রাত তখন দশটা। আমার দু’চাকাটা ঘড় ঘড় করে যাত্রার সূচনা করল। তারপর
ফার্স্ট গিয়ার, সেকেন্ড গিয়ার থার্ড গিয়ারে ভর করে যেই চড়তে যাবে গতির পাহাড়ে অমনি
এক রামধাক্কা। গলাধাক্কার থেকেও প্রবল এ ধাক্কার নাম প্রতিমা দর্শনার্থী। পুরীর
সমুদ্রে যখন ঢেউয়ের পরে ঢেউ আসতে থাকে তখন মাথা উঁচিয়ে থেকেছেন কি? যিনি থেকেছেন
তিনি ক্রমশ চলে যাচ্ছেন সমুদ্রগর্ভে অর্থাৎ বেলাভূমি থেকে অনেক দূরে। আমারও অবস্থা
খানিকটা তেমনই। সেই মহাভীড়ের ভয়ে ভীত আমার দ্বিচক্রযান তার ইঞ্জিনকে পৌঁছে দিয়েছে
থার্ড গিয়ার থেকে আবার ফার্স্ট গিয়ারে। আমার বাঁ পা যথারীতি মাথা নত করেছে মাটিতে।
ক্লাচকে অতি কষ্টে চেপে ধরে অ্যাকসিলারেটর ঘোরাচ্ছি সন্তর্পণে। মাঝে
মাঝে পেছন ফিরে দেখছি খানিকটা গরুচোরের মত। কিন্তু ব্যাকগিয়ারেও (যদিও এটা কোনও
দু’চাকার গাড়িতে থাকে না।) নো এন্ট্রি। ভীড় এসে ট্র্যাফিক পুলিশের ভূমিকায়
অবতীর্ণ।
পুজো প্যান্ডেলকে বাঁ হাতে পাশ কাটিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরেছি
নিরূপদ্রব পরিভ্রমণের উদ্দেশ্যে। এখানে নেই আলোর উজ্জ্বলতা। কিন্তু সেই
আধা-অন্ধকারে কলকাকলির কমতি নেই। আলোআঁধারির এই লুকোচুরিতে অভাব নেই
হাস্যপরিহাসের। অভাব নেই যথেষ্ট রস নিনিময়েরও। আমার দু’চাকার গিয়ার সেকেন্ড হয়েই
রইল থার্ড আর হতে পারল না।
গলি থেকে রাজপথ—কোনরকমে তো এসেছি। রাজপথে পা দিয়ে মাথা ঘুরছে বনবন
করে। কোথায় পা রাখব আমি মানে আমার চাকা? কালো পিচের বদলে শুধুই কালো মাথা। এ সময়
উপগ্রহ থেকে তোলা কোনও ভিডিও চিত্র দেখলে মনে হবে অসংখ্য কালির ফোঁটা বুঝি নড়ে চড়ে
বেড়াচ্ছে।
ক্লাচের চাপুনিতে আমার গাড়ি রুদ্ধশ্বাসে ফুঁসছে। দুই থেকে এক নম্বরে
আবার হয়েছে গিয়ারের অধঃপতন। পা ছুঁয়েছে মাটিকে (মাঝে মাঝে আবার চলতি মানুষের বিছোন
পায়ের পাতার কার্পেটে। নিখঞ্জ আমি খোঁড়াতে খোঁড়াতে কেমন ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে
চলেছি। আমার গাড়ির হর্ণের তারস্বর সম্মিলিত কোলাহলে ঢাকা পড়ে গেল। পদযাত্রিদের
সতর্ক করার প্রয়াসে আমিই সর্বদা সতর্ক আর ভয়ে কাঠ হয়ে রইলাম। গাড়ি চালানোর মহাসুখ
আমি টের পেলাম হাড়ে হাড়ে।
নদীর স্রোতের মত ভিড় এগিয়ে চলেছে। রাস্তায় আলোর বিশেষ সমারোহ নেই।
মাথার ওপর অদূর আকাশে বিছোন মিড়মিড়ে মিনিয়েচারের তারকামন্ডলী আর মাটির নিচে তার
অস্পষ্ট কম্পিত ছায়া। এটাই নাকি এ যুগের ফ্যাসান। ভীড়ের ঘনত্ব এখানে তুলনায় অনেক
কম। ছায়াছায়া সেই ভাবগম্ভীর পরিবেশে টুকরো টাকরা কথা। কেমন যেন আধি দৈবিক পরিবেশ।
কত গলি কত রাস্তা। আগে দেখিনি। কিংবা দেখেছি হয়ত খেয়াল করিনি। কিংবা
খেয়াল করেছি মনে রাখিনি। দূরে প্যান্ডেল দেখা যাচ্ছে। না প্যান্ডেল নয়। এ তো একটা
বিয়ে বাড়ি। বিশাল আলোকমালায় সজ্জিত এক প্রজাপতি। সানাই বাজছে। আশ্বিন মাসে বিয়ে হয়
কিনা ভাবতে ভাবতেই আর এক বাধা। এখান থেকে শুরু হল ডিভাইডার। পথ মেপে দিল দড়ির
বন্ধন গ্রন্থি। প্রবেশেচ্ছু আর নির্গমোনেচ্ছুদের আলাদা পথ। গাড়ি এখানে রেখে হয়ত
সিকি কিলোমিটার হাঁটতে হবে।
ফিরে এসে আবার চলা (মানে গড়ানো আর কি)। কতদূর গেছি আর কত ঠাকুর
দেখেছি মনে নেই। কেননা ভাবে হঠাৎ বিভোর হয়েছি আমি। অতি আধুনিকতার মাঝে
অতিপ্রাচীনতাও আমাকে আবিষ্ট করে রেখেছে। হঠাৎ সোমনাথের মন্দির আমার সামনে। পুলকিত
আমি মুহূর্তে অনুভব করি আমার সামান্য দু’চাকায় গুজরাট ভ্রমণ করছি আমি। তার মানে
আমার সামনে একঝাঁক রিপোর্টার আর ক্যামেরা পার্সন। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে
হাত-পা-মুখ নেড়ে আমি ব্যক্ত করছি আমার সুদীর্ঘ কষ্টকর ভ্রমণ কাহিনী। এই বয়েসে আমি
সেলিব্রিটি হয়ে গেছি। আর আমাকে পায় কে।
--প্যান্ডেলটা দারুণ তাই না? মনেই হয় না এটা একটা প্যান্ডেল। আহা কি
দারুণ টেকনিক!
কে যেন বলল পাশ থেকে। আর হয়ত আমার নীরবতাকে তার মতের সমর্থক ধরে নিয়ে
চলে গেল আর সময় নষ্ট না করে। চলে গেল আমাকে পেছনে ফেলে। কারণ মুগ্ধতার রেশ তখনও
কাটে নি আমার।
সত্যি তো। গুজরাটে নয় আমি রয়েছি এই বাংলাতেই। আর হুঁকোমুকো হ্যাংলার
মতই অবাক বিস্ময়ে চোখ আমার ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। তারপর এক এক করে কোথাও ভিক্টোরিয়া
মেমোরিয়াল, কোথাও অজন্তা ইলোরার গুহা আবার কোথাও খাজুরাহো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে
চোখের সামনে থিমের পর্দায়। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, স্থাপত্য, ভাস্কর্য
সব কিছু যেন নিপুণ মোড়কে উপস্থাপিত। নকল যে আসলকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে এটা যেন আবার
একবার উপলব্ধ হল।
থিমের এই আশ্চর্য মলম দু’চোখে মেখে আমার দু’চাকার রথ ভীড়ের মধ্যে
দিয়ে শ্লথ গতিতে। হঠাৎ একটা বিশাল ঝাঁকুনি দিল গাড়িটা তারপর আবার চলতে লাগল। এই
ঝাঁকুনিটা অবশ্যই ছিল থিমের এই জগৎ ছেড়ে অন্য কোনও জগতে যাওয়ার গিয়ার পরিবর্তনের
ঝাঁকুনি।
বিশাল বিশাল প্যান্ডেল যেন আকাশকে ছোঁয়ার পাল্লায় নেমেছে। বিরাট
বিরাট গেট। আধ কিলোমিটার জুড়ে আলোকের কেরামতি। রামরাবণের যুদ্ধ থেকে কারগিল যুদ্ধ
কি নেই? যেন জেনারেল নলেজের সচিত্র প্রদর্শনী। প্যান্ডেলের গেটে পর্দা ঝোলান। মা
এখানে পর্দানশিন। গেটের বাইরে আধ মাইল জুড়ে দর্শনার্থীদের সাগ্রহ সারিবদ্ধ
অপেক্ষা। কচ্ছপকে লজ্জা দিয়ে এগিয়ে চলেছে সে লাইন। মনের মাঝে অচেনা পর্দাখানা
কিন্তু উঠে গেল সহসা। আরে এ তো আমার চেনা চেনা যেন। হ্যাঁ আমার গাড়ির
ঝাঁকুনি-গিয়ার আমাকে প্রায় দেড় দশকের বেশি পিছিয়ে দিয়েছে। স্মৃতির ডায়রিখানার পাতা
কে যেন উলটে উলটে জানিয়ে দিল এটা ঠিক।
আলো আলো আর আলো। প্যান্ডেলের বিশালতা আর বিস্ময়ভরা বৈচিত্র। এসব
ছাড়িয়ে আমার গাড়ি আবার ঝাঁকুনি দিয়ে এগিয়ে (পড়ুন পিছিয়ে) চলেছে। ভীড় যেন বেশ একটু
কমে গেছে। প্যান্ডেল যেন নয় আর বাক্সবন্দীও। মা এখানে বেশ খোলামেলা আবহে আছেন।
আলোর তান্ডব বেশ একটু কম। প্যান্ডেলগুলোও আকারে আর উচ্চতায় বেশ একটু ছোট। মাইকে
তারস্বরে বাজছে হিন্দিগান। ছেলেমেয়ে সব সে তালে মেতেছে। মেয়েদের থেকে ছেলেরাই
সংখ্যায় অনেক বেশি। প্রতিমার মুখগুলিও যেন চেনা চেনা লাগছে। মনের চোখে ভেসে ওঠে কত
বলিউডি দৃশ্য।
গাড়িতে আবার একটা ঝাঁকুনি। কারা যেন সমস্বরে বলাবলি করছে,
ব্যাকগিয়ার! ব্যাকগিয়ার!!
আমার গাড়ির ঝাঁকুনি-গিয়ার আমাকে আবার নিয়ে গেল গত শতকের সাত দশকের
এপার ওপার। প্যান্ডেলে ভীড় তখনকার হিসেবে গাদা হলেও এখনকার হিসেবে তেমন কিছুই নয়।
ডিজে দূরে থাক, বক্স পড়ে থাক—চোঙা মাইকে আধুনিক গান বাজছে। লতা, আশা, সন্ধ্যা,
হেমন্ত, মান্না, শ্যামল, পিন্টু, তালাদ, কিশোর, আরতি, বনশ্রী, পান্নালাল, ধনঞ্জয়,
পঙ্কজ, আরতি আরও আরও কত। কখনও মাইকে বাজছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের দরদী-ভরাট গলায়
মহালয়ার চন্ডীপাঠ। তখন মহালয়ার ভোর থেকেই বাতাসে শিউলি, পদ্ম, শালুকের সঙ্গেই
শুভ্র শারদীয়ার পুজো পুজো গন্ধ ভেসে বেড়াত।
প্যান্ডেল ধূপ আর ধুনোর গন্ধে আমোদিত উৎফুল্ল। সোনাগলা রোদ্দুরটা কড়া
হলেও মানুষ সইয়ে নিচ্ছে দিব্বি। কেননা শরৎ এসেছে, শারদীয়া হেসেছে। ঢাকের ডাক যেন
মনের মধ্যে ছড়িয়ে দিত অদ্ভুত এক মাদকতা।
সারা বছর যে সব জামাকাপড়ের দোকান মাছি খুঁজে খুঁজে হন্যে হয়ে বেড়াত
মারার জন্যে তারাই এখন গায়ে মশা বসলেও মারার সময় পাচ্ছে না। তখনও মাল্টি
ন্যাশন্যাল হয় নি। প্রাইভেট সেক্টর বলে কোনও শব্দ আছে কিনা সে সব নিয়ে সাধারণ
মানুষ মাথা ঘামাত না। ছেলেমায়েদের সারা বছরের জামাকাপড় হত এই সময়। তাও বছরে দুই বা
তিনটির বেশি নয়। সেই নিয়েই উদবাহু হত। বাড়ি বাড়ি সবাই ঘুরে ঘুরে পুজোর জামাকাপড়
দেখতে বেরোত। উৎসবের আগে সেও ছিল এক আকর্ষণীয় মহা উৎসব। নস্টালজিয়া শব্দটি তখনও
কিছু প্রোথিতযশা সাহিত্যিকের কলমে আটকে ছিল। প্রবেশ করে নি সাধারণ্যে। প্রবেশ করার
দরকার হয় নি। তখন পৃথিবীর ঘূর্ণন বেগ এখনকার মত প্রচন্ড ছিল না। জগৎ পাল্টাত খুব
ঢিমেলয়ে।
তারপরে এক কান্ড। আবার এক প্রকান্ড ঝাঁকুনি। গাড়ি কোথায়? আমি শুয়ে
আছি বাড়িতে। পাশে আমার মা। ঘুম ভেঙ্গেছে ‘দুর্গা মাইকি’ এই আনন্দ উচ্ছ্বল চিৎকারে।
আমরা সবাই উঠে পড়েছি। এই পঞ্চমীর রাত আমাদের যেন এক মহা জাগরণের রাত। ঘড়িতে তখন
রাত দেড়টা পৌনে দুটো। হুড়মুড় করে সবাই সেই গভীর রাতেও বাইরে। ল্যাম্প পোস্টের অল্প
আলোয় লড়িটা এগিয়ে আসছে ঢিমেতালে পিঠে প্রতিমা নিয়ে। লড়ির পিঠে ঠাকুর নয় যেন একটি
গোটা বাঙালি পরিবার। মধ্যরাত থেকে তিনটে চারটের মধ্যে পাড়ার রাস্তা দিয়ে পিঠে মাকে
বয়ে নিয়ে যাওয়া লড়ির দল। এ পাড়া ওপাড়া সেপাড়া। এরা শুধু প্রতিমাই বয় না। বয়ে নিয়ে
আসে আসন্ন শারদীয় আনন্দকেও।
প্রতিমা দেখার পর আমরা শুয়ে পড়েছি। গুরুজনের ভ্রূকুটির ধার এখন একটু
কম। হাই এসেছে গন্ডায় গন্ডায় কিন্তু ঘুম আসে নি। মা বলল, দেখতে দেখতে পঞ্চমী এসে
গেল। মনে হচ্ছে যেন এই তো সেদিন পুজো গেল।
বোন বলল, পঞ্চমী কি গো মা। মহালয়ার ভোর থেকেই তো পুজো লেগে গেল। ওঃ
এই চারপাঁচ দিন যে কিভাবে কাটিয়েছি। শুধু ভেবেছি পঞ্চমী কবে আসবে। এই রাতে ঠাকুর
দেখতে খুব মজা তাই না ভাই?
পঞ্চমীর সেই রাতটা কি আর ঘুমোতে পেরেছি? কখন যে ষষ্ঠীর সকালটা আসবে।
কনমতে মুখটা ধুয়েই ছুটতে হবে প্যান্ডেলে। চা খাবার সময় পর্যন্ত থাকবে না। প্রতিমা
কেমন হল দেখতে হবে। অসুরের মাসল গুলো কত ফুলো কিংবা সিংহের হাঁ টা কত বড় তা দেখার
প্রবল বাসনা আমাদের। সরস্বতীর হাঁস কিংবা গনেশের ইঁদুর ঠিক দিয়েছে তো? মা লক্ষ্মীর
প্যাঁচা বা কার্তিকের ময়ূর? সে পেখম ছড়িয়েছে বেশ। আমাদের কৌতূহলী কল্পনার সঙ্গে
বাস্তবটাকে মিলিয়ে নিতে হবে তো?
এখনও প্রতিমা অসজ্জিতা। অস্ত্র আর গয়না বা অন্য সাজ পরান হবে আজ
রাত্রে। এ ক’দিন আর বই খোলা নয়। আমাদের মাত্রাছাড়া পরিশ্রমের মধ্যে তাদের কিছু
বিশ্রাম। এসে গেল সপ্তমী। কলাবৌকে কেমন দেখতে লাগছে দেখ পেট মোটা গনেশের পাশে। লাল
শাড়ির ঘোমটা দেওয়া কলাবৌ। বাজছে ঢাক, বাতাসে উড়ছে ধূপ ধুনোর গন্ধ, ঢাকের আওয়াজ আর
পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের গমগমে আওয়াজ।
সপ্তমী থেকে আবার প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে পুজো দর্শন। তখন গাড়িতে করে
প্রতিমা দর্শন ছিল এক দুঃস্বপ্ন। গাড়ি বলতে তখন বোঝাত রিক্সাকেই। মোটর গাড়ি যাদের
থাকত তাঁদের সংখ্যা ছিল তা হিসেব করার জন্য জোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের কোনও দরকার ছিল
না। একমাত্র খুব অসুস্থ বা ধনীদেরই রিক্সায় চেপে ঠাকুর দেখতে দেখেছি। তাদের সেই
ঠাকুর দর্শনও ছিল আমাদের অবাক-দর্শনের তালিকাতেই। হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা হয়ে গেলেও
ঠাকুর দেখার আনন্দ কিছুতেই ম্লান হয়ে যেত না।
সপ্তমীর সন্ধ্যায় হত আবৃত্তি প্রতিযোগিতা। অষ্টমীতে অন্ন চলবে না।
লুচি, বেগুনভাজা, কুমড়োর ছক্কা আর সুজির হালুয়া। অষ্টমীর সন্ধিপুজো ছিল দেখার মত।
রাত আড়াইটের সময় হুড়মুড় করে উঠে পড়েছি। আশ্চর্য! এত রাতেও পুজো দেখতে এত ভীড়! সেই
ভীড়ের মধ্যে কোনও রকমে মাথা গলিয়ে দিয়েছি আর দেখছি এক মহা বিস্ময়কে। একশ আটটা
প্রদীপ জ্বেলে সন্ধি পুজো হচ্ছে। পরে জেনেছি এই সময়টা হচ্ছে অষ্টমী আর নবমীর মহা
সন্ধিক্ষণ। অষ্টমী যাচ্ছে আর নবমী আসছে। তাই নবমীতে বড় মন খারাপ হয়ে যেত। পুজোর
শেষ।
দশমীর দিনটা হল দুঃখ আর আনন্দের এক সহাবস্থান। উৎসবের শেষ এই কারণে
দুঃখ আবার এইদিন সবাই একসঙ্গে মিলিত হবে সেই কারণে বড় আনন্দের। এইদিন হল মিলনের
দিন। (বর্তমানে হয়ত ডিজে বাজিয়ে অন্যের হার্ট আর কান ফুটো করার দিন)। এদিন মাংস
খেতে হয়। তখন মুরগীর মাংসের চল তেমন ছিল না। আর ব্রাহ্মণদের তো নাম করা বা মনে
আনাটাই ছিল গর্হিত কাজ। সেই হিসেবে মুরগী আমাদের বাড়িতে কোনদিন আসত না। এমন কি
রেস্টুরেন্টেও বিশেষ সহজলভ্য ছিল না।
বিকেল থেকে শুরু হত আমাদের এক মহা অভিযান। এর দুটো অংশ ছিল। একটা হল
যারা আসবেন আমাদের বাড়িতে প্রণাম করতে বড়দের বা সমবয়সীদের সঙ্গে কোলাকুলি করতে
তাদের অভ্যর্থনা করা। আর দ্বিতীয়টা হল পাড়ায় আমাদের থেকে বয়স্কদের বাড়ি গিয়ে তাদের
প্রণাম করা। এই কাজ খুব ভাল লাগত আমাদের। অধিকাংশ বাড়িতেই মিষ্টি তৈরি হত।
নারকোলের ছাপা, নাড়ু। দোকানে হত বড় বড় গজা, মিহিদানা আর বোঁদে। আর হত সুন্দর
ঘুঘনি। একটানা মিষ্টির মরুভূমিতে এটাই ছিল স্নিগ্ধ এক মরূদ্যান।
রাত বোধহয় ভোর হয়ে এল। ফেরার সময় দেখা সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে। যাবার
সময় যিনি বলেছিলেন, একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন? শরীর টরির----
--হ্যাঁ, এলার্জিক ব্রংকাইটিস তো। শ্বাস যে বশে থাকে না আমার সব সময়।
ফেরার সময় তিনি বললেন, আপনাকে এখন বেশ চাংগা লাগছে। ঠাকুর দেখার একটা
গুণ আছে কি বলেন?
--ঠাকুর দেখা নয়। একটা অপারেশন হল যে। আর তাতেই—
--অপারেশন! কি অপারেশন? কোথায়? লাঙে নাকি মশায়? খুব চিন্তিত সে
ভদ্রলোক।
--লাঙে নয় লঙে। আশ্বস্ত করে আমি হাসতে হাসতে বলি, অপারেশন টাইম
মেশিন। বোধহয় অন্তত অর্ধশতক পিছিয়ে গিয়েছিলাম। পৌঁছে গিয়েছিলাম আমার ছেলেবেলায়।
--টু হুইলারে ব্যাক গিয়ার পেলেন কোথায় দাদা? ভদ্রলোক হাসলেন। খুব
রসিক কিনা।
--মনের ইঞ্জিনে সব থাকে মশাই। স্মৃতির পেট্রল ঢেলে চলে যান না মাইলের
পর মেইল। যতদূর খুশি। তবে পেছনে যেতে যেতে একসময় ভীষণ ধাক্কা খাবেন। অনেক কিছু
হারিয়ে ফেলার বেদনার ধাক্কা হজম করা খুব কষ্টকর জানেন? অতএব—
--অতএব টপ গিয়ার জিন্দাবাদ ব্যাক গিয়ার মুর্দাবাদ। হো হো করে হেসে
উঠলেন ভদ্রলোক। খুব অমায়িক আর রসিক কিনা।
আমি ফার্ষ্ট গিয়ার থেকে আবার টপ গিয়ারে। বাড়ি ফিরতে হবে তো? সূর্য
উঠে পড়েছে। ও বেচারির তো কোনও ব্যাক গিয়ার নেই।
No comments:
Post a Comment