Sunday, March 25, 2018

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া


সম্পাদকীয় -/ গৌতম সেন




চৈতি হাওয়ায় এখন বসন্তের বিদায় সুর। আর তো মাত্র ক’টা দিন, বাংলা নতুন বছরের হবে শুভাগমন। বাঙালির নববর্ষ। ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ - এই ধারার প্রথম উৎসব বলা যেতে পারে এই নববর্ষ উদ্‌যাপন। ফাগুনের রঙ ফিকে হয়ে আসছে - বৈশাখ মাস আসবে গ্রীষ্মের খরতাপের আভাস নিয়ে। এরই ফাঁকে মেতে উঠবে বৎসরান্তের শেষ উৎসব –চৈত্র সংক্রান্তির দিন চরকের পুজো, চরকের মেলা।

এমন একটা শুভ সন্ধিক্ষণে চিলেকোঠার ই-ম্যাগ আজ প্রকাশিত হল তার গল্প,কবিতা, নিবন্ধের ডালি সাজিয়ে আবার। যাঁরা তাঁদের সম্বৃদ্ধ লেখনীর দানে ঋদ্ধ করে আসছেন এই ই-ম্যাগের জন্মলগ্ন থেকে, বা সাম্প্রতিক কালে যাঁরা এগিয়ে এসেছেন তাঁদের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে, তাঁদের সবাই কে জানাই চিলেকোঠা ই-ম্যাগের তরফে দেদার শুভেচ্ছা ও আন্তরিক কৃ্তজ্ঞতা। প্রসঙ্গক্রমে একটা অনুরোধ জানিয়ে রাখি, আরও বেশি সংখ্যায় লেখা দিন অর্থাৎ আরও সদস্য সদস্যা এগিয়ে আসুন,  লেখা দিন ই-ম্যাগে। শুধু গল্প-কবিতা বা অনুগল্পই নয়, ভোজন বিলাসীরা তো অপেক্ষায় থাকেই স্বাদে গন্ধে আকর্ষণীয় রান্নার রেসিপির জন্য। আনন্দের কথা এই একটা ভ্রমণ কাহিনী পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হছে এখন ই-ম্যাগে। এমনই বৈচিত্র আসুক দিনে দিনে এমন একটা আশাব্যঞ্জক অনুরোধ রইল সমস্ত লেখক-লেখিকার কাছে।

আজ তবে বাংলা শুভ নববর্ষের আগাম শুভেচ্ছা ও ভালবাসা জানিয়ে শেষ করি। সবাই আনন্দে কাটান আগামী দিনগুলি। সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন এই কামনা জানাই।


স্বপ্নস্বরূপ - ১৬ / ন ন্দি নী সে ন গু প্ত




গত বছর এমনই কোনও বসন্তের দিনে কবির কথা মনে করতে গিয়ে লিখেছিলাম যে অপেক্ষায় আছি এরকম কোনও বসন্ত উৎসবের যেখানে উদযাপনের প্রাণশক্তির প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে কেউ কাউকে পাঁকে টেনে নামানোর খেলায় মেতে উঠবে না। আশা মরে না, তাই অপেক্ষাও মরেনি।  এই জগতে নিয়ত চলেছে সুন্দর-অসুন্দরের লড়াই। কবি নিজের জীবন দিয়ে যেন সুন্দরকে জিতিয়ে দিয়ে যেতে চান বারে বারে। বসন্তের আগমন তাই তার কাছে এরকমই একটা লড়াই। কিন্তু সুন্দর যে কখনো খুব উচ্চকিত নয়। সে জোরগলায় ঝগড়াটুকু অবধি করে উঠতে পারে না, তবে লড়াই করবে কীভাবে? সুন্দরের ‘করুণ চরণ’ সে বিছিয়ে দেয় আঁধার কর্দমলাঞ্ছিত পৃথিবীর বুকে। সে দুর্বল। তবে এই দুর্বলতার মধ্যেই নিহিত তার শক্তি। অন্ধকারকে দমিয়ে  রাখবার মত প্রবল পৌরুষ হয়ত বা তার নেই, কিন্তু আছে সদিচ্ছা, আছে শুভকামনা। হয়তো বা সেই কারণেই বসন্ত বার বার আসে এই পৃথিবীর বুকে। মনে করিয়ে দেয়, অসুন্দরের  বিরুদ্ধে, রিক্ততার বিরুদ্ধে হেরে গেলে চলে না। নতুন পাতায়, ফুলে পৃথিবীকে সাজিয়ে দিতে চায় সে। এই আগমন যেন এক উপাসনায় রূপান্তরিত হয়। কবি উচ্চারণ করেন,
‘--- কুঞ্জে কুঞ্জে জাগিছে বসন্ত পুণ্যগন্ধ,
        শূন্যে বাজিছে রে অনাদি বীণাধ্বনি
......’
অসুন্দরের কুৎসিত আঘাত অজস্রবার সয়েছেন কবি। হয়তো বা চরম হতাশায় কখনো বলেছেন, ‘...মনে হল,  মানুষ অন্যায়ের আগুনে আপনার সমস্ত ভাবী কালটাকে পুড়িয়ে কালো করে দিয়েছে,  সেখানে বসন্ত কোনোদিন এসে আর নতুন পাতা ধরাতে পারবে না। ... তখন এত দিনের আয়োজন আবর্জনা হয়ে ওঠে। তখন চারি দিক থেকে শুনতে পাই,  জয়, পশুর জয়। তখন শুনি, “আজও যেমন কালও তেমনি। সময় চোখে-ঠুলি-দেওয়া বলদের মতো, চিরদিন একই ঘানিতে একই আর্তস্বর তুলছে। তাকেই বলে সৃষ্টি। সৃষ্টি হচ্ছে অন্ধের কান্না। মন বললে, “তবে আর কেন। এবার গান বন্ধ করা যাক। যা আছে কেবলমাত্র তারই বোঝা নিয়ে ঝগড়া চলে, যা নেই তারই আশা নিয়েই গান।...... ‘ হ্যাঁ, এই জায়গায় এসে ভাবতে বাধ্য করেন কবি। সময়ের আর্তনাদ কীভাবে তাকে স্পর্শ করেছিল যে তিনি ভেবেছিলেন, ‘এবার গান বন্ধ করা যাক!’ আমরা ভুলে যাই যে তিনি স্রষ্টা, যেকোনো ক্ষুদ্র অসাম্য, তুচ্ছ বিরূপতাও এড়িয়ে যেতে পারেনা তার চোখ, তার অনুভব। হয়তো বা সময়ের দাবী মেনে চুপ করে যেতে চান তিনি সেখানে, যেখানে সমস্ত কোলাহল ছাপিয়ে শোনা যাবেনা বসন্তের কুহুতান। হয়তো বা বিলুপ্ত হয়ে যেতে চাইবে সুর, মুছে যেতে চাইবে সৌন্দর্য। কিন্তু সেই মুছে যাবার আগের মুহূর্তে, যখন তার অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে, তখন কি ঘুরে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে চাইবে না সুন্দরের দাবী? যতই দুর্বল হোক সে, যতই মৃদু হোক তার কণ্ঠস্বর, ধ্বংসস্তুপের পোড়া ছাইয়ের ভিতর থেকে হয়তো বা ফিনিক্স পাখির মত ডানা মেলে দেবে সে, যে আগের মুহূর্তে মরে গিয়েছিল। কীভাবে? সেই যে কবি বলেছেন, যা নেই, তারই আশা নিয়ে মানুষ গান গায়। চরম আশাবাদী সুরে তাই কবি বলে ওঠেন পথে নামার কথা, বলেন বীণায় সুর লাগাবার কথা।
সুন্দরকে এবং সদিচ্ছাকে প্রতি পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়, সে কথা চরম সত্যি। সে শিক্ষা কবি নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন নিজের জীবন দিয়েই, নাহলে কেন তিনি বলে উঠবেন, ‘বড় বড় বুদ্ধিমান লোকের সৌন্দর্য্যের উপর বড় একটা বিশ্বাস নাই, সৎ-উদ্দেশ্যের প্রতি অকাট্য সংশয় বিদ্যমান। এই জন্য সৎকার্য্যের নাম শুনিলেই ইহাঁদের সংশয়কুঞ্চিত অধরৌষ্ঠের চারি দিকে পাণ্ডুবর্ণ মড়কের মত একটা বিষাক্ত হাসি ফুটিয়া ওঠে। অতিবুদ্ধিমান জীবের সম্মুখের দাঁতের  পাটিতে যে একটা দারুণ হাস্যবিষ আছে, হে জগদীশ্বর, সেই বিষ হইতে পৃথিবীর সমুদয় সৎকার্য্যকে রক্ষা কর। ইহাঁরা যখন পরস্পর টেপাটিপি করিয়া বলিতে থাকেন “এই লোকটার মৎলব বুঝিয়াছ? কেবল আমাদের খোশামোদ করা “ বা “অমুকের নিন্দা করা “ বা “সাধারণের কাছে নাম পাইবার প্রয়াস” – তখন সৎলোকের জীবনের মূলে গিয়া কুঠারঘাত পড়ে, তাহার সমস্ত জীবনের আশা ম্রিয়মাণ হইয়া যায়।’ এইখানে এসে মনে হয়, তাহলে কি অতিবিজ্ঞতার সাথে সুন্দরের বিরোধ আছে কোথাও? সম্ভবত আছে। স্বার্থবুদ্ধি হয়তো কোথাও মানুষকে সুন্দরের পরিপূর্ণ রসাস্বাদনে বাধা দেয়। মানুষ যদি সচেতন হয়ে ভাবতে বসে, এই সুন্দরে আমার কী লাভ? ব্যস, তাহলে আর সুন্দর তার কাছে ধরা দেবেনা কোনওদিন। সেই অর্থে সুন্দর হয়ত বা চঞ্চল। 
তার সেই চঞ্চলতাকে তিনি চিনতে পারেন, কারণ তিনি যে কবি। তার ভাষায় তাকে বেঁধে রাখেন সহজ সরল ভঙ্গীতে। প্রকৃতির মাঝে যা স্বাভাবিক, অমোঘ-- সেখানেই চোখে আঙুল দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিতে পারেন সুন্দরের অধিষ্ঠান। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ব্যাপ্ত প্রাণশক্তির মধ্য থেকে খুঁজে  নিয়ে সঠিক পর্দায় বেঁধে রাখতে পারেন গানের সুর। কবি আনন্দগান গেয়ে বলে ওঠেন, ‘‘ভয় নেই, ভয় নেই!... এই তো মূল সুর আমি বেঁধে রেখেছি, এই আদি প্রাণের সুর। সকল উন্মত্ত তানই এই সুরে সুন্দরের ধুয়োয় এসে মিলবে আনন্দের গানে। সকল পাওয়া, সকল দেওয়া ফুলের মতো ফুটবে, ফলের মতো ফলবে        

    




হে নট / অনুপম দাশশর্মা





কততম এপিসোডে দাঁড়িয়ে আপনি
উন্নাসিক হবার ভাষণ দিলেন হে নট!
'এখানে বৃষ্টি ঝরে বারোমাস'
শব্দের ভ্রুণ হাতড়িয়ে যতটুকু শ্রাবণ ভাসাতে
পেরেছি সে-সবই তো আপনার
অনন‍্য অভিনয়ের চরণে দিয়েছি ঢেলে
তবে আজ পারিতোষিকের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে
কেন-ই বা রাজনৈতিক ভাষণ ঝাড়লেন
ভাসান হয়ে গেল কদিনের উল্লাস
শ্রদ্ধাকুতির উপঢৌকন ছড়িয়ে দিলাম
সওদাগরের উড়ো খর-বাতাসে...


ভ্রমণ কাহিনী / ইতিহাস তুমি কেমন আছ / --অরুণ চট্টোপাধ্যায় দ্বিতীয় পর্ব


                

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য জগৎশেঠের বাড়ি। সিরাজকে ধরিয়ে দেওয়ার চক্রান্তের অন্যতম এক নায়ক হিসেবে পরিচয় হলেও সেটি জগতশেঠের একমাত্র পরিচয় ছিল না। ধনকুবের রক্তচোষা এক মহাজন হিসেবে ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়ে আছেন যিনি তিনি হলেন জগতশেঠ বা মহতাব শেঠ। মুর্শিদাবাদের কিছু দূরে কাঠগোলা বাগান পেরিয়ে নসীপুরের রাজবাড়ির অনতিদূরে বিরাট এক ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান হল এই জগতশেঠের বাড়ি। বাড়িটি এখন মিউজিয়াম হিসেবে পর্যটকদের দেখান হয়। এখানে বাড়ি ছাড়াও রয়েছে গুপ্ত সুড়ঙ্গ, পাতালঘর, তাঁর নিজস্ব টাঁকশাল যেখানে সোনা রূপোর মুদ্রা তৈরি হত। শেঠের ব্যবহৃত পোশাক, বিছানাপাতি, আসবাবপত্র, গয়না, অস্ত্রশস্ত্র, বন্দুক হাতকামান ইত্যাদি বহু বহু জিনিস। আছে নানা ফুলে ভর্তি বাগান আর একটি সুরম্য শ্বেত পাথরে মোড়া মন্দির। দর্শকরা এই বাড়িটি দেখে বেশ আনন্দ পাবেন আশা করি। জগতশেঠ ইতিহাসে একজন খুব বিখ্যাত বা কুখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। মীরজাফরের পর দ্বিতীয় এক বিশ্বাসঘাতক ব্যক্তির নাম করা যায় যিনি বাংলায় নবাবী শাসনের পতন আর ইংরেজ শাসনের পত্তন ত্বরান্বিত করেছিলেন তিনি হলেন এই জগতশেঠ। তিনি ছিলেন এমনই ধনকুবের যিনি নবাবদের অর্থ ঋণ দিতেন এমন কি অর্থ বা মুদ্রা ছাপানোর পর্যন্ত লিখিত অনুমতি যার ছিল তাঁর জীবনযাত্রা, বিলাসব্যসন ইত্যাদি সম্পর্কে মানুষের কৌতূহল থাকাই স্বাভাবিক। এই বাড়ি ভাল করে দেখলে সেই কৌতূহল অনেকটাই পূরণ হতে পারে। রাজা বা নবাব কিছুই ছিলেন না অথচ তাঁর ভান্ডারে এত অর্থ ছিল যা কোনও নবারেরও ছিল না। আর তার জোরে নবাবদের নিজের হাতের মুঠোয় রাখতেন তিনি। এখানে লর্ড ক্লাইভের একটা পোশাক আছে। আছে আরও কিছু বিস্ময়কর জিনিস। যেমন খাবারে বিষ আছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্যে বিশেষ ধরণের পাত্র। এখানে তাঁর ব্যবহৃত টাইপ রাইটার, টেলিফোন কি না ছিল। তখনকার বিখাত নর্তকী হীরা বাঈ যার উচ্চতা ছিল অসাধারণ আর তা হল ছয় ফুটের ওপর কিন্তু ওজন ছিল মাত্র ৪২ কেজি। তার একটা তৈলচিত্র আছে এখানে। সব মিলিয়ে বেশ দেখার মত জায়গাটা।
                   এরপর আসা গেল নসীপুরের রাজবাড়ি। এককালে বাংলার বাইরে থেকে আসা দেবী সিংহ মুর্শিদকুলি খাঁর অধীনে চাকরি ও আনুগত্য পেয়েছিলেন। তারপরেও তিনি নাকি নানা অসৎ পথে অর্থ রোজগার করতেন। এই অসৎ পথের মধ্যে ছিল ঠ্যাঙ্গাড়েগিরি, ডাকাতি, লোককে নানাভাবে শোষণ ইত্যাদি। কিন্তু নবাবদের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি ইংরেজদের গোপনে প্রচুর সাহায্য করতেন। এর প্রতিদানে ইংরেজরা তাঁকে মহারাজা উপাধি দেন। ইংরেজদের চাটুকার লর্ড ক্লাইভের হাত থেকে এই রাজা উপাধি হস্তগত করেন। ১৭৭৬ সালে লালবাগে নসীপুর স্থানে রাজা দেবী সিংহের উত্তর পুরুষ কীর্তিচাঁদ এই বিরাট প্রাসাদ নির্মাণ করেন। দ্বিতল এই প্রাসাদটিতে অতীতের বহু নিদর্শন পাওয়া গেলেও কাঠগোলা বাগান, হাজার দুয়ারি, ইত্যাদির মত বিনোদন এখানে মিলবে না। মিলবে শুধু এক বিরাট রাজপ্রাসাদের ভগ্নদশা মাত্র। এখানে আছে একটি ফাঁসিঘর যেখানে অবাধ্য প্রজাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হত। আর কিছু দেবদেবী। রামের মন্দির আর রাম লক্ষণ সীতা প্রভৃতির মূর্তি।
                   নসীপুর রাজবাড়ির অদূরে নসীপুর আখড়া। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে প্রতিষ্ঠিত রামানুজ সম্প্রদায়ের সাধুদের এই আখড়া অবশ্যই একটা দেখার মত জিনিস। ঝুলন পূর্ণিমা ও রথযাত্রায় এখানে বিরাট উৎসব হয়। এখানের বিরাট বিস্ময় হল সম্পূর্ণ চাঁদির তৈরি ১৪ ফুট উঁচু রথ। এ ছাড়া নানা দেবদেবীর মূর্তি, উৎসবের সময় গুরুজীদের আর শিষ্যদের থাকার জায়গা ইত্যাদি। এটিও ঘুরে দেখতে বেশ ভাল লাগবে। এক নাগাড়ে ঐতিহাসিক স্থান আর কবরখানা দেখতে দেখতে যারা বিষন্ন অথবা ধার্মিক মনোভাবাপন্ন তাদের ক্ষেত্রে এটা একটা ভাল টনিক অবশ্যই।  
                   এরপর জাফরাগঞ্জ মানে মীর জাফর আলী খান আর তার বংশধরদের বিশাল কবরখানা। প্রধান ফটকটি এখনও ভগ্নদশায় বেশ বিদ্যমান। ভেতরের প্রধান কবরগুলির ভালভাবে দেখা গেলেও তার বাইরে রয়েছে অসংখ্য শয়ে শয়ে কবর। একটু সন্ধ্যে হলে গা যেন ছমছম করে উঠবে কবরে শায়িত অতীতকে ছায়ামূর্তির মত উঠে আসতে দেখে।  
                    এছাড়াও দেখা গেল মুর্শিদকুলি খাঁর মেয়ে আজিমুন্নেসার কবর। মসজিদটি ধ্বংস হয়ে গেছে ভূমিকম্পে। কিন্তু একটি প্রবেশদ্বার এখনও এক কোণ ভাঙ্গা নিয়ে অপেক্ষমান ভ্রমনার্থীদের আপ্যায়নের জন্যে। আজিমুন্নেসা বেগম সম্পর্কে কথিত আছে তিনি নাকি শিশুদের কলিজা খেতে অভ্যস্থ হয়েছিলেন। বহু শিশু এইভাবে মারা যাবার পর তার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘কলিজাখাকি বেগম’। এখানেও বাবা মুর্শিদকুলির মতই মসজিদে ওঠার সিঁড়ির নিচে কবরস্থ হয়েছে মেয়ে।
চক মসজিদ, ত্রিপোলিয়া গেট, নৌসুরী বানুর সমাধি এসব আছে ছোট বড় অনেক কিছু। নৌসেরি বানু হচ্ছে মুর্শিদকুলির স্ত্রী আর আজিমুন্নেসার মা। এরপর আমাদের প্রবেশ মুর্শিদাবাদ বললেই এক কথায় যার ছবি মনের চোখে ভাসে হাজার দরজাওয়ালা সেই বিখ্যাত হাজারদুয়ারি। তখন প্রায় বেলা তিনটে বাজে। পেটের ভেতরে ছুঁচোরা এতক্ষন নানা স্থান দেখে বিরক্ত হয়ে পেটের নাড়িভুঁড়ি নিয়ে ছেঁড়া ছিঁড়ি করছে। গঙ্গা বা ভাগীরথী তার ধারে ধারে অসংখ্য ভাতের হোটেলের একটায় ড্রাইভার আমাদের নিয়ে এল যখন তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না আগে খাব না আগে ঘুরে আসব। ড্রাইভার আশ্বাস দিল যে ভেতরে ঘুরতে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বেশি লাগে না। তাই আগে খেয়ে নেওয়াই ভাল।
মোটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এই হোটেলগুলো। খাবার মাঝারি দামের আর মোটামুটি খারাপ নয়। সব পর্যটক এখানেই খেয়ে নেয়। অগত্যা আমারাও বসে গেলাম আমাদের পেটের ছুঁচোগুলো মারতে। ভাত, ডাল, আলুভাজা, সবজির তরকারি আর কাতলা বা রুই মাছের ঝাল। সত্তর আশিটাকার মধ্যে আমিষ ভোজন শেষ করে মৌরী হাতে উঠে যাওয়া হাজারদুয়ারি দর্শনে।
                   বর্তমান নিয়মে হাজারদুয়ারির ভেতরে মোবাইল কিংবা ক্যামেরা কিছু নিয়ে যাওয়া যায় না। রক্ষীদের দ্বারা রীতিমত মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা হচ্ছে। হাতে আর বিশেষ সময় নেই। এখন বাজে প্রায় পৌনে চারটে। সাড়ে চারটেতে বন্ধ হয়ে যাবার কথা এই সৌধের। আমি মোবাইল গাড়িতে রেখে এসেছিলাম। ঢুকে গেলাম ভেতরে। প্রায় ৪২ বছর আগে ১৯৭৬ সালে যখন এসেছিলাম তখন হাজারদুয়ারির মধ্যে হাজার হাজার শুধু দরজাই নয়, খুঁজে পেয়েছিলাম হাজার হাজার বিস্ময়। তাই আমার দেখতে বেশি সময় নিল না। তাছাড়া নিরাপত্তার কারণে তিনতলা সম্পূর্ণ বন্ধ। তাই দেখতে পেলাম না অনেক কিছুই।
                    ফিরে এসে মাঠে খানিক অপেক্ষা করছিলাম। বন্ধুকে বলেছিলাম আমার জন্যে অপেক্ষা না করে গাড়িতে মোবাইল রেখে যেন সে একাই ঢুকে যায়। মাঠে কিছুক্ষন অপেক্ষা করতেই বন্ধু ফিরে এল দেখে। এরপর মাঠে কিছুক্ষণ দুজনে আসন্ন সান্ধ্য প্রকৃতিকে দর্শন বেশ ভালই লাগল। গঙ্গা বা ভাগীরথীর ওপারে পশ্চিম আকাশে সূর্যটা তার তেজ হারিয়ে বড় স্নিগ্ধ হয়ে পড়েছে। আমার বিমুগ্ধ মোবাইল ক্যামেরা তাকে গোটা দুই চুমু খেয়ে ফেলল।  
                   চারপাশ অন্ধকার আস্তে আস্তে ঘন হতে শুরু করেছে। হাজারদুয়ারি বন্ধ হয়ে গেছে। পর্যটকরা নেমে আসছে বিরাট চওড়া সিঁড়ি বেয়ে। মাঠ হয়ে গেছে যেন স্বপ্নাচ্ছন্ন। চারপাশ তাকিয়ে দেখি। উত্তরে সাদা রঙের সুবিস্তৃত দ্বিতল ইমামবাড়া। ভারতের এটি সবচেয়ে বড় আর দীর্ঘ ইমামবাড়া। দৈর্ঘ ২০৭ মিটার। এটি প্রথমে সিরাজউদ্দৌলা নির্মিত কাঠের ছিল। ১৮৮৬ সালে পুড়ে যাবার পর এটির পুনর্নিমান করা হয়েছিল। সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্যে শুধু মহরমের সময় খুলে দেওয়া হলেও সারা বছর কেউ ঢুকতে পারেন না।  এর বিশালত্ব হাঁ করে দেখার মত।
                         হাজারদুয়ারির চত্বরে রয়েছে আরও কিছু মুগ্ধ হওয়ার মত জিনিস। যেমন ক্লক টাওয়ার বা ঘড়িঘর, ফুলের বাগান। সুন্দর মদিনা মসজিদ আর বাচ্চাওয়ালি কামান। ইমামবাড়ার কাছেই রয়েছে মদিনার আদলে তৈরি খুব ছোট একটি মসজিদ যা মদিনা মসজিদ নামে খ্যাত। সিরাজের মা আমিনা বেগমের প্রতিজ্ঞা ছিল ছেলে নবাব হলে মদিনার মাটি এনে মদিনার আদলে একটি মসজিদ নির্মাণ করবেন। নবাব হবার পরে মায়ের প্রতিজ্ঞার কথা মাথায় রেখে সিরাজ নিজে মদিনার মাটি এনে এই ছোট্ট মসজিদ তৈরি করিয়েছিলেন। অনেক রত্ন দিয়ে এটিকে সাজানো হয়েছিল। এটিও শুধুমাত্র মহরমের সময় খুলে দেওয়া হয়। এটি ছোট হলেও খুব সুন্দর দেখতে।  
                      আর আছে একটি সুন্দর ও দীর্ঘ কামান যাকে বলে বাচ্চাওয়ালি কামান। ১৬৪৭ সালে জাহানকোষা কামানের নির্মাতা জনার্দন কর্মকার এই কামান নির্মাণ করেন। ১৮ ফুট দীর্ঘ এই কামানের ওজন সাত হাজার ছশ সাতান্ন কেজি। এই কামানে একসঙ্গে আঠারো কেজি বারুদ লাগত। আশ্চর্যের বিষয় এক মর্মন্তুদ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই কামান মাত্র একবারই দাগা হয়েছিল। সেই ঘটনাটি হল এর তীব্র আওয়াজে একসঙ্গে বহু গর্ভবতী মহিলার গর্ভপাত ঘটেছিল। তাই এই কামানকে বাচ্চাওয়ালি কামান বলে আর নবাবের নির্দেশে দ্বিতীয়বার আর এতে বারুদ ভরা হয় নি।
সন্ধ্যা সমাগত। পশ্চিম দিকে একটা গাছের আড়ালে দিগন্তগামী সূর্যটা যেন লজ্জায় লাল হয়ে লুকিয়ে আছে। ভারি সুন্দর লাগছে এই দৃশ্য। বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নেওয়া গেল এর। অন্ধকারে ঢাকা হাজারদুয়ারি তার ভেতরের ইতিহাসকে নিজের মধ্যে ঢেকে রেখে একটা অদ্ভুত রহস্য-উন্মাদনায় রহস্যময় হাসি হাসছে।   
বেরিয়ে পড়েছি রাস্তায়। আমাদের গাড়ি চলল মোতিঝিলের উদ্দেশ্যে। তখনও বুঝিনি মোতিঝিল নিজের মধ্যে এত সৌন্দর্য আর রহস্য লুকিয়ে রেখেছে। নবাব আলীবর্দী খাঁর জামাই নওয়াজিস মহম্মদ খাঁ এই অপূর্ব অশ্বখুরাকৃতি লেকটি খনন করেছিলেন। এই লেকের পাশে একটি সুন্দর বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন যা মোতিঝিল প্রাসাদ নামে বিখ্যাত। থরে থরে সৌন্দর্য এখানে সাজানো আছে যা পর্যটকদের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
এই প্রাসাদ সিরাজের মাসি ঘষেটি বেগমের অত্যন্ত প্রিয় ছিল আর তাই স্বামী নওয়াজিসের মৃত্যুর পরও এখানে ছিলেন যতদিন না সিরাজ এই প্রাসাদ দখল করে। এই প্রাসাদ দখল করে প্রভূত ধনরত্ন এখান থেকে উদ্ধার করে ভাগীরথীর অপর পাড়ে অনুরূপ একটি প্রাসাদ তৈরি করেন যা হীরাঝিল নামে খ্যাত। মুর্শিদাবাদ থেকে আধ কিলোমিটার দক্ষিনে আর হাজারদুয়ারি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে এই সুরম্য প্রাসাদে ওয়ারেন হেস্টিংসও থেকেছেন ১৭৭১ থেকে ১৭৭৩ পর্যন্ত। বিশাল এই প্রাসাদে এমন একটি ঘর ছিল যার কোনও দরজা বা জানলা ছিল না। চারিদিক থেকেই বন্ধ এই ঘরে বেগম নাকি তার সমস্ত মণি মানিক্য সঞ্চিত থাকত বলে সকলের ধারণা ছিল। ৬৫ ফুট লম্বা, ২৩ ফুট চওড়া, ১২ ফুট উঁচু ১৩৩৯ বর্গফুট ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট এই ঘরের ভেতরের ধনরত্ন বার করার জন্যে মজুরেরা একবার এটিকে ভাঙ্গার অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা রক্তবমি করে সব নাকি মারা যায়। সেই থেকে সেই অভিশপ্ত ঘর ভাঙ্গার চেষ্টা আর কেউ করে নি।
মোতিঝিলে বেশ ঠান্ডা ছিল। তবে হাওয়া না থাকায় উপভোগ্য ছিল এই ঠান্ডা। রাতের অন্ধকারে এই বিশাল ঝিল আমরা তেমন করে দেখতে পাই নি। তাই সকলের কাছে অনুরোধ রাতে আর দিনে দুবার করে এই ঝিল পরিদর্শনে আসুন। আনন্দ অনেক বেশ পাবেন।
শেষ হল আমাদের প্রথম দিনের পরিভ্রমণ। এবার ফিরে চলেছি বহরমপুরে আমাদের টুরিষ্ট লজে। আবার তো কাল সকাল নটাতেই সূচনা হবে আর এক যাত্রার। আজকের মত তাই শুরু হোক বিশ্রামের পালা।   
[এখনও চলবে]


সমাজগুরু / পিনাকী দত্ত গুপ্ত



শিক্ষা আছে, দীক্ষা আছে, নেই কোনো তিতিক্ষা,
সাবাশ সাবাশ সমাজগুরু, বৃত্তি শুধুই ভিক্ষা?
যেমন ধরো, কেউ বলেছে কাজের সময় কাজ না,
কেউ বলেছে অধিক হ’ল খাজনা থেকে বাজনা,
কেউ বলেছে খিস্তি খেউড় শিখুক যত ছাত্র,
 কেউ বলেছে চৌর্য-বৃত্তি লোভের প্রকাশ মাত্র।
কেউ বা আবার গড্ডালিকায় পাখনা মেলে উড়ছে,
সৎ মানুষের বিবর্ণ বুক, আগুন জ্বরে পুড়ছে।

 কেউ দিনে পায় হাজার দুয়েক, তবুও ভীষণ কষ্ট,
 স্বভাব দোষে অভাব রোষে সংসারটাই নষ্ট।
কেউ বা প্যাঁচে নিত্য বেচে পণ্য -সেবার লিস্টি,
গণৎকারের ছদ্মবেশে কেউ গোনে রোদ-বৃষ্টি।
 কেউ বা খোঁজে আকাশবাণী, দেব-দেবীদের দিব্বি,
 কেউ বা টোলের ঝোলের লোভে হাই-মুকাশিন-হিব্বি।
 সবাই এমন ভাবছ কেন, সৎ মানুষের কান্না,
সমাজগুরুর ঢক্কানিনাদ শুনতে কিছুই পান না।

ফাগুন বিদায় / বুবুসীমা চট্টোপাধ্যায়





শুকনো বকুল
চললি কোথায় ?
গ্রহণলাগা দুপুরবেলা 
লাল মাটি পথ একলা চলা -
রুদ্রপলাশ মোড়ের মাথায় ?
কি বললি ?
আজ বিকেলে মোরগ লড়াই 
মহুলবনির হাটের তলায় ?

শোন রে বকুল -
চিকন চাকু শান দিয়ে তুই 
রাখনা রে আজ নিজের কাছেই ;
জানিস কি তুই ?
রোদ ঝরছে সূর্যি পোড়া 
রুদ্রপলাশ কাঁটায় মোড়া ;
কে শিমূলের ভাঙলো রে বুক ?
কাঁদছে অশোক হাপুসহুপুস ; 
কোন মোরগের দাম হেঁকেছিস ?
কোন পায়ে কার চাকু বেঁধেছিস ?

শুকনো বকুল -
একটু দাঁড়া , 
লাল গামছা মাথায় বেঁধে 
গ্রহনলাগা হাঁড়িয়া খেয়ে 
রুদ্রপলাশ মূর্ছা যাবে !  
ফাগুন শেষে - চৈত্র এসে -
ঝরা পাতাও উড়িয়ে দেবে ;
কচি সবুজ উত্তরীয় 
নিয়ে আসছে নূতন  বোশেখ
একটু না হয় তখন থামিস ; 

শুকনো বকুল -
একলা যাবি ? 
চলে যাবিই ফাগুন গেলে ? 
লাল মাটি পথ -
রুদ্রপলাশ-  শিমূল তুলো -
রঙিন যত ফুলের কুঁড়ি 
লালধুলোপথ উড়িয়ে নিয়ে
একলা ফাগুন  ডাকছে তোকে 
চৈতী এসে সাজিয়ে  দিয়ে
উতাল হাওয়ায়  ভাসিয়ে নিয়ে ।। 


'' ধূসর শূন্যতা'' / রীনা রায় ।



শিবশঙ্করবাবুর বাড়ীতে মালীর কাজ করে দুঃখীরাম।নামের মতোই তার জীবনটাও দুঃখে ভরা। কিছুদিন হল দুই রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে অকালে তার জোয়ান ছেলেটার প্রাণ গেছে। 
বাড়িতে বউয়ের শরীর ভাল নয়, টিবি ধরা পড়েছে।
একমাত্র আশা ভরসার জায়গা এই ছোট ছেলে।
সরকারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে, মাস্টারমশাইরা বলেন, ওর মাথা নাকি খুব পরিষ্কার ।
স্কুল না থাকলে ছেলেটা মাঝে মাঝেই বাবার সাথে এ বাড়ীতে চলে আসে।
এ বাড়ীর মালকিন ছেলেটিকে যথেষ্ট স্নেহের চোখে দেখেন, কিন্তু মালিক যে তার ছেলেটাকে কেন সহ্য করতে পারেনা, সেটা দুঃখীরাম কিছুতেই বুঝতে পারে না। 
হয়তো তার নিজের ছেলে লেখাপড়ায় অত ভাল নয় বলে।
মালিক তাকে সহ্য করতে পারেনা, সেটা ছেলেটাও বোঝে, তাই শিবশঙ্করবাবু যখন বাড়ীতে থাকেন না তখনই সে আসে।
সেদিনও এসেছিল।
তার বাবা তখন বাগানে কাজ করছিল। সে বাগানের এককোণে চুপ করে বসেছিল। সে যেখানে বসেছিল, তার ঠিক পাশেই একটা টবে খুব সুন্দর একটা টকটকে লাল রঙের গোলাপ ফুটেছিল, ছেলেটি বসে বসে ফুলটাকে দেখছিল। কোনোদিন সে কোনো ফুলে হাত দেয়না, মালিক রাগ করে।
হঠাৎ ওর নজরে পড়লো, একটা কালো পিঁপড়ে ফুলের ওপর উঠে আসছে। ও ভাবলো পিঁপড়েটাকে আস্তে করে তুলে ফেলে দেবে, এই ভেবে যেই ও ফুলটার দিকে হাত বাড়িয়েছে, কোথা থেকে যেন ওর মাথায় সজোরে কেউ আঘাত করলো। 
প্রচন্ড যন্ত্রণায় ও চীৎকার করে উঠলো।
ছেলের চীৎকার শুনে দুঃখীরাম ঘুরে তাকিয়ে প্রথমে দেখতে পেল মালিক দাঁড়িয়ে আছে, আর পাশ দিয়ে কতকগুলো গোলাপের পাপড়ি উড়ে যাচ্ছে। তারপর নজরে এল তার ছেলের মাথাটা মাটিতে পড়ে আছে আর লাল রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে ।
'বাবুয়া', বলে দুঃখীরাম আর্তনাদ করে উঠলো।
'তোর ছেলেকে আজ মেরেই ফেলবো, বলেছিলাম না, আমার ফুলগাছে হাত দিবিনা-----'
'মালিক, মাফ করে দিন এবারের মতো।আর মারবেন না, ছেলেটা মরে যাবে মালিক--- '
দুঃখীরামের কাকুতি মিনতি স্পর্শ করলো না শিবশঙ্করবাবুকে, তিনি তখন রাগে অন্ধ।
লাঠিটা তুলে আর একবার মারলেন বাবুয়ার মাথায়----
ছেলেটার ছোট্ট শরীরটা একবার কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল।
দুঃখীরামও শিবশঙ্করবাবুর পা ছেড়ে দিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বোবা হয়ে গেল। 
ওর ভূবন জুড়ে তখন শুধুই ধূসর শূন্যতা!!


অশুভ / সুবর্ণা বসু






সাদা জমির ওপর লাল সবুজ ছোপানো নামী কম্পানির দামী সালোযার কামিজটা পরে নিজেকে আযনায দেখতে লাগলো রোশনি, সযত্নে সেজেছে নীল এর কথা ভাবতে ভাবতে! নিজের ই চোখ ফিরছে না তো অন্যের কি অবস্থা হবে তাই অনুমান করে ঠোঁটের কোণে একচিলতে নরম হাসি খেলে গেলো ।  

"এই আজ তোমাকে কি দারুণ লাগছে.." বলতে বলতে আলতো করে নিজের মাথাটা ওর কোলে রেখে একেবারে কাছে টেনে নিল নীল ওকে।কি সুন্দর সেজেছে ও, আর কি মিষ্টি একটা গন্ধ শরীর ঘিরে জড়িয়ে রেখেছে । এত সুন্দর করে কি করে যে সাজায নিজেকে ভেবে পায় না নীল  !                                
আপাতত বেশ সুখের আমেজে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে । বেশি কথা হচ্ছে না, অল্প মৃদু আওয়াজ ছাড়া সুন্দর করে সাজানো সতেরো তলার ওপরের এই ফ্ল্যাটের এই শোওযার ঘরে শুধু ঐ কোকিল ঘড়ি টার আওয়াজ। ঘণ্টায ঘণ্টায ছোট্ট দরজাটা ফাঁক করে মুখ বাড়িয়ে সময় জানান দিচ্ছে কোকিলটা। পর্দা আলতো করে উড়িয়ে মৃদু হাওয়া ঢুকে পডছে  ঘরটায। নাঃ... আজ কোন তাড়া নেই , খুব নিশ্চিন্ত লাগছে রোশনির। 

অনেক দিন পরে আজ আশা পূরণ হতে পেরেছে ওর, কতদিন অপেক্ষা করেছে এই দিনটার জন্য, কত কিছু ই মনে মনে সাজিয়েছে, ভেংগেছে আবার জুড়েছে এই দিনটার কথা মনে করে। আজ সম্পূর্ণ করে পাবে নীলকে, ওর মনকে।     
আজ শুধুই ওরা দুজন।    অপলকে নীলকে দুচোখ ভরে দেখতে দেখতে কোলের ওপর রাখা মাথার ঘন চুলের রাশির মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে কখন যেন বড়ো আপন লাগতে লেগেছে ওর মুখটা... ফর্সা রং, একমাথা ঘন কালো চুল, পাশে খুলে রাখা আধুনিক ফ্রেমের চশমা, গায়ে নরম কটন এর গাঢ় রং এর টিশার্ট... একটা শক্ত পোক্ত হাত কোলের ওপর দিয়ে ঘিরে ধরে রেখেছে রোশনি কে ।                                                    

খুব মনে পড়ছে প্রথম আলাপের সময় টা। মুখোমুখি দেখা তো আজ ই, প্রথম নিবিড় করে পাওয়ার দিন, কত মুহূর্তের অপেক্ষার অবসান। প্রথম আলাপ মেসেঞ্জারে হ্যালো হাই দিয়ে ...আজ আর মনে পড়ে না কে প্রথম শুরু করেছে কথা বলা । ছোট ছোট লাজুক কথার দিন পেরিয়ে কত রাত পর্যন্ত কত গল্প হয়েছে, দুজন দুজনকে যেন নিঃশেষে জেনে নিয়েছে। রাত গডিযে গভীর হয়েছে কেউ কথা শেষ করতে পারে নি । 

তাই...   আজ এই নিরিবিলি সাক্ষাৎ। বহু চেষ্টা করতে হয়েছে ওকে। সময় হচ্ছিল না নীল এরই। নানা অকাজে এখানে ওখানে যেতে আসতে মাসের পর মাস পেরিয়ে গেছে, অপেক্ষাও বেড়েছে। ছোটমতন উইক এন্ডে কাছেপিঠে বেডাতে যাওয়ার প্ল্যানও শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি ।
বড়ো তাড়াতাড়ি যেন সময় কেটে যাচ্ছে ওদের, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে কূল ছাপিয়ে গেছে, ওদের আটকায কার সাধ্য, বড়ো সুন্দর মাযাময চোখ, মিষ্টি গলার আওয়াজ, নেশাধরা...মোহগ্রাস! 

হঠাৎ ই বডো বডো চোখ মেলে রোশনির হাত টা চেপে ধরে নীল বলে ওঠে " এতদিন তোমাকে বলতে চেযেও পারিনি। এইজন্য দেখাও করতে চাইনি "। রোশনির দম আটকে আসছে, কি বলবে নীল! আচমকা অনেক কাঁচ ভাঙ্গার ঝনঝন শব্দ, কানে তালা লেগে যাচ্ছে, মাথার মধ্যে সমুদ্রের গর্জন, হাজার ঢেউ ভাঙ্গার শব্দ । যেন ঘোর লেগে গেছে। যেন কতদূর থেকে কানে আসছে নীল এর কথাগুলো...  "অনেক টাকা চাই আমার, তোমার সংগে আলাপ করার উদ্দেশ্য ই এই, বলো দেবে? তবেই পাবে আমাকে। বলো, চুপ করে থেকো না। " 

হিসহিস করে ওঠে নীল ... যেন অজগর ফুঁসছে। 


নোংরা / সুজয় চক্রবর্তী



কলেজের কাছেই চন্দনদের বাড়ি । নিচেরতলাটা ভাড়া দেওয়ার জন্য ।
আজই এসেছে একজন । বাড়ি গ্রামে । ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে ।
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল চন্দনের বউয়ের ।  নিচে তাকাতেই চোখ ছানাবড়া !
ঘরে ঢুকে চন্দনকে বললো, ‘ছেলেটা  মুসলমান !’
‘তাতে কি  ?’
‘জানো , ওরা খুব নোংরা হয় !’
‘এটা জানি , বাইরের নোংরা ধুলে চলে যায় ।‘

নিষেধাজ্ঞা / গৌতম সেন




কালো মেঘ ভয় পায়
বাতাসের হাবেভাবে দুরভিসন্ধির গন্ধ
বিবেকের উর্বর জমি বন্ধ্যা আজ
ফোটা ফুলের পাপড়ি বর্ণহীন কেন?

সৌরভে আতঙ্কের বিষাক্ত আভাষ
চারদিকে দলে দলে কীট ওত পেতে আছে
পরাগরেণুর কণায় কণায় জমে ভয়
ওই ওরা যদি আসে কাছে!

এখন বৃষ্টির রঙ নিকশ কালো
নির্যাতনের বজ্রপাতে ভয়াল হুঙ্কার
নির্বিকার মানবিকতা বৈকল্যের শিকার -
বড় ভয়ঙ্কর, বড় বিপর্যস্ত সময়।

তবু অভিশপ্ত সময়ের আকাশ
রোদে-জলে আঁকুক রঙধনু তার দেয়ালে,
রামধনু বর্মে ঢাকা থাক সদ্যফোটা
যত সদ্যজাত ফুল। তাদের বিতান।

যত কুৎসিত, যত ঘৃণ্য আচরণ
পুড়ে খাক হয়ে যাক
সে আকাশবাণীর নির্মোঘ ঘোষণায় -
‘এ বাগানে ফুল তোলা নিষেধ!’


অবাঞ্ছিত / অর্পিতা ভট্টাচার্য




মায়ের কোলের নরম ওমেই,
সন্তান বাঁচে মার সত্ত্বায়।
অবাঞ্ছিত,জারজ নামীরা,
বঞ্চিত কেন এই নিরাপত্তায়?

বঞ্চিত শিশু জগতটাকে
দেখে,আর ভাবতে থাকে,
আমি কি তবে জন্মেছিলাম,
আকাশ ফুঁড়ে, আঁধার রাতে?

মা বাপ যদি থাকতো আমার
তবে কি এই আস্তাকুঁড়ে,
 আবর্জনায়, রোদ, বাদলে
থাকতে হতো এমন পড়ে?

বলেছিল তারই মতো,
পথের সাথি মেয়েটারে।
বললো সে "মা ছাড়া কি,
বাচ্চা কখনো জন্মাতে পারে"?

"আমরা ছিলাম অবাঞ্ছিত,
আমাদের বাপ মায়ের কাছে।
আমাদেরকে বিদেয় করে,
এখন তারা সুখেই বাঁচে"।

সেদিন থেকে ভেবেছে সে,
চিনতে যদি পারতো মা কে,
কাছে গিয়ে একবার সে,
ছুঁড়ে দিতো প্রশ্ন টাকে।

জন্ম দিয়েই, ত্যাগের সময়
মূক ছিল কি বিবেকটাও?
সুখের কাছে  মূল্যহীন,
নাড়ি ছেঁড়ার যন্ত্রনাটাও ?



" উবাসুতে " / নারায়ণ রায়।




অষ্টাদশ শতাব্দীর জাপানের প্রত্যন্ত একটি পাহাড়ি এলাকা। দুর্গম এই
এলাকাটিতে প্রচন্ড খাদ্যের অভাব, তাই বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কঠিন জীবন
সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে মানুষগুলো কেমন যেন হিংস্র হয়ে উঠেছে। আর
এখানকার একটি বিভৎস স্থানীয় রীতি হ'ল 'উবাসুতে'। এই প্রথা অনুযায়ী কোন
মানুষের সত্তর বছর বয়স হলেই তার আর বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। সমাজ বা
সংসার তার আর কোন দায় বা দায়িত্ব নেবে না। তাকে 'উবাসুতে' যেতেই হবে।

দুশো বছরেরও বেশি আগে প্রচলিত এই 'উবাসুতে' আমাদের দেশের সহমরণের চেয়েও
ভয়াবহ, অকল্পনীয় এবং অত্যন্ত কদর্য একটি জাপানী প্রথা। এই রীতি অনুযায়ী,
গ্রামের কোন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার বয়স সত্তর হলেই তাকে একটি খাদ্য পানীয়হীন
দুর্গম এক পাহাড়ের মৃত্যু উপতক্যায় বসিয়ে দিয়ে আসা হবে এবং একজন বৃদ্ধের
পক্ষে সেই দুর্গম উপত্যকা থেকে কোনদিনই আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। বাড়ির
লোকেরা তাকে ঐ মৃত্যু উপত্যকায় বসিয়ে দিয়ে আসার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই
চারিদিকে চিল শকুনের মাঝে এবং তার পূর্বসুরীদের কঙ্কালের মধ্যে জল এবং
খাদ্যের অভাবে এক নিদারুন কষ্টের মধ্যে সে মৃত্যুমুখে পতিত হবে। ঐ
মৃত্যুপুরীতে তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই চিল ও শকুনের দল তার উপর ঝাপিয়ে
পড়বে এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যেই একটি জীবন্ত মানুষ পরিনত হবে একটা ছিন্ন
ভিন্ন নর কঙ্কালে।

এদিকে বৃদ্ধা মিসাকিরও আর সত্তর হতে বেশি বাকি নেই। মিসাকি জানে এই
পৃথিবীতে তার আয়ু আর মাত্র এক মাসও নয়। কিন্তু তার যে এখনো অনেক কাজ
বাকি! আগামী শীতে ছেলে মেয়েদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করা হয়নি। সে 'উবাসুতে'
গেলে তার ছেলে মেয়ে নাতি নাতনীরা এই শীতে খাবে কি? তাছাড়া ছোট ছেলেটি তো
এখনও সংসারীই হল না। তার বিয়ে থা দিয়ে তাকে সংসারী করে যেতে হবে। এত সব
কাজ বাকি, অথচ তার হাতে সময় বেশি নেই। এই সব কাজ মাত্র আগামী কয়েকদিনের
মধ্যেই তাকে শেষ করে যেতে হবে।

এই তো পাশের বাড়ির বৃদ্ধ আকিরাকে আজ তার ছেলেরা 'উবাসুতে' নিয়ে গেল।
যাওয়ার সময়ে বৃদ্ধের সে কি কান্না! কাঁঁদতে কাঁদতে বূড়োটা বলেই যাচ্ছে
যে, এখনও তার শরীরের জোর কম কিছু নেই। ছেলেদের সংসারের জন্যে সে সকাল
থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত খেটে তাদের খাদ্য সংগ্রহ করে দেবে, সংসারের সব কাজ
করে দেবে । সে তার ছেলেদের ক্রীতদাস হয়ে থাকবে। তবু রেহাই নেই...।

ভাবা যায়? জীবন্ত এবং সম্পুর্ণ একটি সুস্থ মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে
বলপূর্বক 'উবাসুতে' নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? সেইযুগে ওই প্রত্যন্ত অঞ্চলে
মানুষের জন্ম তারিখ তো আর সেই ভাবে হিসেব নিকেস করা থাকতো না! বাড়ির
লোকেরা যখন মনে করত যে এই সংসারে বুড়োটার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, এই পরিবারে
সে আর কোন উপকারে আসবে না, তখনই ধরে নেয়া হত যে তার সত্তর বছর বয়স হয়েছে।

ইদানিং মিসাকিরও কাজে কর্মে খুব ভুল হচ্ছে, পরিবারের অনেকের কাছেই তাকে
খুব কথা শুনতে হচ্ছে। তাই মিসাকিও 'উবাসুতে' যাওয়ার জন্য নিজেকে মানসিক
ভাবে প্রস্তুত করে নিয়েছে। সে কাঁঁদবে না। আর মাত্র তো কয়েকটা তো দিন!
মিসাকি মনে মনে ভাবে ততদিনে নিশ্চই সংসারের সবার জন্য শীতের খাদ্য সংগ্রহ
করা হয়ে যাবে। ছোট্ট নাতিটা গত শীতে খুব কষ্ট পেয়েছে, ওর জন্য এবার একটা
মোটা দেখে কাঁথা বুনে দিয়ে যেতে হবে। আর মাত্র কয়েক দিন তার আগেই নিশ্চই
সব কিছু হয়ে যাবে।

মিসাকি নিজেই নিজের মনকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে। যেতে যখন হবেই তখন সে নিজেও
উবাসুতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আচ্ছা আজকে ওই বুড়ো আকিরার সঙ্গে চলে
গেলেই তো হত? মাত্র কয়েকটা তো দিন ! অন্তত মৃত্যুর আগে ওই মৃত্যু পাহাড়ে
বসে কয়েক ঘন্টা দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁঁদতে তো পারতো? আজ বুড়ো আকিরার
জন্য মিসাকির বুকের ভিতরের কান্নাটা দলা পাকিয়ে বার বার গলা পর্যন্ত উঠে
আসছে।

কত কথা মনে পড়ে যায়। বৃদ্ধ আকিরার বউকে কিম্বা মিসাকির স্বামীকে অবশ্য
উবাসুতে যেতে হয়নি। বুড়ি নিজের বাড়িতেই হটাৎ একদিন বুড়োর কোলে মাথা রেখে
ডাং ডাং করে সোনার রথে চড়ে স্বর্গে গেল। ঠিক একই রকম ভাবে মিসাকির বরও
দুদিনের অসুখে নিজের বউ এর হাতে ভাত খেয়ে নাচতে নাচতে স্বর্গে চলে গেল।

পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে খাবার জল কিম্বা আগুন জ্বালানোর শুখনো কাঠ আনতে মিসাকি
যখন জঙ্গলে যেত, প্রায়ই একই কাজে বেরনো আকিরার সঙ্গে তার দেখা হয়ে যেত।
নিজের নিজের সংসার নিয়ে ওদের দুজনে কত সুখ দুঃখের গল্প হ'ত। আকিরা বলতো,
জানিস মিসাকি, তোর বরের মত আর আমার বউ এর মত ভাগ্য কি আর আমাদের হবে?
মিসাকি তার উত্তরে বলত, কি জানি, কি যে হবে তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।

মাঝে মাঝে শুখনো কাঠ আর জল বইতে বইতে যখন দুজনে ক্লান্ত হয়ে পর'ত। একটা
পাহাড়ি মাপেল গাছের নীচে বসে দুজনে গল্প করেই যেত। তল্লা বাঁঁশের তৈরী
জল-পাত্র থেকে ঢক ঢক কয়েক ঢোক করে জল খেয়ে নেয় আকিরা, তারপর মিসাকিকে
বলে, অনেক ক্ষন বক বক করেছিস, নে একটু গলাটা ভিজিয়ে নে। এই বলে মিসাকি
যেই হাঁ করে মুখটা উচু করে ধরে, আকিরা তখন এক হাতে মিসাকির চিবুকটা ধরে
ওর মুখে আস্তে আস্তে জল ঢেলে দেয়। কিছুটা জল ছলকে পরে মিসাকির মুখ ও জামা
ভিজে যায়। আকিরার চোখে মিসাকিকে তখন কি সুন্দরীই না লাগে! মিসাকিও ইদানিং
লক্ষ্য করেছে, আকিরা মানুষটা বড্ড ভাল। ওর সঙ্গে বসে একবার গল্প করতে
শুরু করলে আর উঠতেই ইচ্ছে করে না।

এই তো সেদিন যখন পাহাড়ি রাস্তায় মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে হাটতে হাটতে খাড়াই
পথ ধরে নেমে আসছিল, তখন আর একটু হলে মিসাকি তো পা পিছলে পরেই যাচ্ছিল।
ভাগ্যিস আকিরা তখন ওর বলিষ্ঠ হাত দুটো দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরেছিল। নাহলে তো ও
পা পিছলে পরে মরেই যেত। এদিকে আকিরাও এখন একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে যে
মিসাকিকে না দেখলে আকিরারও মনটা কেমন যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে। বলিষ্ঠ চেহারার
আকিরাকে কে বলবে তার সত্তর বছর বয়স হল। শুধু ডান পা টা একটু টেনে টেনে
হাটে। তাই রসিকতা করে মাঝে মাঝে মিসাকি তাকে বলে আমার "ল্যাংড়া আকিরা"।

আপন মনে এসব কথা ভাবতে ভাবতে হটাৎ মিসাকি লক্ষ্য করল, আকিরাকে নিয়ে ওর
ছেলেরা উবাসুতে চলে গেছে। মিসাকির দু চোখ বয়ে নেমে আসছে জলের ধারা। এই তো
মাত্র কয়েক মাস আগের কথা। শীত আগত প্রায়। চারিদিকে ধীরে ধীরে চেরী
গাছগুলো লাল হতে শুরু করেছে। আকিরা কয়েকটা চেরীফুল নিয়ে মিসাকির মাথায়
গুজে দিয়ে বলল, তোকে কি সুন্দর লাগছে, আর লাগবে নাই বা কেন? তোর নামটাই
তো কত সুন্দর 'মিসাকি' মানে 'সুন্দর ফুল'। জানিস মিসাকি, তুই কাছে এলেই
তোর শরীর থেকে একটা সুন্দর ফুলে গন্ধ পাই আমি। উত্তরে মিসাকিও বলে তোর
নামটা তো আরও সুন্দর, 'আকিরা' মানে, উজ্জ্বল। তুই আমার কাছে সত্যি সত্যিই
উজ্জ্বল হয়েই থাকবি।

অথচ সেই আকিরা আজ...। সকাল থেকেই আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। মাঝে মাঝেই
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সঙ্গে বৃষ্টি। কারও উবাসুতে যাওয়ার দিনে মেঘে ঢাকা
আকাশ মানেই নাকি সে খুব ভাগ্যবান। ধুস্ মৃত্যুমুখে পতিত একজন মানুষের
আবার ভাগ্য ! এত দুঃখেও মিসাকির হাসি পায়। মিসাকি ভাবতেই পারছে না তার
'গোপন প্রেম' আকিরা ওই দুরের মৃত্যু পাহাড়ে অনাহারে, পিপাসায় শিয়াল,
শকুনের খাদ্য হয়ে ...। ইসস্স্স্...। আবার মিসাকির দু চোখ বয়ে নেমে আসে
জলের ধারা। কিন্তু পরক্ষনেই মিসাকি নিজেকে সামলে নেয়। এখন ওর কান্নার সময়
নয়। ওর যে এখনো অনেক কাজ বাকি। হাতে আর অল্প কয়েকটা দিন মাত্র। তার আগে
ছোট ছেলে দাইসুকুকে সংসারি করে যেতে হবে। শীত আসার আগে পরিবারের জন্য
শীতের খাদ্য মজুত করে যেতে হবে। ওর প্রিয় ছোট্ট নাতির জন্য একটা কাঁথা
বুনে দিয়ে যেতে হবে।

আকিরাকে পিঠে নিয়ে প্রায় চার-পাচ ঘন্টার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে মৃত্যু
পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলেছে ওর ছেলে আর কয়েকজন আত্মীয় পরিজন। ভীষণ দুর্গম
সে পথ। ঘন মেঘে আচ্ছাদিত আকাশ, সকাল থেকে একটানা বৃষ্টি হয়েই চলেছে। যেমন
করে আমাদের দেশে পাহাড়ি তীর্থ ক্ষেত্রে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে দোলায় চাপিয়ে নিয়ে
যাওয়া হয়, ঠিক সেই ভাবে বয়ে নিয়ে আকিরাকে নিয়ে চলেছে তারই আত্মজ এবং
ঘনিষ্ট জনেরা। বৃষ্টির জোর যেন কমশ বেড়েই চলেছে, আর যেন কোনমতেই এগোন
যাচ্ছে না। প্রচন্ড খাড়াই রাস্তায় যেকোন মুহুর্তে পা পিছলে একটা দুর্ঘটনা
ঘটে যেতে পারে। এরপর সঙ্কীর্ণ পাহাড়ি রাস্তাটা এতটাই খাড়াই এবং বিপজ্জনক
ভাবে উপরের দিকে উঠে গেছে যে রাস্তা না শুকোলে এই বৃষ্টির মধ্যে কোনমতেই
ঐ উতরাই অতিক্রম করা সম্ভব নয়। অথচ এখনও প্রায় এক ঘন্টার পথ বাকি।

একটা গাছে তলায় সবাই কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর তারা ঠিক করলো, আকিরা কে
ওখানেই রেখে দিয়ে তারা চলে আসবে। বুড়ো নিশ্চই ওখান থেকে এই দুর্গম রাস্তা
হেঁঁটে আর বাড়ি ফিরে যেতে পারবে না। তাছাড়া 'উবাসুতে'র নিয়ম আনুযায়ী
একবার যাকে উবাসুতে দিয়ে আসা হয় কোনকারনে সে ফিরে এলেও তাকে আর কোনদিন
সংসারে ফিরিয়ে নেয়া হয় না। সেইমত সবাই আকিরাকে ওখানেই একটা গাছ তলায়
বসিয়ে দিয়ে বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরল। আকিরার আজকের এই আত্মজ এবং ঘনিষ্ট
আত্মীয় স্বজনদের ব্যবহারের সঙ্গে সভ্য সমাজের আচার ব্যবহার কোনমতেই মেলে
না। অথচ এটাই ছিল সেকালের ওই এলাকার নিয়ম। এই নিয়মের অন্যথায় সেই
পরিবারকে সমাজে একঘরে হতে হবে।

আকিরা এখন আর কাঁদছে না। ওর সব কান্না যেন শেষ। ইতিমধ্যে বৃষ্টি অনেকটা
কমে এসেছে বলিষ্ঠ চেহারার আকিরা উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে হেটে এলাকাটা
ঘুরতে লাগলো। একটা শকুন ও দুটো চিল ঊড়ে এসে ওর মাথায় ঠোক্কর দিতে চাইলে ও
এক ঝটকায় তাদেরকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে লাগলো। আস্তে আস্তে দিনের আলো
শেষ হয়ে আসছে। একটা পাহাড়ি গুহা যদি পাওয়া যেত, অন্তত রাতটুকুর জন্য!
প্রচন্ড দুর্গম আবহাওয়ায় অতি সংকীর্ণ পাহাড়ি পথে কোনরকমে জীবনটাকে হাতে
নিয়ে আকিরা একটু আশ্রয়ের আশায় পাহাড়ি গাছের ডাল পালা ধরে ধরে হেঁটে যেতে
লাগলো। বেশ কিছুক্ষন হাটার পর একটা পাহাড়ি গুহার সন্ধান পেল। আশে পাসে
কয়েকটা সুস্বাদু ফলের গাছের সন্ধানও পেল সে। কিছু দূরে একটা পাহাড়ি
ঝর্ণারও শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সে কিছুটা নিশ্চিন্ত হল অন্তত আজকের রাতটুকু
কোনরকমে এই গুহাটাতে কাটানো যাবে। ইতিমধ্যে বেলা শেষ হয়ে অন্ধকার হয়ে
আসছে।

পরদিন সকালের গ্রাম আর পাঁচটা দিনের মধ্যেই স্বাভাবিক। সবাই যে যার কাজ
নিয়ে ব্যস্ত। শুধু একজন, মিসাকি, সারা রাত নীরবে কেঁদে গেছে। সকালে সেও
আর পাঁঁচটা দিনের মতই পাহাড়ি জঙ্গল থেকে শুখনো কাঠ আর ঝর্ণার জল আনতে
বেরিয়ে গেল।
তবে আজ সে সম্পূর্ণ একা, মনটাও খুবই খারাপ। বার বার মনের মধ্যে শুধু
উঁঁকি দিয়ে যাচ্ছে একটাই মুখ, 'আকিরা', 'আকিরা' আর 'আকিরা'। গত কালকের
ঘটনা মিসাকি সবই শুনেছে। বেচারা আকিরা হয়ত এখন উদ্ভ্রান্তের মত ওই লাল
পাহাড়তার চুড়োয় ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে একটু খাবারের জন্য, একটু জলের
জন্য। একবার আকিরা ওকে দেখিয়েছিল ঐ মৃত্যু উপত্যকায় যাওয়ার রাস্তাটা। ঐ
তো ডান দিকের ঝর্ণার পাশ দিয়ে পাহারি খাড়াই টা পার হলেই নাকি সেই রাস্তা।
তারপর চার পাচ ঘন্টা দুর্গম পাহাড়ি রাস্তায় শুধু হাঁটা আর হাঁঁটা।

মিসাকির আর বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। আচ্ছা, আর মাত্র কয়েকদিন পরেই
তো মিসাকিকে ছেলেদের কাঁঁধে চড়ে ঐ মৃত্য পাহাড়ে যেতেই হবে, তার চেয়ে ও
যদি আজ একাই হাটতে হাটতে জায়গাটাতে......। যেমন ভাবা ঠিক তেমনই কাজ। এক
ঝটকায় কাঁধ থেকে ছুড়ে ফেলে দেয় কুড়িয়ে আনা জঙ্গলের সব কাঠ আর ঝরণার জল।
তার জোরে জোরে পা ফেলে সে এক মনে এগিয়ে যেতে থাকে সেই মৃত্যু উপত্যকার
দিকে। মিসাকির আর পিছন ফিরে তাকাবার সময় নেই। বেলা বাড়তে বাড়তে তার পা
ব্যাথা হতে থাকে, তবু সে একবারের জন্যও পিছন ফিরে তাকায় না। সূর্য্য তার
লাল আভা ছড়িয়ে ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে। মিসাকির পায়ে ফোস্কা পরে গেছে।
তবু সে দুর্গম পাহাড়ি রাস্তায় গাছের ডাল পালা ধরে ধরে এগিয়ে চলে।

হটাৎ তার সমস্ত শরীর এক পরমানন্দে শীহরিত হয়ে উঠলো, মিসাকি স্পষ্ট দেখতে
পেল, কিছুটা দূরে সেই বলিষ্ঠ চেহারার লোকটি ঋজু ভঙ্গিমায় ডান পা টা টানতে
টানতে এই দিকেই এগিয়ে আসছে। লোকটি মিসাকিকে দেখতে পেয়েই দৌড়ে এসে
মিসাকিকে বুকে টেনে নিয়েই বলল... ঈশ্বর কিই কখনও প্রকৃত প্রেমকে ব্যর্থ
হতে দেয়? একথা বলেই দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না!


এক প্রতিবাদিনীর চিঠি / শমিতা চক্রবর্তী





প্রিয়  নীল , 
                তোমাকে এভাবে চিঠি লিখতে হবে ভাবিনি . কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস দেখো --পাশের ঘরে তুমি অকাতরে ঘুমোচ্ছো,আর আমার এতদিনের না বলা কথাগুলো  তোমাকে লিখে যেতে হচ্ছে ! 
                        যাই হোক শোনো,কালই এবাড়ি ছাড়ছি।হয়তো চিরদিনের মতোই ! হ্যাঁ ঝিলমিল কেও সঙ্গে নেবো , বোধহয় অবাক হচ্ছো --এতো সাহস আমার হল কবে থেকে !  আসলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বোধহয় মানুষ এমনই মরিয়া হয়ে যায় ! কাল যখন আলট্রা সোনোগ্রাফির রিপোর্ট টা এলো তখনই স্থির করে ফেলেছিলাম।নাঃ এবার আর তোমাদের কথা শুনছি না।এ সন্তান আমি রাখবো ই , নো অ্যাবোরশন ! এবারেও কন্যা ভ্রূণ ! তোমার মায়ের তীব্র কটাক্ষ --আবার মেয়ে !  বুঝে গিয়েছিলাম এবারেও তোমার ডাক্তার ভাই এর সহযোগীতায় তোমার মা এই ভ্রূণ নষ্ট করিয়ে দেবেন !  আমি অবাক হয়ে যাই --তোমরা কোন যুগে বাস কর --এখনও মধ্যযুগীয় মানসিকতা !  তোমার মা এর নাহয় শিক্ষা -দীক্ষা -রুচির অভাব আছে --কিন্তু তুমি তো শিক্ষিত আর তোমার ভাই তো একজন ডাক্তার --তাহলে এতো নীচ মনোবৃত্তি কেন ?  নাকি তুমি একেবারে মাম্মা'স বয় ! 
                           সেবার যখন ঝিলমিল হল --তোমার মা কোথায় আনন্দিত হবেন --সংসারে নতুন অতিথি এসেছে --তা না একঘর লোকের সামনে বলে বসলেন --- এতো সেবা যত্ন করলাম বৌমা র -শেষে কী না মেয়ে !  আমার মা তখন সামাল দিয়েছিল --প্রথম সন্তান মেয়েই ভালো দিদি --ঘরে লক্ষ্মী এলো ! 
            ঝিলমিলের একবছর হতে না হতেই তোমার মা শুরু করলেন --বৌমা এবার ছেলে চাই --বংশ তো রক্ষা করতে হবে ! তোমার কানের কাছেও গুনগুন করতেন বুঝোছিলাম !
                  দ্বিতীয় বারের জন্য অন্তঃস্বত্তা হলাম . এবার তো ডাক্তার মেঘাদ্রী বোস মায়ের পরামর্শে একেবারে আটঘাট বেঁধেই নামলেন !  আল্ট্রাসোনোগ্রাফি হল --কন্যা সন্তান আসছে --না না তাকে কিছুতেই আসতে দেওয়া যাবে না --সুতরাং অ্যাবরশন !  আমার আপত্তি ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলে সবাই ! তুমিও চুপ করে রইলে . হয়তো ওদের কথায় তোমারও প্রচ্ছন্ন সম্মতি ছিল !  কে জানে !
আমি অবাক হই -তুমি এদের কথার প্রতিবাদ কেন করোনা !  মেঘাদ্রী বোস ডাক্তার হয়েছে ঠিকই --কিন্তু নীলাদ্রী বোস ই  বা কম কিসে ?  বাবার অকাল মৃত্যুর পর তোমাদের এই ব্যবসা টার হাল তুমিই ধরেছিলে --আর সেই ব্যবসা আজ ফুলে ফেঁপে এতো বড় !  বিয়ের পর এসব গল্প শুনে গর্ব হয়েছিল তোমার জন্য --বেশ করেছিলে নিজের এম .বি .এ ডিগ্রী টা নিয়ে চাকরির দ্বারস্থ না হয়ে নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা টা সামলেছিলে .
                  তোমাদের সব কথা আমি চুপচাপ এতদিন মেনে নিয়েছি --কারণ ঝগড়া -ঝাঁটি -অশান্তি এগুলো থেকে আমি বরাবর দূরেই থাকতে চেয়েছি !  আমার শিক্ষা , আমার রুচি আমাকে বাধা দিয়েছে তোমার মায়ের সঙ্গে আমার মতের অমিল গুলো নিয়ে খিটিমিটি করতে !  তাই হয়তো তোমরা আমার ভালোমানুষি টাকে আমার দুর্বলতা বলে ধরে নিয়েছো ! 
                            তোমার মা বংশ রক্ষা করতে চেয়েছেন --তাই আমাকে খানিকটা অনিচ্ছা সত্বেও তৃতীয় বারের জন্য অন্তঃস্বত্তা হতে হয়েছে কিন্তু বংশ রক্ষার দায় কী শুধুই আমার !  মেঘের কি কোন দায় নেই ! বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মৌলী র সঙ্গে বিয়েটা ভেঙে ফেললো . মৌলী অবশ্য খুব স্বাধীনচেতা মেয়ে --পারবে কেন এ সংসারে টিকে থাকতে ! 
                         আর এখন দুজন এসেছেন আমার অনাগত সন্তানের ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করতে !  তোমরা জান আমি চাইলে তোমাদের বিরুদ্ধে লিগ্যাল স্টেপ নিতে পারি --কিন্তু না ওসব রাস্তায় যাবো না . তাই তোমাদের ঘর ছাড়বো মনস্থ করেছি .
                                  শিক্ষাগত যোগ্যতা এই রনিতা বোসের ও আছে --চাকরি একটা ঠিক জুটে যাবে . আমার মেয়েদের লালন পালনের ভার আজ থেকে শুধু আমারই . আপাতত মায়ের কাছেই যাবো . একটি সুস্থ সবল কন্যা সন্তানের জন্ম দিতে হবে তো ! 
                      রাখছি তবে . শুভেচ্ছা নিও .আর যেদিন মায়ের অবাধ্য হতে পারবে -সেদিন আমার কাছে যেও .
                                   ইতি 
                                         .........

চিঠি টা লিখে ফেলার পর বেশ নির্ভার লাগছে রনিতা র !  ব্যালকনি তে এসে দাঁড়ালো --সমস্ত চরাচর নিঝুম ঘুমে .মধ্যযামের চাঁদ ও বুঝি মেঘের আড়ালে অল্প তন্দ্রামগ্ন !  আশপাশেই বুঝি পূর্ণিমা --আলো আঁধারীর এক অদ্ভুত খেলা চলছে সামনের বাগানটা জুড়ে !  একটু বুঝি মন কেমন ও করছে --নিজের হাতে লাগানো গাছগুলো কাল থেকে হয়তো অনাদরে পরিচর্যা হীন হয়ে পড়ে থাকবে . তা সে যাই হোক --আজ যে এইটুক প্রতিবাদ করতে পেরেছে -এতেই খুব খুশী ও ! 
                               কাল খুব ভোরেই বেরিয়ে যাবে --শুধু ঝিলমিল টাকে একটু বেশিই ভোরে উঠতে হবে এই যা ! 
           কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে এলোমেলো ভাবনায় কেটে গেল কে জানে - অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে এবার ...
                     ঐ বুঝি বড় মাঠের ওপারের বস্তিটায় মোরগ ডেকে উঠলো ,
           নতুন ভোরের সূচনা --আজ থেকেই ! 


সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া