Wednesday, March 22, 2017

ফিরে দেখা (ধারাবাহিক)............সুব্রত ঘোষ



মাঝে মাঝে দেখছি আসিফের কল আসছে, বোঝা যাচ্ছে ও আড্ডায় থেকেও কাজের চাপে অন্য মনস্ক।
ঘন ঘন বিজয় বউয়ের খবর নিচ্ছে, খাওয়া হয়েছে কিনা। পলাদি রান্নার তদারকি করছে মাঝে আর আমাদের জ্ঞান দিচ্ছে, বেশী ড্রিঙ্ক করিস না কেউ তোরা। কবীর আবার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত, কি করছে জানি না। সব্বাই কেমন আড্ডায় থেকেও নেই, নিজের নিজের জগত নিয়ে আছে আড্ডার মাঝেই। শুভ পানীয়ের নেশা উপভোগ করছে বেসুরো গান করে। আমি একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, ভাই সব্বাই কতদিন পর একসঙ্গে হলাম, একটা দিন তো নিজের রোজকার জগতের বাইরে এসে প্রানখুলে আড্ডা দে। গএকবার একটু ধোঁয়ার নেশা করা দরকার, তাই উঠে পড়লাম, ব্যালকনিতে গিয়ে সিগারেট ধরালাম। বাইরে টা বেশ সুন্দর বাগান দিয়ে সাজানো, আকাশ টা খুব পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম অহনা পাশে দাঁড়িয়েছে। কিরে কেমন আছিস রজতদা, জিজ্ঞাসা করলো অহনা। অনেকদিন পর তোকে দেখছি, কতো পরিবর্তন, শেষ যখন দেখেছি তখন তুই বেশ রোগা কিন্তু হ্যান্ডসাম ছিলি। এখন মোটা হয়েছিস, চোখে চশমা, মাথায় চুল কমে গেছে,মুখে বয়সের ছাপ পড়লেও তুই আজও একই রকম গ্লামারাস। কতদিন তোর কথা ভেবেছি, কোথায় আছিস, কেমন আছিস।বলে আমার পিঠে হাত রাখল অহনাএকটু অস্বস্তি হচ্ছিলো কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম আমি এখন মুম্বাই তে আছি রে, আর কেমন আছি? একদম ফিট আর ফাইন। রোজকার জীবনে কখনো এখানে কখনো বিদেশে, যাযাবরের জীবন। বাড়িটা আমার সরাইখানার মতো। আমরা যে যার মতো আছি, কাজ নিয়ে, বাড়িতে বউ ছেলে সবার সঙ্গে রোজ যে দেখা হয় তাও না। আচ্ছা তোর কি আমার কথা মনে পড়েছে কখনো...জিজ্ঞাসা করে অহনা। তোর কথা কেন ভুলবো, কি করে ভুলবো বললাম আমি। ছোটবেলা পাশা পাশি বাড়িতে আমরা বড় হয়েছি। একে অপরকে দেখেছি খুব কাছাকাছি। শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা একসঙ্গে,  "কৈশোর যৌবনের অধ্যায় তোকে দেখেই শুরু। সেইদিন গুলো কি ভোলা যায় রে...বললাম। আমাকে দেখে শুরু... তবে সেটা বলিস নি তো কোনদিন ?" জিজ্ঞাসা করে অহনা। বলার মতো অবকাশ পেলাম কৈ। মাধ্যমিকের ফল বেরোনোর পর সেই দৌড় শুরু। আর যখন শেষ হল ! আমরা দুর্গাপুর ছেড়ে দিয়েছি। তুইও তো বর্ধমানে পড়তে চলে গেছিসযোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেলো। যেই অনুভূতি গুলো নিয়ে যৌবনের দ্বারে তোর সঙ্গে দেখা, সেগুলো শেয়ার করার মতো উপযুক্ত সময় এলো কোথায় রে।"চল একবার আমাদের পুরনো বাড়ি দুটো দেখে আসি,যাবি? ওরা একটু আড্ডা দিক," বললাম অহনাকে। বাবুলকে বলে আমি আর অহনা বেরলাম গাড়িতে, উদ্দেশ্য আমাদের পুরনো বাড়ি দুটো চাক্ষুষ করা, কতো স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে ওই বাড়ি দুটোয়, সেই স্মৃতিগুলো একটু নেড়ে চেড়ে দেখা। গাড়িতে বসে এগোতে শুরু করলাম, রাস্তার দুই ধারে গাছ গুলো সব কেমন চেনা, কতদিন পর দেখে ওরাও আন্দোলিত হয়ে স্বাগত জানাচ্ছে যেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই এসে পড়লাম আমাদের সেই চেনা রাস্তায়, যেখান থেকে একটা বাঁক নিয়ে ছোট রাস্তা চলে গেছে সেই বাড়ি দুটোর গায়ে, ছোটবেলার সেই পুরনো কোয়ার্টার। আজ যদিও অন্য কেউ থাকে নিয়মানুযায়ী। একটু কিন্তু কিন্তু করে ঢুকলাম সেই বাড়িতে, যেখানে আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে, যৌবনের শুরু হয়েছে যেখান থেকে। গেট খুলে ভেতরে ঢুকবার সময় বুক দুরু দুরু করছিলো, পাছে এখন যেই পরিবার আছে তারা কিছু বলে। ভেতরে ঢুকে বেল দিয়ে জানালাম আমাদের আগমনের কারণ, যে মহিলা বেরিয়ে এলেন,তিনি সহাস্যে আমাদের ঘরে যেতে বললেন। যদিও আমরা ঘরে না গিয়ে বাগানে গিয়ে দাঁড়ালাম। বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে দুজনেই তাকিয়ে রইলাম বাগান আর পাশের বাড়িটার দিকে। ওই বাড়িতেই তো থাকতো অহনারা। দ্যাখ ওই যে পেয়ারা গাছটা, স্কুল থেকে ফিরে কতদিন ওই গাছের ডালে বসে থাকতাম,তোকে দেখব বলে, তুই চুল আঁচড়াতিস জানালার ধারে এসে, কিরে তাই তো? কখনো  তুই ওই জানালার সামনে এসে দাঁড়াতিস, মাসীমা তোকে ভেতরে যেতে বলতেন, আর তুই এক শালিক দেখেছিস, দুই শালিক দেখার ছলে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতিস, আমাকে দেখবি বলে, তাই না... জিজ্ঞাসা করলাম অহনাকে। আস্তে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো অহনা। আর ওই যে টগর গাছটা তোদের বাগানে, রবিবার সকালে পুজর ফুল তুলতিস তুই, অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থাকতিস অছিলায়, আমার ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে, আমি লুকিয়ে দেখতাম তোর সেই আকুলতা, ছটফটানি। তবে তুই আমাকে ভালবাসতিস... বলিসনি কেন তখনজিজ্ঞাসা করে অহনা। তুই গান করতিস ওই ঘরে বসে, কৈশোরে কোন মহিলার গান শোনা সেতো তোর কণ্ঠেই।  ক্লাবে বিজয়া দশমীর অনুষ্ঠানে তুই গান করতি, সঙ্গে শুভ, এক এক সময়ে খুব রাগ হতো সুভর ওপর, ভাবতাম বুঝি তোকে গানের খেয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে যাবে আমার মনের বাইরে। জানিস কতদিন গান শুনি নি, আসলে শোনার মতো সুযোগ বা পরিস্থিতিও হয় নি। একটা গান করবি...আব্দার করলাম অহনাকে। অহনা গান ধরল, জীবন মরন সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে... আমি তোকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম উত্তর পাই নি...গান শেষ করে বলল অহনা। তুই  তোর মনের কথা গোপন করে রেখেছিলি কেন? তুই কি আমাকে ভালবাসতিস, জিজ্ঞাসা করলাম অহনাকেতুইই বা কেন সেই কথা এতদিন গোপন করেছিলি, বললাম। দ্যাখ তোর প্রতি একটা দুর্বলতা ছিল, সেটা ভালোবাসা নাকি ভালোলাগা, সেই ব্যপারটা বোঝার আগেই তো তুই চলে গেলি দুর্গাপুর ছেড়ে, বলে অহনা। পরে বুঝেছিলাম সেটা ভালোলাগা দিয়ে শুরু হলেও মনের সূক্ষ্ম তন্ত্রে অনুরণন সৃষ্টি করেছিলো, বহুদিন বলব বলব করেও কেমন একটা লজ্জা আর দ্বিধায় বলা হয় নিআর যখন বলার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হলাম তখন তোকে পেলাম কোথায় প্রকাশ করার জন্য, বলে উঠলো অহনা। জানিস হোস্টেলে থাকার সময়ও কিছু কিছু সময় একটা শূন্যতা সৃষ্টি হতো মনে, বিশেষ করে বিকেলের দিকেওই সময়টা জানালা দিয়ে তোকে দেখতাম, ভীষণ ভাবে মিস করতাম তোকে, আমিও বুঝি নি সেটা ভালোলাগা , ভালোবাসা নাকি একটা মোহ, বললাম। তবে দুর্গাপুর ছেড়ে যাওয়ার পর কোনদিন ভাবিনি তোর সঙ্গে আবার দেখা হবে। মনের ভেতর একটা অদ্ভুত শূন্যতা কাজ করতো, সেটা কেন জানি না বা বুঝতে পারি নি বললাম অহনাকে তুই গান করছিস এখন...জিজ্ঞাসা করলাম। নাহ্ অনেকদিন গান করি নি, আসলে গান করার মতো পরিস্থিতি বা শোনার মতো মানুষও নেই আমার জীবনে। কত্তা মশাই টিউশন নিয়ে থাকেন, স্কুলের পরে। তাই কোন অবকাশ নেই ওনার, তা ছাড়া গানের ব্যপারে কোন আগ্রহ নেই ওনার, তাই আর গান করা হয় না, বলল অহনা। দ্যাখ জীবনে যে কোন কাজে যদি কোন উৎসাহ দেওয়ার মানুষ না থাকে তবে সেই কাজ অকালে শেষ হয়ে যায়, বলে অহনা। আমার জীবনে সুখ বা স্বাছন্দ যা আছে তা সবই বাঝ্যিক, মনের জায়গাটা আজও অপূর্ণ, বলে অহনা। যদি সেই সময় তোর মনের কথা প্রকাশ করতিস তবে হয়তো আজ আমার ঠিকানা কেয়ার অফ রজত বাসু হতো। কিন্তু বিধাতার না চাওয়া, সেটাকে তো আমরা কেউই উপেক্ষা করতে পারি না। জানিস আমি রোজ বাড়ি ফিরি যখন, আমাকে একটু জল গড়িয়ে দেওয়ার জন্য কেউ থাকে না, আমার স্ত্রী নিজেও কাজের মধ্যে আছে তাই তাকেও আমি বলতে পারি না, আমার অবস্থান ওই বাড়িতে খানিক টা ফিনান্সারের মতো। স্ত্রীর ব্যবসায় টাকা লাগবে, ছেলের জন্য টাকা লাগবে, সেই সময় শুধু আমার সঙ্গে কথা বা যোগাযোগ। সংসারের মাধুর্য আজও আমার কাছে অধরা। হয়তো আর এই জীবনে সেটা ছোঁয়া হবে না, বলে ফেললাম আমিতবে একটা কথা জানবি, ভাললাগার মধ্যে যে মাধুর্য আছে, ভালবাসার মধ্যে সেটা নেই। খেয়াল করে দেখিস ভালোবাসা কথাটার মধ্যে একটা আশা বা প্রতি আশার কথা লুকিয়ে আছে। আর আছে নিজের মতো করে চাওয়া বা পাওয়ার একটা অভিপ্রায়।আমার মনে হয় যে কোন সম্পর্কে বিবাদ সেই আশা বা প্রত্যাশা থেকেই। তোর কাছ থেকে আমার আশা বা প্রত্যাশা কিছু নেই, তাই হয়তো তোর ব্যপারে আজও মনে একটু অন্য অনুভূতি রয়েছে। আচ্ছা আজ আমার মুখে তোর সম্পর্কে আমার মুল্যায়ন শুনে কেমন অনুভূতি হচ্ছে তোর...জিজ্ঞাসা করলাম অহনাকে। বলব? খুব আফসোস হচ্ছে, ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে সেই সময়ে যখন আবার নতুন করে তোকে বলার সুযোগ পেতে পারি, ভালবাসি, বলল অহনা। দ্যাখ আজ তোর আর আমার জীবন একদম ভিন্ন স্রোতে বয়ে চলেছে, গন্তব্য এক হলেও আমরা দুজনে দুটো পথে এগিয়ে চলেছি অমৃতের সন্ধানে, বললাম আমি। ফিরে দেখা দিনগুলো আমাদের জীবনে পথ চলার পাথেয় হতে পারে কিন্তু সমান্তরাল সরল রেখার মতো, যা কোনদিন এক হয়ে যাবে না অথচ ভীষণভাবে একে অপরের প্রতি দুর্বল। জানিস আমার কোন অভিযোগ নেই পরিবারের প্রতি যদিও আমার গিন্নি কোনদিন বুঝতে চায় নি আমি ঠিক কি চাই মানসিকভাবে। সংসারের প্রতি দায়বদ্ধ তাই নিজের চাহিদাকে গুরুত্ব না দিয়ে সংসারের কর্তব্য করে চলেছি। আমি যন্ত্রমানব হয়ে গেছি, বলে কেঁদেই ফেললাম আমি। অহনা আমার কাধে হাত রেখে বলল, রজতদা, যন্ত্রমানব শুধু তুমি নয়, সম্পর্ক বা সমাজের চাহিদার কথা মাথায় রেখে আমরা প্রায় সব্বাই তাই হয়ে আছি। এর মধ্যে যারা একটু বিদ্রোহ করে ফেলে তাদের বিচ্ছেদ অনিবার্য। আর তোমার আমার মতো যারা মুখ বুজে আছে, তাদের সারা জীবন না সওয়া এক সম্পর্ককে বয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় তো নেই। কথা বলতে বলতে অনেক বেলা গড়িয়ে গেলো, প্রায় ২ টো বেজে গেলো। অহনাকে বললাম এইবার চল রে। ওরা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য অপেক্ষ্যা করছে। তোমার হাতে একটু স্পর্শ করবো, জিজ্ঞাসা করে অহনা। খুব ইচ্ছে করছে জানো। যদিও আমরা দুজনে দুটো আলাদা সম্পর্কে আবদ্ধ তবুও কেন জানি না অন্যায় মনে হচ্ছে না এই প্রস্তাবে, হাত বাড়িয়ে দিলাম অহনার দিকে, ও আমার ডান হাতের তালুতে চুম্বন করলো। বিদ্যুতের তরঙ্গ বয়ে গেলো বুঝি মনের ভেতরচুপ করে অনুভব করলাম সেই তরঙ্গের ব্যপ্তি। যৌবনের শুরু যেই মহিলাকে দেখে বা মনে করে সেই মহিলার আবেগ মাখা স্পর্শ কেমন যেন মোহিত করে দিলো কিছুক্ষনের জন্য। তারপর চুপচাপ বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই। গাড়িতে উঠে বসলাম বাবুলের বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়ি চলল।
                                                     ক্রমশঃ 

1 comment:

  1. বেশ লাগছে...পরের সংখ্যা র অপেক্ষায় রইলাম

    ReplyDelete

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া