Sunday, March 25, 2018

এক প্রতিবাদিনীর চিঠি / শমিতা চক্রবর্তী





প্রিয়  নীল , 
                তোমাকে এভাবে চিঠি লিখতে হবে ভাবিনি . কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস দেখো --পাশের ঘরে তুমি অকাতরে ঘুমোচ্ছো,আর আমার এতদিনের না বলা কথাগুলো  তোমাকে লিখে যেতে হচ্ছে ! 
                        যাই হোক শোনো,কালই এবাড়ি ছাড়ছি।হয়তো চিরদিনের মতোই ! হ্যাঁ ঝিলমিল কেও সঙ্গে নেবো , বোধহয় অবাক হচ্ছো --এতো সাহস আমার হল কবে থেকে !  আসলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বোধহয় মানুষ এমনই মরিয়া হয়ে যায় ! কাল যখন আলট্রা সোনোগ্রাফির রিপোর্ট টা এলো তখনই স্থির করে ফেলেছিলাম।নাঃ এবার আর তোমাদের কথা শুনছি না।এ সন্তান আমি রাখবো ই , নো অ্যাবোরশন ! এবারেও কন্যা ভ্রূণ ! তোমার মায়ের তীব্র কটাক্ষ --আবার মেয়ে !  বুঝে গিয়েছিলাম এবারেও তোমার ডাক্তার ভাই এর সহযোগীতায় তোমার মা এই ভ্রূণ নষ্ট করিয়ে দেবেন !  আমি অবাক হয়ে যাই --তোমরা কোন যুগে বাস কর --এখনও মধ্যযুগীয় মানসিকতা !  তোমার মা এর নাহয় শিক্ষা -দীক্ষা -রুচির অভাব আছে --কিন্তু তুমি তো শিক্ষিত আর তোমার ভাই তো একজন ডাক্তার --তাহলে এতো নীচ মনোবৃত্তি কেন ?  নাকি তুমি একেবারে মাম্মা'স বয় ! 
                           সেবার যখন ঝিলমিল হল --তোমার মা কোথায় আনন্দিত হবেন --সংসারে নতুন অতিথি এসেছে --তা না একঘর লোকের সামনে বলে বসলেন --- এতো সেবা যত্ন করলাম বৌমা র -শেষে কী না মেয়ে !  আমার মা তখন সামাল দিয়েছিল --প্রথম সন্তান মেয়েই ভালো দিদি --ঘরে লক্ষ্মী এলো ! 
            ঝিলমিলের একবছর হতে না হতেই তোমার মা শুরু করলেন --বৌমা এবার ছেলে চাই --বংশ তো রক্ষা করতে হবে ! তোমার কানের কাছেও গুনগুন করতেন বুঝোছিলাম !
                  দ্বিতীয় বারের জন্য অন্তঃস্বত্তা হলাম . এবার তো ডাক্তার মেঘাদ্রী বোস মায়ের পরামর্শে একেবারে আটঘাট বেঁধেই নামলেন !  আল্ট্রাসোনোগ্রাফি হল --কন্যা সন্তান আসছে --না না তাকে কিছুতেই আসতে দেওয়া যাবে না --সুতরাং অ্যাবরশন !  আমার আপত্তি ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলে সবাই ! তুমিও চুপ করে রইলে . হয়তো ওদের কথায় তোমারও প্রচ্ছন্ন সম্মতি ছিল !  কে জানে !
আমি অবাক হই -তুমি এদের কথার প্রতিবাদ কেন করোনা !  মেঘাদ্রী বোস ডাক্তার হয়েছে ঠিকই --কিন্তু নীলাদ্রী বোস ই  বা কম কিসে ?  বাবার অকাল মৃত্যুর পর তোমাদের এই ব্যবসা টার হাল তুমিই ধরেছিলে --আর সেই ব্যবসা আজ ফুলে ফেঁপে এতো বড় !  বিয়ের পর এসব গল্প শুনে গর্ব হয়েছিল তোমার জন্য --বেশ করেছিলে নিজের এম .বি .এ ডিগ্রী টা নিয়ে চাকরির দ্বারস্থ না হয়ে নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা টা সামলেছিলে .
                  তোমাদের সব কথা আমি চুপচাপ এতদিন মেনে নিয়েছি --কারণ ঝগড়া -ঝাঁটি -অশান্তি এগুলো থেকে আমি বরাবর দূরেই থাকতে চেয়েছি !  আমার শিক্ষা , আমার রুচি আমাকে বাধা দিয়েছে তোমার মায়ের সঙ্গে আমার মতের অমিল গুলো নিয়ে খিটিমিটি করতে !  তাই হয়তো তোমরা আমার ভালোমানুষি টাকে আমার দুর্বলতা বলে ধরে নিয়েছো ! 
                            তোমার মা বংশ রক্ষা করতে চেয়েছেন --তাই আমাকে খানিকটা অনিচ্ছা সত্বেও তৃতীয় বারের জন্য অন্তঃস্বত্তা হতে হয়েছে কিন্তু বংশ রক্ষার দায় কী শুধুই আমার !  মেঘের কি কোন দায় নেই ! বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মৌলী র সঙ্গে বিয়েটা ভেঙে ফেললো . মৌলী অবশ্য খুব স্বাধীনচেতা মেয়ে --পারবে কেন এ সংসারে টিকে থাকতে ! 
                         আর এখন দুজন এসেছেন আমার অনাগত সন্তানের ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করতে !  তোমরা জান আমি চাইলে তোমাদের বিরুদ্ধে লিগ্যাল স্টেপ নিতে পারি --কিন্তু না ওসব রাস্তায় যাবো না . তাই তোমাদের ঘর ছাড়বো মনস্থ করেছি .
                                  শিক্ষাগত যোগ্যতা এই রনিতা বোসের ও আছে --চাকরি একটা ঠিক জুটে যাবে . আমার মেয়েদের লালন পালনের ভার আজ থেকে শুধু আমারই . আপাতত মায়ের কাছেই যাবো . একটি সুস্থ সবল কন্যা সন্তানের জন্ম দিতে হবে তো ! 
                      রাখছি তবে . শুভেচ্ছা নিও .আর যেদিন মায়ের অবাধ্য হতে পারবে -সেদিন আমার কাছে যেও .
                                   ইতি 
                                         .........

চিঠি টা লিখে ফেলার পর বেশ নির্ভার লাগছে রনিতা র !  ব্যালকনি তে এসে দাঁড়ালো --সমস্ত চরাচর নিঝুম ঘুমে .মধ্যযামের চাঁদ ও বুঝি মেঘের আড়ালে অল্প তন্দ্রামগ্ন !  আশপাশেই বুঝি পূর্ণিমা --আলো আঁধারীর এক অদ্ভুত খেলা চলছে সামনের বাগানটা জুড়ে !  একটু বুঝি মন কেমন ও করছে --নিজের হাতে লাগানো গাছগুলো কাল থেকে হয়তো অনাদরে পরিচর্যা হীন হয়ে পড়ে থাকবে . তা সে যাই হোক --আজ যে এইটুক প্রতিবাদ করতে পেরেছে -এতেই খুব খুশী ও ! 
                               কাল খুব ভোরেই বেরিয়ে যাবে --শুধু ঝিলমিল টাকে একটু বেশিই ভোরে উঠতে হবে এই যা ! 
           কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে এলোমেলো ভাবনায় কেটে গেল কে জানে - অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে এবার ...
                     ঐ বুঝি বড় মাঠের ওপারের বস্তিটায় মোরগ ডেকে উঠলো ,
           নতুন ভোরের সূচনা --আজ থেকেই ! 


No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া