এবছর বঙ্গদেশে বর্ষা
বিলম্বিত। শরত সদ্য প্রবেশ করেছে প্রকৃতিতে। কিন্তু হিসেবমত আশ্বিন ফুরিয়ে গিয়েছে
ক্যালেন্ডারে। তাহলে কি হেমন্তকে আর দেখা যাবে না? লুকিয়ে থাকা এই হেমন্ত ঋতুর
রূপের কথা ত প্রথম পেয়েছিলাম তাঁরই গানে, যখন শুনেছিলাম ‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার
নয়ন কেন ঢাকা’। নিজেকে গোপন করে অন্তরালে থাকার যে মধুর ভাব এই ঋতুর,
রবীন্দ্রনাথের প্রকাশভঙ্গীকে আশ্রয় করে তা অনুরণিত হয়েছে বাঙালির মনে। প্রশ্ন
উঠেছে চরাচরে শুকিয়ে যাওয়া কাশবনে, ‘আপনাকে এই কেমন তোমার গোপন করে রাখা?’
তবে
একই সঙ্গে একটা জিনিস লক্ষ্য করে অবাক লেগেছিল, হেমন্ত ঋতুকে কবি প্রায়ই বলেছেন
‘হেমন্তলক্ষ্মী’। এই ‘লক্ষ্মী’ অভিধাটি এই হেমন্ত ঋতুর সাথে কেন জড়িয়ে গিয়েছিল,
সেটা কিশোরীবেলায় বুঝে উঠতে পারিনি। বয়স বাড়লেও বিস্ময় কমে নি। যখন জেনেছিলাম যে
কবি পৌত্তলিক হিন্দুধর্মের কেউ নন, অথচ ধনসম্পদের অধিষ্ঠাত্রী এই দেবীরূপের উপমাটি
যত্ন সহকারে ব্যবহার করেছেন এক ঋতুর রূপবর্ণনায়, তখন বিস্ময় আরও বেড়েছিল। কিন্তু
প্রকৃতির ফসলসমৃদ্ধ রূপ আর কীভাবে বলা যায়? সোনারূপা বা রত্নরাজি নয়, যে জিনিস
মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তি করে সে খাদ্যশস্যই যে প্রকৃত সম্পদ। লক্ষ্মীর বাস যে
সেখানেই। তাই কবি বারে বারেই তার কাব্যে আবাহন করেন ‘হেমন্তলক্ষ্মী’ কে। প্রণাম
জানিয়ে এই ঋতুকে সম্বোধন করেছেন ‘ক্ষুধার্তজনশরণ্য’ রূপে। এমনকি শুধু লক্ষ্মী নয়,
আরেকধাপ এগিয়ে তাকে বলেছেন ‘অন্নপূর্ণা’।
‘নটরাজ’ গীতিনাট্যে এই ঋতুকে
কবি বলছেন,
‘... “কোথায় গো,
অন্নপূর্ণা, ক্ষুধার্তেরে অন্ন দিবে না কি?
শান্ত করো প্রাণের
ক্রন্দন, চাও প্রসন্ন নয়ানে
ধরার ভাণ্ডার পানে।”
শুনিয়া লুকায়ে হাস্যখানি,
লুকায়ে দক্ষিণ হস্ত
দক্ষিণা দিয়েছ তুমি আনি,
ভূমিগর্ভে আপনার দাক্ষিণ্য
ঢাকিলে সাবধানে। ...’
হ্যাঁ, এখানেও আছে সেই
লুকিয়ে দাক্ষিণ্য দেখাবার কথা। এই বিনীত রূপ, যেখানে ডানহাত সাহায্য করলে, বামহাত
জানতে পারেনা, চিরন্তন এই ভারতীয় মূল্যবোধের প্রকাশও দেখতে পাই এই লেখায়। আজ
বিজ্ঞাপনসর্বস্ব সমাজে দাঁড়িয়ে নিজেকে অপ্রকাশে রেখে অন্যকে দাক্ষিণ্য দেখাবার
এই চিন্তা হয়ত মুর্খামি ছাড়া কিছু নয়। তবুও এই লেখা মনে করিয়ে দেয় যে এই বোধের
মধ্যেও রয়েছে এক আত্মতৃপ্তি, আছে এক অদ্ভুত গর্ব।
হেমন্তের রূপের বর্ণনায়
কবির লেখায় অবধারিতভাবেই আসে দীপাবলির প্রসঙ্গ। শিশুবেলায় এই গান গায়নি এমন বাঙালি
কম আছে। ‘যাক অবসাদ, বিষাদ কালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো!’ এই ত সবে কিছুদিন হল
আমরা পেরিয়ে এলাম দীপাবলির রাত। অদ্ভুত এক দ্যোতনার সৃষ্টি হয় এই গানের মধ্যে
বর্ণিত দৃশ্যে। চোখ বুজলে যেন দেখতে পাই আকাশের নক্ষত্রের প্রদীপের কম্পমান
শিখাগুলিকে আঁচলের ছায়া দিয়ে আড়াল করছে ‘হেমন্তিকা’ রূপিণী ঋতু।
দীপাবলির প্রসঙ্গ উঠলে
কালীপূজার প্রসঙ্গ আসেই। এই প্রসঙ্গে বলিদানের ব্যাপারে কবিমনের বিরূপতা শুধু
‘বিসর্জন’ নাটকে নয়, বিভিন্ন লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয় ‘কালী’ প্রসঙ্গে
বাঙালিজাতির ভক্তির তমোগুণ তার মনকে সেভাবে আকৃষ্ট করেনি, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়
বারে বারে। যখন তিনি ‘জাভাযাত্রীর পত্র’ এ উল্লেখ করেন সে দেশের
হিন্দুধর্মের আচার আচরণের কথা, তখন কতকটা যেন আশ্বস্তবোধ করেছেন তিনি সেখানে
‘করালবদনা উলঙ্গিনী কালী’র অনুপস্থিতিতে। আশ্বস্তবোধ করেছেন সেখানে পূজায় বলিদানের
প্রচলন না থাকায়। তিনি যেন সযত্নে এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন এই দেবীমূর্তি। তার কাছে এই
মূর্তি ‘কাল’ বা সময়ের প্রতীক নয়, নয় ঘরের আহ্লাদী মেয়ে ‘শ্যামা আনন্দময়ী’, বরং
তিনি যেন শিউরে ওঠেন বারে বারে এই ‘রক্ততৃষাতুরা’ দেবীমূর্তির উপস্থিতিতে। এত ভীতি
এবং বিরূপতা থাকলেও ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’য় রচনা করেছেন মায়ের জয়গান ‘কালী, কালী
বলো রে’ এক অদ্ভুত দক্ষতায়। কবির নতুন এক্সপেরিমেন্ট বলা চলে এই গানটিকে, যেখানে
পাশ্চাত্য সুরের সাথে শেষ লাইনে এসে মেলবন্ধন ঘটছে আমাদের দেশজ সুরের। আরও বিস্ময়
জাগে, যখন জানতে পারি যে মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি লিখেছিলেন এই গান। হয়ত বা
তারুণ্যের উচ্ছ্বাস তাকে প্রেরণা দিয়েছিল এই নিয়ম-ভাঙ্গা গানখানি লিখতে। তিনি গেয়ে
উঠেছিলেন শ্যামা মায়ের জয়গান। ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ নাটককে কবি নিজেই বলেছেন
‘দস্তুরভাঙ্গা গীতিবিপ্লবের প্রলয়ানন্দে রচিত’। তিনি নিজেই নিশ্চিত ছিলেন যে অনেক
গানে তিনি অদ্ভুত দুঃসাহসিক হয়েছেন। আশঙ্কা ছিল যে প্রবল সমালোচনার ঝড় উঠবে।
কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি, বরং অনেক গবেষণার উপকরণ হিসেবে কালজয়ী হয়ে উঠেছে তার
লেখনীর আখরগুলি।
No comments:
Post a Comment