গতপর্বেই বলেছিলাম ভেদবুদ্ধির উর্ধ্বে উঠবার কথা রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে বলে
গিয়েছেন। কিন্তু সেকথা উপলব্ধি করা আমাদের বুদ্ধিতে একেবারেই
কুলোয়নি। হ্যাঁ, খুব দুঃখের সাথেই একথা বলছি যে আমরা তার লেখা বা কর্মকাণ্ড থেকে কোনও
শিক্ষাই নিতে পারিনি। পারলে আমাদের দেশে জাতধর্ম নিয়ে এত ভুল ভাবনার
স্বার্থাণ্বেষী বীজের গাছ এখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারতো না।
না, তিনি সত্যিই ‘হিন্দুত্ব’ কে শুধুমাত্র একটা ধর্ম বলে
দেগে দেননি। বলেছেন, ‘হিন্দু
ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি জাতিগত পরিণাম। ইহা মানুষের শরীর মন হৃদয়ের নানা বিচিত্র
ব্যাপারকে বহু সুদূর শতাব্দী হইতে এক আকাশ, এক আলোক, এক ভৌগোলিক নদনদী অরণ্য-পর্বতের মধ্য দিয়া, অন্তর ও বাহিরের বহুবিধ
ঘাতপ্রতিঘাত-পরম্পরার একই ইতিহাসের ধারা
দিয়া আজ আমাদের মধ্যে আসিয়া উত্তীর্ণ হইয়াছে।' উদাহরণস্বরূপ বলি,
যখন এই লেখা লিখছি, হয়তো বা সেই মুহূর্তে মাঘমাসে শ্রীপঞ্চমী তিথিতে বন্দিতা
হচ্ছেন বাগদেবী। পূজার আয়োজনে গ্রামের কোনও ইস্কুলে যে মেয়েটি ফলমূল কেটে নৈবেদ্য
সাজাচ্ছে, সাজাচ্ছে ফুল দিয়ে পূজার অর্ঘ,
-কারো যেন প্রশ্ন করার সাহস না হয় তার জাতধর্ম নিয়ে। এরকম ভারতবর্ষের ছবিই কবি
দেখেছিলেন। তবে এই স্বপ্নের ছবি খণ্ডিত, সর্বব্যাপী নয়। এখনো এই দেশে এরকম জায়গার অভাব নেই, যেখানে গ্রামে দলিতদের জন্য আলাদা কূপ এবং দিনের বেলা নিচুজাতের ছায়া
মাড়ানো পাপ। হিন্দু বর্ণাশ্রমের প্রধান চার বর্ণের বাইরের এই বর্ণকে সরকারীভাবে
সংরক্ষণের আওতায় রাখা হলেও বর্তমান জটিল জীবনযাত্রায় অর্থই প্রধান চালিকাশক্তি। ফলে
অনগ্রসর জাতি কোথাও কোথাও আরও অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।
পৃথিবীতে অনেক দেশেই
অর্থনৈতিক মেরুকরণ এখন এক চরম আকার ধারণ করতে চলেছে। এর ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর
বিলোপ আসন্ন। এই বিশাল বিভেদের পাশাপাশি যোগ হয়েছে ধর্মভিত্তিক মেরুকরণ, যা
বিভিন্ন স্বার্থাণ্বেষী গোষ্ঠীর
নিজেদের অস্তিত্ব জিইয়ে রাখার কৌশল। আমরা
ভুলে গিয়েছি শতাধিক বর্ষ আগে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ
পথে নেমে জাত-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের হাতে রাখি পরিয়েছিলেন। সে কাজ হয়তো বা কারো
কাছে মনে হয়েছিল অতিরিক্ত নাটকীয় গিমিক, কিন্তু তার সেই উচ্চারণ, ‘বঙ্গদেশটি ভাঙলে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান -সকল
মানুষের বঙ্গদেশই ভাঙবে। কেবল হিন্দুর বঙ্গদেশ ভাঙবে না।' সেই কথা কেউ
অস্বীকার করতে পারেনি। না, বাংলা ভাগ আটকানো যায়নি। যদিও কবি নিজের জীবদ্দশায় দেখে
যান নি এই ভাঙন।
ভাঙন দেখে না গেলেও তিনি জানতেন বিপদ
কোথায়। বলেছিলেন, ‘শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে
পারে না; অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই
সাবধান হইতে হইবে।' হিন্দু-মুসলমানের মাঝের প্রভেদ সেই ব্রিটিশ আমল
থেকে ইংরেজ শাসকরা নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে। দুঃখের বিষয় এখন স্বজাতির
দ্বারা শাসিত হয়েও, ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হবার সত্তর বছর পরেও সম্পূর্ণরূপে
বেরিয়ে আসতে পারিনি এই বিভেদ থেকে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বারে বারে মাথাচাড়া
দিয়েছে অসন্তোষ। নিজেরাই আহ্বান করে নিয়ে এসেছি ‘শনি’।
ভেদ মোছা যায়না। প্রকৃতির নিয়মে, সমাজের
নিয়মে, কালের নিয়মে ভেদ অতি স্বাভাবিক বস্তু। সকল রকম বৈচিত্র ভিন্ন ভিন্ন
প্রকৃতির বলেই তা সুন্দর বলে মনে হয় আমাদের চোখে। ভেদ নিন্দনীয় নয়, নিন্দনীয় হল
ভেদবুদ্ধি। নিন্দনীয় হল তজ্জনিত বঞ্চনা, অন্যায়, অবিচার, যা যুগ যুগ ধরে আমাদের
দেশে চলে আসছে। আবার নতুন করে মনে করবার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে যে কবি বলে গিয়েছিলেন
যিনি বর্ণভেদের অতীত, তিনি শুভবুদ্ধি দ্বারা আমাদের সংযুক্ত রাখুন। কবি এই
ভেদবুদ্ধিকে ভূত তাড়ানোর মত তাড়িয়ে দেবার কথাও বলেছিলেন। সমাধানের পথ হিসেবে বলে
গেছেন বলপ্রয়োগ বা কণ্ঠপ্রয়োগ নয়, অর্থাৎ দাদাগিরি বা গলাবাজি করে এখন আর এই
‘ভেদবুদ্ধি’ র ভূত ভাগানো সম্ভব নয়। কবি বলেছেন,
‘কথায় তো শোধ
হয় না দেনা, গায়ের জোরে জোড় মেলে না—
গোলেমালে ফল কি ফলে জোড়াতাড়ার ছাঁদে ॥...’
গোলেমালে ফল কি ফলে জোড়াতাড়ার ছাঁদে ॥...’
হ্যাঁ, এই জোড় মেলাতে, ভেদবুদ্ধি তাড়াতে শুভবুদ্ধি প্রয়োজন,
হিতবুদ্ধি প্রয়োজন। কর্মের দ্বারা, বিশ্বাসের দ্বারা, পারস্পরিক শ্রদ্ধার দ্বারা
হয়তো বা সম্ভব। স্বপ্ন দেখেছিলেন কবি, আমাদেরও দেখিয়েছিলেন। অপেক্ষায় আছি আজো...
‘এসো হে আর্য, এসো
অনার্য,
হিন্দু মুসলমান।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ,
এসো এসো খৃস্টান।
এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন
ধরো হাত সবাকার,
এসো হে পতিত করো অপনীত
সব অপমানভার।
মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা
মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা,
সবারে-পরশে-পবিত্র-করা
তীর্থনীরে।
আজি ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।’
খুব ভাল ও সময়োপযোগী লেখা
ReplyDelete