বসন্ত। হায়রে! এই ইঁট- কাঠ- কংক্রিটের শহরে বসন্ত কোথায়? সারা শহর
খুঁজলে একটা পলাশ গাছ দেখতে পাওয়া যায়? এক-আধটা অলীক স্বপ্নের মত শিমূল বা
রুদ্রপলাশ জেগে থাকে।
কারণ, সে গাছগুলোর যে ভারি কড়া জান। শহরের শত অনাদরেও তারা বেঁচে থাকে- আর হ্যাঁ, রঙ
ছড়ায়। তখন কার কথা মনে পড়ে? মনে পড়ে, ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও’; মনে পড়ে ‘লাগলো যে দোল!’
দোলা লাগে বসন্তের, দোলা লাগে উদাসী দক্ষিণ হাওয়ায়। সব কথা যে তাঁকে ঘিরেই।
বোলপুরগামী ট্রেন-বাস ভিড়ে ঠাসা
দোলপূর্ণিমার সময়। হুজুগ?
হ্যাঁ, বাঙ্গালী হুজুগে, তাতে সন্দেহ নেই। তবুও ত, হুজুগেও যদি তাঁকে মনে পড়ে,
ক্ষতি কি?
বসন্ত যে শুধুমাত্র শীতের অবসান ঘটিয়ে পৃথিবীর
আবর্তনের মধ্য দিয়ে ঋতুবদলের কথা বলে, তা নয়। বসন্ত যেন এক নতুন সময়ের আহ্বান। এমন
তো নয় যে বাঙালিজাতি রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের আগে বসন্ত উৎসব পালন করত না! অবশ্যই
করত। সেই দোলযাত্রা এখনো আছে। বাঙ্গালীর অন্তরের জিনিস হয়েই আছে। বৈষ্ণবরা বিশেষ
মর্যাদায় পালন করেন এই উৎসব। কিন্তু ধর্মের গণ্ডী ছাড়িয়ে এই উৎসবের যে শোভন- শালীন
রূপ, তা সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের মননের আশ্রয়ের
বাইরে কল্পনাতীত। রাজস্থানের হোলি উৎসবের যে রূপ দেখিয়েছেন কবি ‘হোরিখেলা’ কবিতায়,
রোমাঞ্চিত হয়নি সেই বর্ণনা পড়ে, এমন বাঙালি কমই আছে। কিন্তু সেই উৎসবের সুর বড়ই
উচ্চগ্রামে বাঁধা। এমনকি কবিতার নাটকীয় ঘটনা শেষ হয় লড়াই এবং প্রতিশোধে। এ যে
শুধুই মধুবনের ফুল উৎসব নয়।
কেউ বা রবীন্দ্র-প্রভাবিত শান্তিনিকেতনের ধাঁচে
পালিত বসন্ত উৎসবকে বলবেন আরোপিত ন্যাকামি। বলবেন এই উদযাপনে প্রাণের স্পন্দনের স্বাভাবিক
প্রকাশ কোথায়? কিন্তু তার আগে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন স্বাভাবিক প্রকাশ বলতে আমরা ঠিক
কি বুঝবো। বর্তমান সময়ে সমাজে বিভিন্ন স্তরে নারীমানুষ যত এগিয়ে আসছে, তত তাকে
বাধাপ্রাপ্ত হতে হচ্ছে। দোল উৎসবের দিনে নারীর সম্ভ্রমহানি, পশুদের প্রতি
নিষ্ঠুরতা- এটাই কি উল্লাসের স্বাভাবিক প্রকাশ? তাহলে মেনে নেওয়া ভালো স্বাভাবিক প্রকাশের প্রয়োজন
নেই। তাহলে বাঙ্গালী নাহয় বন্ধ করুক বসন্তের উদযাপন। তিনি যে পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন দোল উৎসব উদযাপনের, থাক না সেটুকু
সেখানেই তার সমস্ত অস্বাভাবিকত্ব নিয়ে বাঁধা পড়ে। এ জাত যে এখনো নারীকে সম্মান
দিতে শেখে নি, শেখে নি দুর্বলের পাশে দাঁড়াতে। সে জাতি বসন্তের উদযাপন করবে কি
ভাবে? এই বিকৃতিকে কবিই বলে গিয়েছিলেন, ‘পরস্পরকে মলিন করাই তার লক্ষ্য, রঙিন করা
নয়।’
তিনি কবি। বসন্তে প্রকৃতির শোভা তার মত করে আর কে
বলতে পারে? সেই অপার সৌন্দর্যের মধ্যে আনন্দের সন্ধান করতে গেলে তার ভাষা ধার করা
ছাড়া আমাদের বিশেষ উপায় থাকে না। এই সুন্দরকে তিনি বর্ণনা করেন... ‘বসন্তকালে
লতাগুল্মের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে কুঁড়ি ধরিয়া ফুল ফুটিয়া পাতা গজাইয়া একেবারে যে
মাতামাতি আরম্ভ হয়, আম্রশাখায় মুকুল ভরিয়া উঠিয়া
তাহার তলদেশে অনর্থক রাশিরাশি ঝরিয়া পড়ে, ইহা আনন্দের প্রাচুর্য।’ কিন্তু আবার শুধুই সুন্দরকে উপভোগ করা, শুধু আনন্দস্বরূপকে উপলব্ধি
করা, তাও কিন্তু এই উদযাপনের মূল সুর নয়। কবি
আমাদের নিয়ে যেতে চান আরও গভীর
অবগাহনে। বসন্ত
উৎসবের অনুভব তার কথায়... ‘এ উৎসব তো
শুধু আমোদ করা নয়, এ তো অনায়াসে হবার জো নেই ।
জরার অবসাদ, মৃত্যুর ভয় লঙ্ঘন করে তবে সেই
নবজীবনের আনন্দে পৌঁছনো যায়।’ হ্যাঁ, বাধাবিপদ সবকিছুকে পিছনে রেখে তবেই হয়
বসন্তের প্রকৃত উদযাপন। কবির অনুভবে বসন্তের উদযাপন শুধুই ঋতুর বরণ নয়, নয় রঙের
উৎসব, এ যেন এক বিপ্লব! কবি দেখতে পান এই লীলা বারেবারে। ‘ফাল্গুনী’ নাটকে বাউল
বলে ওঠে, ‘যুগে যুগে মানুষ লড়াই করেছে, আজ বসন্তের হাওয়ায় তারই ঢেউ। যারা মরে অমর, বসন্তের কচি পাতায় তারাই পত্র পাঠিয়েছে।’ হ্যাঁ, সমাজের
পুরাতন, জীর্ণ যা কিছু ফেলে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মানুষের যে আত্মবলিদান, যে
ত্যাগ, সে সবকিছুই যেন বসন্তের দক্ষিণ সমীরণে এসেছে ফিরে নতুন দিনের বার্তা নিয়ে। এত পলাশ- শিমুলের সমারোহ শুধুই যে রঙের খেলা নয়!
বসন্ত-পূর্ণিমায় সুন্দরের আবাহনে ‘পঞ্চমে বাঁশি বাজবে, পুষ্পকেশরের ফাগ উড়বে, আলোয় ছায়ায় হবে গলাগলি সেই
দক্ষিণের কুঞ্জবনে।’ হ্যাঁ, আলোয়- ছায়ায় মিলে যাওয়ার কথা। ভুলে যেতে
হবে অগৌরবের দিন। সেইদিন আসবে কবির অনুভবের সেই বসন্তের প্রকৃত উদযাপন, যেদিন
আমরা পরাভূত করতে পারবো সমাজের অশুভ
শক্তিকে। উদযাপনের প্রাণশক্তির প্রকাশ হিসেবে আর কেউ কাউকে মলিন করা বা পাঁকে টেনে
নামানোর খেলায় মেতে উঠবে না।
ভীষণ ভাল লাগছে......।কত কিছু জানতে পারছি.........
ReplyDeleteভীষণ ভাল লাগছে......।কত কিছু জানতে পারছি.........
Deleteবাঃ....
Delete