Monday, December 19, 2016

ধারাবাহিক গল্প.........নারায়ণ রায়

আমার না বলা কথা (5)
নারায়ণ রায়

এই তেঁতুলিয়া গ্রামে থাকার সময় আমার ইছামতী নদীর সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়। সেদিন আমার মনে হয়েছিল যে একটা নদীরও যেন প্রান আছে। তারও যেন সুখ আছে দুখ আছে, আনন্দ আছে অনুভুতি আছে। এই দেখি ভাঁটার সময় নদীর শীর্ন প্রবাহ উত্তর থেকে দক্ষিনে প্রবাহিত, আবার কিছুক্ষন পরেই জোয়ার এসে স্ফীত নদীর দুকুল ভাসিয়ে দক্ষিন থেকে উত্তরে ধাবিত। কত রকমের নৌকো, তার কত রকমের যাত্রীসেই যুগে ওই সব এলাকায় জলপথই ছিল যোগাযোগের একমাত্র পথ। তখনও বসিরহাট থেকে তেঁতুলিয়া বাস চালু হয়নি, তাই নদী পথই এক মাত্র ভরসা।
জন্মের পরেই ২১ দিনের মাথায় ষষ্ঠী পুজোয় মা তার সন্তানকে নিয়ে এসে নদীতে চান করে নবজাতকের মাথা নদীর জলে ধুয়ে নিয়ে যেত। এলাকায় কোন বিয়ে হলে, বিয়ের দিন সকালে বাড়ির বউরা লাইন দিয়ে শাঁখ বাজিয়ে নদী থেকে ঘট ভরে জল নিয়ে যায়, আবার বিয়ের পরদিন ওই নদী পথেই সানাই-তাসা বাজিয়ে পাড়ার মেয়ে অশ্রু সজল নয়নে শ্বশুর বাড়ি যায়। পুজোর শুরুতে পুরোহিত মশাই ঐ নদীতেই কলাবৌ কে স্নান করিয়ে নিয়ে যায় আবার দশমীর দিন ঐ নদীতেই মাকে চোখের জলে ভাসিয়ে দেয়। আর সর্বংসহা নদীর যেন এসবে কোন হেল দোল নেই। ওই বয়সে একটা জিনিস দেখে আমার খুব মজা লাগতো, সেটা হল নদীতে বাঁশ নিয়ে যাওয়া। কোন নৌকো নেই হাজার হাজার বাঁশ একত্রিত হয়ে ভেসে চলেছে, তার এক কোণে একটা ছাউনি। যেন একটা চলন্ত দ্বীপের মধ্যে একটি ঘর। আর দ্বীপটির উপর লোকজন ঘোরাঘুরি করছে, রান্না বান্না হচ্ছে। তখন মনে হত ইস্ ওরা কত সুখী, আমি যদি ওদের মত ভাসতে ভাসতে কোন নীলপরী বা লালপরীর দেশে চলে যেতে পারতাম যেখানে পড়াশোনা নেই শুধু আনন্দ আর আনন্দ!
তবে নদী মানেই শুধু আনন্দ নয়। নদী বহুল এলাকায় প্রায় সব শ্মশানগুলি নদীর ধারে। আর এই ইছামতীর ধারেই সেই বয়সেই আমি জীবনে প্রথম দেখেছিলাম কি ভাবে একটি মানব দেহ প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুন্ডে ধীরে ধীরে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়।
তখন নদীতে খুব বেওয়ারীশ লাশ ভেসে আসতো, সেগুলি আমাদের বাড়ির কাছে কোন গাছের শিকড় বা কোন কিছুতে আটকে গেলে বিশ্রী গন্ধে পুরো এলাকার লোক ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ত। বাবার অফিসের কেউ তখন নাকে মুখে গামছা বেঁধে একটা বাঁশ নিয়ে ঐ লাশ টাকে দূরে ঠেলে দিত। কত রকমের মৃতদেহ, নারী, পুরুষ, শিশু, কোনটা চিত হয়ে কোনটা উপুড় হয়ে, কোনটা সদ্য মৃত, কোনটা আবার এতটাই বিকৃত যে নারী, পুরুষ নাকি শিশু বোঝাই যায় না।
কখনো কখনো নদীতে একটা আদ্ভুত দৃশ্য দেখতাম। সেইযুগে ওই সব অঞ্চলের লোকেরা কেউ সাপে কামড়ানো মানুষের সৎকার করত না। একটা অদ্ভুত সংস্কারের বশবর্তী হয়ে মৃতদেহ একটা কলা গাছের ভেলায় বিছানা করে শুইয়ে দিয়ে, চাদর ঢাকা দিয়ে, মশারী খাটিয়ে, এমন ভাবে ভাসিয়ে দিতেন যেন মনে হত, পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোতে ঘুমোতে কেউ তার গন্তব্য স্থানের দিকে চলেছেন।
তেঁতুলিয়ার আর একটা জিনিস আমি আজও ভুলতে পারিনি সেটা হ, ওই বিলবল্লির খাল দিয়ে তাল গাছের ডিঙ্গিতে চড়ে যাতায়াত করা। শহরতলিতে যেমন প্রত্যেক মধ্যবিত্তের বাড়িতে একটা করে সাইকেল থাকে ঠিক তেমনই ওই এলাকায় প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতে একটা করে তাল গাছের ডিঙ্গি নৌকো বাড়ির কাছে ঘাটে বাঁধা থাকতো। আর সেটা চেপেই সবাই এখানে ওখানে যাতায়াত করে নিজের কাজকর্ম সেরে নিতেন। আমাদের প্রাইমারী স্কুলের পাশেই ছিল হাইস্কুল, সেই স্কুলের অনেক ছাত্রই ঐ রকম নিজে নিজে ডিঙ্গি বেয়ে স্কুলে আসতো। আমার বাবার এক সহকর্মী হরিপদদা ওই রকম ডিঙ্গি বেয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। হরিপদ দা একবার আমাকে তার ডিঙ্গিতে চাপিয়েছিলেন কিন্তু ডিঙ্গিটা এত নড়বড় করছিল যে মনে হচ্ছিল এই বোধহয় ডুবে যাবে। তার পর থেকে আমি আর কোন দিন চাপিনি।
তখন ঐ সুদুর গ্রামাঞ্চলে সাধারন মানুষ বরফ কাকে বলে জানতোই না। সাধারনত জেলেরা মাছ ধরে দিনে দিনেই স্থানীয় হাটে বিক্রি করে দিত। তবে ইলিশ মাছ ধরতে অনেক দূরে যেতে হত তাই দিনে দিনে বিক্রি করা সম্ভব নয়। সেজন্য ইলিশ মাছ কেটে নুন হলুদ মাখিয়ে একটা কলসির মধ্যে রেখে মুখটা ভালো করে বন্ধ করে রাখতো। দশ পনের দিন বা এক মাস পরে যখন ফিরতো তখন আমরা ওই নৌকো থেকেই ওদের কাছ থেকে মাছ কিনতাম। ওইগুলোকে নোনা ইলিশ বলতো, এক টাকায় ৫/৬ পিস দিত। মা প্রথমে মাছটা কিছুক্ষন গরম জলে ডুবিয়ে রেখে ওর নুন হলুদটা ধুয়ে নিতেন তার পর রান্না করতেন সেই স্বাদ যেন এখনো মুখে লেগে আছে। তখন ৮/৯ বছর হল ভারত সদ্য স্বাধীন হয়েছে এবং দ্বিখন্ডিত হয়েছে। তবে তখনো ভারত আর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সীমানায় কোন কড়াকড়ি ছিল না।
তেঁতুলিয়া থেকে সামান্য দূরে গেলেই সীমান্ত। একবার বাবার সঙ্গে তাঁর এক সহকর্মীর বাড়িতে গিয়েছিলাম। কলা পাতায় মুড়ি আর বাতাসা খেতে দিয়েছিলেন তার পর গাছ থেকে ডাব পেড়ে ডাবের জল। ভদ্র লোকের নাম ছিল হাজারি বাবু। কথা প্রসঙ্গে জানলাম যে মাত্র আধ মাইল দূরে ঐ গ্রামটাই পাকিস্তান। আমাদেরকে কিছুতেই ভাত না খাইয়ে ছাড়বেন না তাই তিনি তার ছেলেকে পাঠাবেন পাকিস্তানের ঐ গ্রাম থেকে মুরগী কিনে আনতে। অমনি আমিও বায়না ধরলাম যে আমিও দাদার সঙ্গে ফরেন দেখতে যাব। কয়েক পা গিয়েই দেখলাম, ঠিক রাস্তার ধারে যেমন মাইল পোস্ট থাকে, বেশ কিছটা দূরে দূরে তেমনি মাইল পোস্টের মতো শিল পোঁতা আছে তার এদিকটায় লেখা ইন্ডিয়া আর ওদিকটায় লেখা পাকিস্তান। আমরা ওই শিলার ওপারে যেতেই ওই দাদাটি বলল ...... “এই দ্যাখ আমরা এখন ফরেনে পৌছে গেছি, আমরা এখন পাকিস্তানে, কিন্তু আমি মোটেও খুসি হলাম না, ভাবলাম এ আবার কেমন ফরেন?
আর কয়েক পা যেতেই আমরা একটা গ্রামে এসে পৌছলাম। সবাই বেশ নিম্নবিত্ত। অতি সাধারন ছিটে বেড়ার ঘর, দু-তিটে বাড়ি আর কিছুটা ঝোপ ঝাড় পার হয়ে আমরা একটা বাড়ির সামনে আসতেই আমার ওই দাদাটি চিৎকার করে ডাকতে লাগলো... কই গো চাচি বাড়িতে আছো? এক জন অতি শীর্ন চেহারার মাঝারি বয়সের ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এসে এক গাল হেসে বললেন... কে ভোলা এলি? তা তুই গত রবিবারে এলি না কেন ? তোর জন্য চারটে হাঁসএর ডিম রেখেছিলাম! তারপর আমার দিকে তাকিয়ে আমার থুতনিতে হাত দিয়ে বললেন,  এই চাঁদপানা ছেলেটা কে রে ? ভোলাদা বললো ... ও আমার বাবার অফিসারের ছেলে...একটা ভাল দেখে মুরগী দাও তো ?” আসলে মুরগী সকালে ছেড়ে দেয়া হয় তারা এখন চরে বেড়াচ্ছে, তাই এত বেলায় হঠাৎ মুরগী ধরা খুব মুসকিল। কিন্তু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চাচি বাড়িতে রাখা দুটো ডাব কেটে আমাদেরকে খেতে দিয়ে, বারান্দায় একটা খেজুরপাতার চাটাই পেতে আমাদের বসতে বললেন। তারপর হাতে এক মুঠো ধান নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই চাচি একটা হৃষ্ট পুষ্ট মোরগ নিয়ে ফিরে এলেন। তখন জ্যান্ত এক সের মত ওজনের একটা মোরগের দাম ছিল দেড় টাকা থেকে দু টাকার মত। এখন ভাবি ইস্ আজও যদি ভারত আর বাংলাদেশের সীমানাটা ঐ রকমই থাকত। ঠিক ওই ভাবেই যদি আমরা যাতায়াত করতে পারতাম !! 
আগেই বলেছি যে প্রায় প্রতিদিনই অফিস থেকে হোটেলে ফেরার পথে হেঁটেই ফিরতাম, তবে যেদিন আমার পুরানো কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে কফি হাউসে যাওয়ার কথা থাকত সেদিন ওয়েলিংটন থেকে বাঁদিকে নির্মল চন্দ্র স্ট্রিট ধরে সোজা হেঁটে কফি হাউসে যেতাম। সামান্য একটু এগলেই ডান দিলে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার আর বাঁদিকে ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের বাড়ি। এখন যেমন এক পয়সা দামের নেতারাও লালবাতি লাগানো দামি গাড়িতে পারিষদবর্গ নিয়ে ঘুরে বেড়ান, তখন সেরকমটা ছিল না, এম এল এ রা সাধারন মানুষের মতোই পায়ে হেঁটে ঘোরাফেরা করতেন। আর মন্ত্রীদের একটা করে এম্বাসাডর গাড়ি থাকতো, তখন সব এম্বাসাডর গাড়িরই রং ছিল কালো। তবে যেসব এম এল এ বা মন্ত্রীরা কিছুটা বিলাশবহুল জীবন যাপন করতেন, আসলে তারা বংশগত কিম্বা পেশাগত ভাবেই বড় লোক ছিলেন, পশ্চিম বাংলায় রাজনীতিবিদরা তখন চুরি কাকে বলে জানতেন না। আসলে দেশে রাজনীতির এত বাড় বাড়ন্ত ছিলনা, মানুষ রাজনীতির ব্যাপারে বেশ উদাসীন ছিল।
এর সব চেয়ে বড় কারণ দেশে এত বেকার ছিল না, একটা মানুষ যদি রাজনীতিবিদদের তৈলমর্দন না করেই খেয়ে পরে স্বাধীনভাবে বাচঁতে পারে তাহলে সে কেন নেতাদের তৈলমর্দন করতে যাবে? অর্ধেক লোকের বাড়িতে রেডিও ছিলনা, মোটামুটি বাংলায় তিনটে চালু খবরের কাগজ ছিল, আনন্দ বাজার, যুগান্তর আর বসুমতী, এর মধ্যে আনন্দ বাজার বড় বড় করে লিখত দৈনিক লক্ষাধিক প্রচারিত”, তার মানে বুঝতেই পারছেন যে তখন সমস্ত বাংলা সংবাদ পত্র গুলির মিলিত প্রচার সংখ্যা ছিল হয়তো দুই লক্ষের মত। আর এখন সেটা বোধ হয় ত্রিশ লক্ষের মত, তার উপর আপনি আমি চাই বা না চাই, বেসরকারী টি ভি চ্যানেল গুলোর সারাদিনের কাজ হচ্ছে , রাজনৈতিক নেতারা কেমন করে ভাত খাচ্ছেন, কেমন করে তারা প্রেম করছেন প্রতিনিয়ত তা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া। তখন এসব ছিল না।
আমি যে সময়ের কথা বলছি ততদিনে ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় মারা গেছেন প্রায় দশ বছর হয়ে গেছে, তবু ঐ বাড়িটার সামনে এলেই আমার একটা অদ্ভুত অনুভতি হত। এই সেই বাড়ি, যেখানে বাংলার রূপকার থাকতেন, অতি সাধারন একটি ত্রিতল বাড়ি। পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে একদিকে যখন ওপার বাংলা থেকে আসা এককোটি শরনার্থীর দায়িত্ব নিয়ে নতুন বাংলাকে গড়ে তুলছেন, অন্যদিকে একই সঙ্গে চিকিৎসক হিসেবে নিয়মিত দরিদ্র রোগীদের সেবাও করে চলেছেন। মানুষ বিখ্যাত হলে তার সম্মন্ধে অনেক মিথ তৈরী হয়, যেমন তিনি নাকি রোগীর মুখ দেখেই তার কি হয়েছে বলে দিতে পারতেন, আমি সেসব বিশ্বাস করি না, কিন্তু এক জন মানুষের মৃত্যুর ৫৩ বছ র পরেও যেদিকে তাকাই সর্বত্র তার স্পর্শ। দুর্গাপুর, কল্যানী, বিধান নগর, হলদিয়া, হরিনঘাটা , সি এস টি সি, দন্ডকারন্য। তিনি চেয়েছিলেন আন্দামানকে আর একটা বাংলাভাষী রাজ্য গড়ে তুলতে কিন্তু এক শ্রেনীর নেতাদের বাধায় তা সম্ভব হয়নি। খড়গপুর আই আই টি, কল্যানী এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আর কত বলবো ?
বিধান রায় বিদেশে গিয়ে দেখেন যে পড়ার কোন বয়স নেই, এমন কি বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারির মত কোর্সও রাত্রে পড়া যায়। কোন ছাত্র হয়তো কোন কারনে অল্প বয়সে পড়াশোনায় তেমন সুবিধা করতে পারেনি তাই ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা কিম্বা মেডিক্যাল-এ ফার্মাসী কিম্বা নার্সিং কোর্স করেই চাকরি করতে বাধ্য হয়েছেন । পরবর্তী কালে তিনি ইচ্ছে করলে রাত্রে আবার পড়াশোনা করে পুরোপুরি ইঞ্জিনিয়ার কিম্বা ডাক্তার হতে পারবেন। ডাঃ রায় দেশে ফিরে যাদবপুরের তৎকালীন রেক্টর ডঃ ত্রিগুনা সেনকে ডেকে আলোচনায় বসলেন এবং ইউ জি সির সঙ্গে কথা বলে, ভারতবর্ষে প্রথম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাত্রে ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চালু করলেন। আপনাদের অনেকের কাছে আজকের এই পর্বটি তেমন ভাল হয়তো নাও লাগতে পারে। কিন্তু আজ আপনাদের কানে কানে একটা গোপন কথা বলতে চাই, সেটা হল এই লেখাটার মাধ্যমে এই অধম আসলে সেই প্রনম্য মানুষটির প্রতি আমার ঋণের কিছুটা শোধ করার চেষ্টা করলাম। কারন সেই ডাঃ রায়ের জন্যই আমি পরবর্তী কালে আবার নতুন করে পড়াশোনা করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি,, পাশ করি। 
নতুন চাকরিতে যোগদান করার পর দুই সপ্তাহ কেটে গেছে, মাত্র দু সপ্তহেই বাবা মা ভাই বোনেদের ছেড়ে থেকে এবার যেন একটু হোম সিক হয়ে পড়েছি। আসলে ইচ্ছে করলেই যখন ৩/৪ ঘন্টার মধ্যে তাদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া যায়, তখন যাই না একবার ঘুরে আসি! ঠিক করলাম শুক্রবার ঝাড়গ্রাম যাব। রাত্রি ৯ টা নাগাদ বাড়ি পৌছলাম। বাড়ির সবাই তো অবাক, অবশ্য আমার বাবার মধ্যে বরাবরই উচ্ছ্বাসের বর্হিপ্রকাশটা খুব কম। তবে মা খুব খুসি আমাকে দেখে, ছেলে চাকরি করে প্রথম বাড়ি ফিরলো। পরদিন সকালে গেলাম ডাঃ অমল চ্যাটার্জ্জীর বাড়ি। তখন জেরক্স ছিলনা কোথাও চাকরির দরখাস্ত করতে গেলে মার্কসিট সার্টিফিকেট এসব কার্বন কপি করে কোন গেজেটেড অফিসার কে দিয়ে এ্যাটেস্টেড করাতে হত। ডাঃ চ্যাটর্জ্জী ছিলেন ঝাড়গ্রামের মহকুমা হেলথ অফিসার আর ওনার অফিসটা ছিল আমাদের বাড়ির ঠিক সামনে। গেলেই হাসিমুখে এ্যাটেস্টেড করে দিতেন। এই ডাঃ চ্যাটর্জ্জীর আর একটা পরিচয় ছিল উনি বিখ্যাত চলচিত্র অভিনেতা অনিল চ্যাটার্জ্জীর নিজের বড় দাদা।
এক সময়ে সামরিক বাহিনীতে চাকরি করা অকৃতদার এই ভদ্রলোক অফিসের কাজের বাইরে সারাদিন শুধু রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতেন আর নিজের হাতে রান্না করতেন। আমার চাকরির খবরটা আগেই বাবার কাছে শুনেছেন। আমাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানালেন, বললেন মন দিয়ে কাজ করতে, আর বললেন “ First Love Your Job, Then Enjoy it & Ofcourse be Honest.” সারাদিন বেশ হৈ হৈ করে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করে দিনটা কেটে গেল। আমার বন্ধু অশোক মহান্তির সম্পাদনায় আমরা তখন শালপাতানামে ঝাড়গ্রাম থেকে একটা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করতাম। ঠিক হল আমি হাজারো কাজের মধ্যেও মাসে দুবার করে এসে সময় দেব, এবং লেখা দিয়ে যাব। মাত্র দুশ কপি ছাপা হত কিন্তু তার-ও বিজ্ঞাপন যোগাড় করা, এবং বিক্রয় করা যে কি কঠিন কাজ, সেটা এক মাত্র ভুক্তভোগিরাই জানেন। তাই অনেক চেষ্টা করেও আমি কলকাতায় চলে আসার পর পত্রিকাটির আয়ু ছয় মাসের বেশী বর্ধিত করা সম্ভব হয়নি। কলকাতা কর্পোরেশনের চাকরিতে যোগদান করার আগে আমি কিছুদিন ঝাড়গ্রাম থেক প্রায় ৩০ মাইল দুরে বেলপাহাড়ি নামে একটি মনোরম স্থানে একটা সরকারী অফিসে কিছুদিন ঠিকাদারির কাজ করেছিলাম। সে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। হটাৎ চাকরি পেয়ে কলকাতা চলে যাই তাই সেখানে কিছু অসমাপ্ত কাজ ছিল সেগুলো শেষ করার একটা ব্যবস্থা করতে হবে, তাই রবিবার সকালেই বেলপাহাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বাসে বেলপাহাড়ি যেতে ঘন্টা দেড়েক লাগে, কিন্তু বেলপাহাড়ি তে নেমে আর-ও তিন চার মাইল পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটতে হত। 
ঝাড়গ্রাম থেকে সোমবার সকালে সোজা অফিসে এলাম, সেই একই পরিবেশ, বসার জায়গার অভাব, আমাদের কারও কোন নিদ্দির্ষ্ট বসার জায়গা ছিল না। একটা বড় টেবিল, আর তার চারিদিকে কয়েকটা চেয়ার। একেবারে মিউজিক্যাল চেয়ার। কাজও নেই তেমন। রোদে রোদে কতই বা ঘুরবো ? কতই বা সিনেমা দেখবো? সবার নিজের নিজের বাড়ি আছে কিন্তু আমাকে তো গিয়ে ঐ তিনতলার ছাদে এসবেসটসের ছোট্ট জেলখানার সেলে গিয়ে সিদ্ধ হতে হবে?
র্পোরেশনের যে বিল্ডিংটায় আমরা বসতাম অর্থাত হগ বিল্ডিং তার নীচেই নিজাম হোটেল, ওখানকার সিক্কাবাব খুব বিখ্যাত ছিল। নীচে সারাদিন ধরে হাজার হাজার সিক্কাবাব তৈরী হ, আর ঠিক তার উপরে ঐ চোঁয়া গন্ধে এবং ধোঁয়ায় আমাদের প্রান ওষ্ঠাগত হয়ে উঠত। পিছন দিকের জনলা থেকে আমরা সব দেখতে পেতাম। কত রকমের খাবার তৈরী হত সারাদিন ধরে। তবে আমি কোন দিন নিজাম হোটেলের সিক্কাবাব খাইনি, আসলে তখন আমার অতো পয়সাও ছিলোনা, তাছাড়া নিজাম হোটেলের পরিবেশটা আমার একদম ভালো লাগতো না। সারা দিনে টিফিনের পিছনে দুটাকার বেশী খরচ করলে পরদিন হিসেব করে চলতে হত। অবশ্য পাশের ফুটনানী চেম্বারের এক তলায় আমীনিয়া রেস্তোরায় বেশ কয়েকবার টিফিন করেছি...। ওদের আমীনিয়া স্পেশাল নামে একটা ডিস ছিল, এক পিস মাটন, এক পিস ডিম, এক পিস গোটা আলু, এক পিস গোটা পিঁয়াজ এসব দিয়ে একটা স্ট্যু মত, সঙ্গে পাউরুটি আলাদ করে কিনতে হ, সব নিয়ে বোধ হয় দুটাকার মত দাম পড়ত।
তবে বেশীর ভাগ দিন আমি এলিট সিনেমার পশ্চিম দিকের গলির ভিতরে কয়েকটা খুব সাধারন খাবারের দোকান ছিল ওখানেই টিফিন করতাম। পঞ্চাশ পয়সায় ঘুগনী পাউরুটি, কিম্বা ডিম-পাউরুটি অথবা তেলেভাজা মুড়ি। পিছনের জানালা দিয়ে যেমন সিক্কাবাব তৈরী দেখা যেত, সামনের জানলা দিয়ে ঠিক তেমনই রাস্তার ওপারেই মিনার্ভা সিনেমা (এখন নাম হয়েছে চ্যাপলিন)। তখন সিনেমা হল গুলির খুব রম রমা, নতুন কোন ছবি এলেই মার মার কাট কাট ভীড় হ, জানালা দিয়ে দেখতাম ব্লাকাররা চিৎকার করত দো-কা-দশ, দো-কা-দশ, মানে দুটাকার টিকিট দশ টাকা।
ওই সময়ে ওই হলে রিলিজ হওয়া একটা সিনেমার নায়িকার নাম ছিল জয়শ্রী টি’, এই নামটা বেশী করে মনে থাকার একটা কারণ আছে। তখন আমাদের সবার বয়স ২৩-২৪-২৫, স্বাভাবিক ভাবেই ঐ বয়সে একটু বালখিল্যেপনা তো থাকবেই। আমাদের অফিসে এক জন মহিলা কর্মচারী ছিলেন তিনি বেশ গুরুত্বপুর্ণ পদে চাকরী করতেন, খুব সম্ভব বড় সাহেবের পি এ ছিলেন। তাই আমাদের উপর বেশ গার্জেনগিরি ফলাতেন। তারও নাম ছিল জয়শ্রী, ৩৫/৪০ বছরের ঐ ভদ্রমহিলা বেশ রোগা এবং একটু ট্যারা ছিলেন তাই আমরা তার নাম দিয়েছিলাম জয়শ্রী টি।মানে জয়শ্রী ট্যারা,” এমন কি মাঝে মাঝে ওনার সামনেও জয়শ্রী টি কথাটা এমন ভাবে উচ্চারণ করতাম যেন উনি শুনতেন জয়শ্রী দি।
মাত্র কয়েক বছর আগেও যেমন ময়দানে বইমেলা,, লেদার এক্সপো,,হ্যান্ডিক্রাফট ফেয়ার এই সব হোত, তখন তেমনি বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে প্রায় এক মাস ধরে একটা মেলা বসত, নাম ছিল বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন
আর আমার সময় কাটানোর পক্ষে এই মেলাটা ছিল একটা দারুন ব্যবস্থা। প্রতিদিন অফিস ছুটির পর আমরা দু-তিন জন একটা করে পচিশ পয়সার টিকিট কেটে মেলায় ঢুকে পড়তাম। এমন কি সঙ্গী সাথী না থাকলে আমি একাই যেতাম। এমনিতে আর পাঁচটা মেলা যেমন হয় তেমনই, চারিদিকে বিভিন্ন দোকানের সারি, নাগোরদোলা সহ বিভিন্ন রাইডস। তবে মেলার মাঝখানে একটা বেশ বড় মঞ্চ তৈরী করা হত, যাতে এক সঙ্গে তিন চার হাজার লোক বসে অনুষ্ঠান দেখত পারত।
আর এই মঞ্চে প্রতিদিনই কোন না কোন আসাধারণ সব উচ্চ মানের অনুষ্ঠান হত। মাত্র পচিশ পয়সার বিনিময়ে উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সব বিখ্যাত নাটক, বিখ্যাত সব গীতিনাট্য এই ধরনের আনুষ্ঠান কিছু না কিছু প্রতিদিনই হত। একমাত্র কিশোরকুমার ছাড়া সব বাঙ্গালী সঙ্গীত শিল্পীর আনুষ্ঠান আমি এখানেই দেখেছি। ভাবা যায়? একই মঞ্চে একদিকে যখন শ্যামা, বজ্রসেন, উত্তরীয়, কোটালের ভুমিকায় অলকানন্দা রায় (?) বা শম্ভু ভট্টার্চায্যের মত নৃত্য শিল্পীরা নৃত্যের মাধ্যমে তাদের অভিনয়কে প্রানবন্ত করে তুলছেন তখন তাদের মুখে ভাষা যুগিয়ে চলেছেন ঐ মঞ্চে বসেই হেমন্ত, কনিকা, সন্তোষ সেনগুপ্ত, বা সুমিত্রা সেন ?
আজ ও মনে পড়ে দেবব্রত বিশ্বাস একে একে গেয়ে চলেছেন...... আজ তোমারে দেখতে এলেম... তোমার পুজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি...... কেন চেয়ে আছো গো মা...... এবং দুটি বা তিনটি গানের মধ্যে একবার করে বিশ্রাম নিয়ে ইন-হেলার নিয়ে নিচ্ছেন। যে জর্জদা তারঁ শুদ্ধ উচ্চরণের জন্য বিখ্যাত, শোনা যায় তাঁর উচ্চারণ থেকেই নাকি স এবং শ-র কিম্বা ন এবং ণ-র তফাৎ বোঝা যায়, সেই জর্জদা কিন্তু মঞ্চে  যখন কথা বলতেন এক্কেবারে ঢাকাইয়া ভাষায়। জর্জদাকে পরে আমি আর একবার মাত্র রবীন্দ্র সদনে গাইতে দেখেছি কোনদিনই আমি তাকে নিজেকে হারমোনিয়াম বাজাতে দেখিনি দুবারই ওনার সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজাতে দেখেছি মায়া সেনকে, আর উনি খালি গলায় গেয়ে যেতেন। কোন দিন আবার মান্না দে শুরু করলেন......না চাহিলে যারে পাওয়া যায়......দশ বারো খানা গান গেয়ে শেষ করলেন...... শাওনো রাতে যদি.......দিয়ে। তবে এদের প্রত্যেককেই এর আগে কিম্বা পরে অন্য কোন অনুষ্ঠানে আবার দেখার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু এক জনকে আমার জীবনে একবারই শুধু এই অনুষ্ঠানে দেখতে পেয়ে আমার দু চোখ ধন্য হয়েছিল, তিনি ভারতের সঙ্গীতের কর্তা...... শচীন দেব বর্মন। গরদের পাঞ্জাবী আর ধুতি পরে যেন সজ্ঞীতের সম্রাট এসে বসলেন। একে একে শুরু করলেন ......তোরা কে যাস রে ভাটি গান গাইয়া... কিম্বা ...টাকডুম টাকডুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল...। পিছন থেকে চিৎকার গাইড গাইড, আরাধনা আরাধনা......। কর্তা তার কুমিল্লার ভাষায় বললেন, না না এইহানে ফিলিমের গান গাইতে কইবেন না, ফিলিমের গান গামু না।



                                                ক্রমশঃ

1 comment:

  1. নারায়ণ দা, খুব ভাল লাগছে আপনার এই লেখা পড়তে । অনেক অজানা কথা জানতে পারছি...

    ReplyDelete

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া