Monday, October 2, 2017

ধারাবাহিক / স্বপ্নস্বরূপ - ১০ / ন ন্দি নী সে ন গু প্ত


বর্ষার দীর্ঘ ধারাপাতের শেষে শরত প্রকৃতিতে নিয়ে আসে উৎসবের আমেজ। শরত আকাশের রূপ দেখে যে কোনও বাঙালি মনে মনে যে সুর গুণগুনিয়ে ওঠে, তা হল, ‘নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা’। যে ছন্দে নেচে ওঠে বাঙালির হৃদয় তা হল,
‘আজি কি তোমার মধুর মূরতি
     হেরিনু শারদ প্রভাতে!
হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ
     ঝলিছে অমল শোভাতে।’
কী ভাবে বাঙালি অগ্রাহ্য করতে পারে এই প্রকাশভঙ্গিমা? প্রকৃতির এই উৎসবকে আর কোনও কবি কি বাঁধতে পেরেছেন এত সুন্দর শব্দ দিয়ে, যা একই সঙ্গে সহজ অথচ দোলা দিয়ে যায় মন-প্রাণকে এক গভীর ভাবের স্পর্শে। শরতের এই মিশ্রভাবটি কবি নিজে অনুভব করেছেন বলেই প্রকৃতির উৎসবের আবেশ, উচ্ছ্বাস পৌঁছে দিতে পেরেছেন তার পাঠক/ পাঠিকাদের হৃদয়ে।

কবি বলছেন, ‘শরৎকালের মধ্যে আমি একটি নিবিড় গভীরতা, একটি নির্মল নিরতিশয় আনন্দ অনুভব করি’। এই যে গভীরতার মধ্যে আনন্দের অনুভব, অতি সংবেদনশীল মন না থাকলে তা সম্ভব নয়। কবি অনুভব করেন কাশফুলের  তন্তুপাপড়ির গায়ে মৃদুবাতাসের ছোঁয়াটুকু। অনুভব করেন বর্ষণশেষের হাল্কা হয়ে যাওয়া মেঘের চঞ্চল গতায়াত। রোদ্দুরের সোনার রেণু রেণু আলোর অলঙ্কারে সেজে ওঠা প্রকৃতিকে তিনি বিশেষভাবে দেখতে পান, তাই লেখেন তার নয়ন- ভোলানো রূপের কথা।
‘কোথায় সোনার নূপুর বাজে,
বুঝি আমার হিয়ার মাঝে-
সকল ভাবে, সকল কাজে পাষাণ-গালা সুধা ঢেলে।’

এই উৎসবঋতু কবিমানসে একটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। কবি বলেছেন ‘চাষিদের ধান-পাকানো শরত, আমার গান-পাকানো শরত’। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শরতের গান কেবলমাত্র প্রকৃতির উৎসবমুখর রূপবর্ণনা নয়, এক অনুভবের গভীরে অবগাহন। ভাবটি বিশেষ পরিপক্ক রূপ ধারণ করেছে বেশিরভাগ গানে, কখনও আবার নিয়ে এসেছে সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রার এক ভাব; উদাহরণস্বরূপ ‘তোমার মোহন রূপে’ গানটিতে প্রকৃতির ধ্বংসের কথা, ঝড়ের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রকৃতি সুন্দর হলেও তার ভীষণ, ভয়াল রূপটিকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা মানুষের আজো হয়নি। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, অশ্রুজলের মধ্য দিয়ে মানুষ এই ভয়ঙ্কর সুন্দরের পূজা সাঙ্গ করে। অদ্ভুতভাবে ‘শরত’ ঋতুর পর্যায়ের মধ্যেই কবি এই বিশেষ গানটিকে স্থান দিয়েছেন।  

শরত-উৎসব নিয়ে কবির বিভিন্ন লেখার মধ্যে যে কবিতাটি সম্ভবত বাঙালি কোনওদিন ভুলবে না, সেটি হল ‘পূজার সাজ’। শিশুপাঠ্য বইয়ে স্থান পেলেও, শিশুদের নীতিশিক্ষা মূলমন্ত্র হলেও, এই কবিতার ভাবনা সব্বার জন্য প্রযোজ্য। এই বিশেষ মূল্যবোধের শিক্ষা আমরা ভুলেছি বলেই হয়ত উৎসবের সুর আর সেভাবে আমাদের স্পর্শ করে জাগিয়ে তুলতে পারেনা অন্তরের আলো, আমরা হয়ত বুঁদ হয়ে থাকি বাইরের চাকচিক্যের দেখানেপনায়।
        
‘জীবনস্মৃতি’ তে একজায়গায় দেখি তিনি বাল্যকালের সঙ্গে বর্ষার এবং যৌবনের সঙ্গে শরতের তুলনা করছেন। কবি লিখছেন, ‘তখনকার জীবনটা আশ্বিনের একটা বিস্তীর্ণ স্বচ্ছ অবকাশের মাঝখানে দেখা যায়— সেই শিশিরে ঝলমল-করা সরস সবুজের উপর সোনা-গলানো রৌদ্রের মধ্যে মনে পড়িতেছে, দক্ষিণের বারান্দায় গান বাঁধিয়া তাহাতে যোগিয়া সুর লাগাইয়া গুন্‌ গুন্‌ করিয়া গাহিয়া বেড়াইতেছি—সেই শরতের সকালবেলায়।
আজি   শরততপনে প্রভাতস্বপনে
            কী জানি পরান কী যে চায়।’
উপরের এই গানটির রচনাকাল আশ্বিন, ১৮৮৬, অর্থাৎ সেই ‘তখনকার’ সময় কবির বয়স ২৫। শিশুকালের বর্ষা-প্রকৃতির উৎসবের মধ্যে মগ্ন হয়ে থাকা কবি যৌবনের শরতে এসে চিনতে শিখে গিয়েছেন মানুষের উৎসব। তিনি তখন মানুষে মানুষে সংযুক্ত থাকার উৎসব খুঁজে পেয়েছেন শরত-ঋতুর আলোতে। বলেছেন, ‘আমার কবিতা এখন মানুষের দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।’
কবি মানুষের জন্যই লিখেছেন। মাতৃভূমির মধ্যে দেবী দুর্গার রূপকল্পনায় লিখেছিলেন ‘অয়ি ভুবনমনমোহিনী’। হ্যাঁ, যদিও সে লেখা ফরমায়েশি লেখা ছিল। পরাধীন ভারতে দেশমাতৃকার প্রতি ভক্তিভাব জাগরিত করে মানুষকে একত্রিত করবার ব্রতের জন্য হেমচন্দ্র মল্লিক ও বিপিন পালের অনুরোধে লিখেছিলেন এই গান। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল বলেই নিজে পৌত্তলিক না হয়েও মাতৃ-আরাধনার একাধিক গান লিখেছিলেন তিনি।
উৎসবের কথা যেমন লিখেছেন, ভুলে যান নি উৎসব শেষের ভাঙ্গা হাটের কথাও। লিখছেন, ‘মাটির কন্যার আগমনী গান এই তো সেদিন বাজিল। মেঘের নন্দীভৃঙ্গী শিঙা বাজাইতে বাজাইতে গৌরী শারদাকে এই কিছু দিন হইল ধরা-জননীর কোলে রাখিয়া গেছে। কিন্তু বিজয়ার গান বাজিতে আর তো দেরি নাই ; শ্মশানবাসী পাগলটা এল বলিয়া — তাকে তো ফিরাইয়া দিবার জো নাই ; হাসির চন্দ্রকলা তার ললাটে লাগিয়া আছে কিন্তু তার জটায় জটায় কান্নার মন্দাকিনী।’ শেষ দুটি লাইনে শিবের রূপবর্ণনায় হাসি-কান্নার সহাবস্থান ঠিক যেন শরতের রৌদ্রছায়ার খেলার মত। উৎসবের সমারোহের মধ্যে পূর্ণতার পরবর্তী এই স্বপ্নভঙ্গ একজন কবির পক্ষেই দেখা সম্ভব। কারণ তিনি তার যাদুকলমে বন্দী করে রাখেন সেই স্বপ্নগুলো এবং তার ভাষায় মানুষের চোখে পরিয়ে দেন সেই স্বপ্নের মায়াকাজল।     

      


No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া