ছাদের দরজাটা ভালো করে
দেখেই বন্ধ করেছিলেন প্রতুল বাবু, নাহ! কোনো ভুলচুক তো হয়নি, তালাটাও দুবার
নেড়েচেড়ে দেখেছিলেন, ওপরের খিলটা লাগিয়ে কড়াগুলো টেনে তালা লাগানো, তাহলে
আজও ওই শব্দটা আসছে কোত্থেকে! এই এক জ্বালা হয়েছে !গত এক সপ্তাহ হল ঠিক মাঝরাতে
ছাদে কারা যেন হেঁটে বেড়ায়, চোরের মত চুপিচুপি নয় বেশ গটমটিয়ে ধুপধাপ শব্দে। প্রথম
প্রথম ভাবতেন মনের ভুল, এই ভাগাড়ে কে আসবে ছাদে চুরি করতে আর এলেও প্রতুলবাবুর
আছেটা কি? ওই তো একটা ঝুরঝুরে ট্রাঙ্ক, আদ্দিকালের একটা তক্তাপোষ, আলনা আর একটা
কেরোসিনের স্টোভ, দুটো বাসন । নিজেই দুমুঠো ফুটিয়ে খান প্রতুলবাবু সেগুলো নিতে আর
যাই হোক ভাঙা কার্নিশ বেয়ে চোরের দল আসবেনা। কিন্তু গত তিন রাতে বার বার ঘুম
ভেঙেছে প্রতুলবাবুর।
আজ তাই চারদিক ভালো করে
দেখে তালাটা লাগিয়েছিলেন, কি বিপত্তি! এই মাঝরাতে কি শুরু হল রে বাবা! টর্চটা নিয়ে
চটিতে পা গলান প্রতুলবাবু।কুলঙ্গিতে রাখা চাবির গোছাটা বের করে চুপিসারে ছাদে উঠে
দরজা খোলেন, কোথাও কিচ্ছু নেই। দুদিন আগে পুর্ণিমা গেছে চাঁদের আলোয় ফুটফুটে ছাদ,
সামনে কাঁঠাল গাছের পাতা দুলছে, বাতাবী লেবু গাছের ফুলের গন্ধ ম ম করছে, নাহ ছাদে
এসে ভুল করেন নি, জ্যোৎস্নার এই হাড়পাঁজর বের হওয়া বাড়িটাকেও রাজপুরী মনে
হচ্ছে।একটু পায়চারী করেন প্রতুলবাবু ছাদের উত্তরে ধানক্ষেত, ওদিক থেকে বেশ হাওয়া
আসছে।হঠাৎ একটা আলো ধক করে জ্বলে আবার নিভে গেলো আর একটা রাতচরা পাখি ডানা ঝাপটে
বিদীর্ণ চিৎকার করে মাথার ওপড় দিয়ে উড়ে গেলো। একটু কেঁপে উঠলেন প্রতুলবাবু, গ্রামে
আলেয়ারআলো প্রায়ই দেখা যায় অনেকবার পড়েছেন, একটা গ্যাস জল কাদা থেকে উঠে বাতাসের
সংস্পর্শে জ্বলে ওঠে,এই প্রথমবার আলেয়া নিজের চোখে দেখলেন প্রতুলবাবু। হঠাৎ কেমন
শীত শীত করতেলাগলো, প্রতুলবাবু নীচে নেমে এলেন।
পরেরদিন মাঝরাতে
প্রতুলবাবুর ঘুম আর ভাঙেনি, একটা সলিড ঘুম দিয়ে সকাল ছ'টায় মর্নিং ওয়াকে বেরোলেন।
ওদিকের ধানক্ষেতটা বেশ ভালো করে দেখে এলেন, কোথাও কিছু নেই! শুধু জলা জায়গার
কিছুটা শুকিয়ে টান ধরেছে, শীত পড়বে পড়বে... ঠিকই ধরেছিলেন কাল আলেয়ার উৎপত্তি এখান
থেকেই। জলার ধারে প্রচুর পরিযায়ী পাখি এসেছে।
প্রতুলবাবু বাড়ি ফিরে
দেখলেন ক্ষিদেটা বেশ চাগাড় দিচ্ছে। ভাতে ভাত বসিয়ে উত্তরের জানালাটা খুলতেই একটা
কি পাখি না বাদুড়ের মত উড়ে চলে গেলো ঠিক তখনি একটা লেবু ফুলের গন্ধ টের পেলেন, এই
গন্ধটা সেদিন ছাদেও পেয়েছিলেন। প্রতুলবাবুর মনে পড়লো বাতাবী লেবুর গাছটা তো গতবছর
ঝড়ে পরে মরে গেছে তাহলে লেবুর গন্ধ এলো কোত্থেকে? এ তল্লাটে কোথাও লেবু গাছ নেই।
যাহোক বাতাসে ভেসে এসেছে হয়ত দূর থেকে আবার মনের ভুলও হতে পারে, এই নিয়ে আর কিছু
ভাবলেন না প্রতুলবাবু। পরদিন সকালে প্রতুলবাবু ঘুম ভেঙে দেখলেন ছাদের এক কোনে শুয়ে
আছেন। রাতে কখন উঠে তালা খুললেন কখনই বা ছাদে এলেন কিছুই মনে করতে পারলেন না, তবে
কাল রাতে বেশ গুমোট লাগছিল হয়তো ঘুমের ঘোরে এসেছেন। সারা গায়ে ব্যথা চোখ জবাফুলের
মত লাল, এই শীতের শুরুতে খোলা ছাদে শোয়ার ফল, দুপুরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো
প্রতুলবাবুর।
রাতটা ঘোরের মধ্যে
কাটলো, সকালে চোখে রোদ পড়তেই দেখলেন আবার ছাদের কোনে শুয়ে আছেন, শরীর এত দুর্বল
উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই! কিভাবে এলেন ছাদে? এবার বেশ ভয় পেয়ে গেলেন প্রতুলবাবু।
একটু বেলা যেতেই খানিকটা সুস্থ বোধ করলেন, কোনোমতে রেলিং ধরে ধরে নীচে নেমে এসে
ধপাস উঠোনে বসলেন প্রতুলবাবু। ভাগ্যক্রমে সাইকেল নিয়ে পাড়ার একটি ছেলে যাচ্ছিলো
প্রতুলবাবুকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে লোকজনকে খবর দিলো। প্রতুলবাবুর এক দুঃসম্পর্কের
শরিক ওনাকে তার নিজের বাড়ি নিয়ে এলো খবরটা পেয়েই। মাঝরাতে ঘুমভেঙে আবার সেই
মিষ্টি গন্ধটা পেলেন প্রতুলবাবু এবার দেখলেন ঘর জুড়ে এক অস্পষ্ট ছায়া ক্রমে একটা
মুখের আকার নিচ্ছে, গন্ধটা গাঢ় হতে হতে সেই ছায়ামূর্তি সামনে এগিয়ে এলো প্রতুলবাবু
ভয়ে জ্ঞান হারালেন।
পরদিন সকালে সবাই দেখলো
প্রতুলবাবু এই অসুস্থ শরীরে নিজের বাড়ি ফিরে গেছেন শুধু ফিরেই যাননি ছাদের এক কোনে
শুয়ে আছেন।
সেদিন বিকেল থেকে
প্রতুলবাবুর কথা বন্ধ হলো, ভয় পেয়ে প্রতুলবাবুর শহরের বাড়িতে খবর দিলেন
ওনাদের শরিক।
No comments:
Post a Comment