প্রিয় নীল ,
তোমাকে এভাবে চিঠি লিখতে হবে ভাবিনি . কিন্তু
অদৃষ্টের পরিহাস দেখো --পাশের ঘরে তুমি অকাতরে ঘুমোচ্ছো,আর আমার এতদিনের না বলা
কথাগুলো তোমাকে লিখে যেতে হচ্ছে !
যাই হোক শোনো,কালই এবাড়ি ছাড়ছি।হয়তো চিরদিনের মতোই ! হ্যাঁ ঝিলমিল কেও সঙ্গে নেবো , বোধহয়
অবাক হচ্ছো --এতো সাহস আমার হল কবে থেকে ! আসলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বোধহয়
মানুষ এমনই মরিয়া হয়ে যায় ! কাল যখন আলট্রা সোনোগ্রাফির রিপোর্ট টা এলো তখনই স্থির
করে ফেলেছিলাম।নাঃ এবার আর তোমাদের কথা শুনছি না।এ সন্তান আমি রাখবো ই , নো
অ্যাবোরশন ! এবারেও কন্যা ভ্রূণ ! তোমার মায়ের তীব্র কটাক্ষ --আবার মেয়ে ! বুঝে
গিয়েছিলাম এবারেও তোমার ডাক্তার ভাই এর সহযোগীতায় তোমার মা এই ভ্রূণ নষ্ট করিয়ে
দেবেন ! আমি অবাক হয়ে যাই --তোমরা কোন যুগে বাস কর --এখনও মধ্যযুগীয়
মানসিকতা ! তোমার মা এর নাহয় শিক্ষা -দীক্ষা -রুচির অভাব আছে --কিন্তু তুমি
তো শিক্ষিত আর তোমার ভাই তো একজন ডাক্তার --তাহলে এতো নীচ মনোবৃত্তি কেন ?
নাকি তুমি একেবারে মাম্মা'স বয় !
সেবার যখন ঝিলমিল হল --তোমার মা কোথায় আনন্দিত হবেন --সংসারে নতুন অতিথি
এসেছে --তা না একঘর লোকের সামনে বলে বসলেন --- এতো সেবা যত্ন করলাম বৌমা র -শেষে
কী না মেয়ে ! আমার মা তখন সামাল দিয়েছিল --প্রথম সন্তান মেয়েই ভালো দিদি
--ঘরে লক্ষ্মী এলো !
ঝিলমিলের একবছর হতে না হতেই তোমার মা শুরু করলেন --বৌমা এবার
ছেলে চাই --বংশ তো রক্ষা করতে হবে ! তোমার কানের কাছেও গুনগুন করতেন বুঝোছিলাম !
দ্বিতীয় বারের জন্য অন্তঃস্বত্তা হলাম
. এবার তো ডাক্তার মেঘাদ্রী বোস মায়ের পরামর্শে একেবারে আটঘাট বেঁধেই নামলেন !
আল্ট্রাসোনোগ্রাফি হল --কন্যা সন্তান আসছে --না না তাকে কিছুতেই আসতে দেওয়া
যাবে না --সুতরাং অ্যাবরশন ! আমার আপত্তি ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলে সবাই ! তুমিও
চুপ করে রইলে . হয়তো ওদের কথায় তোমারও প্রচ্ছন্ন সম্মতি ছিল ! কে জানে !
আমি অবাক হই -তুমি এদের
কথার প্রতিবাদ কেন করোনা ! মেঘাদ্রী বোস ডাক্তার হয়েছে ঠিকই --কিন্তু
নীলাদ্রী বোস ই বা কম কিসে ? বাবার অকাল মৃত্যুর পর তোমাদের এই ব্যবসা
টার হাল তুমিই ধরেছিলে --আর সেই ব্যবসা আজ ফুলে ফেঁপে এতো বড় ! বিয়ের পর এসব
গল্প শুনে গর্ব হয়েছিল তোমার জন্য --বেশ করেছিলে নিজের এম .বি .এ ডিগ্রী টা নিয়ে
চাকরির দ্বারস্থ না হয়ে নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা টা সামলেছিলে .
তোমাদের সব কথা আমি চুপচাপ এতদিন মেনে
নিয়েছি --কারণ ঝগড়া -ঝাঁটি -অশান্তি এগুলো থেকে আমি বরাবর দূরেই থাকতে চেয়েছি !
আমার শিক্ষা , আমার রুচি আমাকে বাধা দিয়েছে তোমার মায়ের সঙ্গে আমার মতের
অমিল গুলো নিয়ে খিটিমিটি করতে ! তাই হয়তো তোমরা আমার ভালোমানুষি টাকে আমার
দুর্বলতা বলে ধরে নিয়েছো !
তোমার মা বংশ রক্ষা করতে চেয়েছেন --তাই আমাকে খানিকটা অনিচ্ছা সত্বেও তৃতীয় বারের
জন্য অন্তঃস্বত্তা হতে হয়েছে কিন্তু বংশ রক্ষার দায় কী শুধুই আমার ! মেঘের
কি কোন দায় নেই ! বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মৌলী র সঙ্গে বিয়েটা ভেঙে ফেললো . মৌলী
অবশ্য খুব স্বাধীনচেতা মেয়ে --পারবে কেন এ সংসারে টিকে থাকতে !
আর এখন
দুজন এসেছেন আমার অনাগত সন্তানের ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করতে ! তোমরা জান আমি
চাইলে তোমাদের বিরুদ্ধে লিগ্যাল স্টেপ নিতে পারি --কিন্তু না ওসব রাস্তায় যাবো না .
তাই তোমাদের ঘর ছাড়বো মনস্থ করেছি .
শিক্ষাগত যোগ্যতা এই রনিতা বোসের ও আছে --চাকরি একটা ঠিক
জুটে যাবে . আমার মেয়েদের লালন পালনের ভার আজ থেকে শুধু আমারই . আপাতত মায়ের কাছেই
যাবো . একটি সুস্থ সবল কন্যা সন্তানের জন্ম দিতে হবে তো !
রাখছি তবে . শুভেচ্ছা
নিও .আর যেদিন মায়ের অবাধ্য হতে পারবে -সেদিন আমার কাছে যেও .
ইতি
.........
চিঠি টা লিখে ফেলার পর
বেশ নির্ভার লাগছে রনিতা র ! ব্যালকনি তে এসে দাঁড়ালো --সমস্ত চরাচর নিঝুম
ঘুমে .মধ্যযামের চাঁদ ও বুঝি মেঘের আড়ালে অল্প তন্দ্রামগ্ন ! আশপাশেই বুঝি
পূর্ণিমা --আলো আঁধারীর এক অদ্ভুত খেলা চলছে সামনের বাগানটা জুড়ে ! একটু
বুঝি মন কেমন ও করছে --নিজের হাতে লাগানো গাছগুলো কাল থেকে হয়তো অনাদরে পরিচর্যা
হীন হয়ে পড়ে থাকবে . তা সে যাই হোক --আজ যে এইটুক প্রতিবাদ করতে পেরেছে
-এতেই খুব খুশী ও !
কাল খুব ভোরেই বেরিয়ে যাবে --শুধু ঝিলমিল টাকে একটু বেশিই ভোরে উঠতে
হবে এই যা !
কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে এলোমেলো ভাবনায় কেটে গেল কে জানে - অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে এবার ...
ঐ বুঝি বড় মাঠের ওপারের
বস্তিটায় মোরগ ডেকে উঠলো ,
নতুন ভোরের সূচনা --আজ থেকেই !
No comments:
Post a Comment