এই বিমলি , ছেনাল মাগী,
কোথায় গেলি হারামজাদী , কাল থেকে বলে রেখেছি আমায় আজ সকালে দশটায়
প্রেসক্লাবে যেতে হবে অথচ আমার জুতো পালিশ করে রাখিস নি কেন ?বলি তোর বাপের
বাড়ি থেকে কয়টা চাকরাণী পাঠিয়েছে যে তুই আমার কাজ না করে এখনও বিছানায় শুয়ে আছিস ?
রাগে গজ গজ করতে করতে আপন পুত্রবধূর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলেন মিসেস
চৌধুরী ॥
মিসেস চৌধুরীকে অবশ্য
আপনারা চেনেন না । আমি চিনি । তা কতদিন ধরে চিনি সে কথা বলতে গেলে আমায় আবার
হিসেব কষতে বসতে হবে । এই ধরুন আমি এপাড়ায় এসেছি বছর পাঁচেক আর তার আগে ওই
যখন এই কোলকাতার বিখ্যাত দৈনিক সংবাদপত্র "----বাজারের "একজন মামুলি
জার্নালিস্ট ছিলাম বছর তিন -চার তখন এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যারা আবার বিভিন্ন নারী
কল্যাণমূলক কাজের সাথে যুক্ত ও সেই কাজের সুবাদে বিদেশ থেকে প্রচুর সংবর্ধনা ও
আর্থিক অনুদানও পেত তাদের এক মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে আমার সাথে মিসেস চৌধুরীর
আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন ওদের প্রেসিডেন্ট মিসেস পাকড়াশী । মিসেস চৌধুরী তখন ছিলেন ওই
সংস্থার একজন নবাগতা সদস্যা । তারপর আমি ও হঠাৎ কপালের জোরে একটা নামকরা ইংরেজী
পত্রিকার সহকারী রিপোর্টার হিসেবে দিল্লী চলে গেলাম । সেখানে গেলেও কোলকাতার সঙ্গে
যে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছল তা নয় , আমার এখানকার বন্ধুদের সৌজন্যে সব
খবরাখবর ঠিকই পাচ্ছিলাম । সেই বন্ধুদের কাছেই জেনেছিলাম কেমন উল্কার বেগে মিসেস
চৌধুরী সাধারন সদস্যা থেকে কেমন ভাইসপ্রেসিডেন্ট , প্রেসিডেন্ট হলেন , কোন কোন
নেতার বদান্যতায় কেমন করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নারী সংগঠনের সর্বময়নেত্রী ও পরে
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপার্সন হলেন ॥
তা যাক ঘটনাক্রমে কোন
একটা কাজে আমি ঠিক ওই সময়ই মিসেস চৌধুরীর কাছে গিয়েছিলাম । মিসেস চৌধুরীর পুত্রবধূ
লতা যে আবার আমারই কোলকাতায় থাকা কালীন যে পাড়াতে থাকতাম সেই পাড়ারই মেয়ে ,
শাশুড়ির চিৎকারে বাইরে এলো ও তাকে দেখে আমি যারপরনাই বিষ্মিত হলাম । লতার
বয়স অনুমানিক সতেরো -আঠেরো বছর । দুধে -আলতা গায়ের রং । নাক ও চোখ দুটি যেন কোন
নামী শিল্পীর তুলিতে আঁকা । দেখে মনে হলো দিনমেসে পোয়াতি এবং তার প্রসব কালীন সময়
আসতে হয়তো দু -একমাস বাকি আছে ।
অত সুন্দর দেখতে হলেও
তাকে কেমন যেন বিমর্ষ ও অপুষ্টিতে ভোগা বলে মনে হলো । সে এসে মেঝেতে বসে আঁচল দিয়ে
আপন শশ্রুমাতার জুতো জোড়া পরিষ্কার করে রাখলো । মিসেস চৌধুরী এসে সোফায় বসলেন এবং
আমায় চা দেওয়ার কথা বলে আপন অভিষ্ট প্রেস ক্লাবে যাবেন বলে উঠে দাঁড়ালেন । মেয়েটি
জুতো জোড়া পায়ে পরিয়ে দিলো । মিসেস চৌধুরীও দ্রুত বেরিয়ে সরকার থেকে প্রাপ্ত
গাড়িতে উঠলেন । লতা অবশ্য আমায় তেমন চিনতো না । আমি চায়ের সাথে মিষ্টি
বিস্কিট নাকি নোনতা নেবো জিগ্গেস করায় আমি বললাম যে আজ নয় অন্য কোনদিন । আজ
আমার ভীষন তাড়া আছে । সে বললো যে আমি যদি চা না খেয়ে চলে গেছি মিসেস চৌধুরী
জানতে পারেন তবে তার কপালে অশেষ লাঞ্ছনা জুটবে । আমি কথা দিলাম যে আমি চা না
খেয়ে যাচ্ছি তা মিসেস চৌধুরী কোনদিনই কোনমতেই জানতে পারবেন না এবং কথা
দিচ্ছি যে পরে যে কোনদিন এসে অবশ্যই তার হাতের চা খেয়ে যাবো ॥
বাইরে বেরিয়ে আমি নিজের
বাসার দিকে ফিরছি এমন সময় হঠাৎ একটা বেলেরো ক্যাচ করে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো ।
গাড়ির সামনে প্রেস স্টিকার দেখে বুঝলাম যে সেটা কোন সাংবাদিকের । গাড়ির ড্রাইভারের
পাশের থেকে চোখে কালো চশমা পরা এক সুবেশা সুন্দরীর গলা ---হাই নিখিলেশদা ! আপ ইঁহাপর
? দিল্লী সে কব কোলকাত্তা আয়ে হ্যায় ?কাঁহা পর ঠেহরে
হ্যায় ? একদমে এতগুলো কথা বলেই দরজা খুলে সটান আমার পাশে এসে দাঁড়ালো । আমি
কেমন থতমত খেয়ে গেলাম । ভালো করে নজর করে বললাম ----তুই বিনীতা না ? তুই এখানে ?
আমি তো জানতাম তুই সাউথে কোন একটা নামী পেপারের জার্নালিস্ট হিসেবে ছিলিস ? তা এই
কোলকাতায় ?
আসলে বিনীতা
অন্ধ্রপ্রদেশের মেয়ে । ওর পুরো নাম বিনীতা নাইডু । দিল্লীর জহরলাল নেহেরু
ইউনিভার্সিটি থেকে মাস কমুনিকেসন এর মাস্টার্স করে দিল্লীর আমাদের পেপারে ট্রেনি
হিসেবে কিছুদিন আমারই গাইডেন্সে ছিলো । আমি ওকে হাতে ধরে সাংবাদিকতার বিভিন্ন
অ্যাঙ্গেল ও তার বিশ্লেষণ শিখিয়েছিলাম । একবার এক ক্রাইম রিপোর্টের সংবাদ সংগ্রহ
করতে ও জোর করে আমার সাথে গিয়ে কি বিপদেই না আমায় ফেলেছিল সে গল্প না হয় আর একদিন
করা যাবে ॥
ও যা বলল তার মোদ্দা
কথা হলো ইদানিং পশ্চিমবঙ্গে হঠাৎ ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও নারীপাচার বেড়ে
গেছে । সেই নিয়ে ওদের পেপার থেকে ওকে একটা এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট তৈরি করে জমা
দেওয়ার জন্য ওদের চীপরিপোর্টার ওকে আদেশ করেছেন আর ও যেহেতু মেয়ে তাই ওর পক্ষে
রিপোর্ট সংগ্রহ করা সহজ হবে বলে তাঁর বিশ্বাস । ওর এখানের এক করেসপন্ডেন্ট ওকে সে
ব্যাপারে সহযোগিতা করছে । তার কাছেই ও জেনেছে যে আজ এখানকার প্রেসক্লাবে
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপার্সন এই নিয়ে "মিট দ্য প্রেস "তে বক্তৃতা
দেবেন । সেকারণেই সেখানে সে যাচ্ছিল । পথে পরিচিত আমায় দেখে সে থেমেছে
॥
আমি তাকে জিগ্গেস করলাম
যে সে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপার্সনকে চেনে কিনা বা তার সাথে তার কোন জানাশোনা
বা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে কিনা । বিনীতা ঘাড় নাড়ালে আর বললে যে না তার সেরকম কোন
কিছুই করা নেই । মিসেস চৌধুরীর সাথে আমার বিশেষ জানাশোনা আছে জেনে সে আমায় আর
ছাড়লে না । একরকম বগলদাবা করেই ধরে নিয়ে প্রেস ক্লাবে গেল ॥
আমরা যখন প্রেস ক্লাবে পৌঁছলাম দেখি সেখানে তখন গিজগিজে ভিড় । দৈনিক
রঘুমতি পত্রিকার অনিন্দ্য আমায় দেখতে পেয়ে নিখিলেশদা এদিকে এদিকে বলে আমায় বসতে
বললে । আসলে এই অনিন্দ্য আর আমি এক কলেজ থেকেই জার্নালিজম পড়েছিলাম । তবে আমি ওর
থেকে দুবছরের সিনিয়র ছিলাম ॥
আমি বললাম--অনিন্দ্য
আমি একা নেই । আমার সাথে বিনীতা মানে বিনীতা নাইডুও আছে । ও সাউথের চেন্নাই
মিরর থেকে এসেছে । আর বিনিতাকে বললাম -বিনীতা মিট মাই জুনিয়র ফ্রেন্ড
অনিন্দ্য । হি ইজ এ অ্যামাজিং পার্সন । নাউ হি ইজ ওয়ার্কিং অ্যাজ সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার
ইন ডেইলি রঘুমতি । ওরা পরস্পর করমর্দন করলে ।
অনিন্দ্য বিনীতার ও
বসার জায়গা করে দিল । সে সময় কোন একজন হোমরা চোমরা ব্যক্তি বর্তমান সমাজে নারী
জাতির ভূমিকা নিয়ে কিছু বলছিলেন । সম্ভবতঃ রাজ্যের কোন মন্ত্রী হবেন , মুখটা
চিনি নামটা মনে করতে পারলাম না । আসলে বয়স হয়েছে তো ! আজকাল সবকিছু তেমন মনে রাখতে
পারি না । জানি না অ্যালঝাইমাতে আক্রান্ত হচ্ছি কিনা ।
মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই
ডক্টর বোসের সাথে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা দরকার । সুমনাও বলছিল সেদিন যে আজকাল
আমার নাকি স্মৃতি শক্তি হ্রাস পেয়েছে । বাজার থেকে যাকিছু আনতে বলে তার নাকি বেশ
কিছু ভুলে যাই আর বেশ কিছু অন্য জিনিস নিয়ে আসি এই নিয়ে তার অভিযান ও কম নয়
॥
তা যাক সে কথা । আমি
ভাবছি ওই সব কথা আর ঠিক তখনই মিসেস চৌধুরী উঠলেন বলতে । ঝাড়া পয়তাল্লিশ মিনিট ধরে
তিনি বর্তমান সমাজে মেয়েরা কত অবহেলিত , বাড়িতে কত নির্যাতনের শিকার , পণ প্রথার
জন্য কত বধূর উপর বাড়ির অত্যাচার , বধূহত্যা , নারী ধর্ষণ , বিয়ের নামে মেয়ে
বিক্রী ইত্যাদি নিয়ে গালগর্ভ বক্তৃতা দিলেন । পুরো প্রেস ক্লাব করতালিতে ফেটে পড়ার
অবস্থা । ঠিক তখনই আমি ভাবছিলাম ওনার বাড়ির কথা । আসন্ন প্রসবা ওর পুত্রবধূর কথা ,
সেই উদাস বিমর্ষ নেতিয়ে যাওয়া লতার কথা । হ্যাঁ লতা মানে মিসেস চৌধুরীর
পুত্রবধূ । ভাবছিলাম আর বাস্তবের সাথে তার তফাৎ কত মেলাতে চাইছিলাম । আসলে
কোন সেই ছোটবেলায় পড়া একটা কথা মনে পড়ছিল বড়ো বেশি করে তা হলো লোহাই লোহাকে কাটে ।
মানুষের মুখ আর মুখোশের পার্থক্য ধরা বড়ো কঠিন ।।
যতোদিন না পুত্রবধূকে মেয়ে হিসেবে মেনে নিতে পারবে শাশুড়িরা , যতোদিন
না আমরা নারীকে ভোগ্য বস্তু না ভেবে সম্মান দিতে পারবো , তাঁরাও যে আমার আপনার মতো
কোন বাড়ির মা , মেয়ে ,বোন ভাবতে পারবো ততদিন যতই কেন আন্তর্জাতিক নারী দিবস
পালন করি তার কোন স্বার্থকতা আছে বলে আমি মনে করি না ॥
No comments:
Post a Comment