Friday, December 23, 2016

গল্প.........সুজয় চক্রবর্তী

লুঙ্গি প্যান্টের জীবন

সুজয় চক্রবর্তী

পাছায় একটা আধলা ইঁঁট দিয়ে দুপা ফাঁক করে বসে আছে নিত্য। কাজে যায়নি। ওর সামনে দিয়ে একটা ডেঁয়োপিঁপড়ে চলে যাচ্ছে  নিজের ছন্দে। নিত্য সেটাকে পায়ের তলায় পিষে মারতে যাবে, অমনি ভোম্বলের গলা, " বাবা, আমার কিন্তু কালকেই লাগবে। আর দুটো শ্যাম্পুর পাতা।"
নিত্য ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ ব্যাজার করে বললো, " আচ্ছা, এখন যা, দেখছি।" ঘাড়েমাথা সোজাসুজি হওয়ার সময়টুকু,
পিঁপড়েটা এরমধ্যেই নিত্য'র নাগালের বাইরে। দুর্বল তো সব সময় পালানোরই চেষ্টা করে! সব যুগে।
নিত্য একটা বিড়ি ধরায়। তারপর উঁকি মারে  ছেলেবেলার দিকে । কাদামাটি মাথায় ঘষে ঝপাং করে লাফ মারলো ইছামতীর জলে। নিত্য একা না। বিজু, উৎপল, নীলু। তারপর মাথা মুছে রোদে শুকোনো মিনিট দশ। ব্যস, চুল ফুলে ফেঁপে হাওয়ায় উড়ছে তখন। শ্যাম্পু-ট্যাম্পুর বালাই ছিল না। আর সাবান! তখন লাল লাইফবয় সাবান ঘষে জামাও কেচেছে, আবার গায়েও মেখেছে। একমাত্র কোনও অনুষ্ঠান বাড়িতে যাওয়ার আগেই মা ডাক দিত, " নিত্য, এদিকে আয়, সেন্ট দে জামায়।" তখনই দিত। তার আগে না। আর ওর বড় ছেলে ভোম্বল, বাড়ির বাইরে বেরোলেই কি যে গায়ে লাগায় আজকাল, ছ্যাঁঁক ছ্যাঁক করে আওয়াজ হয়!
সকাল থেকে তুমুল বৃষ্টি হয়েছে। রিক্সা বার করেনি নিত্য। বাড়ি থাকলে এটা ওটা নিয়ে অশান্তি হবেই। এ জানা কথা। তাই বৃষ্টি একটু কমতেই কলপাড়ের এই ফাঁকা জায়গাটায় এসে বসেছে নিত্য।  বাড়ি থাকলে বেশিরভাগ সময়টা এখানেই ও বসে থাকে ইট পাছায় দিয়ে। ঘরে থাকলে ছেলেদুটো'র নানান কিসিমের বায়নার কথা শুনতে শুনতে একঘেয়ে লাগে ওর। তখনই কলতলায়। একটার পর একটা বিড়ি টেনে যায় নিত্য। এই সময় ও বিড়বিড় করে কি যেন বলেও। বোঝা যায়, নিত্য চিন্তা করছে। দিয়েছে, একটা সময় ছেলেদুটো যা চেয়েছে, সব না পারলেও ওর সাধ্যমত ও দিয়েছে। এখন পারছে না।
রিক্সা স্ট্যান্ডের প্রায় সবাই এখন টোটো কিনে ফেলেছে। কেনেনি নিত্য। কেনেনি মানে কিনতে পারেনি। জমানো টাকা কিছুই নেই। জমাতে গেলে তো ব্যাঙ্কে যেতে হয়। টাকা রাখতে হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত নিত্য ব্যাঙ্কে যায়নি। টাকা থাকলে তো যাবে! ব্যাঙ্কের সামনে কতো লোককে নামিয়ে দিয়েছে। কতোদিন। কিন্তু ব্যাঙ্কের  ভেতরে ঢোকেনি কখনও। তবে একটা সমিতি করতো। মাসে মাসে তিনশো টাকা। রোজ দশ করে দিত। সেই সমিতিও ঝাড় খেয়ে গেছে। সমিতি নাকি চিটফান্ডের ব্যবসা খুলে বসেছিল। নিত্য'র হিসেবে ও পুরো পাঁচ হাজার টাকা পেত। কিন্তু সমিতি ওকে কাঁচকলা দেখিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। সতীশদাকে ধরেছিল পরে। ও বলেছিল, " তুমি একটু ওয়েট করো, তোমার টাকা পেয়ে যাবা।"
নিত্য আর ওয়েট করেনি। ও জানে ও টাকা আর পাবে না।
টোটোকে অনেকে টুকটুক বলে। ব্যাটারিতে চলে বলে ওর খরচাও কম। টোটো আসাতে রিক্সা মার খেয়ে গেছে। আর যাদের রিক্সা আছে, তারা সবাই নিত্য হয়ে গিয়েছে। সময় বাঁচছে, আরামে যাওয়া যাচ্ছে, পয়সাও কম লাগছে। পাবলিক তো এটাই চায়। নিত্য কয়েকবার ভেবেছেও ভাড়ায় টোটো চালাবে। বাজারে প্রবোধ তোকদারের পাঁচটা টোটো খাটছে। নিত্য শুনেছে আরও পাঁচটা নামাবে সামনের মাসে। কিন্তু মন সায় দেয়নি। মধুও বারণ করেছে। হাজার হোক, রিক্সাটা তো তার নিজের! যাও না যাও কারও কৈফিয়ত দেওয়া লাগবে না। আর ভাড়ায় টোটো চালানোতে তো হ্যাপাও আছে। তুমি সারাদিন কি পেলে না পেলে মালিক দেখবে না। সন্ধে হলেই তার হাতে গুঁজে দিতে হবে দেড়শো টাকা! এর চেয়ে রিক্সাই ভালো। স্বাধীন।
স্ট্যান্ডেও নিত্য যখন একা থাকে, বেশিরভাগ সময়টাই বিড়ি টানে। আগে এতো বিড়ি খেতো না। ইদানীং বেড়েছে। বছর খানেক। আগে যখন সবার রিক্সা ছিল, টোটো যখন আসেনি, তখন দিনে তিনশ' সাড়ে তিনশ' নিয়েও বাড়ি ফিরেছে নিত্য। এখন দেড়শ'ও হয় না। কালই তো সত্তর হয়েছিল!
বউ মধুকে সব কথা বলে নিত্য। কেন তার রোজগার ইদানীং কমে গেছে তা জানে মধুও। কিন্তু ছেলে দুটো বুঝলে তো! সব সময় কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করলে মধুরও কি আর মাথার ঠিক থাকে! দিয়েছিল, সেদিন গরম খুন্তির  ছ্যাঁকা দিয়েছিল ছোটটার পায়ে। ফোস্কা পড়ে, ঘা হয়ে একাকার অবস্থা। সেই ঘা শুকাতেই তো লাগলো পনেরো দিন। ছেলেগুলোর চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে যখন মুখ থুবড়ে পড়ে নিত্য, একমাত্র তখনই বউ মধুর মুখ আর মিষ্টি থাকে না। খিচিয়ে ওঠে। যেমন আজ উঠেছে।
---- আমার তো কোনও শখ-আহ্লাদের কথাই বলি না। ওরাও কি মুখে লাগাম দেবে এবার?  জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না! বুঝলে?
ছেলেদুটোর সামনে মধু একথা বললো! ভীষণ রাগ হল নিত্য'র। সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে কোথাও পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে নিত্য। আগে মধু এতো মুখরা ছিল না। হবেই বা কেন, হা করা লাগতো না। সব হাতের কাছে পেয়ে যেত। তখন নিত্য রাগ দেখালেও এক গাল হেসে নিত্য'র কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতো মধু। এখন তার কথার ঝাঁঝ কতো!
বড়ো ছেলেটা সপ্তাখানেক ধরে বলে যাচ্ছে, ওর একটা বডি অয়েল চাই। নিত্য আজ দেবো, কাল দেবো বলে চালিয়ে যাচ্ছিল সাতদিন ধরে। কিন্তু টাকা যোগাড় করে উঠতে পারছিল না। পারবে কি করে! সত্তর টাকার রোজগারে যদি পঞ্চাশ টাকা ভাগ বসায়, তাহলে তো না খেয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই।  ধারে জিনিস কিনতো বিপ্লবের দোকান থেকে। অনেক জমে আছে সেখানেও। তবু কাল গিয়েছিল। ভোম্বলের জন্যই।  বডি অয়েল আনতে।
----- বিপ্লবদা, আর দুদিন দেরি করো, সব শোধ করে দেবো।
মুখে বললো নিত্য, কিন্তু কি করে শোধ দেবে সে নিজেও জানে না। বিপ্লব ওর কথায় আর কান দেয়নি।
----- ওসব রাখো। আগের টাকা শোধ করে দাও। যা লাগে নিয়ে যেও।
চলে এসেছিল।
অসময়ের মধ্যে দিয়েও কিভাবে চললে সংসারটা ঠিকঠাক চলে, তা জানে মধু।  কোনও বাজে খরচ ও করে না। আর তাই, নিত্য'ও বাজে খরচ করার সাহস পায়নি এযাবৎ। 'যারাই রিক্সা চালায়, একটুআধটু মালটাল খায়',---- একথা নিত্য'কে বলা যাবে না। কেননা নিত্য'র নেশা বলতে ঐ এক, বিড়ি। চা খায় দিনে চার-পাঁচ বার। কিন্তু ওটাকে তো আর নেশা বলা যাবে না। চা সবাই খায়। তবে সঙ্গদোষে যে নিত্য পড়েনি, তা নয়। ভোলার বিয়েতে একবার বাংলা খেয়ে চুর হয়ে ঘরে ফিরেছিল নিত্য। মধু তখন মিছরির ছুরি চালিয়েছিল মুখে। দ্বিতীয় বার আর মাল খাওয়ার নাম করেনি সে। নিজে হাতে সংসারের সমস্ত খরচ চালিয়েছে মধু। এখনও। একটু একটু করে জমিয়ে ঘর গুছিয়েছে। আলমারি। শোকেস। টেবিল ফ্যান। একটা কালার টিভিও কিনে ফেলেছে। সেকেন্ডহ্যান্ড। মাসে মাসে টাকা দিয়ে। সুবীরের টিভি সারাইয়ের দোকান থেকে।
ছেলে দুটোকে হাইস্কুলে ভর্তি করেছে মধু। ওরা একটু পড়াশোনা করুক। মানুষ হোক। নিত্য'র সেসবে চোখ দিতে হয়নি। দেখতে দেখতে বড়োটা নাইনে, ছোটটা ফাইভে। বড়ো ছেলেটার পড়াশোনা হবে। মধু বোঝে। তাই লেগে আছে। ওরই তো যত বন্ধু-বান্ধব। বাড়িতেও আসে ওরা। ছেলেগুলো খুব ভালো। কোনও অহংকার নেই!          দীপন ছেলেটা তো একদম অন্যরকম। মধুর খুব ভালো লাগে। ওর বাবার যে পেট্রল পাম্প আছে, তা দেখলে বোঝা যায় না। বাড়িতে আসলে মধুরই বরঞ্চ লজ্জা লাগে, কোথায় বসতে দেবে, কি খেতে দেবে। ওদের সঙ্গে মিশে বড়োটার একটু সাজগোজের  ঝোঁক হয়েছে। গতবারই তো  পুজোতে হাঁটুর কাছে সাদা ছোপ্ দেওয়া জিন্স চেয়ে বসলো ভোম্বল। নিত্য তা দিয়েওছিল। তাছাড়া, আজ এর জন্মদিন, কাল ওর দিদির বিয়ে, এসবে নেমন্তন্ন রক্ষা করাও আছে। সব নিত্য'র একার পক্ষে সম্ভব না বলে বাড়িতে বসে না থেকে ঠোঙা বানানো শুরু করেছে মধু। সপ্তাহে সেখান থেকে কিছু আসেও। আসলে মধুও তো গরীব ঘরের মেয়ে। কষ্টটা ও বোঝে। কষ্ট কি সেও কম করেছে! ওর বাবা শ্যামল একটা সময় ধাবায় কাজ করতো। পাঞ্জাবি ধাবা। পরে লরির খালাসি হয়েছিল। চারজনের সংসার টেনে নিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছিল বাবা।  দিদির বিয়ে হয়ে গেল ক্লাস এইটেই। দুইবোনেরই চোখে পড়ার মতো চেহারা তখন।      ব্যস্, বাবা-মা ওর জন্যও ছেলে দেখা শুরু করলো। ক্লাস সিক্সে ওঠার পরই পড়াশোনায় ছেদ পড়লো মধুরও। পয়সার অভাবে পড়াশোনা হল না। অভাবটা ও বোঝে। তুলনায় নিত্যরা ছিল একটু ভালোর দিকে। চন্ডীতলা বাজারে ছিল নিত্য'র বাবার সব্জির দোকান। বিক্রিবাটা ভালোই হতো। বাবার দোকানে নিত্যও বসতো। ওদের দোকানেই সবজি কিনতে আসতো মধুর বাবা শ্যামল।কখনও বাবার সঙ্গে মধুও যেতো বাজারে। সেই থেকে আলাপ। তারপর দে ছুট, একসাথে।
নিত্য'কে বুঝিয়েছে মধু, " যারা তুমার বাঁধাধরা প্যাসেঞ্জার ছিল, ওদের কাছ থেকে টোটো যা নেচ্ছে, তার থেকে এট্টু কম নাও। দেখবা, আবার সব ঠিক।"
নিত্য এখন মধু'র ফর্মুলা মেনে চলছে। বেশ কিছুদিন ধরেই। গতকাল ষষ্ঠীকে একপ্রকার বাড়ি থেকেই তুলে নিয়ে এসেছে সে। ষষ্ঠী নিত্য'র ডেলি প্যাসেঞ্জার ছিল। ইদানীং টোটোয় সওয়ার হচ্ছিল। আগে রোজ দশটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে দীপকের পানের দোকানের সামনে দাঁড়াতো ষষ্ঠী। তারপর মুখে একটা পান গুঁজে এদিকওদিক তাকাতো।  ঠিক কৃষ্ণচূড়া গাছটা, নয়তো শৈলেনের ফার্মেসীর সামনে রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো নিত্য। শুধুমাত্র তার জন্যই। মুখে একগাল হাসি। ষষ্ঠীর অফিস যাওয়ার টাইমটায় নিত্য কোনও ভাড়া নিত না। ষষ্ঠীকে ব্লকে পৌঁছে দিয়ে তারপর স্ট্যান্ডে দাঁড়াতো নিত্য। বেশ কিছু দিন ধরে নিত্যকে দেখলেই ষষ্ঠী সরে পড়তো। টোটোয় উঠতো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে। ভাড়া কম।
নিত্য সেদিন ওকে দেখতে পেয়েই কাছে এগিয়ে গেল।
----- দাদা, অনেকদিন থেকে আপনি আমার প্যাসেঞ্জার। এখন টোটোয় চড়ছেন, খারাপ লাগে। আচ্ছা, এবার থেকি টোটোয় যা ভাড়া দেন, আমারেও তাই দেবেন।
নিত্য'র কথায় ষষ্ঠী অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল।
---- না না, মাত্র দু-পাঁচ টাকা বাঁচানোর জন্য আমি টোটোয় উঠবো কেন? আসলে ঐ কদিন একটু তাড়া ছিল। ঠিক আছে, তুই যখন বলছিস তোর গাড়িতেই যাবো।
----- আপনি রেডি হয়ে আমার  মুবাইলে শুধু একটা মিস কল দেবেন। আমি বাড়ির সামনে দাঁড়ায় থাকবো।
গতকাল কথামতো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল নিত্য। এক পা-ও হাঁটতে হয়নি ষষ্ঠীর।
নিত্য যে ভাঁড়া কম নিয়ে ইদানীং রিক্সা চালাচ্ছে, তা কি করে যেন চাওর হয়ে গিয়েছিল  স্ট্যান্ডে। সেদিন একটা ভাড়া খেটে যখন সে স্ট্যান্ডে এল, খোঁচা মারলো সঞ্জয়, " নিত্যদার  প্যাসেঞ্জার আবার হচ্ছে তালে!"
---- সবই তো জানো। বলার কি আছে!
নিত্যকে গম্ভীর দেখে সঞ্জয় একটা সিগারেট ধরালো। তারপর টোটোর গ্লাস মুছতে মুছতে  বললো, " একটা সময়  ভাড়ায় না পুষালি যেতে না, এখন পুষাচ্ছে তো?"
---- আরে গান্ডু, তুই তোর কাজটা কর না। পুষাচ্ছে নাকি সেটা আমি বুঝে নেবো।
লুঙ্গির গিঁট খুলে বিড়ি বার করলো  নিত্য। সঞ্জয় আর ঘাঁটানোর সাহস পেল না। একটা ভাড়া পেয়ে চলে গেল।
অনেক দিন বাড়িতে মাছ নিয়ে যায়নি নিত্য। আগে সপ্তাহে দুদিন পরিমলের বাঁধা খদ্দের ছিল সে। কাটা মাছ চার থেকে পাঁচ পিস। কখনও রুই, কখনও কাতলা। বাড়ি যাওয়ার সময় রিক্সার সিটের নিচে রাখতো প্যাকেটটা। তারপর দুপুরবেলায় মধুর হাতের মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে একটু টিভি ছেড়ে দিত। আবার ঠিক তিনটে বাজলেই স্ট্যান্ডে। সেসব বহুদিন হয় না। মানে যবে থেকে টোটো এসেছে।
(২)
---- বেশ হয়েছে। এবার দ্যাখ কেমন লাগে? ফুটানি! সব বেরোয় যাবে।
শংকরের চায়ের দোকানের টিভিতে খবরটা দেখেই বিকাশকে দাঁত ক্যালাতে ক্যালাতে কথাগুলো বললো নিত্য। বিকাশও নিত্য'র দলে। বাবা কানাকড়িও রেখে যায়নি। আর শ্বশুরও দেনেওয়ালা না। তাই আর রিক্সা ছেড়ে টোটো ধরতে পারেনি। তবে রেলের মাঠে যখন গদাই হাত সেট করছিল টোটোতে, তখন বিকাশও স্বপ্ন দেখেছিল টোটো কেনার। কোথা থেকে, কিভাবে কিনবে সেকথা ভাবেনি। গদাই ওকেও দু-একবার চালাতে দিয়েছিল। টোটোয় উঠে হ্যান্ডেল ধরতেই কেমন বাবু বাবু লেগেছিল বিকাশের। এখন তো যারা টোটো চালায়, সবাই-ই প্যান্টশার্ট পরে। লুঙ্গি রিক্সায়ালারা পরে। ও আর নিত্য পরে। সঞ্জয় তো যখন টোটো চালায়, চোখে সানগ্লাস দেয়। হেব্বি লাগে বিকাশের। কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মধ্যের ফারাকটা বুঝে কেন্নো হয়ে চুপ করে যায়। স্ট্যান্ডে ও আর নিত্যই যেন রিক্সার ঐতিহ্যটাকে ধরে রেখেছে।
---- কি হল নিত্যদা,অনেকদিন পর দাঁত বের করলে দেখলাম!
---- এমনি নাকি? খবরটা দেখলি না, টোটো বে-আইনি ঘোষণা করার কথা ভাবছে হাইকোর্ট! জনস্বার্থ মামলা হয়েছে।
---- তাই নাকি! তালি যারা টোটো কিনলো?
---- আবার কি, রিক্সা চালাবে। প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরবে।.... শালা, ভদ্দরলোক সাজছিল সব!
বিকাশ কি বুঝলো কে জানে, নিত্য খবরটা দেখে খুশি। খুশি মানে খুব খুশি। আবার সব আগের মতো! পরিমলের থেকে মাছ নেওয়া শুরু হবে। ভোম্বলের বডি অয়েলটা কিনে দেবে। বিপ্লবের মুদির দোকানের সব টাকা শোধ করে দেবে। মধু আর খিঁচিয়ে উঠবে না। নরম সুরে কথা বলে পাশে এসে বসবে। টিভিতে পটল কুমার গানওলা দেখে বলবে, " বলো তো পটল মেয়ে না ছেলে?"
একসাথে সবাই গামলায় মুড়ি চানাচুর মেখে খাবে । ছোটছেলেটা ঝম করে মাথা থেকে একটা পাকা চুল তুলে বলবে, " বাবা, তুমি কিন্তু বুড়ো হয়ি যাচ্ছো!" অমনি মধু নিত্য'র দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলবে। মন মেজাজ ভালো না বলে অনেকদিন ইয়েও  হয়নি। মধু অপেক্ষা করে আছে। এদিকে অনেকদিন ধরে সিদ্ধ খেয়ে খেয়ে মুখে স্বাদ জিনিসটা যে কি ভুলতে বসেছে সবাই। আবার মাংস- মাছ, মিষ্টি-সিঙাড়ার স্বাদ পাবে জিভগুলো। আবারও অসাবধানে লুঙ্গির গিঁট খুলতেই খুচরো পড়বে ঝনঝন করে। ছোটটা টুপ করে সরিয়ে নেবে দু-একটা। তারপর কুড়ানো শেষ হলে নিজেই বলবে, " বাবা, আমি কিন্তু কোনও পয়সা নিই নি!" কথা শুনে মৃদু ধমক দেবে মধু। তারপর স্বীকার করবে, " একটা নিয়ছি।" দেখা যাবে হয়তো পাঁচ টাকার কয়েন সেটা। নিত্যই তখন বলবে, " থাক্, ও তো আর খায় না। জমাচ্ছে জমাক।" এইভাবে পয়সা জমিয়ে ও পুজোতে খরচ করে। বেশ কিছুদিন হল ছেলেটা আর পয়সা-টয়সা চায় না।
বাড়িতে আজ সন্ধের মধ্যেই চলে এসেছে নিত্য। রাত করেনি। ওকে আসতে দেখে অবাক হয়েছে মধু। শরীর-টরীর খারাপ করলো না কি! রিক্সাটা জামরুল গাছটার নিচে দাঁড় করিয়ে ঘরে ঢুকলো নিত্য। অন্যদিন মুখটা কালো করে থাকে। আজ বেশ চনমনে মনে হল। টিভিটা চলছিল। স্টার জলসা।
নিত্য বললো, " মধু, কোনও খবরের চ্যানেলে দ্যাও তো।"
---- ঘরে ঢুকেই খবর! দাঁড়াও অ্যাডটা দিক।
খাটের উপর পা তুলে বসলো নিত্য। মধুর সন্দেহ হল। এত তাড়াতাড়ি আসে না। তারপর ঢুকেই খবর!
---- কেন কিসের খবর?
---- এবিপি আনন্দ, ২৪ ঘন্টা যেকোনও একটাতে দ্যাও।
---- এ ন্যাও, অ্যাড দিয়েছে।
মধু নিজেই রিমোট ঘুরিয়ে একটা খবরের চ্যানেলে দিল।
---- কই, কিছুতো বুঝতি পারছি না।
---- দাঁড়াও, দাঁড়াও। ঐ দ্যাখো দেখাচ্ছে।
মধু দেখলো ব্রেকিং নিউজে দেখাচ্ছে। স্ক্রিনের নিচ দিয়ে চলে যাচ্ছে লেখাটা ----  'হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা :  বে-আইনি টোটোর বিরুদ্ধে রাজ্যকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ।'
---- বুঝলে কিছু?
---- না।
---- এবার থেকে আর টোটো রাস্তায় দেখা যাবে না। টোটো বন্ধ করে দেবে সরকার।
---- কেন?
---- টোটোতে যাতায়াত করা বিপদজনক। চারিদিক খোলা,  যাত্রী-নিরাপত্তা নেই। সামান্য ঘা  লাগলেই যখন তখন উলটে যেতে পারে।
---- কিন্তু এতো পয়সা খরচা করে যারা টোটো কিনলো, তাদের কি হবে?
----- তাদের খোঁজ নিয়ে আমাদের কি লাভ? আমাদের কেউ খোঁজ নিয়েছে এতদিন? বড়োলোকি চাল এবার ঘুচে যাবে!
----- তাহলে সঞ্জয়, মদন ওরা?
----- আবার রিক্সা ধরবে। সিগারেট ফুঁকা?.....সব বিড়িতে আসবি, দাঁড়া।
---- তোমার কি আনন্দ হচ্ছে? এটা ঠিক না।
----- না, আনন্দ না। সবাই করে কম্মে খাক। আমি আর বিকাশই বা বাদ যাবো কেন?
----- ওদের টোটো কেনার ক্ষমতা ছিল, কিনেছে। এতে ওদের তো দোষের কিছু দেখি না।
----- সবই ঠিক। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে ওরা এমন ঠ্যাস মেরে মেরে কথা বলছিল, যা শুনলি তুমারও গা পিত্তির জ্বলে যাবে।
---- ঠিক আছে, তুমি কি এখুন চা খাবা?
----- করো।
নিত্য হাত-পা ধুতে গেল কলপাড়ে।
(৩)
"বীরপাড়ায় এক আমবাগানে গতকাল রাতে এক ব্যক্তির ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মৃতের নাম প্রকাশ সরকার। বয়স ৪৫। তিনি বীরপাড়া চা বাগানের কর্মী ছিলেন। চা বাগান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর প্রকাশবাবু হালে টোটো চালাচ্ছিলেন। স্থানীয় ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে তিনি এই টোটো কেনেন। টোটো বে-আইনী ঘোষণা করার খবরে খুব মুশড়ে পড়েছিলেন তিনি। ওদিকে বড়ো মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েইছিল। দুপুরে খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া সারাদিন টোটো চালাতেন তিনি। ইদানীং প্রকাশবাবু বাড়িতেও কারও সাথে খুব একটা কথা-টথা বলতেন না। মানসিক দিক থেকে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন। তার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে বর্তমান।"
দুপুরে বাড়িতে এসে খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে অনেকদিন পর টিভিটা ছেড়ে বসেছিল নিত্য। খবরটা দেখে খানিকক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে থাকলো। অস্ফুটে বলে ফেললো, " আহা, বেচারী!"
বাসনমেজে একটু আগেই ঘরে ঢুকেছে মধু। নিত্যকে ওভাবে 'আহা' করতে দেখে তারও মনখারাপ হয়ে গেল।
---- ইস্, মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়িছিল! দুটো মেয়ে! বউটা এখন তিনটে বাচ্চা নিয়ে যাবে কোথায় ?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিত্য বললো, "হুঁ, খুব খারাপ খবর।"
---- দেখলে, একটাই খবর, তোমারে খুশি করলিও, ঐ লোকটাকে খুশি করতি পারিনি। ধারে টোটো কিনিছিল। না চালাতি পারলি টাকা শোধ করবে কি করে, সামনে মেয়ের বিয়ে, এই সব চিন্তায় লোকটা মারা গেল!
মাথা নিচু করে ফেললো নিত্য। লজ্জায়। সে তো এতো কিছু বোঝেনি। কিন্তু এটা ঠিক নিত্য এটা জানতো, শিক্ষিত বেকার যুবক থেকে, অন্য পেশা ছেড়ে আসা কত লোকও আজকাল টোটো চালাচ্ছে রাস্তাঘাটে, বাজারে গলিতে। তবু ওর যত রাগ হত, যারা রিক্সা ছেড়ে টোটো চালাচ্ছিল, তাদের উপর। রাগ হত সঞ্জয়ের উপর, বক্সীর উপর। স্ট্যান্ডে দাঁড়ালে ঐ দুজনই তো সবচেয়ে বেশি খোঁচা মেরে কথা বলতো। কিসের এতো অহংকার! তারা নিত্য'র চেয়ে বেশি রোজগার করে বলে!  কই আগে নিত্য যখন ডেলি তিনশো সাড়ে তিনশো কামাতো, তখন তো কাউকে সে লাটসাহেবি চাল  দেখায়নি! অহংকার। এই অহংকার জিনিসটা যাদের ভেতর আছে, তাদের দুচোখে দেখতে পারে না নিত্য।
---- জানো মধু, খুব খারাপ লাগছে আরেকজনের কথা ভেবে।
---- কে?
---- বিকাশ। এই তো কিছুদিন আগে ও পাঁচ হাজার, ওর দাদা পাঁচ হাজার আর এদিকসেদিক থেকে ধার দিনা করে রবীনকে টোটো কিনে দিয়েছিল। রবীন ওদের জামাই। একমাত্র বোন শ্যামলী কতদিন পড়েছিল ওর আর ওর দাদার ঘাড়ে। বাচ্চা নিয়ে। জামাইটা কোনও কাজবাজ করতো না। কুঁড়ে। টোটো কিনে দেওয়ার পর সংসারে না কি মতিগতি এসেছিল। কামায় করছিল ভালো। ও প্রায় বলতো, " নিত্যদা, বাপ্-মা মরা বোনটা  চোখের জল ফ্যালে না, এটা দেখে যে কি আনন্দ হয়,  তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না।" আমি বুঝতাম বিকাশের কথাটা, বোন তো আমারও ছিল! ব্যস্, জামাইটা যদি বসে যায়, ওর বুনের চোখের জল তো আবারও ঝরবে! তখন....
বুঝেছি, সেদিন দীপকের চায়ের দোোকানে খবরটা দেখে ওকে দু-চার কথা বলিছিলাম। ও কিন্তু মোটেই খুশি হয়নি। ওর জায়গায় আমি থাকলে আমিও তো তাই করতাম!....হয়নি, আমার ওটা উচিত হয়নি।"
নিত্য এরকমই। মধুও সেটা জানে। কোনও অন্যায় করলে, আজও বাড়ি এসে সেকথা স্বীকার করে ও।
" ইস্, এটা না করলেেই পারতাম।" একথা একমাত্র নিত্যই বলতে পারে। অনুশোচনাবোধ ওর মধ্যে প্রবল। এমনই যদি সব মানুষের মধ্যে থাকতো!  নিত্যকে বর হিসেবে পাওয়াটাও তো ভাগ্যের!
মধু বললো, " শোনো, কিছু প্যাসেঞ্জার তো এখুনও আছে, যারা টোটো না, রিক্সাতেই চড়ে। তুমি যেমন হাতে পাচ্ছো, দ্যাখবা তাই দিয়েই আমাদের সংসারটা দিব্যি চলে যাবে। ঠোঙার অর্ডারটা এট্টু বেশি নেবো। ভোম্বলও এখুন আমার সাথে হাত লাগায়। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর ভোম্বলও সব বোঝে। ঐ-ই তো সেদিন বলছিল, " মা, বাবাকে ব'লো আমার বডি অয়েল লাগবে না।" তোমার আর অত চিন্তা করতি হবে না।"
ঘাড় নাড়ে নিত্য। ছেলেদুটো তার অবস্থা বোঝে, এই ভেবে আনন্দ হয়। আর এমন বউ পাওয়াও তো চাড্ডিখানি কথা না! নিত্য এটাও বুঝেছে, পরের সর্বনাশ চেয়ে কেউ কখনও ভালো থাকতে পারে না।
রিক্সার প্যাডেলে পা রাখলো  নিত্য।
স্ট্যান্ডে বিকাশকে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখলো নিত্য। রিক্সাটা পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে বিকাশকে বললো, " কতক্ষণ" ?
---- এই আধা ঘন্টা হল।
---- ভাড়া মেরেছিস?
---- একটা। ঐ বাজার পর্যন্ত।
---- ও...
---- বিড়ি আছে?
---- আছে।
নিত্য বিড়ি বার করে দেয়। বিকাশ বিড়ি ধরায় ।
---- তুমি খাবা না? ---- একটু আগেই খেলাম।
বিড়িতে টান দিয়ে বিকাশ বললো, " আবার সেই এক সমস্যা।"
---- কিসের?
---- ঐ যে টোটো বে-আইনি.... বোনটার কথা ভাবছি।
---- ওসব ভাবিস না। বে-আইনি বললেই হল! কতো লোক এর সাথে যুক্ত বলতো!
---- হুঁ, আমাকেও মালতী তাই  বলছিল।
মালতী বিকাশের বউ। অঙ্গনওয়ারিতে কাজ করে।
---- সবাই-ই তাই বলছে। বে-আইনি! ওরম গাড়ি তৈরির পারমিশন দিল কেন সরকার? তখন ভাবা উচিত ছিল।
---- সেই।
এর ভেতরে একটা প্যাসেঞ্জার পেয়ে নিত্য চলে গেল।
আজও সন্ধের মধ্যেই বাড়িতে ঢুকলো নিত্য। রিক্সাটা জামরুল তলায় রেখেই হাঁক পাড়লো, " মধু, মধু।"
কাগজে আঠা দিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মধু। বাইরে এসে দেখলো নিত্য এসে গেছে।
---- বলো, কি হল?
---- যে কোনও একটা খবরের চ্যানেলে দ্যাও, তো। খবরটা দ্যাখাচ্ছে।
---- আবার কি?
---- দ্যাও-ই না।
চব্বিশ ঘন্টা অন করতেই খবরটা দেখলো হেডলাইনে।
" টোটো বন্ধে সহানুভূতির বার্তা রাজ্যের"।
--- মানে?
কৌতূহলী প্রশ্ন মধুর।
---- হাইকোর্টের নির্দেশ মেনেও টোটোর সঙ্গে যারা যুক্ত সেইসব পরিবারের কথা চিন্তা করে সরকার তাদের অন্য কাজে যুক্ত করা যায় কি না ভাবছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন নবান্নে। কালকে মন্ত্রীসভার বৈঠক।
---- ইস্, তাই! এই খবরটা যদি আগে হত, হয়তো বীরপাড়া চা বাগানের ঐ লোকটা বেঁচে যেতো!
---- একদম ঠিক বলেছো। রোজগারের পথই যদি বন্ধ হয়ে যায়, মানুষ তখন হয় শকুন হয়ে মড়া খোঁজে, নয়তো নিজেই মড়া হয়ে অপেক্ষা করে শকুনের।
---- তুমি বিকাশকে একটা ফোন করো। ও একটু শান্তি পাবে।
---- আমি খবরটা শুনে রাস্তাতেই বিকাশকে ফোন করেছি। ও-ও নিশ্চয় এতক্ষণ খবরটা দেখে থাকবে।
---- এবারে সত্যিই এট্টু হাল্কা লাগছে।
---- আমারও। সবাই দুটো খেয়েপরে শান্তিতে থাকলেই তো ভালো লাগে।
---- ঠিক।
পড়া ফেলে ছোট ছেলেটা কোন ফাঁকে এসে বসেছে মধু আর নিত্য'র মাঝখানে। চুপচাপ ছিল। এবার সে মুখ খুললো, " বাবা, তুমার পাকা চুল তুলে দেবো, কতো করে দিবা? "
ওর কথা শুনে মধু, নিত্য কি বলবে ভেবে পেল না, দুজনেই হেসে ফেললো।
           -------------------



No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া