ইন্সপেক্টর সৌমাভ সান্যাল হাতের ফাইল থেকে চোখ তুলে জানলার বাইরে কাঠচাঁঁপা গাছটার দিকে তাকায় | নাহ - হিসেবে কোথাও গরমিল আছে | অংকের ছাত্র সৌমাভ সন্তুষ্ট হতে পারছে না ।ফাইল এর বর্ণনা অনুযায়ী সহজ সরল "দুর্ঘটনা" নামক উপসংহার এ সই করতে ও পারছে না |
সুনীল সরকার মানুষটি খুচরো গুঁড়ো মশলার ব্যবসায়ী, অবিবাহিত, হিসেবী, অনাড়ম্বর জীবন যাপন এ অভ্যস্ত | তিনতলার উপর থেকে পড়ে গিয়ে মাথা ও মেরুদন্ড ভেঙে মৃত্যু হয়েছে । পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট সহ ফাইল এসেছে সৌমাভর টেবিল এ - সই করে কেস ক্লোস করে দিলেই হলো |
সেখানেই সৌমাভ কোথাও হোঁচট খাচ্ছে | লোকটার চরিত্র ও জীবন যাত্রার সাথে শেষ দশ মিনিটের হিসেবে আকাশ পাতাল তফাৎ |
তিনতলার যে ঘরে থাকতো - সেটা তে তিনটে দরজা - দুটো জানলা | করিডোর দিয়ে ঘরে ঢুকলে ঘরের মাঝখানেএকটা সেকেলে খাটপার হয়ে যে দেওয়াল - তাতে দুটো জানলা | একটার সামনে একজোড়া টেবিল চেয়ার , আরেকটা জানলার পাশে একটাস্টিলের আলমারি | ব্যাস - আর কোনো আসবাব নেই | অন্য দুটি দেয়ালে দুটি দরজা | বাঁঁ দিকের দরজাটা বাথরুম |
ডানদিকের দরজাটা ই গোলমালের মূল সূত্র |
মাস ছয়েক আগেও ওই ডানদিকের দেয়াল ঘেঁষে খাট থাকতো | ছাদে যেতে তিনটে তালা খুলতে হয় বলে সুনীল বাবুওই দেওয়াল কেটে একটা দরজা আর একটা ছোট ব্যালকনি বানিয়ে নেন | মাস তিনেক খুব খুশি ছিলেন - ওখানে বসেই চা খাওয়া,কাগজ পড়া,দাড়ি কামানো - সব করতেন |
হঠাৎ কর্পোরেশন থেকে নোটিশ আসে - ওই বারান্দা বেআইনী - ভেঙে ফেলতে হবে | সুনীল বাবু তাই করলেন | শুধু দরজা সরিয়ে দেওয়াল গেঁথে দেয়া বাকি ছিল |
জানলা খোলা থাকতো - সেদিকেই মাথা করে শুতেন |
রাতে একবার বাথরুম যেতেন - খাট থেকে নেমে ডান দিকের দরজা |
বাঁ দিকে কোনোদিন যান নি - দরজা খুললেই সোজা নিচের চাতাল এ পতন |
"দুর্ঘটনা" সেভাবেই ঘটলো | বাথরুমের দরজা ভেবে বাঁদিকের দরজা খুলে পা বাড়ালেন মৃত্যুর দিকে |
এইখানেই সমীকরণে ধাক্কা খাচ্ছে সৌমাভ | যে মানুষ কোনোদিন বাথরুম যেতে বাঁদিকের দরজা খোলেন না -- ওই রাতে কেন খুললেন ? আত্মহত্যা ? কোনো কারণ দেখা যাচ্ছে না ৬৭ বছর বয়েসী মানুষটার ফাইল এ |
সৌমাভ বেল বাজিয়ে জীপ্ বার করতে বলে নিজেই একবার বাথরুম যায় | তারপর ফাইল আর দুই সহকারী নিয়ে রওনা দেয় অকুস্থলের দিকে |
তিনতলার ঘরে ঢুকে ফাইল এ রাখা ফটোগুলির সাথে মিলিয়ে দেখতে থাকে সব কিছু | সহকারী দুজন টেবিল আর আলমারি দেখে নেয় | খাট টা একটু দেখে সৌমাভ | ভুরু কুঁচকে তাকায় মাথার আর পায়ের দিকের কারুকাজ করা রেলিং এর দিকে | উঁচু দিকটামাথা - নিচু দিকটা পা | সেটা জানালার দিকে ! বুট সমেত শুয়ে পড়ে বালিশে মাথা দিয়ে -- হাত দুটো লম্বা করে দুপাশে ছড়ায়ে তর্জনী উঁচু করে |
লাফ মেরে উঠে এক সহকারীকে বলে সব জানলা দরজা খুলে দিয়ে ঠিক ওর মতো করে শুয়ে পড়তে
- আরেকজন কে বলে দোতলা থেকে সুনীলবাবুর গোমস্তা সহদেব কে সপরিবারে ওপরে আসতে | মোবাইল এ খবর পাঠায়ে থানা থেকে মহিলা পুলিশ সহ আরো
ফোর্স পাঠাতে |
দোতলায় সহদেব থাকে তার দুই ছেলে, স্ত্রী ও বড়ো ছেলের বৌকে নিয়ে | এক তলায় থাকে এক ঠাকুর ও এক চাকর - সেই পড়ে যাবার আওয়াজ শুনে বাইরে গিয়ে মৃতদেহ দেখে থানায় ফোন করে |
সিঁড়ির সব তলাতেই গ্রিলের গেট - রাতে তালা পড়ে - চাবি সহদেবের কাছে থাকে |
সহদেবরা বলেছে তারা কিছু শোনেনি, দেখেনি, কিছুই জানে না | পুলিশ যা বলেছে - তাই জানে যে দুর্ঘটনায় মৃত্যু |
তারা উপরে এসে দেখে সৌমাভ টর্চ নিয়ে খাটের তলায় উপুড় হয়ে প্রত্যেকটা পায়া দেখছে - একটি কনস্টেবল খাটে দু হাত ছড়িয়ে শুয়ে আছে | আরেকজন করিডোর এর দরজায় - হাত কোমরের পিস্তলে |
সৌমাভ উঠে দাঁড়ায় | সহদেবের বৌমাকে জিজ্ঞেস করে,"হাতে পিঠে খুব ব্যথা - তাই না ?"
মেয়েটি ঘাড় নেড়ে হাঁ বলেই চমকে আর সবার দিকে তাকায় -- সবার চোখে রাগ দেখে মাথা নিচু করে |
সৌমাভ হেসে ফেলে | সহদেব কে বলে,
" যে মানুষটা এতবছর ডান দিকের দরজা খুলে বাথরুম গেলো - সে হঠাৎ বা দিকের দরজাটা বারান্দা জেনেও খুলবে কেন ? রোজ সকালে স্নানের পরে আলমারির
মাথায় রাখা লক্ষ্মী - গণেশ কে যে পুজো দেয় -- সে হঠাৎ সেদিকে পা দিয়ে শোবে কেন ? জবাব দিন সহদেব বাবু !"
পাঁচ জন নিশ্চুপ | থানা থেকে আসা মহিলা পুলিশ আর বাকি সহকারীদের সৌমাভ বলে ঘিড়ে দাঁড়াতে | সহদেবের দিকে ঘুরে বলে,
"চলুন - বাকি কথা থানায় হবে |"
পাঁচ জন এবার আর্তনাদ করে ওঠে | সৌমাভ এক ধমক দেয়,
" সে রাতে সুনীল বাবু ঘুমোনোর পরে পাঁচজন এসে ওনার খাটের চারটে পায়া ধরে পুরো উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেন - মহিলারা দুজন একটা পায়া তুলেছিলেন - তাও ব্যথা করছে বৌমার পিঠে | পায়াগুলো এতবছর একভাবে থাকাতে যে দাগ পড়েছিল - ঘুরিয়ে দেওয়াতে দাগে দাগ মেলেনি |
যে এখন শুয়ে আছে - তার ডান হাত ভাঙা দরজার দিকে - বা হাত বাথরুমের দিকে - পা ঠাকুরের আসনের দিকে | সেই রাতে সুনীলবাবু অভ্যেস মতো ডান দিকেই গেছিলেন | আপনারা ওনার সম্পত্তি আর ব্যবসার লোভেই "দুর্ঘটনা" ঘটার ব্যবস্থা করেন | চলুন - বাকি কথা থানায় হবে |"
No comments:
Post a Comment