পোস্ট থাকে, বেশ কিছটা দূরে দূরে তেমনি মাইল পোস্টের মতো শিল পোঁতা আছে তার এদিকটায় লেখা ইন্ডিয়া আর ওদিকটায় লেখা পাকিস্তান। আমরা ওই শিলার ওপারে যেতেই ওই দাদাটি বলল ...... “এই দ্যাখ আমরা এখন ফরেনে পৌছে গেছি, আমরা এখন পাকিস্তানে, কিন্তু আমি মোটেও খুসি হলাম না, ভাবলাম এ আবার কেমন ফরেন?
আর কয়েক পা যেতেই আমরা একটা গ্রামে এসে পৌছলাম। সবাই বেশ নিম্নবিত্ত। অতি সাধারন ছিটে বেড়ার ঘর, দু-তিটে বাড়ি আর কিছুটা ঝোপ ঝাড় পার হয়ে আমরা একটা বাড়ির সামনে আসতেই আমার ওই দাদাটি চিৎকার করে ডাকতে লাগলো... কই গো চাচি বাড়িতে আছো? এক জন অতি শীর্ন চেহারার মাঝারি বয়সের ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এসে এক গাল হেসে বললেন... কে ভোলা এলি? তা তুই গত রবিবারে এলি না কেন ? তোর জন্য চারটে হাঁসএর ডিম রেখেছিলাম! তারপর আমার দিকে তাকিয়ে আমার থুতনিতে হাত দিয়ে বললেন,  এই চাঁদপানা ছেলেটা কে রে ? ভোলাদা বললো ... ও আমার বাবার অফিসারের ছেলে...একটা ভাল দেখে মুরগী দাও তো ?” আসলে মুরগী সকালে ছেড়ে দেয়া হয় তারা এখন চরে বেড়াচ্ছে, তাই এত বেলায় হঠাৎ মুরগী ধরা খুব মুসকিল। কিন্তু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চাচি বাড়িতে রাখা দুটো ডাব কেটে আমাদেরকে খেতে দিয়ে, বারান্দায় একটা খেজুরপাতার চাটাই পেতে আমাদের বসতে বললেন। তারপর হাতে এক মুঠো ধান নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই চাচি একটা হৃষ্ট পুষ্ট মোরগ নিয়ে ফিরে এলেন। তখন জ্যান্ত এক সের মত ওজনের একটা মোরগের দাম ছিল দেড় টাকা থেকে দু টাকার মত। এখন ভাবি ইস্ আজও যদি ভারত আর বাংলাদেশের সীমানাটা ঐ রকমই থাকত। ঠিক ওই ভাবেই যদি আমরা যাতায়াত করতে পারতাম !! 
আগেই বলেছি যে প্রায় প্রতিদিনই অফিস থেকে হোটেলে ফেরার পথে হেঁটেই ফিরতাম, তবে যেদিন আমার পুরানো কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে কফি হাউসে যাওয়ার কথা থাকত সেদিন ওয়েলিংটন থেকে বাঁদিকে নির্মল চন্দ্র স্ট্রিট ধরে সোজা হেঁটে কফি হাউসে যেতাম। সামান্য একটু এগলেই ডান দিলে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার আর বাঁদিকে ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের বাড়ি। এখন যেমন এক পয়সা দামের নেতারাও লালবাতি লাগানো দামি গাড়িতে পারিষদবর্গ নিয়ে ঘুরে বেড়ান, তখন সেরকমটা ছিল না, এম এল এ রা সাধারন মানুষের মতোই পায়ে হেঁটে ঘোরাফেরা করতেন। আর মন্ত্রীদের একটা করে এম্বাসাডর গাড়ি থাকতো, তখন সব এম্বাসাডর গাড়িরই রং ছিল কালো। তবে যেসব এম এল এ বা মন্ত্রীরা কিছুটা বিলাশবহুল জীবন যাপন করতেন, আসলে তারা বংশগত কিম্বা পেশাগত ভাবেই বড় লোক ছিলেন, পশ্চিম বাংলায় রাজনীতিবিদরা তখন চুরি কাকে বলে জানতেন না। আসলে দেশে রাজনীতির এত বাড় বাড়ন্ত ছিলনা, মানুষ রাজনীতির ব্যাপারে বেশ উদাসীন ছিল।
এর সব চেয়ে বড় কারণ দেশে এত বেকার ছিল না, একটা মানুষ যদি রাজনীতিবিদদের তৈলমর্দন না করেই খেয়ে পরে স্বাধীনভাবে বাচঁতে পারে তাহলে সে কেন নেতাদের তৈলমর্দন করতে যাবে? অর্ধেক লোকের বাড়িতে রেডিও ছিলনা, মোটামুটি বাংলায় তিনটে চালু খবরের কাগজ ছিল, আনন্দ বাজার, যুগান্তর আর বসুমতী, এর মধ্যে আনন্দ বাজার বড় বড় করে লিখত দৈনিক লক্ষাধিক প্রচারিত”, তার মানে বুঝতেই পারছেন যে তখন সমস্ত বাংলা সংবাদ পত্র গুলির মিলিত প্রচার সংখ্যা ছিল হয়তো দুই লক্ষের মত। আর এখন সেটা বোধ হয় ত্রিশ লক্ষের মত, তার উপর আপনি আমি চাই বা না চাই, বেসরকারী টি ভি চ্যানেল গুলোর সারাদিনের কাজ হচ্ছে , রাজনৈতিক নেতারা কেমন করে ভাত খাচ্ছেন, কেমন করে তারা প্রেম করছেন প্রতিনিয়ত তা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া। তখন এসব ছিল না।
আমি যে সময়ের কথা বলছি ততদিনে ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় মারা গেছেন প্রায় দশ বছর হয়ে গেছে, তবু ঐ বাড়িটার সামনে এলেই আমার একটা অদ্ভুত অনুভতি হত। এই সেই বাড়ি, যেখানে বাংলার রূপকার থাকতেন, অতি সাধারন একটি ত্রিতল বাড়ি। পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে একদিকে যখন ওপার বাংলা থেকে আসা এককোটি শরনার্থীর দায়িত্ব নিয়ে নতুন বাংলাকে গড়ে তুলছেন, অন্যদিকে একই সঙ্গে চিকিৎসক হিসেবে নিয়মিত দরিদ্র রোগীদের সেবাও করে চলেছেন। মানুষ বিখ্যাত হলে তার সম্মন্ধে অনেক মিথ তৈরী হয়, যেমন তিনি নাকি রোগীর মুখ দেখেই তার কি হয়েছে বলে দিতে পারতেন, আমি সেসব বিশ্বাস করি না, কিন্তু এক জন মানুষের মৃত্যুর ৫৩ বছ র পরেও যেদিকে তাকাই সর্বত্র তার স্পর্শ। দুর্গাপুর, কল্যানী, বিধান নগর, হলদিয়া, হরিনঘাটা , সি এস টি সি, দন্ডকারন্য। তিনি চেয়েছিলেন আন্দামানকে আর একটা বাংলাভাষী রাজ্য গড়ে তুলতে কিন্তু এক শ্রেনীর নেতাদের বাধায় তা সম্ভব হয়নি। খড়গপুর আই আই টি, কল্যানী এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আর কত বলবো ?
বিধান রায় বিদেশে গিয়ে দেখেন যে পড়ার কোন বয়স নেই, এমন কি বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারির মত কোর্সও রাত্রে পড়া যায়। কোন ছাত্র হয়তো কোন কারনে অল্প বয়সে পড়াশোনায় তেমন সুবিধা করতে পারেনি তাই ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা কিম্বা মেডিক্যাল-এ ফার্মাসী কিম্বা নার্সিং কোর্স করেই চাকরি করতে বাধ্য হয়েছেন । পরবর্তী কালে তিনি ইচ্ছে করলে রাত্রে আবার পড়াশোনা করে পুরোপুরি ইঞ্জিনিয়ার কিম্বা ডাক্তার হতে পারবেন। ডাঃ রায় দেশে ফিরে যাদবপুরের তৎকালীন রেক্টর ডঃ ত্রিগুনা সেনকে ডেকে আলোচনায় বসলেন এবং ইউ জি সির সঙ্গে কথা বলে, ভারতবর্ষে প্রথম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাত্রে ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চালু করলেন। আপনাদের অনেকের কাছে আজকের এই পর্বটি তেমন ভাল হয়তো নাও লাগতে পারে। কিন্তু আজ আপনাদের কানে কানে একটা গোপন কথা বলতে চাই, সেটা হল এই লেখাটার মাধ্যমে এই অধম আসলে সেই প্রনম্য মানুষটির প্রতি আমার ঋণের কিছুটা শোধ করার চেষ্টা করলাম। কারন সেই ডাঃ রায়ের জন্যই আমি পরবর্তী কালে আবার নতুন করে পড়াশোনা করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি,, পাশ করি। 
নতুন চাকরিতে যোগদান করার পর দুই সপ্তাহ কেটে গেছে, মাত্র দু সপ্তহেই বাবা মা ভাই বোনেদের ছেড়ে থেকে এবার যেন একটু হোম সিক হয়ে পড়েছি। আসলে ইচ্ছে করলেই যখন ৩/৪ ঘন্টার মধ্যে তাদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া যায়, তখন যাই না একবার ঘুরে আসি! ঠিক করলাম শুক্রবার ঝাড়গ্রাম যাব। রাত্রি ৯ টা নাগাদ বাড়ি পৌছলাম। বাড়ির সবাই তো অবাক, অবশ্য আমার বাবার মধ্যে বরাবরই উচ্ছ্বাসের বর্হিপ্রকাশটা খুব কম। তবে মা খুব খুসি আমাকে দেখে, ছেলে চাকরি করে প্রথম বাড়ি ফিরলো। পরদিন সকালে গেলাম ডাঃ অমল চ্যাটার্জ্জীর বাড়ি। তখন জেরক্স ছিলনা কোথাও চাকরির দরখাস্ত করতে গেলে মার্কসিট সার্টিফিকেট এসব কার্বন কপি করে কোন গেজেটেড অফিসার কে দিয়ে এ্যাটেস্টেড করাতে হত। ডাঃ চ্যাটর্জ্জী ছিলেন ঝাড়গ্রামের মহকুমা হেলথ অফিসার আর ওনার অফিসটা ছিল আমাদের বাড়ির ঠিক সামনে। গেলেই হাসিমুখে এ্যাটেস্টেড করে দিতেন। এই ডাঃ চ্যাটর্জ্জীর আর একটা পরিচয় ছিল উনি বিখ্যাত চলচিত্র অভিনেতা অনিল চ্যাটার্জ্জীর নিজের বড় দাদা।
এক সময়ে সামরিক বাহিনীতে চাকরি করা অকৃতদার এই ভদ্রলোক অফিসের কাজের বাইরে সারাদিন শুধু রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতেন আর নিজের হাতে রান্না করতেন। আমার চাকরির খবরটা আগেই বাবার কাছে শুনেছেন। আমাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানালেন, বললেন মন দিয়ে কাজ করতে, আর বললেন “ First Love Your Job, Then Enjoy it & Ofcourse be Honest.” সারাদিন বেশ হৈ হৈ করে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করে দিনটা কেটে গেল। আমার বন্ধু অশোক মহান্তির সম্পাদনায় আমরা তখন শালপাতানামে ঝাড়গ্রাম থেকে একটা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করতাম। ঠিক হল আমি হাজারো কাজের মধ্যেও মাসে দুবার করে এসে সময় দেব, এবং লেখা দিয়ে যাব। মাত্র দুশ কপি ছাপা হত কিন্তু তার-ও বিজ্ঞাপন যোগাড় করা, এবং বিক্রয় করা যে কি কঠিন কাজ, সেটা এক মাত্র ভুক্তভোগিরাই জানেন। তাই অনেক চেষ্টা করেও আমি কলকাতায় চলে আসার পর পত্রিকাটির আয়ু ছয় মাসের বেশী বর্ধিত করা সম্ভব হয়নি। কলকাতা কর্পোরেশনের চাকরিতে যোগদান করার আগে আমি কিছুদিন ঝাড়গ্রাম থেক প্রায় ৩০ মাইল দুরে বেলপাহাড়ি নামে একটি মনোরম স্থানে একটা সরকারী অফিসে কিছুদিন ঠিকাদারির কাজ করেছিলাম। সে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। হটাৎ চাকরি পেয়ে কলকাতা চলে যাই তাই সেখানে কিছু অসমাপ্ত কাজ ছিল সেগুলো শেষ করার একটা ব্যবস্থা করতে হবে, তাই রবিবার সকালেই বেলপাহাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বাসে বেলপাহাড়ি যেতে ঘন্টা দেড়েক লাগে, কিন্তু বেলপাহাড়ি তে নেমে আর-ও তিন চার মাইল পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটতে হত। 
ঝাড়গ্রাম থেকে সোমবার সকালে সোজা অফিসে এলাম, সেই একই পরিবেশ, বসার জায়গার অভাব, আমাদের কারও কোন নিদ্দির্ষ্ট বসার জায়গা ছিল না। একটা বড় টেবিল, আর তার চারিদিকে কয়েকটা চেয়ার। একেবারে মিউজিক্যাল চেয়ার। কাজও নেই তেমন। রোদে রোদে কতই বা ঘুরবো ? কতই বা সিনেমা দেখবো? সবার নিজের নিজের বাড়ি আছে কিন্তু আমাকে তো গিয়ে ঐ তিনতলার ছাদে এসবেসটসের ছোট্ট জেলখানার সেলে গিয়ে সিদ্ধ হতে হবে?
র্পোরেশনের যে বিল্ডিংটায় আমরা বসতাম অর্থাত হগ বিল্ডিং তার নীচেই নিজাম হোটেল, ওখানকার সিক্কাবাব খুব বিখ্যাত ছিল। নীচে সারাদিন ধরে হাজার হাজার সিক্কাবাব তৈরী হ, আর ঠিক তার উপরে ঐ চোঁয়া গন্ধে এবং ধোঁয়ায় আমাদের প্রান ওষ্ঠাগত হয়ে উঠত। পিছন দিকের জনলা থেকে আমরা সব দেখতে পেতাম। কত রকমের খাবার তৈরী হত সারাদিন ধরে। তবে আমি কোন দিন নিজাম হোটেলের সিক্কাবাব খাইনি, আসলে তখন আমার অতো পয়সাও ছিলোনা, তাছাড়া নিজাম হোটেলের পরিবেশটা আমার একদম ভালো লাগতো না। সারা দিনে টিফিনের পিছনে দুটাকার বেশী খরচ করলে পরদিন হিসেব করে চলতে হত। অবশ্য পাশের ফুটনানী চেম্বারের এক তলায় আমীনিয়া রেস্তোরায় বেশ কয়েকবার টিফিন করেছি...। ওদের আমীনিয়া স্পেশাল নামে একটা ডিস ছিল, এক পিস মাটন, এক পিস ডিম, এক পিস গোটা আলু, এক পিস গোটা পিঁয়াজ এসব দিয়ে একটা স্ট্যু মত, সঙ্গে পাউরুটি আলাদ করে কিনতে হ, সব নিয়ে বোধ হয় দুটাকার মত দাম পড়ত।
তবে বেশীর ভাগ দিন আমি এলিট সিনেমার পশ্চিম দিকের গলির ভিতরে কয়েকটা খুব সাধারন খাবারের দোকান ছিল ওখানেই টিফিন করতাম। পঞ্চাশ পয়সায় ঘুগনী পাউরুটি, কিম্বা ডিম-পাউরুটি অথবা তেলেভাজা মুড়ি। পিছনের জানালা দিয়ে যেমন সিক্কাবাব তৈরী দেখা যেত, সামনের জানলা দিয়ে ঠিক তেমনই রাস্তার ওপারেই মিনার্ভা সিনেমা (এখন নাম হয়েছে চ্যাপলিন)। তখন সিনেমা হল গুলির খুব রম রমা, নতুন কোন ছবি এলেই মার মার কাট কাট ভীড় হ, জানালা দিয়ে দেখতাম ব্লাকাররা চিৎকার করত দো-কা-দশ, দো-কা-দশ, মানে দুটাকার টিকিট দশ টাকা।
ওই সময়ে ওই হলে রিলিজ হওয়া একটা সিনেমার নায়িকার নাম ছিল জয়শ্রী টি’, এই নামটা বেশী করে মনে থাকার একটা কারণ আছে। তখন আমাদের সবার বয়স ২৩-২৪-২৫, স্বাভাবিক ভাবেই ঐ বয়সে একটু বালখিল্যেপনা তো থাকবেই। আমাদের অফিসে এক জন মহিলা কর্মচারী ছিলেন তিনি বেশ গুরুত্বপুর্ণ পদে চাকরী করতেন, খুব সম্ভব বড় সাহেবের পি এ ছিলেন। তাই আমাদের উপর বেশ গার্জেনগিরি ফলাতেন। তারও নাম ছিল জয়শ্রী, ৩৫/৪০ বছরের ঐ ভদ্রমহিলা বেশ রোগা এবং একটু ট্যারা ছিলেন তাই আমরা তার নাম দিয়েছিলাম জয়শ্রী টি।মানে জয়শ্রী ট্যারা,” এমন কি মাঝে মাঝে ওনার সামনেও জয়শ্রী টি কথাটা এমন ভাবে উচ্চারণ করতাম যেন উনি শুনতেন জয়শ্রী দি।
মাত্র কয়েক বছর আগেও যেমন ময়দানে বইমেলা,, লেদার এক্সপো,,হ্যান্ডিক্রাফট ফেয়ার এই সব হোত, তখন তেমনি বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে প্রায় এক মাস ধরে একটা মেলা বসত, নাম ছিল বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন
আর আমার সময় কাটানোর পক্ষে এই মেলাটা ছিল একটা দারুন ব্যবস্থা। প্রতিদিন অফিস ছুটির পর আমরা দু-তিন জন একটা করে পচিশ পয়সার টিকিট কেটে মেলায় ঢুকে পড়তাম। এমন কি সঙ্গী সাথী না থাকলে আমি একাই যেতাম। এমনিতে আর পাঁচটা মেলা যেমন হয় তেমনই, চারিদিকে বিভিন্ন দোকানের সারি, নাগোরদোলা সহ বিভিন্ন রাইডস। তবে মেলার মাঝখানে একটা বেশ বড় মঞ্চ তৈরী করা হত, যাতে এক সঙ্গে তিন চার হাজার লোক বসে অনুষ্ঠান দেখত পারত।
আর এই মঞ্চে প্রতিদিনই কোন না কোন আসাধারণ সব উচ্চ মানের অনুষ্ঠান হত। মাত্র পচিশ পয়সার বিনিময়ে উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সব বিখ্যাত নাটক, বিখ্যাত সব গীতিনাট্য এই ধরনের আনুষ্ঠান কিছু না কিছু প্রতিদিনই হত। একমাত্র কিশোরকুমার ছাড়া সব বাঙ্গালী সঙ্গীত শিল্পীর আনুষ্ঠান আমি এখানেই দেখেছি। ভাবা যায়? একই মঞ্চে একদিকে যখন শ্যামা, বজ্রসেন, উত্তরীয়, কোটালের ভুমিকায় অলকানন্দা রায় (?) বা শম্ভু ভট্টার্চায্যের মত নৃত্য শিল্পীরা নৃত্যের মাধ্যমে তাদের অভিনয়কে প্রানবন্ত করে তুলছেন তখন তাদের মুখে ভাষা যুগিয়ে চলেছেন ঐ মঞ্চে বসেই হেমন্ত, কনিকা, সন্তোষ সেনগুপ্ত, বা সুমিত্রা সেন ?
আজ ও মনে পড়ে দেবব্রত বিশ্বাস একে একে গেয়ে চলেছেন...... আজ তোমারে দেখতে এলেম... তোমার পুজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি...... কেন চেয়ে আছো গো মা...... এবং দুটি বা তিনটি গানের মধ্যে একবার করে বিশ্রাম নিয়ে ইন-হেলার নিয়ে নিচ্ছেন। যে জর্জদা তারঁ শুদ্ধ উচ্চরণের জন্য বিখ্যাত, শোনা যায় তাঁর উচ্চারণ থেকেই নাকি স এবং শ-র কিম্বা ন এবং ণ-র তফাৎ বোঝা যায়, সেই জর্জদা কিন্তু মঞ্চে  যখন কথা বলতেন এক্কেবারে ঢাকাইয়া ভাষায়। জর্জদাকে পরে আমি আর একবার মাত্র রবীন্দ্র সদনে গাইতে দেখেছি কোনদিনই আমি তাকে নিজেকে হারমোনিয়াম বাজাতে দেখিনি দুবারই ওনার সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজাতে দেখেছি মায়া সেনকে, আর উনি খালি গলায় গেয়ে যেতেন। কোন দিন আবার মান্না দে শুরু করলেন......না চাহিলে যারে পাওয়া যায়......দশ বারো খানা গান গেয়ে শেষ করলেন...... শাওনো রাতে যদি.......দিয়ে। তবে এদের প্রত্যেককেই এর আগে কিম্বা পরে অন্য কোন অনুষ্ঠানে আবার দেখার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু এক জনকে আমার জীবনে একবারই শুধু এই অনুষ্ঠানে দেখতে পেয়ে আমার দু চোখ ধন্য হয়েছিল, তিনি ভারতের সঙ্গীতের কর্তা...... শচীন দেব বর্মন। গরদের পাঞ্জাবী আর ধুতি পরে যেন সজ্ঞীতের সম্রাট এসে বসলেন। একে একে শুরু করলেন ......তোরা কে যাস রে ভাটি গান গাইয়া... কিম্বা ...টাকডুম টাকডুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল...। পিছন থেকে চিৎকার গাইড গাইড, আরাধনা আরাধনা......। কর্তা তার কুমিল্লার ভাষায় বললেন, না না এইহানে ফিলিমের গান গাইতে কইবেন না, ফিলিমের গান গামু না।



                                                ক্রমশঃ

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া