নিশ্চিন্ত সন্ধ্যার অবকাশে দিয়া মাঝে মাঝে ডায়েরী লিখতে লিখতে ভাবে
তাদের সময় মেয়েরা কি ভাবে লাঞ্ছিত হত তার কোন হিসাব কেউ রাখেনা। মানসিক
নিগ্রহ তো বটেই কত মেয়েকে যে নির্মম ভাবে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অসময়ে
প্রাণ বলিদান দিতে হয়েছে তার কোন হিসাব নেই। খবরের কাগজে দু এক দিন লেখালেখি হল, কোর্টে কেস উঠ্ল, উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবার সেই কেস ধামাচাপা দিয়ে পয়সার জোরে বেরিয়ে
গিয়ে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াতে লাগল। ১৯৭৩ সালে এক নামকরা ইংরাজী মাধ্যম বেসরকারি
বিদ্যালয়ের প্রিন্সিপালের স্ত্রীকে খা্বারে বিষ মিশিয়ে খুন করা নিয়ে খবরের কাগজে
খুব খুব হইচই হয়, মধ্যবিত্ত বাড়ির উচ্চশিক্ষিতা মেয়েও সামাজিক নিগ্রহের
হাত থেকে রেহাই পায়নি, তার উচ্চবিত্ত শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা টাকার জোরে মামলা জিতে বেরিয়ে গেল। ৭০ দশক থেকে ৯০ দশক বা তার পরেও অনেকদিন সামাজিক পটভূমি খুব খারাপ
ছিল, পণের জন্য কত মেয়েকে যে পুড়িয়ে মারা হয়েছে তার কোন হিসাব নেই । কটা বিচার হয়েছে, কজন জেল খেটেছে কেউ বলতে পারবেনা, সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে দিয়ার শ্বশুরবাড়ী তো ভালো।তারা আর যাই হোক শারীরিক নির্যাতনের কথা কখনও ভাবেনি, বা বৌকে মেরে ফেলব এ কথা
চিন্তার মধ্যে আনেনি, সত্যি কথা বলতে দিয়ার শ্বশুরবাড়ী থেকে কি দিল
কতখানি দিল এ নিয়ে কোনদিন মাথা ঘামান নি। তাদের মেজাজটা ছিল মধ্যযুগীয়
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মেজাজ, সমস্ত কাজ ঠিক সময়ে হবে যা চাইব তাই করে দিতে হবে
মুখে রা কাটা যাবেনা বা মুখ গম্ভীর করা যাবেনা, বাড়ীতে যত অতিথি আসুক হাসিমুখে
সবাইকে যত্ন করতে হবে, ইত্যাদি। নিজের জীবন বা নিজের পৃথিবী বলতে কিছু থাকবেনা,
দিয়ার শশুড়বাড়ীতে বাড়ীর ছেলেমেয়েরা গান করেছে ফাংশন করত তারজন্য রিহার্সাল চলত
বাড়ীর ছেলেমেয়েদের । দিয়া অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকত, তার মনও ডুবে যেত গান আর সংগীতের
সুর ছন্দে, কিন্তু বাড়ীর সবাই যদি গান কবিতায় মত্ত থাকে তবে সংসারটা চলবে কি করে?
দিয়া নিঃশ্বাস বন্ধ করে অতিথিদের জন্য চা জলখাবারের ব্যবস্থা করত , রাতের রান্নার
মেনু ঠিক করত । হয়ত অন্তরের টানে মাঝে মঝে আসরে গিয়ে বসত ঠিক সেই সময় তার
স্বামীই তাকে বলত তুমি কিছুই খেয়াল করনি , দেখছনা সন্তুদা এসেছে ওর চা জলখাবারটার
ব্যবস্থা কর। আসর শেষ হলে কাজের মেয়েদের দিয়ে ঘর পরিস্কার করিয়ে বাসন পত্র নীচে
নামিয়ে এনে ধোয়ার ব্যবস্থা করে নীচে নেমেছে , তখনি শ্বশুরমশাইয়ের আবার আর এক রাউণ্ড
চায়ের ফরমাস হল সেইসাথে এক হাঁড়ি গরম জল কারণ তাঁকে বাথরুমে যেতে হবে তাই গরম
জল চাই। তখন ঘরে ঘরে গিজারের ব্যবস্থা ছিলনা , তা হয়েছিল অনেক পরে।
বাথরুম থেকে ফিরে এসেই তিনি বললেন রাতের খাবারের কি ব্যবস্থা করেছ?
তাঁর মেনু পছন্দ হলনা হয়ত, ছেলেকে ডেকে বললেন বাবু দু কিলো মাংস নিয়ে এসোতো , রাতে
জামাইরা খাবে । রান্নার ঠাকুর বলল বৌদি এতো পারবনা তাহলে অন্য লোক রেখে দেবেন ,
দিয়া দেখল সর্বনাশ তাহলে সেতো আরো ঝামেলায় পড়ে যাবে , দিয়া তাড়াতাড়ি ঠাকুরকে
ঠাণ্ডা করার জন্য বলল ঠিক আছে তোমায় করতে হবেনা আমি করে নিচ্ছি। খেতে বসে সবাই হয়ত
বলল আঃ মাংসটা যা হয়েছে না , নিশ্চয় দিয়ার হাতের রান্না খেয়েই বোঝা যাচ্ছে। দিয়া
নিজেকে নিজেই বোঝালো ,’দিয়া এইটুকুই তোমার প্রাপ্তি এর চেয়ে বেশী আর চেয়োনা’।
সত্যি কি তাই ? দিয়া কি এতই সাধারণ ? দিয়ার বাবা্ কলকাতা তথা বাংলা দেশের
শিক্ষিত সমাজের সাহিত্যিক এবং গবেষক হিসাবে স্বনামধন্য ছিলেন, কর্মজগতেও একজন উচ্চ
পদস্থ অফিসার ছিলেন , সে নিজেও স্কুল কলেজে ভালো ছাত্রী বলে পরিচিত ছিল , মাত্র ২২
বছর বয়েসে বিয়ে হয়েছিল, তারি মধ্যে আবৃতি করে বেশ কয়েকটা প্রাইজ এনেছিল, তার কি আর
কিছুই প্রাপ্য নেই শুধুই ভাল রাঁধুনি । দিয়া যে নিজের জগতটাকে প্রতিদিন একটু একটু
করে মেরে ফেলছিল , তার সূক্ষ্ণ অনুভুতি গুলোকে মনের আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে
দিচ্ছিল অবসাদগ্রস্ততার শিকার হয়ে পড়ছিল , সে খবর কেউ রাখতনা, এমনকি তার স্বামীও
না। মধ্যযুগীও প্রথাতেই সে বিশ্বাসী, বাড়ীর বউয়ের এটাই কাজ এটাই ধর্ম। অথচ নিজে সে
বাইরের উন্মত্ত ক্লাব পার্টি নিয়ে ব্যস্ত, যেখানে অনেক মহিলা উগ্র আধুনিক
সাজপোষাকে নিজেদের মেলে ধরত , দিয়ার প্রশ্নের উত্তরে সে বলত ওদের সাথে তোমার তুলনা
কোর না। যার স্বামী নিজের স্ত্রীকে বোঝার এতটুকু চেষ্টা করেনি, সে অন্য কার কাছ
থেকে কি আশা করবে? তাই লাঞ্ছনা অপমান গঞ্জনার মধ্যে দিয়ে তার জীবনটাকে টেনে নিয়ে
যাচ্ছিল শুধু তার মধ্যেই সে একটা কাজ খুব জেদের সঙ্গে করত তা তার দুই মেয়ের
ক্ষেত্রে, তাদের মানুষের মতন মানুষ করার জন্য আপ্রাণ প্রয়াস চালিয়ে গেছে । সেখানে সে
কোন রকম কার্পণ্য করেনি বা কারও কথায় কান দেয়নি।
বাংলা প্রতি ঘরে খুঁজলে এরকম অনেক দিয়া পাওয়া যাবে যারা শুধুমাত্র
চোখের জলকে সম্বল করেই জীবন কাটিয়েছে, কেউ প্রতিবাদ করেছে , কেউ বা মেনে নিয়েছে,
কেউ বা বেশী প্রতিবাদ করতে গিয়ে অসময়ে জীবনকে হারিয়েছে।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment